
গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পতনের পরপরই জনপ্রশাসনে পদোন্নতি ও পদায়ন ঘিরে তুলকালাম কাণ্ড ঘটে। বিশেষ করে জেলা প্রশাসক (ডিসি) নিয়োগ নিয়ে কর্মকর্তাদের মধ্যে হাতাহাতি, মারামারি পর্যন্ত হয়েছিল। এবার অবসরপ্রাপ্ত কয়েকজন কর্মকর্তা জনপ্রশাসনে ‘নজিরবিহীন ক্ষমতা’ দেখালেন। পাঁচজন সচিবের অপসারণ ও প্রশাসনে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বন্ধের দাবি নিয়ে গতকাল মঙ্গলবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ (এপিডি) অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব এরফানুল হককে সারাদিন অবরুদ্ধ করে রাখেন তারা। হেনস্তার শিকার হয়েছেন ঊর্ধ্বতন নিয়োগ-১ শাখার উপসচিব জামিলা শবনমও। তাকে হেনস্তার পাশাপাশি তার মোবাইল ফোনও কেড়ে নেওয়ার অভিযোগ ওঠে।
কর্মকর্তারা জানান, আওয়ামী সুবিধাভোগী পাঁচ সচিবকে দ্রুত অপসারণসহ চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিলের দাবিতে সচিবালয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে অবস্থান নেন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা। বৈষম্যবিরোধী কর্মচারী ঐক্য ফোরাম এ কর্মসূচি পালন করে। কিন্তু তাদের কর্মসূচির ধরন একেবারেই বেআইনি। তারা একটা দপ্তরকে অবরুদ্ধ করে সারাদিন কোনো কাজ করার সুযোগ দেননি। এ নিয়ে কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা গেছে।
ক্ষুব্ধ একজন কর্মচারী কালবেলাকে বলেন, সব সুযোগ-সুবিধা কেন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের দিতে হবে? অতীতে বিভিন্ন সময়ে কর্মচারীরাও নানাভাবে বঞ্চিত হয়েছেন; কিন্তু তাদের কোনো সুবিধা দেওয়া হয়নি। অথচ ‘বঞ্চিত’ নাম দফায় দফায় সব সুযোগ-সুবিধা নিয়ে যাচ্ছে প্রশাসন ক্যাডার ও পুলিশ ক্যাডারের কর্মকর্তারা। কর্মচারীরা অতীতেও বঞ্চিত ছিল, এখনো বঞ্চিত। তাদের দেখার কেউ নেই।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেন, অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা যেভাবে এপিডি অবরুদ্ধ করে রেখেছেন, তা কোনোভাবেই সমীচীন হয়নি। তারা রাজনৈতিক কর্মীর মতো আচরণ করে জনপ্রশাসনে এক ধরনের ক্ষমতাই দেখিয়ে গেলেন।
জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এপিডি অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. এরফানুল হক কালবেলাকে বলেন, ‘উনারা (অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) এসে কিছু দাবি-দাওয়ার কথা জানিয়েছেন। আমাদের সচিব স্যারের সঙ্গে কথা বলে ৪টার দিকে তারা চলে গেছেন।’ আপনাকে সারাদিন অবরুদ্ধ রাখা হয়েছে কি না—এমন প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যান এপিডি।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সকাল ১০টা থেকেই ১৫-২০ জন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এপিডির রুমে ঢুকে তাকে অবরুদ্ধ করে রাখেন। তারা বৈষম্যবিরোধী কর্মচারী ঐক্য ফোরামের সদস্য। এ সময় তারা প্রশাসনের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের উদ্দেশ করে নানা অভিযোগ তোলেন। তাদের কেউ কেউ বলতে থাকেন, টাকা খেয়ে আওয়ামী লীগের লোকদের বিভিন্ন পদে বসানো হচ্ছে। তখন এপিডির রুমে প্রবেশ করলে ঊর্ধ্বতন নিয়োগ-১ শাখার উপসচিব জামিলা শবনমের মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়ে তাকে হেনস্তা করেন ভূতাপেক্ষ সচিব পদোন্নতি পাওয়া বিসিএস প্রশাসন ক্যাডার সপ্তম ব্যাচের কর্মকর্তা ও বৈষম্যবিরোধী কর্মচারী ঐক্য ফোরামের সদস্য সচিব কাজী মেরাজ হোসেন। ওই ঘটনার পর এপিডির অন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যেও আতঙ্ক দেখা দেয়। এপিডিকে অবরুদ্ধের পাশাপাশি অন্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে অশোভন আচরণ করেন সাবেক কর্মকর্তারা। ফলে ভয়ে গণমাধ্যমের কাছেও মুখ খুলতে অপরাগতা দেখান আতঙ্কিত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
অবশ্য অভিযোগ অস্বীকার করে বৈষম্যবিরোধী কর্মচারী ঐক্য ফোরামের সদস্য সচিব কাজী মেরাজ হোসেন কালবেলাকে বলেন, ‘আমরা জনপ্রশাসন সচিব আসা পর্যন্ত এপিডির রুমে অবস্থান করেছি। কোনো কর্মসূচি পালন করিনি। কাউকে অপদস্তও করিনি। এগুলো মিথ্যা অভিযোগ।’
তিনি বলেন, আমরা পাঁচজন সচিবের অপসারণ ও সব চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বন্ধের দাবি জানিয়েছি। বিকেল ৪টার দিকে জনপ্রশাসন সচিব সচিবালয়ে আসার পর তার সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। তিনি আমাদের দাবি-দাওয়ার বিষয়ে আশ্বাস দিয়েছেন। আগামী ২০ মে সমস্যা সমাধান করবেন।
এ বিষয়ে জনপ্রশাসন বিশ্লেষক ও সাবেক সচিব একেএম আব্দুল আউয়াল মজুমদার কালবেলাকে বলেন, এপিডি একজন ছোট কর্মকর্তা। হেনস্তার শিকার নারী উপসচিবেরও কোনো ক্ষমতা নেই। নিয়োগ-পদোন্নতিতে তাদের কোনো ভূমিকাই নেই। সিদ্ধান্তগুলো একেবারেই ওপর থেকে হয়। সুতরাং তাদের অবরুদ্ধ রাখা কিংবা হেনস্তা করা একেবারেই অন্যায়। প্রশাসনে এগুলো চলতে পারে না। অবসরপ্রাপ্তরা উপদেষ্টা, মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও জনপ্রশাসন সচিবের সঙ্গে কথা বলতে পারতেন। দাবি আদায়ের নামে এভাবে দপ্তর অবরুদ্ধ করে রাখা কোনো সমাধান নয়।