Image description
চট্টগ্রামে জুলাই আন্দোলনে হামলা উদ্ধার হয়নি অবৈধ অস্ত্র লুটের ১৫৬ অস্ত্রের হদিস নেই

জুলাই আন্দোলনে চট্টগ্রামে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করা অন্তত অর্ধশত অস্ত্রধারীর মধ্যে ৪৬ জনকে শনাক্ত করেছে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি)। ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের পর সিএমপির ক্রাইম ডিভিশন এই অস্ত্রধারীদের চিহ্নিত করে। এর মধ্যে বিভিন্ন সময়ের অভিযানে র‌্যাব এবং পুলিশ মিলে ১৯ জনকে গ্রেফতার করে। বাকি ২৭ জনই রয়েছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। গ্রেফতার হওয়া অস্ত্রধারীদের কাছ থেকে দুটি বিদেশি পিস্তল ছাড়া ব্যবহৃত অস্ত্রগুলো উদ্ধার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এছাড়া চট্টগ্রামের ৮টি থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্রের এখনো ১৫৬টির হদিস মিলছে না। সবমিলিয়ে এখনো পর্যন্ত অস্ত্রের ঝনঝনানি রয়েই গেছে।

তবে সিএমপি কমিশনার হাসিব আজিজ বলেছেন, ইতোমধ্যে দুর্ধর্ষ বেশ কয়েকজন অস্ত্রধারী গ্রেফতার হয়েছে। অন্যদের গ্রেফতারেও সিএমপি কাজ করছে। তারা গ্রেফতার এড়াতে শহর ছেড়ে আত্মগোপনে রয়েছে। চট্টগ্রাম শহরের বাইরে আত্মগোপনে থাকা অস্ত্রধারীকেও পুলিশ পাকড়াও করে নিয়ে এসেছে। কেউ রেহাই পাবে না।

সূত্র জানায়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে নগরীর ষোলশহর, মুরাদপুর, বহদ্দারহাট ও নিউমার্কেট এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের পাশাপাশি মহানগর ছাত্রলীগ (বর্তমানে নিষিদ্ধ), যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের কিছু নেতাকর্মীকে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে ছাত্র-জনতাকে লক্ষ্য করে গুলি করতে দেখা যায়। সহিংসতার ঘটনায় সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করা ছবি ও ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে ৪৬ জনের পরিচয় নিশ্চিত হয়েছে সিএমপি। এর মধ্যে ১৬ জুলাই নগরীর মুরাদপুরে অস্ত্র হাতে ছাত্র-জনতার ওপর গুলি করেন যুবলীগ নেতা মো. ফিরোজ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের মো. দেলোয়ার, ছাত্রলীগকর্মী এনএইচ মিঠু, হাবিবুর রহমান আহনাফ ও যুবলীগকর্মী মো. জাফর। এদের মধ্যে ফিরোজ ও আহনাফ গ্রেফতার হয়েছেন। একদিন পর ১৮ জুলাই বহদ্দারহাট এলাকায় চিহ্নিত অস্ত্রধারীদের মধ্যে রয়েছে মহিউদ্দিন ফরহাদ, মো. জালাল ওরফে ড্রিল জালাল, মো. তৌহিদুল ইসলাম ফরিদ, ছাত্রলীগকর্মী ঋভু মজুমদার ও যুবলীগকর্মী মো. জামাল। এদের মধ্যে তৌহিদ, ঋভু মজুমদার ও জামাল গ্রেফতার হয়েছেন। তবে তাদের ব্যবহৃত অস্ত্রগুলো উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ। আগ্নেয়াস্ত্র হাতে আরও যারা মহড়া দিয়েছিল, তাদের মধ্যে রয়েছে মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা মহিউদ্দিন মাহমুদ, মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের কর্মী মো. দেলোয়ার, মোহাম্মদ জালাল ওরফে ড্রিল জালাল, যুবলীগ নেতা মোহাম্মদ ফরিদ, ছাত্রলীগ নেতা মোহাম্মদ তাহসিন, যুবলীগ নেতা মোহাম্মদ জাফর, এইচএম মিঠু ও সোলেমান বাদশা।

সূত্র আরও জানায়, ২২ নভেম্বর সাতক্ষীরার কমলনগর থেকে তৌহিদুল ইসলাম ওরফে ফরিদকে গ্রেফতার করে নগরীর চান্দগাঁও থানা-পুলিশ। ফরিদ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে একটি শাটারগান দিয়ে ২৮ রাউন্ড গুলি করেছিল বলে পুলিশের কাছে স্বীকার করেছে। তবে তার ব্যবহৃত অস্ত্রটি এখনো উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ। এর আগে ২৪ অক্টোবর মো. ফিরোজ নামে যুবলীগের এক কর্মীকে গ্রেফতার করেছিল র‌্যাব। ফরিদকে ফেনী সদর থানার রামপুরা এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। ওই বছরের ১৮ জুলাই নগরীর মুরাদপুর ও বহদ্দারহাট এলাকায় আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নির্বিচারে গুলি করার কথা স্বীকার করেছিল ফরিদ। এছাড়া অস্ত্রধারী আরও চারজনকে র‌্যাব ও পুলিশ গ্রেফতার করেছিল। তাদের মধ্যে র‌্যাব গ্রেফতার করেছিল মো. মিজান, মো. ফয়সাল ও বাদশাকে এবং ছাত্রলীগের কর্মী হাবিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে নগরীর খুলশী থানা পুলিশ।

