
গত বছরের ২৭ জানুয়ারি রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী উপজেলার মাদারপুরের এক খামারবাড়িতে বাজারের ব্যাগ থেকে আট কেজি ৪০০ গ্রাম হেরোইন জব্দ করে গোদাগাড়ী থানার পুলিশ। খামারটি ছিল ফরিদুল ইসলামের। ওই খামারবাড়ি থেকে জব্দ করা হেরোইনের আনুমানিক দাম আট কোটি ৪০ লাখ টাকা। ফরিদুলকে এখনো পুলিশ ধরতে পারেনি।
এমনকি তার বিরুদ্ধে মামলাও করেনি পুলিশ। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, এই ফরিদুল ইসলাম আড়ালে থেকে হেরোইনের বড় বড় চালান আনছে। যদিও মাদক কারবারিদের সরকারি দপ্তরের তালিকায় তার নামটি আছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, শুধু এই ফরিদুল নয়, রাজশাহী, নাটোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ ও পাবনা জেলায় মাদক কারবারের অন্তত দুই শতাধিক হোতা রয়েছে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, এদের মধ্যে শুধু রাজশাহীর গোদাগাড়ীতেই রয়েছে ৭৭ জন পাইকারি হেরোইন ব্যবসায়ী। তারা প্রত্যেকেই কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলে যুক্ত আছে। তারা কেউ পেশায় রাজমিস্ত্রি, ঠিকাদার, গরুর খামারি, মাছচাষি, অটোরিকশা চালক, আমদানিকারক, সাংবাদিক, গরু ব্যবসায়ী, মুদি দোকানদার, ইটভাটার মালিক, ট্রাক মালিক, আমবাগানের মালিকসহ নানা পেশাজীবী। এসব পেশার আড়ালে মূলত মাদক ব্যবসা করছে তারা। তাদের বেশির ভাগই একসময় কেউ দিনমজুর, কেউ ডিম বিক্রেতা, কেউ দোকানের কর্মচারী, কেউ গাড়িচালক বা সুপাইরভাইজার ছিল। এদের বেশির ভাগকেই নিয়ন্ত্রণ করতেন তানোর-গোদাগাড়ীর সাবেক এমপি ওমর ফারুক চৌধুরী।
অভিযোগ রয়েছে, ওমর ফারুক চৌধুরীর মালিকানাধীন রাজশাহী নগরের নিউ মার্কেটে গড়ে তোলা বহুতল মার্কেট থিম ওমর প্লাজায় গোদাগাড়ীর অন্তত ২০ জন মাদক কারবারির দোকান ও ফ্ল্যাট রয়েছে। সাবেক এমপি ফারুক এসব মাদক কারাবারিদের আশ্রয় দিয়ে তাদের উচ্চমূল্যে দোকান বা ফ্ল্যাট কিনতে বাধ্য করেছিলেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকা অনুযায়ী, রাজশাহীতে অঞ্চলে মাদক কারবারের হোতা কমপক্ষে দুই শ ব্যক্তি।
তার মধ্যে শীর্ষ পাইকারি মাদক ব্যবসায়ী অর্ধশতাধিক ও শীর্ষ হোতা ৩০ জন। এরা মূলত রাজশাহী সীমান্ত দিয়ে মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণ করছে। মাঠপর্যায়ে রয়েছে আরো ১২০ মাদক কারবারি। দেশের অস্থিতিশীল পরিবেশে এই মাদক কারবারিরা এখন আরো বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠেছে বলে জানা গেছে। মাঝেমধ্যে অবশ্য রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে বহু ওজনের হেরোইন জব্দ করা হচ্ছে। আগে মাসে-ছয় মাসে বা বছরে দুই-এক দিন এমন খবর পাওয়া যেত। এখন হরহামেশায় এমন খবর পাওয়া যাচ্ছে। আফিমও আসছে রাজশাহীতে। সমপ্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে রাজশাহী মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিচালক মাসুদ হোসেন বলেছেন, ‘আফিম এখন মায়ানামারে বেশি চাষ হচ্ছে। বাংলাদেশের সঙ্গে মায়ানমারের বর্ডার আছে। তাই মাদক ঢুকছে সহজে।
