
জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের ভূমি ও সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা বিভাগে দুর্নীতির অভিযোগ নতুন নয়। তবে এবার একটি গোপন প্রতিবেদনের মাধ্যমে যে চক্রের তালিকা সামনে এসেছে, তা ঘিরে চরম বিতর্ক ও বিস্ময়ের সৃষ্টি হয়েছে। এই প্রতিবেদনে একজন মৃত ব্যক্তির নাম রয়েছে, যার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়েছে। পাশাপাশি দেখা গেছে, যাদের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে তাদের অনেকেই বহাল তবিয়তে রয়েছেন, অথচ শাস্তির মুখোমুখি হয়েছেন মাত্র একজন। এতে গৃহায়ন দপ্তরের অভ্যন্তরে চরম অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।
গোপন প্রতিবেদন অনুযায়ী, দুর্নীতি চক্রের সদস্য হিসেবে গৃহায়নের ভূমি ও সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা বিভাগের অফিস সহকারী মো. ফরিদ উদ্দিন কামালের নাম রয়েছে, যিনি ২০২১ সালে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। অথচ তার নামই এখন উঠেছে বর্তমান সময়ের দুর্নীতি সিন্ডিকেটের সদস্য হিসেবে। এই নাম প্রকাশের পর গৃহায়নের অভ্যন্তরে তা হাস্যরস এবং বিতর্কের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। কর্মকর্তারা বলছেন, এই প্রতিবেদনকে ভিত্তি করে ব্যবস্থা নিতে গেলে প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে। একজন বলেন, যারাই এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলে বলা হচ্ছে, একই রিপোর্টে একজন মৃত ব্যক্তি আছে, তাহলে কীভাবে বাকি অভিযোগ বিশ্বাসযোগ্য? ফলে অভিযোগকারী এবং কর্তৃপক্ষ—দুই পক্ষই একটি জটিল পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে। আরও বিস্ময়কর তথ্য হলো, যাদের সিন্ডিকেটের সদস্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে তাদের মধ্যে কেউ কেউ দীর্ঘদিন ধরে ঢাকার বাইরে বদলি ছিলেন কিংবা কয়েক মাস আগে যোগদান করেছেন। কিন্তু এই রিপোর্টের আলোকেই তাদের সদস্য বলে উল্লেখ করে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে একজনকে সাময়িকভাবে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে, যার কারণে অনেকেই বলছেন, ২০ জনের নাম থাকা সত্ত্বেও শুধু একজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া পক্ষপাতমূলক ও দায়সারা সিদ্ধান্ত।
এই বিতর্কিত তালিকার কেন্দ্রে রয়েছেন মিরপুর ডিভিশন অফিসে কর্মরত অফিস সহকারী মোস্তফা কামাল শাহীন, যিনি বর্তমানে সিবিএ কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, অবৈধ সম্পদ অর্জন, পাসপোর্ট গ্রহণ, কিশোর গ্যাংয়ের মাধ্যমে কর্মকর্তা ও ঠিকাদারদের ভয়ভীতি প্রদর্শন, স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকে মামলা, সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বিপুল সম্পত্তি হাতিয়ে নেওয়া। প্রতিবেদনে বলা হয়, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের সুনাম ক্ষুণ্ন এবং সরকারের ভাবমূর্তি বিনষ্টে তার বিরাট ভূমিকা রয়েছে। এই সুপারিশের ভিত্তিতেই ১৭ এপ্রিল গৃহায়ন চেয়ারম্যান নূরুল বাসির স্বাক্ষরিত চিঠিতে মোস্তফা কামাল শাহীনকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়। যদিও একই প্রতিবেদনে আরও ২০ জনের নাম উল্লেখ থাকলেও শুধু শাহীনকে বরখাস্ত করায় বিষয়টি নিয়ে কর্মকর্তারা অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। এ প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে যাদের বিরুদ্ধে বদলির সুপারিশ করা হয়েছে তারা হলেন মো. আসান হাবিব, পরিচালক; মো. নাহিদ আরমান, হিসাব সহকারী; মো. মালেকিন নাসির, হিসাব সহকারী; এম সেলিম শাহনেওয়াজ, উপপরিচালক-১ এবং মো. কামরুজ্জামান, রেকর্ড কিপার।
এ ছাড়া অভিযোগ আছে—ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তার স্বাক্ষর জাল করে সরকারি জমি ব্যক্তিমালিকানায় রূপান্তর করে জাল দলিল করা হয়েছে। একজনের বরাদ্দকৃত জমির সামনে থাকা খণ্ড জমি অন্যজনের নামে বরাদ্দ দিয়ে পরে সমাধানের নামে মোটা অঙ্কের অর্থ গ্রহণ করা হয়। এর মধ্যে অন্যতম অভিযোগ হলো, প্লট বরাদ্দের নিয়ম ভেঙে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নামে বরাদ্দ দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া। কর্মকর্তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, এই সিন্ডিকেটের মূলহোতা হিসাব সহকারী মো. মালেকিন নাসির, যার সহযোগী হিসেবে রয়েছেন চেয়ারম্যানের পিএস মো. নাহিদ আরমান, পরিচালক মো. আসান হাবিব, উপপরিচালক সেলিম শাহনেওয়াজ এবং রেকর্ড কিপার মো. কামরুজ্জামান।
দীর্ঘদিন ভূমি শাখা থেকে ক্ষমতার বলয়ে যিনি প্রভাব বিস্তার করেছেন তিনি হিসাব সহকারী মালেকিন নাসির। ২০১০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত টানা ১২ বছর একই শাখায় থেকে কোটি টাকার দুর্নীতি করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। তাকে একবার বদলি করা হলেও চলতি বছরের শুরুতে তিনি আবার সেই শাখায় ফিরে এসেছেন এবং পুনর্বাসনের সব কাজ হাতে নিয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে, এই কাজগুলোও তিনি করছেন মোটা অঙ্কের চুক্তিতে।
একইভাবে গৃহায়নের কর্মচারী সমিতির সাবেক নেতা দেলোয়ার হোসেনের সহযোগী ছিলেন এই মালেকিন নাসির। নাসির নারী নির্যাতনের মামলায় গ্রেপ্তার হন এবং এরপর এই বলয়ের কার্যক্রম আরও প্রকাশ্যে আসে। জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ দেলোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করলে সেখানে নাসিরের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়।
চক্রের সদস্য হিসেবে যে ২০ জনের নাম প্রতিবেদনটিতে রয়েছে তারা হলেন মো. আসান হাবিব, এম সেলিম শাহনেওয়াজ, মো. মালেকিন নাসির, মো. কামরুজ্জামান, মো. নাহিদ আরমান, মো. শওকত হোসেন, মো. সোহেল হোসেন, মো. আব্দুর রাজ্জাক শেখ, মো. ফরিদ উদ্দিন কামাল (মৃত), নাফিজা খানম, মো. রেজাউল ইসলাম, মো. জাকির হোসেন, মো. আইয়ুব আলী খন্দকার, মোসাব্বিবাল আসবাব ইকবাল, শোয়েব উল আহসান, ইউসুফ হোসেন, মো. রিয়াজুল ইসলাম, মো. মমিনুল ইসলাম, মো. মাজেদুল ইসলাম ও মো. আসাদ।
