সম্প্রতি প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রোজিনা ইসলাম তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে গেলে সেখানকার কর্মকর্তারা তাঁকে প্রায় ছয় ঘণ্টা আটকে রাখেন। এরপর তঁার বিরুদ্ধে শত বছরের পুরোনো অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টে মামলা করে কারাগারে পাঠানো হয়। কোনো সাংবাদিকের বিরুদ্ধে এই আইনে মামলা দায়ের এবং সচিবালয়ে আটকে রেখে নিগ্রহ করা নজিরবিহীন ঘটনা। এ নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন নিউজ টুডের সম্পাদক ও জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ।সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রিয়াদুল করিম
প্রথম আলো: আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা নিয়ে সাংবাদিকদের উদ্বেগ ছিল। সাংবাদিকদের প্রতিবাদের মুখে তা বাতিল করা হলেও কঠোরভাবে এল ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। এই আইনের নানা অপপ্রয়োগ আমরা দেখছি। এবার দেখলাম সাংবাদিকের বিরুদ্ধে অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের মামলা। বিষয়টি আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ: প্রথম আলোর সিনিয়র সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে নির্যাতন ও চাপ এবং তাঁর বিরুদ্ধে মামলা সাংবাদিকতাকে নতুনভাবে চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়েছে। যদিও এ ধরনের চাপের মধ্যেই সব সময় সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। সাংবাদিকতা কুসুমাস্তীর্ণ কোনো পেশা নয়, বরং কণ্টকাকীর্ণ। আইয়ুব খানের প্রিন্টিং প্রেসেস অ্যান্ড পাবলিকেশনস অর্ডিন্যান্স, বিশেষ ক্ষমতা আইন এবং এখনকার ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট—সব কটিতে একই ধারায় সাংবাদিকতার স্বাধীনতাবিরোধী বিধান প্রণয়ন করা হয়েছে। এসব করা হয়েছে স্বাধীন সাংবাদিকতার পথ রুদ্ধ করার জন্য। নানা কালাকানুন সাংবাদিকতার পথ রুদ্ধ করছে। সাংবাদিকেরা কালাকানুনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন। এই পেশা যত দিন থাকবে, কালাকানুন পিছু ছাড়বে না।
কিন্তু এবার যা হলো, তা সভ্য গণতান্ত্রিক দেশে বিরল। অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের ব্যবহার সম্ভবত বাংলাদেশে এই প্রথম। এই আইন সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হলো। সম্প্রতি এই আইন ব্যবহার করা হয়েছে মিয়ানমারে, রয়টার্সের দুজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে। এই আইনে দুজন সাংবাদিককে সাত বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। আইনটি ব্রিটিশ ভারতে প্রণীত হয়েছিল ১৯২৩ সালে। আইনটি করার উদ্দেশ্য ছিল সত্য গোপন করে দুর্নীতি করা, স্বাধীনতা আন্দোলনকে দমিয়ে রাখা।
১৯২৩ সালে প্রণয়ন করা এই আইনের ৩ উপধারায় রোজিনার বিরুদ্ধে চুরির অপবাদ আনা হয়েছে। তিনি নাকি তথ্য চুরি করেছেন! সত্য উদ্ঘাটন যদি তথ্য চুরি হয়, তাহলে সাহসী সাংবাদিকতা কোনটি? চুরি বা গুপ্তচরবৃত্তির অপবাদ নিন্দনীয়। সাংবাদিকতা পেশাকে যা কলঙ্কিত করে।
প্রথম আলো: আমরা দেখলাম, রোজিনা ইসলামকে প্রায় ছয় ঘণ্টা আটকে রেখে সচিবালয়ের মতো একটি জায়গায় মানসিক ও দৈহিক নিগৃহীত করা হলো। প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দুতে এ রকম কোনো ঘটনা কি আগে দেখেছেন? সাংবাদিক নেতাদের অনেকেই বলছেন, এটি অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার কণ্ঠরোধের চেষ্টা।
রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ: যাঁরা এই মন্তব্য করেছেন, তাঁরা সঠিক। যা ঘটেছে, সেটি একটি বিরল ঘটনা। আমি কর্মী হিসেবে ১৯৭২ সাল থেকে এ পর্যন্ত সাংবাদিকতার স্বাধীনতার জন্য যতটুকু সম্ভব কাজ করে এসেছি। কিন্তু এই আইনের ব্যবহার কোথাও দেখিনি। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারায় (সরকারি গোপনীয়তা ভঙ্গের অপরাধ ও দণ্ড) যখন অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টটি যুক্ত করা হয়, আমরা তার প্রতিবাদ করেছিলাম। আইনমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে এর বিরোধিতা করেছিলাম। আইনমন্ত্রী বলেছিলেন, তথ্য অধিকার আইন হয়েছে। অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট সে আইনের পরিপন্থী। তথ্য অধিকার আইন বলবৎ থাকলে অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট কার্যকর হবে না। অথচ আমরা এই আইনের নির্লজ্জ ব্যবহার দেখলাম। শুধু তা-ই নয়, এই আইনের ছত্রচ্ছায়ায় সচিবালয়ের ভেতরে আমলাদের একটি অংশ রোজিনার ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করেছে। তাঁকে মিথ্যা বলার জন্য চাপ দিয়েছে। খুশির কথা হলো, দেশের সাংবাদিকেরা রুখে দাঁড়িয়েছেন।
প্রথম আলো: স্বাধীন সাংবাদিকতার পথে এখন কী কী বাধা আছে বলে আপনি মনে করেন?
রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ: প্রথমত, সাংবাদিকতার পথে বড় বাধা স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক পরিবেশের অভাব। আমাদের দেশে ‘সেলফ-সেন্সরশিপ’ কথাটা চালু আছে। আমাদের দেশে কেউ সাহস করে সত্য বলতে চাইছে না, পারছে না। এটাই সবচেয়ে বড় বাধা। দ্বিতীয়ত, আমাদের সাংবাদিকতা পেশায় সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠানটিকে নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। জায়গাটি এমন সব মানুষের দখলে চলে গেছে, যাঁরা সাংবাদিক নন। যাঁর টাকা আছে, তিনিই সম্পাদক হতে পারবেন। অভিজ্ঞতার কোনো প্রয়োজন নেই। অনভিজ্ঞ, অসাংবাদিক বা ব্যবসায়ী সম্পাদক হলে তাঁর অধীনে স্বাধীন সাংবাদিকতা হতে পারে না। তৃতীয়ত, বিভিন্ন কালাকানুন, যার কতগুলো নতুন করে সামনে এসেছে। এর বাইরে আছে রাজনৈতিক চাপ। প্রেশার গ্রুপের চাপ আইনি বাধার চেয়েও বড়। রাজনৈতিক প্রেশার গ্রুপ, কালোবাজারি প্রেশার গ্রুপ, ব্যবসায়ীদের প্রেশার গ্রুপ—এ রকম নানা গোষ্ঠী কখনো টাকা বা কখনো পেশিশক্তি দিয়ে স্বাধীন সাংবাদিকতাকে বাধাগ্রস্ত করে। বিভিন্ন সময়ে আমাদের অনেক সাংবাদিক প্রাণ দিয়েছেন। নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনের পর বহু কালাকানুন মুক্ত করা হয়েছিল। সেগুলো নানাভাবে আবার ফিরে আসছে। আইয়ুব খানের প্রিন্টিং প্রেসেস অ্যাক্টে সাংবাদিকদের কলম এবং পত্রিকা বন্ধ করার জন্য যেসব ধারা ছিল, পরে সেগুলো বিশেষ ক্ষমতা আইনের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। এখন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বিষয়গুলো ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। এগুলো স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য প্রচণ্ড বাধা।
