ড. এম সাখাওয়াত হোসেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও সাবেক সামরিক কর্মকর্তা। বর্তমানে নির্বাচন বিশ্লেষক হিসেবে কাজ করছেন। নিয়োজিত রয়েছেন নর্থ সাউথ বিশ^বিদ্যালয়ের এসআইপিজির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো হিসেবে। দেশের স্থানীয় সরকার নির্বাচন, নির্বাচনকালীন সহিংসতা, নির্বাচন কমিশন আইনসহ প্রাসঙ্গিক বিষয়াবলি নিয়ে তিনি কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দেশ রূপান্তর সম্পাদকীয় বিভাগের এহ্সান মাহমুদ
দেশ রূপান্তর: দেশে স্থানীয় সরকারের ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন চলছে। ইতিমধ্যে এই নির্বাচনে সহিংসতার ঘটনায় অন্তত ৩০ জনের বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। এই নির্বাচন হচ্ছে দলীয় প্রতীকে। এবার নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে মূলত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। বিএনপি বা অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলো অংশ না নিলেও আওয়ামী লীগকে নির্বাচনের মাঠে লড়াই করতে হয়েছে নিজেদের প্রতীক বরাদ্দ না পাওয়া দলীয় বিদ্রোহী প্রার্থীদের সঙ্গে। তবুও সহিংস ঘটনা কেন কমছে না বলে মনে করেন?
ড. এম সাখাওয়াত হোসেন: এর প্রধান কারণ হচ্ছেমনোনয়ন বাণিজ্য। ইউনিয়ন পর্যায়ে এই মনোনয়ন সাধারণত স্থানীয় সংসদ সদস্যের সুপারিশে হয়ে থাকে। অনেক জায়গায় দেখা যায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় বড় বড় নেতার সমর্থক ও অনুসারীরাও পেয়ে থাকেন। এতে করে যারা দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন তাদের থেকেও যারা নিজেদের আরও যোগ্য মনে করেছিলেন, তারা চ্যালেঞ্জ করেছেন। এর ফলেই এই মারামারির ঘটনা ঘটেছে। প্রাণহানি হয়েছে। একজন সংসদ সদস্য প্রকাশ্যে স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে প্রচারণা চালাতে পারেন না। কিন্তু এখানে দেখা গেল দলীয় প্রতীক যেহেতু পাওয়া গেছে, তার অর্থ হচ্ছে সংসদ সদস্য নিজে না পারলেও তার অনুসারীরা ঠিকই সক্রিয় থাকে। এসব কারণে নির্বাচন ঠিক নির্বাচনের মতো হয়নি। এটা গেল একটা দিক।
এ ছাড়া, দলই (আওয়ামী লীগ) তৃণমূলকে বিভক্ত করেছে। কারণ, একজনকে যখন দলীয় প্রতীক দেওয়া হয়, তখন সেখানে বিভক্তি তৈরি হয়। এই নির্বাচন একেবারেই ঘরের নির্বাচন। এখানে যাকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়নি, তার পাশে দাঁড়িয়েছে যেসব রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ নেয়নি তারা। এমন কিছু জায়গা আছে, যেখানে দলীয় প্রতীকের প্রার্থীদের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে। কোথাও আবার দলীয় মনোনীতরা পূর্ণ পরিষদসহ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হয়েছেন। এটা কোনো নির্বাচন হতে পারে না। আরেকটি কারণ হলো ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা। নির্বাচন আয়োজনে নির্বাচন কমিশন অব্যবস্থাপনার পরিচয় দিয়েছে। যারা ক্ষমতাসীন সরকারি দলের প্রতীক বরাদ্দ পেয়েছেন তারা নিজেদের সরকারি লোক ভেবেছেন। নির্বাচন কমিশনও তাদের সরকারি দলের ভেবেছে। আবার আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীও দলীয় প্রতীক যারা পেয়েছে তাদের বৈধ-অবৈধ সুবিধা দিয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে নানা রকম হস্তক্ষেপ। ভোটকেন্দ্রে যাওয়া থেকে শুরু করে ভোটপ্রদানেও নানা রকম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়েছে। স্থানীয় ছাত্রলীগ থেকে শুরু করে অন্যান্য সংগঠন দলীয় প্রতীকের প্রার্থীকে জেতাতে দলাদলি করেছে। এতেও প্রাণহানি হয়েছে।
দেশ রূপান্তর: কিন্তু এবার আমরা দেখলাম যে, নির্বাচন কমিশন বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে ‘বিব্রত’ হওয়ার কথা বলছে। কমিশন আসলে বিব্রত হতে পারে কিনা? কিংবা কোন পরিপ্রেক্ষিতে এমন অবস্থা তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন?