সিএমপির এডিসি পিআর মাহমুদা বেগম যুগান্তরকে বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলা করা ৪৬ অস্ত্রধারীকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে কোতোয়ালি থানার মামলায় ২৭ জন, পাঁচলাইশ থানার মামলায় ৪ জন, চান্দগাঁও থানার মামলায় ৬ জন, ডবলমুরিং থানার মামলায় ৬ জন ও হালিশহর থানার মামলায় ৩ জন রয়েছেন। এদের মধ্যে এ পর্যন্ত (১৯ জুলাই পর্যন্ত) ১৯ জন অস্ত্রধারীকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়েছে। এছাড়া কোতোয়ালি থানার মামলায় গ্রেফতার দুই আসামির কাছ থেকে ২টি বিদেশি পিস্তল উদ্ধার করা হয়েছে। বাকিদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

জুলাই আন্দোলনে অংশ নেওয়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি সাহিত্য বিভাগের শিক্ষার্থী মশিউর রহমান সোহাগ বলেন, ‘সেদিন (গত বছরের ১৬ জুলাই) বিকাল ৩টা ১৫ মিনিটে কোটা সংস্কারের দাবিতে নগরীর মুরাদপুর থেকে আমাদের মিছিল বের করার কথা ছিল। আমি সেখানেই অবস্থান করছিলাম। মিছিল শুরুর আগেই চকবাজারের দিক থেকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা প্রথমে আমাদের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। ধাওয়া-পালটাধাওয়ার একপর্যায়ে আমরা তাদের পিছু হটাতে সক্ষম হই। পরে দেশীয় অস্ত্র এবং পিস্তল নিয়ে আমাদের ওপর আক্রমণ করে অস্ত্রধারীরা। সেই হামলায় ওয়াসিম, শান্ত ও ফারুক শহীদ হয়। আমার পিঠেও ছররা গুলি লেগেছিল।’

তিনি আরও বলেন, ‘গত বছরের ১৫ জুলাই থেকে গণ-অভ্যুত্থানের দিন পর্যন্ত তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের উচ্চপর্যায়ের নেতাদের নির্দেশে তাদের পেটুয়া গুন্ডাবাহিনী জুলাই যোদ্ধাদের ওপর হামলে পড়ে। ১৮ জুলাই নগরীর বহদ্দারহাটে আওয়ামী লীগ সন্ত্রাসীদের গুলিতে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন আামাদের চবি শিক্ষার্থী হৃদয় চন্দ্র বড়ুয়া। পরে ২৩ জুলাই চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনিও মারা যান। অথচ ছাত্র-জনতার ওপর হামলা করা নাম জানা ও না জানা অস্ত্রধারীরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে। তাদের অস্ত্রগুলোও উদ্ধার হয়নি। এই জায়গায় ইন্টেরিম গভর্নমেন্ট একেবারেই ব্যর্থ।’

সিএমপি সূত্র জানায়, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা ও হতাহতের ঘটনায় নগরীর ১৬ থানার মধ্যে ৮টি থানায় ৬৩টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে হত্যা মামলা রয়েছে ১৪টি। এসব মামলায় এজাহারনামীয় আসামি রয়েছে ৬ হাজার ৬৯৪ জন। আর অজ্ঞাতনামা আসামি রয়েছে ১৩ হাজার ৫৯০ জন। গত বছরের ৫ আগস্ট পরবর্তী সময় থেকে এ পর্যন্ত ১৪৬ জন এজাহারনামীয় আসামি গ্রেফতার করেছে পুলিশ। আর তদন্তে প্রাপ্ত আসামি গ্রেফতার হয়েছে ৮৩৭ জন। সব মামলাতেই নিরপরাধ এবং ব্যক্তি, পারিবারিক ও রাজনৈতিক আক্রোশের কারণে আসামি করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এ কারণে গত এক বছরে একটি মামলায়ও চার্জশিট দিতে পারেনি পুলিশ। তবে একটি মামলায় ফাইনাল রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন), চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী বলেন, ‘জুলাই আন্দোলনে যারা অস্ত্র নিয়ে শিক্ষার্থী বা সাধারণ মানুষের ওপর হামলা করেছিল, তারা গ্রেফতার না হওয়ায় জনমনে আতঙ্ক রয়েছে। হয়তো তারা এখন গা-ঢাকা দিয়েছে। কিন্তু যারা থানা থেকে অস্ত্র লুট করেছে, এখনো তারা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অস্ত্রের ঝনঝনানি রয়েই গেছে। এজন্য পুলিশকে আরও আন্তরিক হতে হবে।’