প্রথম আলো: স্বাধীনতার পর থেকেই আপনি সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত। তখন থেকে এ পর্যন্ত গণমাধ্যম সে অর্থে কখন স্বাধীনতাটা পেয়েছে? এখনকার পরিস্থিতি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ: স্বাধীনতা আদায় করে নিয়ে আমরা স্বাধীন সাংবাদিকতা করেছি। সাংবাদিকতার ইতিহাসে ১৯৭১ সালের ১ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত সাংবাদিকেরা যে স্বাধীনতা ভোগ করেছেন, পৃথিবীর ইতিহাসে তা বিরল। জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে আন্দোলনের মাধ্যমে আমরা স্বাধীন সাংবাদিকতা করেছি। বিভিন্ন সময়েই সাংবাদিকদের ওপর বাধা এসেছে। ১৪ বছর কারাদণ্ড, সামরিক শাসন, স্বৈরাচারী আচরণসহ বিভিন্ন সময়ে নানাভাবে সাংবাদিকতাকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা হয়েছে। ঐক্যবদ্ধভাবে তা প্রতিহত করে সাংবাদিকতা করেছি। সাংবাদিকতার পথ কখনোই মসৃণ ছিল না। আন্দোলনের মাধ্যমে সাংবাদিকেরা অধিকার আদায় করে স্বাধীন সাংবাদিকতা করেছেন। আমরা স্বাধীন সাংবাদিকতা করেছি, করে যাব।
প্রথম আলো: এখনকার যে পরিবেশ, এটা কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ: রোজিনা ইসলামের এ ঘটনাই উন্মোচন করে দিয়েছে, স্বাধীন সাংবাদিকতার পরিবেশ এখন বাংলাদেশে নেই। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না, স্বাধীন সাংবাদিকতার পথ বাংলাদেশে রুদ্ধ।
প্রথম আলো: স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিগ্রহের অভিযোগ আছে। আবার এ ঘটনা তদন্তও করছেন ওই মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ: যাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ তুললেন, অভিযুক্ত যদি বিচারক হয়, তাহলে কোনো দিনই বিচার পাওয়া যাবে না। এটা চিরন্তন সত্য। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি কোনো দিনই স্বাধীন, নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি হতে পারে না। তারা নিজেদের লোকদের নিজেরা প্রটেক্ট করবে। বিষয়টি চাপা পড়ে যাবে।
প্রথম আলো: রাজনৈতিক চাপের কথা আপনি বললেন। আমরা সব সময় দেখি, যখন কোনো রাজনৈতিক দল ক্ষমতার বাইরে থাকে বা বিরোধী দলে থাকে, তখন তারা সাংবাদিকতার স্বাধীনতা নিয়ে সোচ্চার হয়। আবার যখনই তারা ক্ষমতায় যায়, তখন একটি বিপরীত চরিত্র দেখা যায়। এটার কারণ কী?
রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ: এর কারণ হলো, যাঁরা ক্ষমতায় থাকেন, তাঁরা মনে করেন, কাচের ঘরে বসবাস করেন। সব সময় ভীতসন্ত্রস্ত থাকেন, কী হচ্ছে সবাই দেখে ফেলছে। এই যে আমলা যারা আছে, রোজিনার ঘটনায় যেটা প্রকাশিত হলো, তারা সত্য ধামাচাপা দিতে চায়, দুর্নীতি ধামাচাপা দিতে চায়, অপকর্ম ধামাচাপা দিতে চায়। এগুলোকে বের করে আনার জন্যই স্বাধীন সাংবাদিকতা প্রয়োজন। এই মুহূর্তে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট, অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট—এগুলোর বিরুদ্ধে আন্দোলন করা উচিত। রোজিনাকে মুক্ত করেছি, এটা আমাদের আশু কর্তব্য ছিল। কিন্তু সুদূরপ্রসারী পথনকশা হবে এসব কালাকানুন বাতিল করার জন্য আন্দোলন করা। আন্দোলন করলে স্বাধীন সাংবাদিকতার পথ উন্মুক্ত হবে।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ: আপনাকেও ধন্যবাদ।
প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন