‘প্রথমত, প্রচলিত জ্ঞান দ্বারা পৃথিবী ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। দ্বিতীয়ত, কিভাবে সম্ভব এবং সেই তত্ত্বটা কি হতে পারে? এবং সেই তত্ত্ব প্রয়োগ করে বাংলাদেশের কেসটা কিভাবে দেখা যায়? আমাদের ক্ষেত্রে একটা বড় ধরণের ব্যর্থতা দেখি। এটা কোন ব্যক্তির ব্যর্থতা হতে পারে, নাও হতে পারে। নেতৃত্বের ব্যর্থতা হতে পারে, নাও হতে পারে। তবে আমার কাছে সবথেকে বড় ব্যর্থতা মনে হয় মিথ্যা কথা বলা। প্রচুর মিথ্যা কথা বলা হচ্ছে এবং হয়েছে।’
বাংলা ইনসাইডারের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে কথাগুলো বলছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত।
তিনি বলেন,‘আমি মনে করিনা রাজনীতি মানেই মিথ্যা কথা। কারণ বঙ্গবন্ধুকে জীবনে আমি মিথ্যা কথা বলতে দেখিনি। তাঁর সঙ্গে যেকোন বিষয়ে তর্ক করা যেত, একমত না হওয়া যেত। তাকে কখনো আমি মিথ্যে কথা বলতে দেখিনি। আমার কাছে মনে হয় কোভিড-১৯ কোন প্রবলেম নয়, কারণ কমবেশি প্রতি ৯০ বছর পরপর একটা লং টার্ম ডেড সাইকেল দেখা যায়। আমরা যারা অর্থনীতিবিদ তাঁরা শর্ট টার্ম ডেড সাইকেল নিয়ে কথা বললেও লং টার্ম ডেড সাইকেল নিয়ে খুব একটা কথা বলিনা। লং টার্ম ডেড সাইকেলে হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদী ঋণের বোঝা। শর্ট টার্ম বিজনেস সাইকেলে যেমন ওঠানামা থাকে, লং টার্মে তেমন থাকেনা। লং টার্ম বিজনেস সাইকেলের ওঠানামাটা হচ্ছে ন্যাচারাল। শর্ট টার্মেরটা এতটা ন্যাচারাল না। যেটা ন্যাচারাল না সেটা নিয়ে আমরা কথা বলি, কারণ এটা নিয়ে কথা বললে সুবিধা থাকে। জিডিপি কি তা না বুঝেই আমরা অযথা জিডিপি, গ্রোথরেট নিয়ে কথা বলি।’
বিশিষ্ট এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘কেউ যখন বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে কথা বলবে, তাঁকে কথা বলতে হবে বাংলাদেশের শিল্প, সেবা, কৃষি- এই তিন খাত নিয়ে। যে তিনটি খাতকে অর্থনীতির বৃহৎ খাত হিসেবে বলা হয় সেই খাতগুলো নিয়ে কথা বলতে হবে, উন্নতি নিয়ে কথা বলতে হবে, এই তিন খাতের প্রবৃদ্ধির হার নিয়ে কথা বলতে হবে, সেই প্রবৃদ্ধি যেখানেই পৌঁছাক না কেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রবৃদ্ধি দরিদ্রদের কাছে কখনোই পৌঁছায়নি।’
তিনি বলেন,‘১৯৭২-৭৩ সালে দেখা গেছে অসমতাটা একটু কম। লং টার্ম ডেড সাইকেলে যেটা হয় যে, সেখানে দেখা যায় প্রতি ৮০-৯০ বছর পরপর গ্লোবাল ক্রাইসিস বা বিশ্ব মন্দা হয়। যেটা হবেই। এখন থেকে ৯০ বছর পেছনে ফিরে গেলে আসে ১৯৩০ সাল। ১৯৩০ সালের মহামন্দার পরেই কিন্তু ২০১৯-২০২০ সাল। অর্থাৎ বিশ্বব্যাপী একটি মন্দাবস্থা ছিলই। তাঁর মানে করোনা না ঘটলেও বড় ধরনের বৈশ্বিক মন্দা হতোই। এখন এই মন্দার মধ্যে করোনা ঢুকে জিনিসটাকে জটিল করে দিয়েছে। এতটাই জটিল যে সেখান থেকে উত্তরণের কোন পথ নেই। মন্দা থেকে উত্তরণের উপর নির্ভর করে মন্দা কত প্রলম্বিত হচ্ছে এবং তাঁর গভীরতা কেমন?’
