
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) দুই ভাগ করার উদ্যোগের বিরোধিতায় ক্রমেই কঠোর আন্দোলনের দিকে যাচ্ছেন কর্মকর্তারা। বেশ কিছুদিন ধরে এ নিয়ে আন্দোলন চলছে। এর মধ্যেই অংশীজনদের সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনা ছাড়াই খসড়া অনুমোদনের পর আজ সোমবার অধ্যাদেশের গেজেট জারি হতে পারে বলে জানা গেছে। গেজেট জারির গুঞ্জনে বৃহত্তর কর্মবিরতি ও গণ-ইস্তফার ইঙ্গিত দিয়েছেন আয়কর ও কাস্টমস ক্যাডারের কর্মকর্তারা।
এই দুই ক্যাডারের অন্তত ৫০ জন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছেন কালের কণ্ঠের প্রতিবেদক। তাঁরা বলেছেন, ‘বর্তমান বাস্তবতায় এটা ক্যাডার সার্ভিসের অস্তিত্বের প্রশ্ন। আমাদের সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনা ছাড়াই এই অধ্যাদেশের গেজেট জারি করা হলে প্রয়োজনে কর্মবিরতি ও গণ-ইস্তফার ঘোষণা আসতে পারে।’
এর আগে গোপনে ‘রাজস্বনীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশ’-এর খসড়া তৈরি করায় ক্ষোভ দেখিয়েছিলেন কর্মকর্তারা। অস্তিত্ব সংকট উপলব্ধি করে দুই সংগঠনের অ্যাসোসিয়েশন বিশেষ জরুরি সভার (ইজিএম) আয়োজন করেছে। সেখান থেকে অবিলম্বে এই খসড়া বাতিল ও এনবিআর বিলুপ্ত না করার দাবি জানানো হয়েছে। অংশীজন হিসেবে সংবাদ সম্মেলনে একই দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ ট্যাক্স লইয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন ও ঢাকা ট্যাক্সেস বার অ্যাসোসিয়েশন।
রাজস্ব আদায়ের বড় চ্যালেঞ্জ থাকলেও খসড়া অধ্যাদেশের অনুমোদনের পর থেকে রাজস্ব আদায় মুখ থুবড়ে পড়েছে। কাজে মনোযোগ নেই রাজস্ব আদায়কারী কর্মকর্তাদের। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআরের মাঠ পর্যায়ের কয়েকজন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘৫ আগস্টে দেশে পটপরিবর্তনের পরও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে বসে আছেন ফ্যাসিস্টের দোসররা। প্রতিবেশী দেশের প্রেসক্রিপশনে অর্ন্তবর্তী সরকারকে বেকায়দায় ফেলে দেশের রাজস্ব খাত ধ্বংসের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছেন তাঁরা, যার ফল এখন অনেকটা স্পষ্ট।’
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর থেকেই সমৃদ্ধ বাংলাদেশের রূপরেখা তৈরি করতে উদ্যোগ নেওয়া হয়। তবে অভিযোগ উঠেছে, দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি রাজস্বকে ধ্বংস করতে একজোট ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসররা। লুকোচুরির মাধ্যমে এনবিআর সংস্কারের নামে ধ্বংসের দিকে সংস্থাটি।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আহমেদ আযম খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘তড়িঘড়ি করে কোনো অঙ্গনের, দেশের বা সংস্থার প্রেসক্রিপশনে এনবিআর বিলুপ্ত করলে সেটি হিতে বিপরীত হবে। তড়িঘড়ি করে কাউকে কিছু না বলে এই সংস্কারে জাতি অন্ধকারে আছে ও ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। এই অধ্যাদেশ পাস করে বাস্তবায়ন করলে রাজস্ব আদায়ে বড় ধরনের ধস নামতে পারে।’
প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালের ৯ অক্টোবর এনবিআর সংস্কারে পাঁচ সদস্যের পরামর্শক কমিটি গঠন করেছিল সরকার। এই কমিটির সবাই এনবিআরের সাবেক কর্মকর্তা। সদস্যদের মধ্যে দুজন সাবেক চেয়ারম্যান। তাঁরা হলেন ড. মো. আবদুল মজিদ ও ড. নাসিরউদ্দিন আহমেদ। বাকি তিনজন সাবেক সদস্য। তাঁরা হলেন মো. দেলোয়ার হোসেন (আয়কর), ফরিদ উদ্দিন (কাস্টমস) ও আমিনুর রহমান (আয়কর)।
দেশে বিভিন্ন সংস্কার কমিটির প্রতিবেদন প্রকাশে কোনো গোপনীয়তা না থাকলেও এই কমিটির প্রতিবেদন প্রকাশে শুরু থেকেই ছিল গোপনীয়তা। অভিযোগ আছে, এই কমিটি সরকারের কাছে যে প্রতিবেদন জমা দিয়েছিল, খসড়া অধ্যাদেশে তার তেমন কিছুই রাখা হয়নি। এ বিষয়ে জানতে এই কমিটির দুজনের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে।
পরামর্শক কমিটির সদস্য ড. নাসিরউদ্দিন আহমেদ ও আমিনুর রহমান বলেছেন, আমরা যেভাবে অন্তর্বর্তী রিপোর্ট দিয়েছি সেভাবে আইনের খসড়া হয়নি। আমরা সরকারের কাছে যে সুপারিশ দিয়েছি সেখান থেকে সরকার কতটুকু নেবে, সে ব্যাপারে আমাদের কোনো হাত নেই।
জানতে চাইলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. তৌফিকুল ইসলাম খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এনবিআরের সংস্কার প্রয়োজন এতে কোনো সন্দেহ নেই। শ্বেতপত্রেও এ বিষয়ে সুপারিশ করা হয়েছিল। এনবিআর পরামর্শক কমিটি যে প্রস্তাব দিয়েছে তা খসড়া অধ্যাদেশে আসেনি। সর্বশেষ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে অধিকতর আলোচনা করে নেওয়া ভালো ছিল।’
এর আগে ২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এনবিআরের নীতি ও প্রশাসন বিভাগ আলাদা করতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংকের চাপ ছিল। ২০০৯ সালে সংসদে অনুমোদন দেওয়া হলেও এনবিআর সংস্কার হয়নি।