অন্যদিকে পাইকারি মাদক কারবারিদের মধ্যে আছে রাজশাহীর গোদাগাড়ীর আচুয়াভাটের আরিফুল হক, লিপিস্টিকপাড়ার ইটভাটা মালিক তোফাজ্জল হোসেন, মাটিকাটার খামারি মেজবাউল, গড়ের মাঠের আমদানি-রপ্তানিকারক মাসুদ রানা বাবু, ব্যবসায়ী সেতাবুর রহমান বাবু, চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার আজমাতপুর মণ্ডলটোলার কচিবাবু, বারঘোরিয়ার ব্যবসায়ী রিফাত আলী, উজিপুরের কামাল, নাটোরের বড়গাছার ব্যবসায়ী তারেক, রেলস্টেশনের আয়াত আলী, নওগাঁর চাকরাইল দেওয়ানপাড়ার বেলাল হোসেন, পাবনার হাঁড়িবাড়ারের সামসুল প্রামাণিক প্রমুখ। এদের বিরুদ্ধে মাদবসংক্রান্ত এক থেকে একাধিক মামলা রয়েছে। কেউ আবার কারাগারে থেকেও মাদকের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছেন। ২০২৩ সালের ১৪ ডিসেম্বর চাঁপাইনবাবগঞ্জের চরবাগডাঙ্গা থেকে ১০ কেজি হেরোইন জব্দ করে র্যাব-৫, যার আনুমানিক মূল্য প্রায় ১০ কোটি টাকা। এটি রাজশাহী অঞ্চলে এক দিনে এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ মাদক উদ্ধারের ঘটনা। ওই ঘটনায় শরিফুল ইসলাম ধুলু মিয়া ও তার ছেলে মোমিনুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করা হয়। জামিনে বের হয়ে এসে ধুলু ও তার ছেলে ভারতীয় সীমান্ত দিয়ে হেরোইনের বড় বড় চালান আনছে। গত ২২ এপ্রিল রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে সাড়ে ছয় কেজি হেরোইনসহ তারেক হোসেনকে আটক করে জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। জব্দকৃত হেরোইনের আনুমানিক দাম সাড়ে ছয় কোটি টাকা। ডিমভাঙ্গা মাদারপুরের একসময়ের মুদি দোকানের কর্মচারী তারেকের কাছ থেকে তখন নগদ ১৩ লাখ টাকা জব্দও করা হয়। এই তারেক জেলখানায় বসে এখনো মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণ করছে বলে একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে।
২০২৩ সালের ১২ মার্চ রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে অভিযান চালিয়ে ছয় কেজি ৭০০ গ্রাম হেরোইনসহ শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী আশিককে গ্রেপ্তার করে র্যাব। জেল থেকে বের হয়ে সে এখনো মাদক কারবারে আবারও জড়িয়েছে বলে জানা গেছে।
একাধিক গোয়েন্দা সূত্র জানায়, এদের মধ্যে গোদাগাড়ীর আওয়ামী লীগ, বিএনপি এমনকি জামায়াতের কোনো কোনো নেতা সম্পৃক্ত রয়েছেন। আবার কেউ কেউ মাদকের টাকায় রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছে পরিণত হয়ে এখন জনপ্রতিনিধিও হয়েছেন। মাদকের আড়ালে কেউ গরুর খামার, কেউ ঠিকাদারি, কেউ মাছচাষি হিসেবে আয়কর দিয়েছে। তবে তাদের মূল ব্যবসা মাদক।
রাজশাহী রেঞ্জের উপ-মহাপুলিশ পরিদর্শক (ডিআইজি) মোহাম্মদ শাহজাহান কালের কণ্ঠকে বলেন, রাজশাহী বিভাগের মধ্যে রাজশাহীতে মাদক কারবারি বেশি। সীমান্ত এলাকা হওয়ায় এখানে মাদক ব্যবসা বেশি হয়। তবে আমাদের পুলিশ খুব সজাগ আছে। অনেককেই গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। অনেককে নজরদারিতে রাখা হয়েছে।