ড. এম সাখাওয়াত হোসেন: এসব কথা বলে নির্বাচন কমিশন আসলে কমিশনকেই হেয় করছে। কমিশনকেই সামর্থ্যহীন হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। নির্বাচন চলাকালীন কোনো অভিযোগের তারা সামাধান করতে পারেনি। এমন কথা বলার আগে তাদের উচিত ছিল কমিশন থেকে সরে দাঁড়ানো। তারা যখন বলছে, ‘আমরা বিব্রত’এই কথার মানে হচ্ছে, তাদের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল কিন্তু তারা সেটি প্রয়োগ করতে পারেনি। ক্ষমতা প্রয়োগ করে দায়িত্ব পালন করার সৎ-সাহস তাদের ছিল না। যেহেতু তারা কেন ‘বিব্রত’ তার কোনো ব্যাখ্যা আমাদের সামনে পরিষ্কার করেনি, তার মানে আমরা এটাই ধরে নিতে পারি যে, এই কমিশন ব্যর্থ।
দেশ রূপান্তর: নির্বাচন কমিশনের হাতে নির্বাচনকালীন যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে তা কি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে যথেষ্ট?
ড. এম সাখাওয়াত হোসেন: আইনের কোনো ঘাটতি নেই। আইনে যথেষ্ট ক্ষমতা দেওয়া আছে। আইনের তো কোনো শেষ নেই। এখন যদি নির্বাচন কমিশনকে ফাঁসির আদেশের ক্ষমতা দেওয়া হয়, তাহলেও তো কোনো ফল বয়ে আনবে না। যদি না কমিশন তা প্রয়োগ করে। নির্বাচন কমিশন কোনো পদক্ষেপই গ্রহণ করেনি নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও সহিংসতা মুক্ত করতে। তারা কোনো পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি, কোনো প্রার্থীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতেও দেখা যায়নি।
দেশ রূপান্তর: বর্তমান কমিশনের মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী ফেব্রুয়ারিতে। এরপর নতুন কমিশন গঠন করা হবে। এখনকার কমিশন যেভাবে সমালোচিত হচ্ছে, তার বিবেচনায় ভবিষ্যৎ কমিশন কীভাবে গঠিত হওয়া উচিত বলে মনে করেন?
ড. এম সাখাওয়াত হোসেন: নির্বাচন কমিশন গঠন করা নিয়ে খুব বেশি চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। তবে আশঙ্কা হচ্ছেযেভাবেই কমিশন গঠন করা হোক না কেন সেই কমিশনের জন্য নিরপেক্ষভাবে কাজ করা কঠিন হবে। বর্তমান কমিশনের সময়ে নির্বাচন ব্যবস্থা এবং প্রতিষ্ঠানটিকে যেভাবে ধ্বংস করা হয়েছে তাতে করে নতুন আরেকটি কমিশনের প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনতে পরীক্ষা দিতে হবে। একটি প্রতিষ্ঠান যখন ভেঙে দেওয়া হয়, তখন সেটি আবার নতুন করে দাঁড় করানো বেশ কষ্টসাধ্য। এর জন্য কঠিন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। মানুষের আস্থা একবার ভেঙে গেলে তা ফিরিয়ে আনা সহজ নয়।
দেশ রূপান্তর: কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছরেও দেশে একটি স্বাধীন নির্বাচন কমিশন আইন তৈরি করা গেল না। আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে এই আইন হওয়া নিয়েও অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। আইনমন্ত্রী বলেছেন, এখন আইন করার জন্য প্রয়োজনীয় সময় পাওয়া যাবে না, তাই এইবারও সার্চ কমিটির মাধ্যমে কমিশন গঠন করা হবে। বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
ড. এম সাখাওয়াত হোসেন: আইনমন্ত্রী বিজ্ঞ আইনবিদ। তিনি এমন মন্তব্য করেছেন এটা বিস্ময়কর। তবে আমি আমার যে অভিজ্ঞতা ও ক্ষুদ্র জ্ঞান তা থেকে বলতে পারি এখনো যে সময় আছে, সেই সময়ে চাইলে আইন করা সম্ভব। বর্তমান সরকার দায়িত্বশীল হলে এখনই নির্বাচন কমিশন আইন করা সম্ভব। বাংলাদেশে আইন প্রস্তুত করতে খুব বেশি সময় লাগে না। অবশ্য এখন সরকারের ভিন্ন চিন্তাও থাকতে পারে।
দেশ রূপান্তর: নির্বাচন কমিশনের প্রতি মানুষের অনাস্থা, মনোনয়ন বাণিজ্য, ভোটপ্রয়োগ করতে না পারাসহ নির্বাচনী ব্যবস্থাটা ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ভোটের অধিকার নিশ্চিত করতে, নির্বাচনী ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা আস্থা ফিরিয়ে আনতে কী করণীয়?
ড. এম সাখাওয়াত হোসেন: এখানে সরকারকেই দায়িত্ব নিতে হবে। সরকার যদি চায় যে নির্বাচন নিয়ে দেশে-বিদেশে সমালোচনার মুখে পড়বে না, তাহলে সেভাবেই কাজ করবে। কারণ, নির্বাচন নিয়ে পৃথিবীর কোনো দেশেই কমিশনকে জবাবদিহি করতে হয় না। বিদেশে প্রশ্নের মুখে পড়তে হয় সরকারকে, সরকারের মন্ত্রীদের। নির্বাচন কমিশনকে বিদেশের কারও মুখোমুখি হতে হয় না। যেমন এইবার ইউরোপীয় ইউনিয়ন বলছে, তারা এখন থেকেই নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করছে। তাই সরকারেরই উচিত নির্বাচন ব্যবস্থাকে প্রশ্নহীন করে তোলা। সরকারের দায়িত্বশীল আচরণই নির্বাচন ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে পারে। আবার বিরোধী দলসমূহকেও নির্বাচনে অংশ নিতে হবে। যেকোনো রাজনৈতিক দলের নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়ে আগ্রহ দেখাতে হবে। সে লক্ষ্যে কর্মসূচি থাকতে হবে। ২০১৪-তে বিএনপি যেভাবে নির্বাচন বর্জন করেছে সেটি আমার বিবেচনায় ঠিক হয়নি। সেটি ছিল হঠকারী সিদ্ধান্ত। ২০১৪-এর নির্বাচনে অংশ নিলে বিএনপির আজকের অবস্থানে থাকতে হতো না।
দেশ রূপান্তর: কিন্তু বিএনপি বলছে, তারা নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবি তুলেছিল। সেই দাবি পূরণ না হওয়ায় তারা নির্বাচনে অংশ নেওয়া থেকে বিরত থেকেছে। এখন দলটি বলছে, দলীয় সরকারের অধীনে যে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়, সেটি এখন প্রমাণিত। এটিকে কীভাবে দেখছেন?
ড. এম সাখাওয়াত হোসেন: ২০১৪-এর নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নেওয়ায় নির্বাচনের মাঠ খালি ছিল। সেই সময়ে খালি মাঠে ১৫০ জনের মতো সদস্য বিনা ভোটে সংসদে গিয়েছিল। বিএনপি নির্বাচনে থাকলে এই সুযোগটা তৈরি হতো না। ধরে নিই, বিএনপি যদি সেই সময়ে নির্বাচনে যেত, তবে তারা যদি ৮০-৯০টি আসনে জয়ী হতো, তবে পরের নির্বাচনে যে রাতের ভোটের ঘটনা ঘটল তা এড়ানো যেত। কারণ, যারা বিনাভোটে একবার জয়ী হয়েছিল তারা এখন চাইছে, যেকোনো উপায়ে নির্বাচনে আবারও জয়ী হতে। সেজন্য তারা শুরু করে মনোনয়ন বাণিজ্য দিয়ে। সেটা পরে ভোট কারচুপি, হুমকিধমকি, ভোটের আগে ভোট, দলীয় প্রভাব, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবহার থেকে শুরু করে নানারকম পদ্ধতি তারা বেছে নেয়। বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে আছেন। এখন তার অসুস্থতার চিকিৎসা নিয়েও বিএনপিকে মাঠে নামতে হচ্ছে। বিএনপির আরেক শীর্ষ নেতা দেশের বাইরে। বিশে^র অনেক দেশে নজির আছে নেতা কারাগারে বা দেশের বাইরে থাকার পরেও নির্বাচনে জয়ী হয়েছে তার দল। বিএনপির রাজনীতি ভুল সিদ্ধান্তে চলছিল।
দেশ রূপান্তর: এখন নির্বাচন এবং নির্বাচন কমিশন নিয়ে যে অবস্থা বিরাজ করছে, সেখানে নির্বাচনে জনসাধারণকে আগ্রহী করতে রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতা কতটা জরুরি বলে মনে করেন? যেখানে রাজনীতি রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে সরে যাচ্ছে বলে আলোচনা রয়েছে?
ড. এম সাখাওয়াত হোসেন: এখন নির্বাচন হচ্ছে টাকার ছড়াছড়ি। টাকা দিয়ে মনোনয়ন বাণিজ্য থেকে সেই প্রক্রিয়া শুরু হয়। এখন অনেক ব্যবসায়ী আছেন, যাদের মনে হয়, অনেক টাকা আছে এখন একবার সংসদে যাওয়া যায়। সেই চিন্তা থেকে তারা রাজনৈতিক দলে নাম লেখায়। তাই রাজনীতিতে এক ধরনের ব্যবসায়ীর আধিক্য বেড়ে যাচ্ছে। পুরো অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য রাজনৈতিক দলসমূহকে অবশ্যই একটি নির্দিষ্ট সমঝোতায় আসতে হবে।
দেশ রূপান্তর: আপনার পরামর্শ কী?
ড. এম সাখাওয়াত হোসেন: এখন খালি চোখে দেখলে মনে হবে দেশ অনেক এগিয়েছে। অর্থনীতিতে ভালো করছে। অবকাঠামো উন্নয়ন হচ্ছে। এসব হয়েছে সত্যি। কিন্তু এভাবে প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে দিয়ে খুব বেশি দূর যাওয়া যাবে না। শক্ত অবস্থানে দাঁড়ানো যাবে না। এভাবে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো দুর্বল করে টিকে থাকা যাবে না। এতে ভবিষ্যৎ নিরাপদ হবে না। এখন যেভাবে চলছে, সেভাবে হয়তো আরও ৫ বছর, ১০, ১৫ বছর চলবে। তারপরে কী হবে? একসময় ভেঙে পড়বে। ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে এখনই কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে দুর্বল পিলারের ওপরে ভবিষ্যতের গণতন্ত্র দাঁড়াতে পারবে না।
দেশরূপান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন