জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নীতি ও আদর্শ থেকে দেশ সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে চলে গেছে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বলতে যা বোঝায়, তা ছিল জনগণের আদর্শ। বঙ্গবন্ধু সেটাকেই প্রতিনিধিত্ব করেছেন।
আমাদের চার নীতি রাতারাতি আকাশ থেকে নাজিল হয়নি। বঙ্গবন্ধুর কৃতিত্ব হল- সমস্ত আন্দোলন ও প্রবাহকে তিনি মানুষের সামনে উপস্থিত করেছেন। মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক ছিলেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু আজ সেখান থেকে আমরা সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে চলে গেছি।
সম্প্রতি যুগান্তরকে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন। মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, প্রথম থেকেই হোঁচট খাওয়া শুরু হয়। পঁচাত্তর সালে খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে যা একেবারে উল্টিয়ে দেয়া হয়েছিল। কয়েকজন বাদে আওয়ামী লীগের প্রায় সব মন্ত্রী তখন মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছিলেন।
এরপর সামরিক শাসন চলে দীর্ঘদিন। সামরিক শাসন উচ্ছেদ হলেও পতিত স্বৈরাচার ও রাজাকার বহাল তবিয়তেই আছে। তাদের পক্ষে নিয়ে কে ক্ষমতায় যেতে পারে, সেটা নিয়ে এখনও প্রতিযোগিতা চলে। ফলে মুক্তিযুদ্ধের ধারা থেকে আমরা বিপথগামী হয়ে গেছি। রাজনৈতিকভাবে আরেকটি মুক্তিযুদ্ধের পর্ব আমাদের রচনা করতে হবে। সবাই বলে ভিশন-২০২১, কেউ বলে ভিশন-২০৩০। আমি বলি, ভিশন মুক্তিযুদ্ধ-’৭১। সেটাকে আগে ফিরিয়ে আনতে হবে।
করোনা মোকাবেলায় সরকারের পদক্ষেপ যথাযথ ছিল কি না-জানতে চাইলে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি বলেন: আমি বলব, সরকার পুরোপুরি ব্যর্থ। তাদের ব্যর্থতা ও দায়িত্বহীনতা ক্ষমার অযোগ্য। করোনা দেশে আসার আগেই এ বিষয়ে মানুষ জেনে গেছে। কিন্তু তখন সরকার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। আমরা পরামর্শ দিয়েছিলাম। তখনই যদি কয়েক লাখ তরুণ যুবককে অস্থায়ী স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে নিয়োগ দেয়া হতো, তাহলে জনশক্তিকে উদ্বুদ্ধ করে তারা এটা অনেক সফলভাবে মোকাবেলা করতে পারত। পদক্ষেপ নিতে তারা দু’মাস বিলম্ব করে ফেলল। তারপরও একেবারে খামখেয়ালিভাবে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
তিনি আরও বলেন, স্বাস্থ্য খাতে সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতা এখন একেবারে তলানিতে নেমে এসেছে। একদিকে লুটপাট, অন্যদিকে এমনই বেহাল অবস্থা যে, করোনায় আক্রান্ত রোগী তো বটেই, করোনা নেই-এমন রোগীদেরও চিকিৎসা হচ্ছে না। সংবিধানে আছে- স্বাস্থ্য মানুষের মৌলিক অধিকার।
কিন্তু সরকার সেদিকে নজর দেয়নি। জানুয়ারি মাসেই বাজেট পুনর্বিন্যস্ত করে ৩০ ভাগ বরাদ্দ স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও জনকল্যাণের জন্য দেয়ার দরকার ছিল। কিন্তু সেটা তো করলোই না; বরং নতুন বাজেটেও গতানুগতিকভাবে চরম অবহেলা ও বঞ্চিত করা হল। স্বাস্থ্যসহ ১৩টা মন্ত্রণালয় মিলিয়ে দেখানো হল সামান্য কিছু বাড়ানো হয়েছে। ফ্রন্টলাইনের যোদ্ধাদের জন্যও যথাযথভাবে প্রটেকশনের কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
রাষ্ট্রয়ত্ত পাটকলগুলো বন্ধ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এগুলোকে লাভজনক করা সম্ভব। ১২শ’ কোটি টাকা খরচ করলে সব কারখানার যন্ত্রপাতি নতুন করা যায়। এটা না করে কয়েক হাজার কোটি টাকা খরচ করে এটা বন্ধ করে দিচ্ছে। করোনা সংকটে মানুষ এমনিতেই বেকার। এটা করে সেই সংখ্যা আরও বাড়ানো হচ্ছে।
