আজ ৩ মে। বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস। দিবসটিকে কেন্দ্র করে কালের কণ্ঠ’র সঙ্গে একান্তে কথা বলেছেন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহ্মুদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক বাহরাম খান
কালের কণ্ঠ : কতটা মুক্তভাবে কাজ করতে পারছে বাংলাদেশের গণমাধ্যম?
হাছান মাহ্মুদ : বাংলাদেশের গণমাধ্যম অত্যন্ত মুক্ত-স্বাধীনভাবে কাজ করছে। অনেক পশ্চিমা দেশের গণমাধ্যমও এত স্বাধীনতা পায় না। পশ্চিমা দেশেও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা আছে, তবে তারা দায়িত্বশীলতার সঙ্গে কাজ করে। সেখানে গণমাধ্যম ভুল করলে কঠোর শাস্তি পেতে হয়। আপনাদের মনে আছে শত বছরেরও বেশি পুরনো সংবাদ প্রতিষ্ঠান নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড একটি ভুল সংবাদ পরিবেশন করায় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বিবিসিতে একজন আইনপ্রণেতার বিরুদ্ধে অসত্য তথ্য পরিবেশন করার কারণে সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকদের চাকরি চলে গেছে। অনেক উন্নত দেশে এসব কারণে সংবাদমাধ্যমকে মোটা অঙ্কের জরিমানা করা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে সেটা দিতে হয় না।
কালের কণ্ঠ : বৈশ্বিক গণমাধ্যম মূল্যায়নের প্রতিবেদনগুলোতে দেখা যায়, গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের গণমাধ্যমে স্বাধীনতা কমছে...
হাছান মাহ্মুদ : বৈশ্বিক গণমাধ্যম মূল্যায়নের দায়িত্ব তাদের কে দিয়েছে? এগুলো তো সব এনজিও। এরা জাতিসংঘের কোনো সংস্থা নয়। এই এনজিওগুলো যাদের কাছ থেকে সাহায্য-সহযোগিতা পায় তাদের পক্ষেই মত দেয়। দেখবেন এসব সংগঠন যেসব দেশ থেকে পরিচালিত হয় সেসব দেশের অবস্থা ভালো হয়। এটা শুধু গণমাধ্যম মূল্যায়নের ক্ষেত্রে নয়, অন্যান্য জরিপের ক্ষেত্রেও তাই হয়।
কালের কণ্ঠ : এদের কেউ কি আপনাদের কাছে কোনো সহযোগিতা চেয়েছিল?
হাছান মাহ্মুদ : এরা নির্দিষ্ট কিছু সোর্স থেকে তথ্য-উপাত্ত নেয়। তারা যেভাবে তথ্য সংগ্রহ করে ও ফল প্রকাশ করে, এগুলোর সঙ্গে আমরা একমত নই। তাই তাদের ফলাফল আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।
কালের কণ্ঠ : সমালোচনা শুধু আন্তর্জাতিকভাবে নয়, দেশীয় বিভিন্ন মাধ্যমেও হচ্ছে। বিশেষ করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি নিয়ে।
হাছান মাহ্মুদ : ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সাংবাদিক, লেখক, শ্রমিক, গৃহিণী, সরকারি চাকুরে, রাজনীতিক সবার জন্য। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো আইন ভারত, পাকিস্তান, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুরসহ অনেক জায়গায় হয়েছে, হচ্ছে।
কালের কণ্ঠ : ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ক্ষমতা অনুযায়ী পুলিশের একজন এসআই তাঁর সন্দেহ হলে যেকোনো জায়গায় তল্লাশি ও জব্দের মতো পদক্ষেপ নিতে পারবেন। এটা কি বিচারিক ক্ষমতা হয়ে যায় না?
হাছান মাহ্মুদ : আইনমন্ত্রী এসব বিষয়ে একাধিকবার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। ব্রিটিশ আমল থেকে অনেক আইনে এ ধরনের ক্ষমতা ছিল। সেখান থেকেই এসব বিষয় এসেছে।
কালের কণ্ঠ : ব্রিটিশ আমলের সেই মান্ধাতার আইন কেন আমরা এখনো গ্রহণ করব?
হাছান মাহ্মুদ : আপনাকে প্রশ্ন করি, অনলাইনে যদি আপনি হয়রানির শিকার হন তাহলে কোন আইনে প্রতিকার চাইবেন? আপনারা হয়তো জেনে থাকবেন অনেক সাংবাদিকও আত্মরক্ষার জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আশ্রয় নিয়ে মামলা করেছেন। আমাদের দেশে কিছু মানুষ আছে তারা এটা নিয়ে হৈচৈ করে। তারা হয়তো চায় অবাধে অলাইনে চরিত্র হনন হোক, পদ্মা সেতুতে মাথা লাগার গুজব রটুক, গুজবে মানুষের মৃত্যু হোক এবং বিচার না হোক। যারা এটা চায় তারাই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে সমালোচনা করে।
কালের কণ্ঠ : সাংবাদিকতা একটা বিশেষ পেশা। এই পেশায় চিন্তার স্বাধীনতা দরকার। আমাদের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে সেটা বলাও হয়েছে। আপনি তথ্যমন্ত্রী হিসেবে এই বিষয়গুলো বিবেচনায় নেবেন না?
হাছান মাহ্মুদ : উন্নত দেশ সম্পর্কে আমার ধারণা আছে, আমি সেখানে পড়াশোনাও করে এসেছি। বাংলাদেশের সাংবাদিকরা চিন্তা ও লেখার ক্ষেত্রে যে স্বাধীনতা ভোগ করে তা অনেক উন্নত দেশেও ভোগ করে না।
কালের কণ্ঠ : উন্নত দেশে ভুল সংবাদ ছাপা বা প্রচার করা হলে জরিমানা হয়। বাংলাদেশে কেন হয় না?
হাছান মাহ্মুদ: এ জন্য আমাদের দেশে আইনের আরো পরিবর্তন লাগবে। প্রেস কাউন্সিল আইন আরো যুগোপযোগী করার প্রক্রিয়া চলছে।
কালের কণ্ঠ : বিদ্যমান আইনের চেয়ে বিশেষ পার্থক্য কী থাকছে?
হাছান মাহ্মুদ : প্রেস কাউন্সিল বর্তমানে ভুল সংবাদের জন্য কোনো জরিমানা করতে পারে না। প্রস্তাবিত আইনটি পাস হলে কেউ যদি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ভুল নিউজ করে তাহলে প্রেস কাউন্সিল ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করতে পারবে।
কালের কণ্ঠ : টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর অনুমোদন ও পরিচালনায় কোনো আইন নেই। অন্যদিকে অনলাইন গণমাধ্যমের নিবন্ধন দিচ্ছেন একটি নীতিমালার অধীনে। আইন করলে সমস্যা কোথায়?
হাছান মাহ্মুদ : সম্প্রচার আইন করার প্রক্রিয়া চলছে। আইনটি হলে সম্প্রচার কমিশন গঠন করা হবে। এগুলো পর্যায়ক্রমে হচ্ছে। জননেত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে দেশে বেসরকারি টেলিভিশনের যাত্রা শুরু হয়েছিল, পত্রিকা বেড়েছে কয়েক গুণ। কিন্তু এসব বিষয় নিয়ে পরবর্তী সময়ে আর কেউ কাজ করেনি। আমরাই কাজ করছি।
কালের কণ্ঠ : এই সরকারের আমলে গণমাধ্যমের সংখ্যাগত প্রসার ঘটেছে ঠিক, কিন্তু যেভাবে অনলাইন গণমাধ্যমের নিবন্ধন দিচ্ছেন তাতে পেশাদারত্ব থাকবে কিভাবে?
হাছান মাহ্মুদ : বেশি নিবন্ধন দেওয়া হচ্ছে না। আবেদন এসেছিল পাঁচ হাজারের বেশি। পত্রিকা ছাড়া এক শর কিছু বেশি প্রতিষ্ঠানকে নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে।
কালের কণ্ঠ : বিদ্যমান অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোর মধ্যে দু-চার-পাঁচটির বেশি কেউ পেশাদারত্ব বজায় রেখে কাজ করতে পারছে না।
হাছান মাহ্মুদ : আমার মনে হয় এই সংখ্যাটা আরো বেশি হবে। মানুষের একটা সদিচ্ছার উদ্যোগকে প্রথমেই আমরা না করতে পারি না। আর এটা চূড়ান্ত অনুমোদন নয়। যারা পেশাদারত্ব বজায় রাখতে পারবে না তারা এমনিতেই ঝরে যাবে। খেয়াল করে দেখবেন যারা ঠিকমতো ওয়েবসাইট পরিচালনা করে না, তাদের সাইট বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে।
কালের কণ্ঠ : আইনজীবী হতে গেলে একটা নির্দিষ্ট মানদণ্ড পার হতে হয়। সাংবাদিকতায় প্রবেশের ক্ষেত্রে এমন কিছু থাকা উচিত কি না?
হাছান মাহ্মুদ : আমার মনে হয় এমন একটি প্রক্রিয়া থাকতে পারে। তবে এই বিষয়টির উদ্যোগ আসতে হবে সাংবাদিকদের মধ্য থেকেই। বিএফইউজে, ডিইউজে, সিইউজে, জাতীয় প্রেস ক্লাব, ডিআরইউ—এসব প্রতিষ্ঠানের নেতারা বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করতে পারেন। আমরা সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করব।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন