Image description
ভারত-পাকিস্তান সংঘাত

ভারত-পাকিস্তানের সংঘাত যুদ্ধবিরতিতে থামলেও থামেনি কথার লড়াই। চলছে পরস্পরকে হুমকি-ধমকি। চুক্তি ভঙ্গের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ উঠলেও বড় ধরনের সংঘাত হয়নি। এর মধ্যে সোমবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কড়া সতর্কবার্তা দেন। জবাবে গতকাল মঙ্গলবার হুঁশিয়ারি দিয়েছে ইসলামাবাদ। এদিন ভারতের সঙ্গে সংঘাতে প্রাণহানির তথ্য প্রকাশ করেছে পাকিস্তান।

এরই মধ্যে গতকাল সন্ত্রাস ও বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতা নির্মূলে ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু-কাশ্মীরে ‘অপারেশন কিলার’ নামে সেনা অভিযান চালিয়েছে দিল্লি। এ অভিযানে জম্মু-কাশ্মীরের শোপিয়ান জেলায় অন্তত ৩ জন নিহত হয়েছেন। চার দিনের পাল্টাপাল্টি হামলায় দুই দেশই নিজেদের পক্ষে বিজয় দাবি করছে। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সাধারণ মানুষের উচ্ছ্বাস ও সমর্থন। কদিন আগে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের অভিযোগে সমালোচিত হলেও সাম্প্রতিক অভিযান নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভূয়সী প্রশংসা পাচ্ছে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী। অন্যদিকে, ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর সাফল্যের সাতকাহন প্রচারে মাঠে নেমেছে ভারতের কেন্দ্রীয় ক্ষমতাসীন দল বিজেপি।

সোমবার জাতির উদ্দেশে ভাষণে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি পাকিস্তানকে সতর্ক করে বলেন, যদি ভারতের ওপর আবার কোনো সন্ত্রাসী হামলা হয়, তাহলে সীমান্তে ‘সন্ত্রাসীদের আস্তানায়’ আবারও হামলা চালাবেন তারা। এ ক্ষেত্রে পারমাণবিক হামলার ভয় দেখিয়ে তাদের নিবৃত্ত রাখা যাবে না।

এর প্রতিক্রিয়ায় গতকাল পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মোদির ভাষণের সমালোচনা করে বলেছে, ‘মোদির বক্তব্য উসকানিমূলক। যখন এই অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা চলছে, তখন তার এ বক্তব্য উত্তেজনা বৃদ্ধিকেই নির্দেশ করে। পাকিস্তান বর্তমান যুদ্ধবিরতিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ রয়েছে এবং উত্তেজনা নিরসন ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার দিকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছে। ভবিষ্যতের যে কোনো ধরনের আগ্রাসনের জবাব হবে কঠোর।’

বিজেপির ‘তেরঙা যাত্রা’ শুরু: ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর সাফল্য উদযাপনে মঙ্গলবার ভারতজুড়ে ‘তেরঙা যাত্রা’ শুরু করেছে বিজেপি। আগামী ২৩ মে পর্যন্ত বিভিন্ন রাজ্যে এ যাত্রার মধ্য দিয়ে তারা তুলে ধরবে সেনাদের বিজয়গাথা। বিজেপির দাবি, রাজনৈতিক স্বার্থে নয়, বরং বীর সেনাদের কীর্তি তুলে ধরতেই এ আয়োজন। পাশাপাশি এ অভিযান নিয়ে চলমান অপপ্রচারের জবাবও দেওয়া হবে আয়োজনের মাধ্যমে। তেরঙা যাত্রায় তাদের হাতে থাকবে দেশের জাতীয় পতাকা। ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর ‘সাফল্য’ বিজেপি নিশ্চিতভাবে কাজে লাগাবে বিহার নির্বাচনে। চলতি মাস শেষ হওয়ার আগেই প্রধানমন্ত্রী আরও একবার বিহার সফরে যাবেন। বছরের শেষদিকে বিহার বিধানসভা নির্বাচনে জাত গণনার পাশাপাশি ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর সাফল্য হতে চলেছে বিজেপির তুরুপের দুই তাস।

ক্ষয়ক্ষতির হিসাব দিল পাকিস্তান আইএসপিআর: পাকিস্তানে ভারতের ‘অপারেশন সিঁদুর’ পরিচালনার পর নয়াদিল্লি দাবি করেছিল, অভিযানে ৭০ জন পাকিস্তানি সন্ত্রাসী নিহত হয়েছে। তবে পাকিস্তানের দাবি ছিল, নিহত ৩১ জন এবং আহত ৫৭ জনের সবাই বেসামরিক নাগরিক। অবশেষে গতকাল পাকিস্তানের আইএসপিআর ক্ষয়ক্ষতির হিসাব দিয়েছে। তাদের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এ অভিযানে পাকিস্তানে নিহত হয়েছে মোট ৫১ জন, যাদের মধ্যে সাতজন নারী ও ১৫টি শিশু। এ ছাড়া আহত হয়েছে ১২১ জন। নিহতদের মধ্যে ১১ জন সেনাসদস্য রয়েছেন। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, পাকিস্তানের সার্বভৌমত্বকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে—এমন যে কোনো উদ্যোগ ব্যাহত করতে দেশটির সামরিক বাহিনী সর্বদা প্রস্তুত রয়েছে।

