
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকালে গত বছরের জুলাই-আগস্টে পুড়িয়ে দেয়া হয় বেশকিছু থানা ও পুলিশের কয়েকশ যানবাহন। এতে দীর্ঘদিনের সে সংকট আরো প্রকট আকার ধারণ করে। পুলিশ সদর দপ্তর বলেছে, যানবাহনের অভাবে যথাযথ নাগরিক সেবা দেয়াই সম্ভব হচ্ছে না। ব্যাহত হচ্ছে থানা পুলিশের টহলসহ নিয়মিত কাজ। এমনকি অপরাধের খবরে দ্রুত ঘটনাস্থলেও পৌঁছতে পারছে না লক্কড়ঝক্কড় গাড়ি নিয়ে। পুলিশের অন্যান্য ইউনিটের কাজও ব্যাহত হচ্ছে প্রয়োজনীয় বাহন না থাকায়। এমন পরিস্থিতিতে প্রায় সাড়ে চার হাজার যানবাহন সংকট নিয়েই নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে পুলিশ বাহিনীকে। এতে রেসপন্স টাইম বেশি লাগার পাশাপাশি মাঠপর্যায়ের কার্যক্রমও ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে বলে মনে করেন বাহিনীর সদস্যরা। সংকট সমাধানে কার্যকর উদ্যোগ নেয়ার দাবি বিশেষজ্ঞদের।
পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে বাহিনীতে ৪ হাজার ৪৪৭টি যানবাহনের ঘাটতি রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৩ হাজার ৪৯৭টি মোটরসাইকেলের ঘাটতি। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে পুলিশের প্যাট্রোল ডিউটিতে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় এ বাহনটিই। ঘাটতি রয়েছে ডাবল কেবিন পিকআপেরও, যা দিয়ে টহল কার্যক্রমের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের জরুরি অভিযান পরিচালনা করা হয়। এ ধরনের গাড়ির সংকট মোট ৫০৭টি।
মোটরসাইকেল ও ডাবল কেবিন পিকআপের পাশাপাশি পুলিশ বাহিনীতে ঘাটতি রয়েছে সর্বমোট ৪৪৩টি এসইউভি (স্পোর্ট ইউটিলিটি ভেহিকল) বা জিপ গাড়িরও। এসইউভি বা জিপ শ্রেণীর গাড়িগুলো সাধারণত এএসপি থেকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ব্যবহার করে থাকেন, যারা মূলত জেলা বা উপজেলার আইন-শৃঙ্খলা এবং অভিযানের তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে থাকেন।
মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যরা বলছেন, বিদ্যমান যানবাহন দিয়ে বর্তমানে থানাগুলোর রুটিন ডিউটি পালন করাই কঠিন হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে মোটরসাইকেল ও ডাবল কেবিন পিকআপ সংকটের কারণে প্যাট্রোল ডিউটি পরিচালনায় সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। মফস্বল এলাকায় কোথাও অপরাধ সংঘটিত হওয়ার খবর পেলে প্রথমে মোটরসাইকেল নিয়ে সহকারী উপপুলিশ পরিদর্শক (এএসআই) এবং কনস্টেবল পদমর্যাদার পুলিশ সদস্যরা ঘটনাস্থলে যান। এরপর পরিস্থিতি বিবেচনায় উপপুলিশ পরিদর্শক (এসআই) বা পরিদর্শক পদমর্যাদার কর্মকর্তা কনস্টেবল সঙ্গে নিয়ে ছুটে যান ঘটনাস্থলে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে ডাবল কেবিন পিকআপ গাড়ি সংকটের কারণে অনেক ক্ষেত্রে জরুরি প্রয়োজন হলেও অভিযান পরিচালনা সম্ভব হচ্ছে না।
পুলিশের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর বণিক বার্তাকে বলেন, ‘যানবাহনের ঘাটতি পূরণের জন্য আমরা কাজ করছি। গুরুত্ব অনুযায়ী বিভিন্ন ইউনিটে গাড়ি দিচ্ছি। থানা পুলিশকে যেকোনো ঘটনার খবরে প্রথম এগিয়ে যেতে হয়। তাই থানাগুলোর অগ্রাধিকার বেশি। যানবাহনের ঘাটতি নিরসনে সংশ্লিষ্ট সবাই আন্তরিক রয়েছে।’
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীসহ কয়েকটি এলাকায় ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। বিক্ষুব্ধ জনতা হামলা করে যাত্রাবাড়ী থানায়। ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় থানাসহ তিনটি ভবন। এ থানার সাতটি গাড়ি, তৎকালীন একজন এসি ও এডিসির গাড়িসহ মোট নয়টি গাড়িতে আগুন দেয়া হয়। এছাড়া বাইরে থেকে আসা পুলিশ সদস্যদের গাড়িও সেদিন আগুনে পুড়ে যায়। থানার ভেতরে থাকা পুলিশ সদস্যদের মোটরসাইকেল এবং বিভিন্ন মামলায় আলামত হিসেবে জব্দ করে আনা গাড়িও পুড়িয়ে দেয়া হয়। পূর্ব পাশে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশনস কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল) ভবনের সামনে থানার অন্তত ৩৫টি গাড়ি রাখা ছিল, সেগুলোয়ও আগুন দেয়া হয়। ওই সময় সারা দেশেই ক্ষতিগ্রস্ত হয় পুলিশের যানবাহন। সব মিলিয়ে গত বছরের জুলাই-আগস্টের আন্দোলনের সময় ১ হাজার ১৪৬টি গাড়ি ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এতে ক্ষতি হয় ২৮৫ কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ক্ষমতার পালাবদলের পর ধীরে ধীরে থানার কার্যক্রম স্বাভাবিক হতে শুরু করলেও গাড়ির অভাবে পুলিশি টহল কমে গেছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা ও অপরাধ রোধে সবসময়ই সংশ্লিষ্ট থানা এলাকায় একাধিক পুলিশ টিমকে টহলে থাকতে হয়। যেকোনো অপরাধ বা দুর্ঘটনার খবরে দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছতে হয়। কিন্তু বেশির ভাগ থানায় যানবাহন সংকট থাকায় এ কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।
রাজধানীর মিরপুর বিভাগের একজন পুলিশ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘যেসব থানায় গাড়ি ছিল সাত-আটটি, সেখানে এখন আছে দুই-তিনটি। ফলে আমাদের কাজে বিঘ্ন তো হবেই। গাড়ির প্যাট্রোল ডিউটি এখন সম্ভব হচ্ছে না। তবে এ ঘাটতি আমরা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছি। তাই মোটরসাইকেল দিয়ে টিম করে ডিউটির কাজ চলছে। এর জন্য অবশ্য রেসপন্স টাইম বেশি লাগছে। আগে যেখানে খবর পাওয়ার ৭-১০ মিনিটের মধ্যে ঘটনাস্থলে পুলিশ পৌঁছে যেত, এখন সেটা ২০ মিনিট ছাড়িয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সাড়া দিতে আধা ঘণ্টাও সময় লাগছে। এর প্রধান কারণ হলো গাড়ি সংকট।’
যানবাহনের ঘাটতি নিয়ে আগামী নির্বাচনের জন্য পুলিশ প্রস্তুতি নিচ্ছে। একযোগে সারা দেশের নির্বাচনী দায়িত্ব পালনের সময় যানবাহনের এ সংকট সবচেয়ে বড় ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখন যেমন এক থানার গাড়ি দিয়ে আরেক থানায় সাপোর্ট দেয়া হচ্ছে। নির্বাচনের সময় তো একযোগে সব থানাতেই যানবাহনের প্রয়োজনীয়তা তৈরি হবে। তখন এক থানা থেকে অন্য থানায় গাড়ির সাপোর্ট দেয়া সম্ভব হবে না।
পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলমও মনে করেন, তীব্র যানবাহন সংকট নিয়ে বাহিনীর সদস্যদের নির্বাচনী দায়িত্ব পালনে বেগ পেতে হতে পারে। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আগে থেকেই বাহিনীতে যানবাহন সংকট ছিল। গত ৫ আগস্টের আগে-পরে অনেক যানবাহন ক্ষতিগ্রস্ত হলে এ সংকট আরো তীব্র হয়। অফিসারদের গাড়ির অবশ্য অতটা সংকট নেই। কারণ বিগত ১৫ বছরে বহু বিলাসবহুল গাড়ি কেনা হয়েছে। আর এসব গাড়ি খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্তও হয়নি। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মাঠপর্যায়ের গাড়িগুলো। অভিযানের জন্য এসব গাড়িই বেশি প্রয়োজন। পাশাপাশি ফোর্স পরিবহনের জন্য ট্রাক, বাস দরকার। আমরা এখন এক থানার গাড়ি দিয়ে অন্য থানায় সাপোর্ট দিয়ে থাকি। কিন্তু নির্বাচনের সময় সব থানারই গাড়ি প্রয়োজন হবে। যানবাহন সংকট তাই পুলিশের নির্বাচনী দায়িত্ব পালনে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরির কারণ হতে পারে।’