
দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো আইনের মাধ্যমে সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে বেশ কিছুসংখ্যক ‘অতিরিক্ত বিচারক’ নিয়োগ দিতে যাচ্ছে সরকার। ইতোমধ্যে বিচারক নিয়োগে সুপ্রিম জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্ট কাউন্সিল এ সংক্রান্ত খসড়া চূড়ান্ত করেছে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে শিগগির প্রজ্ঞাপন জারি হবে। আবেদনকারীদের মধ্য হতে শুক্রবার ৫৯ জন প্রার্থীর মৌখিক পরীক্ষা নিয়েছে কাউন্সিল। এখন পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের বিষয়ে প্রধান বিচারপতি কাউন্সিলের অন্য সদস্যদের সঙ্গে আলোচনাক্রমে রাষ্ট্রপতি বরাবরে সুপারিশ পাঠাবেন। রাষ্ট্রপতি সেটি অনুমোদন করলে গেজেট আকারে প্রকাশ করবে আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রথম ধাপে অন্তত ৩০ জন অতিরিক্ত বিচারক নিয়োগ দিতে পারে কাউন্সিল। আইন বিশেষজ্ঞদের কয়েকজন যুগান্তরকে বলেন, আইনি কাঠামোর মধ্যে এভাবে বিচারক নিয়োগ বিচার অঙ্গনে নতুন এক মাইলফলক সৃষ্টি করবে। বিশেষ করে এই উদ্যোগ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বিচার বিভাগের পথে দৃশ্যত যাত্রা শুরু হবে।
অতীতে সুপ্রিমকোর্টে বিচারক নিয়োগ ছিল রাজনৈতিক প্রভাব ও সুপারিশনির্ভর। এ নিয়ে নানা আলোচনা ও বিতর্ক হয়েছে। সংবিধানের আলোকে শর্ত সাপেক্ষে অধস্তন আদালতের বিচারক ও আইনজীবীদের মধ্যে থেকে বিচারপতি নিয়োগ হলেও এতদিন ছিল না সুনির্দিষ্ট কোনো আইন। দীর্ঘদিন ধরে বিচারসংশ্লিষ্টরা বিচারক নিয়োগে একটি সুনির্দিষ্ট আইনের দাবি জানিয়ে আসছিলেন। অথচ সংবিধানে বিচারক নিয়োগে আইন প্রণয়নের কথা উল্লেখ থাকলেও তা রাজনৈতিক কারণে করা হয়নি। তবে অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কার কর্মসূচির আওতায় জানুয়ারিতে এ বিষয়ে অধ্যাদেশ জারি করে সুপ্রিম জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্ট কাউন্সিল গঠন করে। এ সুবাদে এবার উচ্চ আদালতের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বিচারপতি নিয়োগ হচ্ছে সুপ্রিম জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্ট কাউন্সিলের মাধ্যমে।
জানতে চাইলে সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের স্পেশাল অফিসার মোহাম্মদ মোয়াজ্জেম হোসাইন শনিবার যুগান্তরকে বলেন, ‘গণবিজ্ঞপ্তি জারির পর প্রায় তিনশটি আবেদন জমা পড়ে। সেখান থেকে বাছাই করে শুক্রবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ৫৯ জনের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে চূড়ান্তভাবে কতজনকে নিয়োগ দেওয়া হবে সেটি কাউন্সিলের বিষয়।’ পরবর্তী প্রক্রিয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, কাউন্সিল চূড়ান্ত তালিকা করে তা রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবে। অনুমোদনের পর গেজেট প্রকাশ করবে মন্ত্রণালয়।
জুলাই অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নানা ক্ষেত্রে সংস্কার উদ্যোগের মধ্যে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এ সংক্রান্ত কমিশন কাজ শেষ করে বেশকিছু বিষয়ে প্রয়োজনীয় সংস্কার আনতে সরকারের কাছে জমা দেওয়া প্রতিবেদনে সুপারিশ করে। প্রস্তাবিত বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠা, প্রধান বিচারপতি ছাড়া অন্য বিচারক নিয়োগে পৃথক কমিশন গঠন, দেশের সব প্রশাসনিক বিভাগে হাইকোর্টের স্থায়ী বেঞ্চ স্থাপন, জেলা পর্যায়ে বাণিজ্যিক আদালত এবং উপজেলায় দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালত প্রতিষ্ঠা। এছাড়া স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস গঠনের বিষয়েও সুপারিশ করা হয়।
২১ জানুয়ারি ‘সুপ্রিমকোর্র্টে বিচারক নিয়োগ অধ্যাদেশ, ২০২৫-এর গেজেট প্রকাশ করে সরকার। এর আলোকে প্রধান বিচারপতিকে চেয়ারপারসন করে সাতজনকে নিয়ে গঠিত হয় ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্ট কাউন্সিল।’ এরপর ২৮ মে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে সুপ্রিমকোর্টে বিচারপতি হতে ইচ্ছুক প্রার্থীদের কাছ থেকে আবেদন আহ্বান করে সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসন। এরপর আবেদনকারীদের মধ্য থেকে ৫৯ জনকে বাছাই করে কাউন্সিল। পরবর্তীতে যাদের সাক্ষাৎকারের জন্য ডাকা হয়।
নিয়োগ প্রক্রিয়ার বিষয়ে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ যুগান্তরকে বলেন, সরকার পরিবর্তনের পর প্রধান বিচারপতির উদ্যোগে বিচারক নিয়োগের আইন হয়েছে। এই আইনে কিছু ত্রুটি রয়েছে। তবে সেগুলো স্বচ্ছ বা পরিবর্তন করলে আরও ভালো হবে। তারপরেও বলব, আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যে নিয়োগ হচ্ছে, নিশ্চয়ই আগের সব নিয়োগের চেয়ে অনেক ভালো হবে। কারণ এখানে প্রার্থীদের বিভিন্ন রায়, দক্ষতা ও পরিচিতি যাচাই করে দেখা হচ্ছে। ফলে আশা করছি, ভালো একটা নিয়োগ হবে। তবে নিয়োগের পর তালিকা দেখে এ বিষয়ে সঠিক মূল্যায়নটা করা যাবে।
সর্বশেষ ৮ অক্টোবর হাইকোর্ট বিভাগে অতিরিক্ত বিচারক হিসাবে ২৩ জনকে নিয়োগ দেয় সরকার। আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগ থেকে একটি প্রজ্ঞাপনে নতুন অতিরিক্ত বিচারপতি নিয়োগের বিষয়ে জানানো হয়। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, এসব অতিরিক্ত বিচারকের মেয়াদ হবে শপথ নেওয়ার দিন থেকে ২ বছর। রাষ্ট্রপতি সংবিধানের ৯৮ নম্বর অনুচ্ছেদের ক্ষমতাবলে এই নিয়োগ দেন। বর্তমানে হাইকোর্ট বিভাগে ৯০ জন বিচারপতি রয়েছেন এবং ৫ লাখ ৯৯ হাজার ১২৬টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। আর আপিল বিভাগে ৩৪ হাজার ৯৮১টি মামলা বিচারাধীন, যা আগের তুলনায় অনেক বেশি।