Image description
 

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ২০২৪-এর ১৯ জুলাই রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বসিলায় র‍্যাবের গুলিতে শহীদ হন মিরাজুল ইসলাম অর্ণব (২৩)। প্রথমে পায়ে ও পরে বুকে গুলি করে তাকে হত্যা করা হয়। মৃত্যুর আগ মুহূর্তে কাঁপা কাঁপা গলায় তার শেষ কথাগুলো ছিল-‘আল্লাহ তুমি আমাকে বাঁচাইয়া রাখো। আমি মরে গেলে আমার আব্বু-আম্মুকে কে দেখবে? আমি আমার আব্বু-আম্মুকে অনেক ভালোবাসি। হুজুর আমাকে কালেমা পড়ান, তওবা পড়ান। আমি পানি খাবে, পানি দাও।’ এর পরই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন অর্ণব।

অর্ণবের গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার সুরেশ্বর গ্রামে। তবে জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকাতেই। আবু তালেব ও সাহিদা বেগম দম্পতির তিন ছেলেমেয়ের মধ্যে অর্ণব সবার ছোট। বড় দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। অর্ণবকে বিয়ে করাবেন বলে পাত্রীও ঠিক করেছিলেন তারা। কিন্তু তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তাদের সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেছে।

পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, রাজধানীর দনিয়া কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে অভাবের সংসারের হাল ধরতে ফকিরাপুল ট্রাভেল এজেন্সিতে চাকরি নেন অর্ণব। জুলাই মাসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরুর পর সময় পেলেই বাসায় না জানিয়ে আন্দোলনে যোগ দিতেন।

অর্ণব মারা যাওয়ার পর থেকেই ছেলের শোকে বাবা আবু তালেব (৫৪) স্ট্রোক করে পড়ে আছেন বিছানায়। কোনোভাবেই ছেলের কথা ভুলতে পারছেন না তিনি। আমার দেশের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে অর্ণবের মা সাহিদা বেগম (৫২) বলেন, ‘১৯ জুলাই শুক্রবার বেলা ১১টার সময় আমি তাকে ভাত দেই। আমরা যে বাসায় থাকতাম, সেটা ছিল বসিলায় র‍্যাব-২ কার্যালয়ের সঙ্গেই। বাসার সামনে মূল সড়কে ওইদিন সকাল থেকেই ছাত্রদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংঘর্ষ চলছিল। এ সময় অর্ণব বাসাতেই ছিল।’

সাহিদা বেগম বলেন, আমার ছেলে কখনো কোনো মিছিল-মিটিংয়ে যেত না । ১৯ জুলাই জুমার নামাজের পর আমাদের বাসার তিনতলায় থাকা এক শিক্ষার্থীকে নিয়ে বাসায় এসে ভাত খায়। পরে ওই ছেলেকে নিয়ে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। আসরের নামাজ পড়তে কোথায় গেছে জানার জন্য ওকে ফোন দিই।

পরে বিকাল ৫টা ৪০-এ কথা হয় আবার। আমি তাকে বাসায় ফিরে আসতে বললে সে বলে, বাসার কাছেই আছি। ওইদিন বিকালে, একটা ছেলেকে গুলি করে মেরে ফেলার পর আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে। সেই আন্দোলনে অর্ণবও যোগ দেয়। মাগরিবের নামাজ পড়তে দাঁড়াব, এমন সময় অর্ণবের সঙ্গে থাকা ছেলেটি জানায়, অর্ণব গুলি খেয়েছে। আমি ভেবেছি হয়তো হাতে বা পায়ে গুলি লেগেছে, এতে কিছু হবে না।

কিন্তু পরে জানতে পারি, র‌্যাব প্রথমে গুলি করেছে পায়ে, এরপর বুকে। গুলি লাগার সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে পড়ে যায় অর্ণব। তার সঙ্গে থাকা ছেলেটি ওকে স্থানীয় একটি মসজিদে নিয়ে যায়। ওই মসজিদেই জুমার নামাজ পড়েছিল সে। মসজিদে নিয়ে যাওয়ার পর হুজুর অর্ণবকে কালেমা ও তওবা পড়ান।

এ সময় অর্ণবের বুক ও পিঠ দিয়ে রক্ত বের হচ্ছিল। এতে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকলে, তাকে ভ্যানে করে প্রথমে দুটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করাতে না পেরে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে সন্ধ্যা ৬টা ৪০ মিনিটের দিকে মারা যান অর্ণব। এরপর লাশ নিয়ে রায়েরবাজার বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে পরদিন দাফন করা হয় তাকে।

সাহিদা বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে আরো বলেন, আমার সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিল অর্ণব। এখন কে দেখবে আমাদের সংসার? আমি আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই। অর্ণবের অসুস্থ বাবা আবু তালেব বলেন, ছেলের জন্য ইতালি থেকে দেশে ফিরে এসেছিলাম ওকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি ব্যবসা করব বলে। তবে ছেলের ইচ্ছা ছিল সে ঢাকায় থাকবে। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে আমি নিঃস্ব হয়ে গেছি। অর্থ সংকটে ডাক্তারও দেখাতে পারছি না। সরকারের কাছে আর্থিক সহযোগিতা চেয়েছেন তিনি।

ছেলেকে হত্যার ঘটনায় মামলা করেছেন কি নাÑ জানতে চাইলে অর্ণবের বাবা-মা বলেন, কে গুলি করেছে, তাতো দেখেননি তারা। তাই অজ্ঞাতনামা আসামি দিয়ে মামলা করেছেন। অর্ণব হত্যার সঠিক তদন্ত করে দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন তারা।