
নির্মাণ শেষ, আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনও হয়ে গেছে; কিন্তু যাত্রা এখনো শুরু হয়নি। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল প্রায় এক বছর ধরে প্রস্তুত হলেও বাণিজ্যিকভাবে চালু হচ্ছে না নানা অজুহাতে।
নতুন নতুন জটিলতায় আটকে আছে এই ‘মেগাপ্রকল্প’। মূলত সরকারি দুই প্রধান সংস্থা, সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ (সিএএবি) ও বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের মধ্যে সমন্বয়হীনতা, পরীক্ষা পর্যায়ে উদ্ভূত ঝুঁকি এবং আর্থিক ও কারিগরি বিরোধেই থমকে আছে এর কার্যক্রম।
জানা গেছে, ২০১৬ সালের জুলাই মাসে যাত্রা শুরু করা এই তৃতীয় টার্মিনাল প্রকল্পের মূল লক্ষ্য ছিল যাত্রী ও কার্গো চাপ সামাল দিয়ে নিরাপত্তা ও আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত করা। ৯ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু হয়নি এই টার্মিনালের। অথচ প্রকল্পের ৯৯.৮০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে বলেই জানা গেছে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক পরিদর্শন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে প্রকল্প বাস্তবায়নে নানা ত্রুটি ও অনিয়ম। যৌথভাবে এই পরিদর্শনে অংশ নেন আইএমইডির সচিব কামাল উদ্দিন ও মহাপরিচালক মাহবুবুর রহমান।
আইএমইডি সচিব কামাল উদ্দিন বলেন, প্রকল্পের শুরুতেই ঝুঁকি নিরূপণে ঘাটতি ছিল।
প্রকল্পটি ১৩ হাজার ৬১০ কোটি টাকার প্রাক্কলনে অনুমোদন পেলেও একবার সংশোধনের পর তা বেড়ে দাঁড়ায় ২১ হাজার ৩৯৯ কোটি টাকায়, যা আগের তুলনায় ৫৭.২৩ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) সরবরাহ করেছে ১১ হাজার ২২১ কোটি টাকা। সময়সীমাও বাড়ানো হয়েছে একাধিকবার; সর্বশেষ ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত। এবার নতুন করে মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত নেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, মন্ত্রণালয় বলছে এ মেয়াদ বাড়াতে তারা অতিরিক্ত অর্থ চাইবে না।
তবে প্রকল্পে নতুন করে আর্থিক চাপ তৈরি হয়েছে বিভিন্ন বিতর্কিত খাতে। যেমন—বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস তাদের সফটওয়্যার সিস্টেমকে প্রকল্পের সঙ্গে সমন্বয় করতে চায় এবং এর জন্য তারা দাবি করেছে ৫০ হাজার ডলার। অথচ এই বিমান সংস্থা ও সিএএবি—দুই সংস্থাই সিভিল এভিয়েশন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের অধীন। তবু তাদের মধ্যে কোনো কার্যকর সমন্বয় হয়নি।
অন্যদিকে মূল অবকাঠামো যেমন—টার্মিনাল ভবন, মাল্টিলেভেল পার্কিং, চেকইন কাউন্টার, ইমিগ্রেশন বুথ, আমদানি-রপ্তানি কার্গো কমপ্লেক্স সবই প্রস্তুত। কিন্তু প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি পরীক্ষার দায়িত্বে থাকা ঠিকাদার, সিএএবি এবং পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে পরীক্ষণ ও কমিশনিং সংক্রান্ত দাবিদাওয়া নিয়ে বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে। মূল্যায়ন ও অর্থনৈতিক বিবরণে ভিন্নমত থাকায় এখন সালিসি বোর্ড গঠন করে সেই বিরোধ নিষ্পত্তির চেষ্টা চলছে। এর নিষ্পত্তিতে সময় লাগবে ছয় মাস থেকে এক বছর।
এ ছাড়া প্রকল্পে আপৎকালীন ব্যয়ের সীমা ধরা হয়েছিল ৫৫১ কোটি টাকা, যা পরে বেড়ে ৭৭১ কোটি টাকা হয়। সংশোধিত প্রস্তাবে এই ব্যয় এক হাজার ১৭৪ কোটি টাকা করার চেষ্টা চলছে। তবে আইএমইডি সুপারিশ করেছে, প্রকল্পটি যেন বর্তমান বাজেটের মধ্যেই শেষ করা হয় এবং এক খাত থেকে অন্য খাতে টাকা স্থানান্তর না করা হয়।
আইএমইডি আরো একটি গুরুতর বিষয় তুলে ধরেছে, প্রকল্পটি শুরু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত ফরেন এইডেড প্রজেক্টস অডিট ডিরেক্টরেট (এফএপিএডি) মোট ৫৬টি অডিট আপত্তি দিয়েছে, যার আর্থিক পরিমাণ ২১ হাজার ২৬৪ কোটি টাকা। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই আপত্তিগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য আরো কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।
প্রসঙ্গত, ২০২৩ সালের অক্টোবরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী আনুষ্ঠানিকভাবে টার্মিনালটির উদ্বোধন করেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, প্রায় এক বছর পরেও এটি পূর্ণভাবে চালু হয়নি। আন্তর্জাতিক মানের এ অবকাঠামো এখনো ব্যবহার অনুপযোগী অবস্থায় পড়ে আছে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রকল্প পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে যদি যথাযথ সমন্বয় ও জবাবদিহি থাকত, তবে এত বড় অবকাঠামো বছরের পর বছর অলস পড়ে থাকত না। এই দীর্ঘসূত্রতা শুধুই সময় বা অর্থের অপচয় নয়; বরং এটা প্রশ্ন তোলে দেশের প্রকল্প ব্যবস্থাপনা, দাপ্তরিক সমন্বয় এবং উন্নয়ন খাতে স্বচ্ছতার অবস্থান নিয়েও। একদিকে দেশের সর্ববৃহৎ বিমানবন্দরের নতুন টার্মিনাল ঝুলে আছে, অন্যদিকে যাত্রী ও পণ্যের চাপে পুরনো অবকাঠামোর ওপর বাড়ছে অতিরিক্ত চাপ। এতে শুধু যাত্রীসেবা নয়, দেশের ভাবমূর্তিও প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে আন্তর্জাতিক পরিসরে।