ভারত-চীনসহ প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমান সম্পর্কের বিষয়ে জানতে চাইলে সিপিবি সভাপতি সেলিম বলেন, আমরা মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছিলাম। কিন্তু এখন ভুলে যাওয়া হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে। কিন্তু আজ আমাদের জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের ধারায় আমাদের সংগ্রাম গড়ে উঠেছিল। আমরা আন্তর্জাতিকভাবে নিঃসন্দেহে সাম্রাজ্যবাদ ও বর্ণবাদের বিরুদ্ধে। আজ আন্তর্জাতিক ও জাতীয়ভাবে বিভিন্ন শক্তি আমাদের নিয়ে খেলার চেষ্টা করছে। সেখানে সরকার প্রধান জাতীয় স্বার্থগুলো শক্তভাবে তুলে ধরার জন্য এগুলো নিয়ে সর্বদলীয়ভাবে আলোচনা করার দরকার থাকলেও করছে না। এটা সব সময় তারা তাদের মতো করে। এভাবেই চলছে।
তিনি আরও বলেন, আসলে সবটাই ক্ষমতায় যাওয়ার সমীকরণ মেলানোর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখা হয়। জাতীয় স্বার্থের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখা হয় না। এই দুটি বুর্জোয়া দলের (আওয়ামী লীগ ও বিএনপি) চরিত্র একই রকম। তাদের কূটনৈতিক সম্পর্কের একটাই উদ্দেশ্য- কীভাবে ক্ষমতায় থাকা যায়। সেখানে অন্য কোনো হিসাব এবং যুক্তি খুঁজে পাওয়া যাবে না। ক্ষমতায় থাকার জন্য যার সঙ্গে বন্ধুত্ব করা উচিত আর যার সঙ্গে শত্রুতা করার প্রয়োজন পড়ে, তারা সেটাই করে।
বলা হচ্ছে- এই সব সমস্যা সমাধানে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোকে যথাযথ জবাবদিহির মধ্যে আনতে হবে। আমাদের সামনে সেই পথ কি খোলা আছে বা কীভাবে সেটা সম্ভব? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আসলে এখন জবাবদিহির বালাই নেই। এসব জায়গায় জবাবদিহি হয় ভোটের মাধ্যমে।
কিন্তু আমাদের দেশে কোনো ভোট হয় না। নৈশকালীন ভোট হয়। কিংবা ১৫৪ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হয়ে ক্ষমতা দখল করে নেয়। সুতরাং এখনও ভোটাধিকারের জন্য সংগ্রাম করতে হবে। তাহলে জনগণ কেন প্রতিবাদ করতে মাঠে নামছে না-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখানে রাজনৈতিক দলগুলোর অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। কিন্তু ইতিহাস ওই কথাই বলে। দু’শ বছর ব্রিটিশরা রাজত্ব করল কীভাবে? জনগণ কোথায় ছিল? চুলায় পানি দিলে সঙ্গে সঙ্গে তো বাষ্প হয়ে যায় না, সময় লাগে। সুতরাং আকস্মিক বিস্ফোরণ কখন হবে, কেউ বলতে পারে না।
করোনাভাইরাস-পরবর্তী সময়ে নতুন পৃথিবী প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, কোনো কিছুই একেবারে নতুন করে শুরু হয় না। পুরোনা ব্যবস্থার যে সংকট সেগুলোর বিস্ফোরণ ঘটে বা ভয়ংকর রকমের প্রকাশ ঘটে। তখন সমাজকে নতুনভাবে বিন্যস্ত করতে হয়। সম্ভবত সেরকম একটা পরিস্থিতির উদয় হয়েছে। করোনা প্রমাণ করেছে এটা প্রাকৃতিক দুর্যোগ বটে; কিন্তু আবার মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগও।
পুঁজিবাদ এবং মুনাফার তাড়নায় যে সমাজ চলে, তথাকথিত মুক্তবাজার অর্থনীতি, সেখানে মানুষের জীবনের চেয়ে মুনাফার মূল্য বেশি। লুটপাটের স্বার্থে যে সমাজ পরিচালিত হয়, সেখানে সংকট মোকাবেলার চেয়ে তা নিয়ে ব্যবসা করা হয়। যেটা আমাদের দেশে হচ্ছে। আবার বড় বড় পুঁজিবাদী দেশগুলোয়ও হচ্ছে। সেই তুলনায় সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো অনেক সফলভাবে তার জনশক্তিকে কাজে লাগিয়ে এটা মোকাবেলা করছে। সুতরাং আগামী দিনেও সেই দিকেই পৃথিবী ঝুঁকে পড়বে, চিন্তাশীল বিবেকবান মানুষ সেরকমই ভাবছে।
যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন