
পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয়েছে বিদ্যুৎ খাতে। যে কারণে এরই মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি বাতিল করেছে। এতে বেসরকারি খাতের অর্ধশতাধিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকরা মূলধনি যন্ত্রপাতি বিদেশে পাঠাতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন। শুল্কমুক্ত সুবিধায় মূলধনি যন্ত্রপাতি নিয়ে আসা পতিত সরকারঘনিষ্ঠ এসব প্রভাবশালী ব্যবসায়ী নিজেরা না এসে বিভিন্ন মাধ্যমে চাপ তৈরি করছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর)। তারা হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের জন্য নিয়ে আসা যন্ত্রপাতি এখন পুনঃরপ্তানি করতে বেআইনি আবদার করছেন। প্রজ্ঞাপনের শর্তে বিক্রি বা হস্তান্তরের ক্ষেত্রে শুল্ককর পরিশোধের বাধ্যবাধকতা থাকলেও তারা তা পরিশোধে নারাজ। যন্ত্রপাতির আয়ুষ্কাল শেষ হয়েছে—এমন সব অস্বাভাবিক যুক্তি দিয়ে সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করছেন। এসব ব্যবসায়ীর চাপে এনবিআর একটি বৈঠকও করেছে। যদিও কোনো ধরনের সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হয় সেই বৈঠক। এনবিআর সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
বিদ্যুৎ খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পতিত আওয়ামী লীগ সরকার দেশে শতভাগ বিদ্যুৎ সরবরাহের নামে চড়া দামে কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু করে। আর কুইক রেন্টালের বড় সুবিধাভোগী হন আওয়ামীপন্থি প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা। তারা অনুমোদন নিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেও বছরের পর বছর ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে হাজার হাজার কোটি টাকার ভর্তুকি পান। আর তৎকালীন সরকার পাওয়ার প্লান্টে ক্যাপিটাল মেশিনারিজে (মূলধনি যন্ত্রপাতি) শুল্ক সুবিধা দেয়। সরকারের সিদ্ধান্তে শুল্ক সুবিধা দিয়ে এ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করে এনবিআর। ওই প্রজ্ঞাপনে বেশকিছু শর্ত দিয়ে দেয় এনবিআর। এর মধ্যে অন্যতম শর্ত হলো শুল্ক সুবিধায় আমদানি করা যন্ত্রপাতি বিক্রয় বা হস্তান্তর করা যাবে না। বিক্রি বা হস্তান্তর করতে হলে সরকারের সমুদয় শুল্ককর পরিশোধ করতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকার কুইক রেন্টাল কেন্দ্রগুলোর সঙ্গে চুক্তি বাতিলের পর এসব কেন্দ্র মালিক যন্ত্রপাতি বিদেশে পুনঃরপ্তানির জন্য এনবিআরে আবেদন শুরু করেছেন। তবে এসব আবেদনে যে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে শুল্ক সুবিধা পেয়েছেন, সেই প্রজ্ঞাপনের শর্তভঙ্গ করে ক্যাপিটাল মেশিনারিজ বিদেশে পাঠাতে চান। যন্ত্রপাতির আয়ুষ্কাল শেষ হয়েছে উল্লেখ করেও নানা অজুহাতে আবেদন করেছেন পাওয়ার প্লান্ট মালিকরা। যদিও ক্যাপিটাল মেশিনারিজ পুনঃরপ্তানির ক্ষেত্রে কত বছরে কত শতাংশ অবচয় হিসেবে বিবেচিত হবে, তা-ও আইনে স্পষ্ট বলা আছে। এসব আইন উপেক্ষা করে প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন মাধ্যমে সুবিধা আদায় করতে চাপ তৈরি করছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এনবিআরের শীর্ষ পর্যায়ের এক কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কুইক রেন্টাল বাতিলের পর থেকে পাওয়ার প্লান্ট মালিকরা ক্যাপিটাল মেশিনারিজ বিদেশে পাঠানোর অনুমতির আবেদন করছেন। এর মধ্যে অনেকে প্রজ্ঞাপনে শুল্ককর পরিশোধের শর্ত জেনে আয়ুষ্কাল শেষ হয়েছে বলে আবেদন করেছেন। আয়ুষ্কাল শেষ হওয়ার অজুহাতে তারা সরকারের শুল্ককর পরিশোধ করতে চান না। আর বিষয়টি আদায় করতে নিজেরা না এসে বিভিন্ন মহল থেকে চাপ তৈরির চেষ্টা করা হচ্ছে। পাওয়ার প্লান্ট নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা রয়েছে। সরকারের উচ্চপর্যায়ের অনুমতি ছাড়া কোনো ধরনের সিদ্ধান্তের অবকাশ নেই বলেও জানান এ কর্মকর্তা। তবে দুটি প্রতিষ্ঠানকে শুল্ককর পরিশোধ সাপেক্ষে যন্ত্রপাতি বিদেশে পাঠানোর অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
এনবিআর সূত্র আরও জানায়, প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের চাপে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিসহ চলতি সপ্তাহে বৈঠকে বসে এনবিআর। ওই বৈঠক কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হয়। এতে বিষয়টি নিয়ে বিশদ আলোচনায় জোরালোভাবে শুল্ককর আদায় করার পক্ষে মত দেন এনবিআর কর্মকর্তারা। ওই বৈঠকে বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড (পিডিবি) থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিনিধি ক্যাপিটাল মেশিনারিজ হিসেবে আমদানি করা যন্ত্রপাতি সরেজমিন দেখা থেকে শুরু করে আয়ুষ্কাল আছে কি না, তা যাচাই-বাছাই করা এবং আমদানি প্রক্রিয়ায় মানি লন্ডারিং সংক্রান্ত কোনো ইস্যু আছে কি না, তা খতিয়ে দেখার বিষয়টি উপস্থাপন করেন। বিষয়টি নিয়ে বিশদ আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হতে পারে বলেও জানান বৈঠকে অংশ নেওয়া এক কর্মকর্তা।
খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশে বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে কুইক রেন্টাল কেন্দ্র চালু করে পতিত আওয়ামী লীগ সরকার। তবে শুধু তৎকালীন সরকারপন্থি প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির অনুমোদন পান। এতে ক্যাপাসিটি চার্জ (বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রকে অলস বসিয়ে রাখলে চুক্তি অনুযায়ী তাদের যে পরিমাণ ভর্তুকি সরকারকে দিতে হয়) দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় তৎকালীন সরকার। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন-সরবরাহ ছাড়াই শত শত কোটি টাকা যায় ব্যবসায়ীদের পকেটে। ক্যাপাসিটি চার্জই নয়, বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির যন্ত্রপাতি আমদানিতেও শুল্ক সুবিধা দেয় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহার্য সব ধরনের আমদানি করা পণ্য সম্পূর্ণ শুল্ক সুবিধা দেওয়ায় কোনো প্রকার শুল্ক পায়নি সরকার। যদিও সাধারণ নিয়ম অনুসারে পাওয়ার প্লান্টের মেশিনারিজ আমদানিতে মোট শুল্ককর প্রায় ২৬ শতাংশ। বেসরকারি খাতের এই শুল্ককর তৎকালীন সরকার সম্পূর্ণ মওকুফ করে দেয়। তবে এ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে বিক্রি বা হস্তান্তর করা যাবে না উল্লেখ করে শর্ত যুক্ত ছিল। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আবারও সুবিধা নিতে সক্রিয় হন পাওয়ার প্লান্ট মালিকরা। অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে বিভিন্ন কৌশলে এ শর্ত শিথিলের জন্য তৎপরতা শুরু করেছেন। শত শত কোটি টাকার সুবিধা পাওয়া ব্যবসায়ীরা এখন যন্ত্রপাতির আয়ুষ্কাল শেষ হয়েছে উল্লেখ করে সরকারের শুল্ক পরিশোধ না করেই এসব যন্ত্রপাতি বিদেশে পাঠানোর চেষ্টা করছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ এবং কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা ড. শামসুল আলম কালবেলাকে বলেন, বিগত সরকারের আমলে বিদ্যুৎ খাতে বড় ধরনের লুটপাট হয়েছে। এই লুণ্ঠনকারীরা আবার শর্ত শিথিল করে সুবিধা নিতে চান। সরকার আসলে কার এসব লুণ্ঠনকারীর নাকি জনগণের বলেও প্রশ্ন রাখেন এ অধ্যাপক।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, গত সরকারের আমলে ৫০টির বেশি পাওয়ার প্লান্টের বিপরীতে শুল্ক সুবিধা দেওয়া হয়েছে। মালিকদের দেওয়া ঘোষণা অনুযায়ী, পাওয়ার প্লান্ট ভেদে প্রতিটির মূলধনি যন্ত্রপাতি বাবদ বিগত সরকার ন্যূনতম ৫০ কোটি টাকার শুল্ক সুবিধা দিয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই পরিমাণ শতকোটি টাকার বেশি। উদাহরণ হিসেবে এক কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, ঢাকার অদূরে কেরানীগঞ্জে সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর বাড়ির পাশে এপিআর এনার্জি বাংলাদেশ লিমিটেড ১০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করে। সেখানে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা টাকার মেশিনারিজ আমদানি করেছে। সাধারণ নিয়ম হলে কোম্পানিটিকে শুধু মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি বাবদ প্রায় ৮০ কোটি টাকা শুল্ক পরিশোধ করতে হতো। সরকার মওকুফ করে দেওয়ায় কোম্পানিটিকে এ শুল্ক পরিশোধ করতে হয়নি। বিভিন্ন মেগাওয়াটের ক্ষেত্রে ভিন্ন খরচ। কেন্দ্র ছোট হলে কম, বড় হলে বেশি। সেই হিসাবে একটি পাওয়ার প্লান্টে ন্যূনতম প্রায় ৫০ কোটি টাকার শুল্ক সুবিধা পেয়েছেন প্লান্ট মালিকরা। সেই হিসাবে প্রজ্ঞাপনের শর্ত শিথিল করে মূলধনি যন্ত্রপাতি বিদেশে পুনঃরপ্তানি করলে অর্ধশতাধিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ক্ষতি হবে বলেও মনে করেন এ শুল্ক কর্মকর্তা। এ ছাড়া দ্বীপ জেলা ভোলায় নতুন বিদ্যুৎ বাংলাদেশ লিমিটেড ২২০ মেগাওয়াট সম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করে। প্রতিষ্ঠানটি শুল্কমুক্ত সুবিধায় প্রায় ৪৯৫ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি আমদানি করেছে। প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ১২৫ কোটি টাকার শুল্ক সুবিধা পেয়েছে। কার্যক্রম শেষ হয়ে যাওয়ায় প্রতিষ্ঠানটি মূলধনি যন্ত্রপাতি বিদেশে পুনঃরপ্তানির আবেদন করলে এনবিআর শুল্ককর পরিশোধ সাপেক্ষে পুনঃরপ্তানির অনুমোদন দিয়েছে।