এই প্রতিবেদন নিয়ে জানতে চাইলে গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান সৈয়দ মো. নূরুল বাসির বলেন, ‘এই অনিয়মের বিষয়টি আমরা মাথায় নিয়েছি।’ একজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলেও বাকিরা ধরাছোঁয়ার বাইরে কেন—এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘যাদের নাম আসছে সবারই কমবেশি দোষ আছে। যারা দোষী সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রোসেসিং চলছে। আস্তে আস্তে সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘যাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে তাদের জায়গায় ভালো লোক খোঁজা হচ্ছে। তা-ও তো পেতে হবে।’ তিনি আরও জানান, ‘যারা প্রতিবেদন তৈরি করেছে, তাদের তো বলা যায় না প্রমাণ দেন। আবার অভিযুক্তদের বললেও তারা বলবে, আপনারা প্রমাণ করুন আমরা দোষী।’ এ ধরনের জটিলতা থেকেই প্রতিবেদন থাকলেও সতর্কভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে।’
অফিস সহকারী মোস্তফা কামাল শাহীন বলেন, ‘আমি সরকারি চাকরিজীবী। কিন্তু আমাকে বলা হয়েছে কিশোর গ্যাং হোতা। আরও বলা হয়েছে, আমার বেসরকারি পাসপোর্ট আছে। কয়েক মাস পরপর বিদেশে যাই। আমার নাকি বিশাল সিন্ডিকেট চক্র আছে এবং অবৈধ সম্পত্তি অর্জনের কথা বলা হয়েছে। এসব মিথ্যা। আমার ছোট ভাই আমেরিকা থাকে। মিরপুরে যে আমার সম্পত্তির কথা বলা হয়েছে, তা গৃহায়ন রক্ষিত নথি যাচাই-বাছাই করলে পাওয়া যাবে। আমার কোনো অবৈধ সম্পত্তি নেই। আমার বিরুদ্ধে একটি পক্ষ ষড়যন্ত্র করছে। এমনকি হাইকোর্টের একজন ব্যারিস্টারের নাম দিয়ে আমার বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। তিনি গৃহায়নের চেয়ারম্যান বরাবর লিখিত দিয়ে জানিয়েছেন, এই অভিযোগ তিনি করেননি। কিন্তু একটি পক্ষ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সিন্ডিকেট চক্রের সদস্য হিসেবে ২০ জনের নাম দেওয়া হয়েছে এবং ৫ জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। কিন্তু কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। অন্যরা এখন বহাল তবিয়তে আছে।’
চেয়ারম্যানের পিএস-২ মো. নাহিদ আরমান বলেন, ‘আমি শুনেছি একটি সংস্থা বিভিন্ন অনিয়ম ও সিন্ডিকেটের তথ্য উল্লেখ করে প্রতিবেদন দিয়েছে এবং আমার নাম আছে। এই প্রতিবেদনে একজন মৃত ব্যক্তির নাম আছে। তাই আমরা মনে করি, এটা ভুয়া এবং ভিত্তিহীন।’
হিসাব সহকারী মো. মালেকিন নাসির বলেন, ‘আমি নতুন আসছি। আমি কোনো সিন্ডিকেটে জড়িত না। কীসের ভিত্তিতে তারা প্রতিবেদনে আমার নাম দিয়েছে? আমি ভূমি ও পুনর্বাসনের কাজ করি, কিন্তু কোনো টাকা নিই না। এখানে ষড়যন্ত্র করে আমার নাম কেউ দিয়েছে।’
উপপরিচালক-১ এম সেলিম শাহনেওয়াজ বলেন, ‘একটি সংস্থা সিন্ডিকেট চক্রের সদস্য হিসেবে আমার নাম দিয়েছে, কিন্তু সঠিক নয়। এর আলোকে অধিদপ্তর একজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে। কিন্তু যে প্রতিবেদন সঠিক নয়, তার আলোকে ব্যবস্থা নেওয়া ও ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা কতটা যৌক্তিক, তা জানি না।’
রেকর্ডকিপার মো. কামরুজ্জামান বলেন, ‘আমি রেকর্ডকিপার ছিলাম। এখন আমাকে বদলি করা হয়েছে। জালজালিয়াতি হয়েছে। কিন্তু আমি জড়িত না। আমি সিন্ডিকেট চক্রের সদস্য না। কীসের ভিত্তিতে আমার নাম প্রতিবেদনে দেওয়া হয়েছে, তারাই বলতে পারবে।’