Image description

বাণিজ্যিক ভারসাম্যে বাংলাদেশ বড় ধরনের ঘাটতিতে থাকা সত্ত্বেও আমদানি-রপ্তানিতে ভারতীয় মুদ্রা রুপির প্রচলন করেছিল স্বৈরাচার শেখ হাসিনার সরকার। তীব্র সংকট ও দরবৃদ্ধির কারণে ডলারের ওপর থেকে চাপ কমানোর উপায় হিসেবে প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে বাণিজ্যিক লেনদেনে ২০২৩ সালে রুপিকে মুদ্রা হিসেবে গ্রহণ করা হয়। ওই সময় ব্যবসায়ীরা রুপির মাধ্যমে লেনদেনকে সাধুবাদ জানালেও বাস্তবে তাতে কোনো সাড়া মিলছে না।

এ পর্যন্ত ভারত থেকে দুই কোটি ৮৮ লাখ রুপির পণ্য আমদানি করা হয়েছে। এর বিপরীতে বাংলাদেশ থেকে তিন কোটি ৪১ লাখ রুপি মূল্যমানের পণ্য রপ্তানি করা হয়েছে। শেখ হাসিনার পতনের পর রুপিতে সবশেষ লেনদেন হয় গত বছরের ৯ সেপ্টেম্বর। ওই সময় প্রায় ৫০ লাখ রুপি মূল্যের পণ্য আমদানি করেছিল হবিগঞ্জ অ্যাগ্রো লিমিটেড। দুই দেশের মধ্যে বছরে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য হয়, বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ এক লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার মতো। সে হিসাবে রুপিতে খুব সামান্যই লেনদেন হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আন্তর্জাতিক মুদ্রা হিসেবে স্বীকৃত না হলেও ভারতের স্বার্থেই রুপিকে লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার।

ভারতীয় মুদ্রা শক্তিশালীকরণের পাশাপাশি ভারতের ওপর বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান নির্ভরশীলতা বাড়ানোই ছিল এটির মূল কারণ। তারা বলছেন, দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক ভারসাম্যে যদি সাম্য বজায় থাকত, সেক্ষেত্রে ডলারের পরিবর্তে রুপিতে লেনদেন হলে এতে ডলারের ওপর চাপ কমত। কিন্তু বড় ধরনের বাণিজ্যিক ঘাটতিতেও ডলারের পরিবর্তে রুপির লেনদেনে মূলত ভারতকে সুবিধাই দেওয়া হয়েছিল।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে আমার দেশকে বলেন, বাংলাদেশ সাধারণত ভারতে দুই বিলিয়ন ডলারের মতো পণ্য রপ্তানি করে। বিপরীতে ভারত থেকে আট বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করে। এখন যদি রুপিতে লেনদেন করতে হয়, তাহলে ঘাটতিতে থাকা ছয় বিলিয়ন ডলারের রুপি বাংলাদেশকে কিনতে হবে। রুপির মাধ্যমে লেনদেন হলে ভারত থেকে ডলারের বিনিময়ে রুপি ক্রয় করে তবেই তা পরিশোধ করতে হবে। রুপির একমাত্র উৎস হিসেবে ভারত ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। ফলে ডলারের সঙ্গে রুপির বিনিময়হারেও ভারতের বাড়তি সুবিধা নেওয়ার প্রবণতা থাকবেই। আর এর মাধ্যমে ভারতীয় মুদ্রা রুপির বাজার শক্তিশালী করার একটি সুযোগ দেওয়া হয়েছে।

ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, আন্তর্জাতিক মুদ্রা হিসেবে ডলারের পর্যাপ্ততা অনেক বেশি। ডলারের সংকট থাকলেও সেটি বিকল্প অনেক উৎস থেকে জোগাড় করা সম্ভব। কিন্তু রুপির একমাত্র উৎস ভারত। ফলে সব মিলিয়ে ভারতের ওপর বাংলাদেশের নির্ভরশীলতার একটি প্রয়াস।

জানতে চাইলে পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী ড. এম মাসরুর রিয়াজ আমার দেশকে বলেন, ভারতের সঙ্গে রুপির লেনদেনের সিদ্ধান্ত সুবিবেচনাপ্রসূত ও বাস্তবসম্মত ছিল না। শুধু রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এবং ভারতকে খুশি করতেই রুপির লেনদেন প্রচলন করা হয়। ২০২৩ সালে যখন রুপিতে লেনদেনের সিদ্ধান্ত হয়, তখন আমেরিকার সঙ্গে শেখ হাসিনা সরকারের একটি টানাপোড়েন তৈরি হয়। সে কারণে ডলারকে চ্যালেঞ্জ জানানোর উদ্দেশ্যে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু রুপিতে লেনদেনে ভারতের রপ্তানিকারকরাও আগ্রহী নন। কারণ ডলার একটি অগ্রাধিকারমূলক ও শক্তিশালী মুদ্রা। সেজন্য ভারতীয়রা রুপির পরিবর্তে ডলারকে বেশি অগ্রাধিকার দেন। এ কারণে ডলারের পরিবর্তে মুদ্রায় লেনদেনে খুব একটা সাড়া মেলেনি।