সীমান্ত এলাকায় সেনা উপস্থিতি কমাতে একমত ভারত-পাকিস্তান: যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর জম্মু-কাশ্মীরসহ সব সীমান্ত এলাকায় সেনা উপস্থিতি কমাতে একমত হয়েছে ভারত ও পাকিস্তান। হটলাইনে আলোচনা করেছেন ভারত ও পাকিস্তানের মিলিটারি অপারেশন্স বিভাগের প্রধানরা। সিদ্ধান্ত হয়েছে, সীমান্তে সেনার সংখ্যা কমাবে দুই পক্ষই। প্রায় ৪৫ মিনিটের ওই বৈঠকের পর কোনো বিবৃতি দেয়নি কেউই। তবে পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যম ডন জানিয়েছে, আপাতত সীমান্ত এলাকার নিরাপত্তা ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকবে দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী। সীমান্তে সেনাবাহিনীও থাকবে, কিন্তু সংঘাত পরিস্থিতির সৃষ্টি না হলে তারা সামনে আসবে না। এ ছাড়া দুই দেশের সীমান্তরেখার ১ কিলোমিটারের মধ্যে কোনো হেলিকপ্টার ও ১০ কিলোমিটারের মধ্যে কোনো যুদ্ধবিমান প্রবেশ করবে না বলেও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে আলোচনায়।

আদমপুর ঘাঁটি পরিদর্শনে মোদি: পাকিস্তানের হামলা চালানো ভারতের আদমপুর বিমানঘাঁটি পরিদর্শন করেছেন মোদি। গতকাল সকাল ৬টা ১৫ মিনিটের দিকে ঘাঁটিতে যান তিনি। তাকে বহনকারী বিমানটি ওই ঘাঁটির রানওয়েতেই অবতরণ করেছে এবং মোদি এস-৪০০ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলেছেন। মোদি তার এক্স অ্যাকাউন্টে আদমপুর ঘাঁটি সফরের কয়েকটি ছবি প্রকাশ করেছেন। সেখানে তিনি সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ ও শুভেচ্ছা বিনিময় করেন।

ক্ষতিপূরণ দাবি ভুক্তভোগীদের: ভারত অধিকৃত কাশ্মীরের সীমান্তবর্তী গ্রামের অনেক বাসিন্দা পাকিস্তানের গোলাবর্ষণে নিজেদের বাড়িঘর ও জীবিকা ধ্বংস হওয়ায় ইসলামাবাদের কাছে ক্ষতিপূরণের দাবি জানিয়েছেন। দুই দেশের এই পাল্টাপাল্টি হামলায় অন্তত ৭০ বেসামরিক নিহত হয়েছেন। সংঘাতের সময় কাশ্মীরের শত শত গ্রামবাসী তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। এ ছাড়া জম্মু, পাঞ্জাব এবং রাজস্থানে সীমান্তবর্তী এলাকায় শত শত পরিবার গৃহহীন হয়েছে। দুই দেশের ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ধসে পড়েছে অনেক বাড়ি ও অবকাঠামো। যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ায় স্বস্তি পেলেও অনেকে অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। এ বিষয়ে ভারত সরকার গতকাল ভুক্তভোগীদের তালিকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার উদ্যোগের ঘোষণা দিয়েছে।

ভারতীয় দুই বিমান সংস্থার সব ফ্লাইট বাতিল: ভারতের দুটি বিমান সংস্থা এয়ার ইন্ডিয়া ও ইন্ডিগো দেশটির উত্তর ও পশ্চিম সীমান্তবর্তী একাধিক শহরে তাদের সব ফ্লাইট বাতিল করে দিয়েছে। গতকাল পৃথক বিবৃতিতে এ তথ্য দেয় সংস্থা দুটি। এয়ার ইন্ডিয়ার বিবৃতিতে বলা হয়, সাম্প্রতিক ঘটনাবলির পরিপ্রেক্ষিতে যাত্রী সুরক্ষার কথা মাথায় রেখে জম্মু, লেহ, যোধপুর, অমৃতসর, ভুজ, জামনগর, চণ্ডীগড় ও রাজকোটের ফ্লাইটগুলো বাতিল করা হয়। অন্যদিকে ইন্ডিগো জানায়, তারা জম্মু, অমৃতসর, চণ্ডীগড়, লেহ, শ্রীনগর ও রাজকোটের ফ্লাইট বাতিল করছে।

গত ২২ এপ্রিল পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পেহেলগামে হামলায় সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তুলে কূটনৈতিক সম্পর্ক হ্রাস, সীমান্ত বন্ধ এবং গুরুত্বপূর্ণ সিন্ধু পানিবণ্টন চুক্তি স্থগিত করে ভারত। যদিও পাকিস্তান এই অভিযোগ অস্বীকার করে। উভয় দেশই একে অপরের নাগরিকদের ভিসা বাতিল করে। ভারতীয় মালিকানাধীন অথবা ভারতীয়দের পরিচালিত সব ধরনের বিমান সংস্থার জন্য নিজেদের আকাশসীমা বন্ধ করে দেয় পাকিস্তান। গত ৭ মে পাকিস্তান ভূখণ্ডে ‘অপারেশন সিঁদুর’ পরিচালনা করে ভারত। জবাবে বুনিয়ান উন মারসুস অভিযান চালায় পাকিস্তান। অবশেষে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় গত শনিবার দুই দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করতে সম্মত হয়।