ভারতের সঙ্গে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের বিশেষ সম্পর্কের কারণে এবং ভারতকে তুষ্ট করার প্রবণতা থেকেই এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে বলে মনে করেন এই বিশ্লেষক।

সংশ্লিষ্টরা জানান, আন্তর্জাতিক মুদ্রা হিসেবে মার্কিন ডলার, ইউরো, পাউন্ড, চীনা মুদ্রা ইউয়ান ও জাপানি মুদ্রা ইয়েন স্বীকৃত। এর মধ্যে ডলার সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়। বিশ্বপরিমণ্ডলে রুপিকে মর্যাদাপূর্ণ মুদ্রায় রূপান্তর করতে ভারত বহু বছর ধরেই চেষ্টা চালিয়ে আসছে। দেশটির অর্থ মন্ত্রণালয় সে দেশের বাণিজ্য সংগঠন ও ব্যাংকগুলোকে ভারতীয় মুদ্রায় বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্য শুরুর পরামর্শ দিতে থাকে। ভারতীয় সরকারের ওই ইচ্ছার বাস্তবায়ন ঘটায় শেখ হাসিনার সরকার।

২০০৯ সালে শেখ হাসিনা রাষ্ট্রক্ষমতায় আসার পর ভারতের সঙ্গে ২০টি চুক্তি এবং ৬৭টির মতো সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করে। ওই সব চুক্তিতে ভারতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া হয় বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। ভারতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়ার আরো একটি উদাহরণ হচ্ছেÑদুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য লেনদেনে ভারতীয় মুদ্রার প্রচলন।

মূলত শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর থেকে ভারতীয় রুপির মাধ্যমে লেনদেনের বিষয়টি আলোচনায় আসে। এ নিয়ে বিভিন্ন সময় নানান ফোরামে আলোচনা হলেও তা কার্যকর হয়নি। তবে দেশে আশঙ্কাজনকভাবে রিজার্ভ কমে যাওয়ায় ডলারের সংকট তৈরি হয়। ডলারের সংকটের কারণে ফের রুপিতে লেনদেনের বিষয়টি আলোচনায় উঠে আসে। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে ভারতে দুই দেশের বাণিজ্যমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে রুপিতে বাণিজ্যিক লেনদেন করার প্রস্তাব করে ভারত। তৎকালীন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি দেশে ফিরে এসে রুপিতে লেনদেনের বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করেন। এরপর সব পক্ষই ভারতীয় রুপির ব্যবহারের বিষয়ে সম্মত হয়। দ্রুততম সময়ের মধ্যে তা বাস্তব রূপ লাভ করে।

তবে সূত্রের দাবি, অর্থনৈতিক বাস্তবতার চেয়ে ভারতীয় মুদ্রা রুপির বিশেষ মর্যাদার বিষয়টি মাথায় রেখেই তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারপ্রধান শেখ হাসিনার বিশেষ আগ্রহেই দুই দেশের বাণিজ্যে রুপি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

শেখ হাসিনাকে খুশি করতে ওই সময় অনেক ব্যবসায়ী নেতা রুপিতে লেনদেন শুরু হওয়াকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। রুপির ব্যবহার হলে মুদ্রাবিনিময়জনিত ব্যয় কম হওয়ায় ব্যবসায়ীরা লাভবান হবেন- এমন মন্তব্য করেছিলেন তারা। এদের মধ্যে একজন হলেন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (ডিসিসিআই) বর্তমান প্রেসিডেন্ট তাসকিন এ খান। রুপির লেনদেনের বিষয়ে একটি গণমাধ্যমকে তিনি বলেছিলেন, ‘রুপিতে লেনদেন শুরু হলে অন্তত ২০০ কোটি ডলার বাঁচবে। সরকার তৃতীয় কোনো দেশ থেকে রুপি আনতে পারলে আরো ডলার সাশ্রয় সম্ভব। বেশ কয়েকটি দেশের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত আছে। সেসব দেশে রপ্তানির অর্থের কিছু অংশ রুপিতে আনার সুযোগ আছে।’

তাসকিন আহমেদ এক সময় ভারত-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি ছিলেন। তার এ মন্তব্যের বিষয়ে জানতে ফোন করলে তিনি সাড়া দেননি। পরে খুদেবার্তা পাঠিয়ে তার মন্তব্য জানতে চাইলে আমার দেশকে জানান, তিনি দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। প্রশ্নটি খুদেবার্তা আকারে পাঠানোর অনুরোধ জানান তিনি। গণমাধ্যমে দেওয়া তার বক্তব্য তুলে ধরে এ বিষয়ে মন্তব্য চাওয়ার পাশাপাশি ভারতের সঙ্গে তার প্রতিষ্ঠান এ পর্যন্ত রুপিতে কী পরিমাণ লেনদেন করেছে তার তথ্যও জানতে চাওয়া হয়। খুদেবার্তাটি দেখার পর সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও তিনি কোনো উত্তর বা মন্তব্য দেননি।

রুপিতে লেনদেনে সাড়া না পাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ আবু আহমেদ আমার দেশকে বলেন, ‘দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক ঘাটতি অনেক বেশি। ভারত থেকে আমদানিতে আমরা যদি রুপি গ্রহণ করি, ভারত তো আমাদের মুদ্রা টাকা গ্রহণ করবে না। তারা ডলারই চাইবে। ফলে রুপির প্রচলন করা হলেও এটি আগ্রহ তৈরি করতে পারেনি।’

এ প্রসঙ্গে রিকন্ডিশন্ড গাড়ি ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ রিকন্ডিশন্ড ভেহিকেলস ইমপোর্টার্স অ্যান্ড ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বারভিডা) সভাপতি আবদুল হক আমার দেশকে বলেন, ভারতীয় মুদ্রাকে আন্তর্জাতিক মুদ্রায় পরিণত করার প্রয়াসের সমর্থনে শেখ হাসিনা রুপিকে লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। তবে ডলারের একক নির্ভরতা কমানোর উপায় হিসেবে রুপির প্রচলন অযৌক্তিক না হলেও এটি খুব একটা প্রভাব ফেলতে পারেনি। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ কম হলে এটির ইতিবাচক প্রভাব পড়ত বলে মনে করেন তিনি।

অবশ্য ডলারের পরিবর্তে রুপির প্রচলন হলেও তাতে ডলার সংকট কমবে না বলেই মন্তব্য করেছিলেন বর্তমান বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। ডলারের পরিবর্তে যখন রুপির প্রচলন শুরু করা হয়, তখন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ছিলেন তিনি।

এ প্রসঙ্গে বিবিসি বাংলাকে দেওয়া মন্তব্যে তিনি তখন বলেছিলেন, ‘যেহেতু বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে বড় ধরনের বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে, সেজন্য রুপিতে লেনদেনে ডলার সংকট কমবে না, বরং বাড়বে।’ তিনি বলেছিলেন, নতুন ব্যবস্থায় এ বাণিজ্যের ফলে বাংলাদেশ আগে যে ২০০ কোটি ডলার পেত, সেটা এখন ভারত রুপিতে পরিশোধ করবে। ফলে বাংলাদেশ ওই পরিমাণ ডলার আর পাচ্ছে না। এতে ডলারের সরবরাহ কমে যাচ্ছে।

আবার এতে ব্যবসায়ীদের যে লাভ হবে, সে লাভের অর্থ ডলারে রূপান্তর করা এবং সেখানে প্রকৃত দাম পাওয়া যাবে কি না তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন মনসুর। কেননা রুপির দাম ডলারের দামের মতো স্থিতিশীল নয়।

তবে যা-ই হোক, আওয়ামী সরকারের আমলে ডলার নিয়ে বড় ধরনের সংকট তৈরি হয়েছিল। তার অন্যতম বড় কারণ ছিল ডলার পাচার। গত বছরের জুলাই বিপ্লবে ফ্যাসিবাদী শেখ হাসিনার পতন ও তার ভারতে পলায়নের পর দেশের অর্থনীতি ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ডলারের সংকটও কেটে গেছে। ডলার সংকটের কারণে যেখানে আমদানিতে লাগাম টেনে ধরা হয়েছিল, সেখানে এখন বাড়তি সরবরাহের কারণে ডলারের দর কমছে। আওয়ামী লীগ আমলে পাহাড়সম বিদেশি ঋণের বোঝা সামলে রিজার্ভের পরিমাণও বাড়ছে। বর্তমানে রিজার্ভ ৩০ বিলিয়ন ডলারss ছাড়িয়েছে।