পৃথিবীর ইতিহাসে সারা পৃথিবীর জনসংখ্যা একবার কমেছিল ১৪ শতকে প্লেগ ডেথের কারণে। এখন পৃথিবীর মোট জনসংখ্যা আবারো কমতে পারে। কারণ করোনার পাঁচটি ওয়েভ থাকবে এবং আমরা কেবল প্রথমটি পার করছি বলে মন্তব্য করেন এই অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন,‘করোনাকে তুলনা করা হচ্ছে ১৮১৯ সালের স্প্যানিশ ফ্লু’র সঙ্গে। তখন পৃথিবীর জনসংখ্যা ছিল ২০০ কোটি। মিডিয়া ততটা উন্নত না থাকায় ধারণা করা হয় তখন সেই ফ্লুতে মারা গিয়েছিল আড়াই থেকে ৫ কোটি মানুষ। অর্থাৎ স্প্যানিশ ফ্লু’তে যদি ধরেই নেই ৩ কোটি মানুষ মারা গেছে এবং বর্তমান জনসংখ্যা যদি তাঁর ৪ গুণ হয়ে থাকে তাহলে করোনায় মারা যাওয়ার কথা ১২ কোটি মানুষের। আমি একটা কথা বলি, ঝুঁকি প্রেডিক্ট করা সম্ভব, অনিশ্চয়তা কিন্তু প্রেডিক্ট করা যায় না। এখানে ঝুঁকি ছিল অর্থনৈতিক মন্দা, তাই আমি এটাকে নাম দিয়েছি ‘কোভিড-১৯ মহামন্দা রোগ’। একদিকে মন্দা, অন্যদিকে মহামারি।’
অর্থনীতিকে স্টক অর্থাৎ টাকা, সোনা-পয়সা, মজুদ হিসেবে দেখা যাবেনা, অর্থনীতিকে প্রবাহ হিসেবে দেখতে হবে। প্রবাহ বজায় রাখতে পারবে যে অর্থনীতি, সেই অর্থনীতি টিকবে। আর যদি হঠাৎ করে উপড়ে উঠে যাওয়া কোন অর্থনীতি প্রবাহ বজায় রাখতে না পারলে সেই অর্থনীতি কোনদিনও টিকবে না। উদাহরণ দিয়ে এই অর্থনীতির অধ্যাপক বলেন, গত ২৬ মার্চের লকডাউনের পর সারাদেশের ইন্ডাস্ট্রিয়াল ক্যাপাসিটি নেমে এসেছে ২০ শতাংশে, ৮০ শতাংশই বন্ধ। সার্ভিস সেক্টরেও সেই একইরকম। ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ উৎপাদন ক্ষমতা বজায় রাখতে পেরেছে শুধু কৃষিখাত। অর্থাৎ যে খাত করোনার মাঝেও দাঁড়িয়ে থাকতে পারে তাঁর ইকোনমিক ইম্যুনিটি লেভেল খুব বেশি। এই কৃষিখাতেই আমাদের বহু এডভান্টেজ আছে। মাটির উর্বরতার কারণে বীজ ফেললেই ফসল হয়ে যায়। অর্থাৎ করোনার কারণে যে শিক্ষাটা আমরা পেয়েছি তা হলো যে কৃষি খাতকে সবসময় আমরা অবহেলা করে এসেছি সেই খাতই এখন অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রেখেছে। অথচ এই কৃষিপণ্যের দামই আমরা সবসময় শিল্প পণ্যের তুলনায় কৃত্রিমভাবে কমিয়ে রেখেছি।’
স্বাধীনতার আগে যেমন পূর্ব পাকিস্তান ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণের শিকার, তেমনি বাংলাদেশে কৃষিখাত শোষণের শিকার হয়ে আসছে। কারণ পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তানকে বলা হয়েছিল যে, পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীনভাবে রপ্তানি বাণিজ্য করতে পারবে। তবে রপ্তানি বাণিজ্যটা ইসলামাবাদ হয়ে যাবে। সেই প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তিনি বলেন,‘পাকিস্তানে দুটো খাতা ছিল, সেখানে পূর্ব পাকিস্তানের ১ ডলারের বিপরীতে লেখা হতো ৪ টাকা ২৫ পয়সা, আর পশ্চিম পাকিস্তানের ১ ডলারের বিপরীতে লেখা হতো ৮ টাকা। অর্থাৎ ১ ডলারে পূর্ব পাকিস্তানের ৩ টাকা ২৫ পয়সা মেরে দিতো পশ্চিম পাকিস্তান। এভাবে ১০ বছর বাদে তাঁরা আমাদের বললো যে আমাদের খাতা খারাপ। অথচ তাঁরা যে আমাদের টাকা মেরে দিয়েছে এটা তাঁরা বললো না। বর্তমানেও আমাদের কৃষিখাতের সঙ্গে সেটাই হচ্ছে। অর্থাৎ আমাদের ভবিষ্যৎ নিহিত যে কৃষিখাতে, সেটার যথাপোযুক্ত ব্যবহার করা উচিত। সেটা খুব কাজে লাগবে। কারণ সামনের দুনিয়াটা হবে খুব বুভুক্ষের দুনিয়া। খাদ্য নিয়ে বুভুক্ষ হবে মানুষের। তাই আমরা যদি আমাদের টা ঠিক করতে পারি আগে, তারপর না হয় লাভজনক ব্যবসাও করতে পারবো।’
তিনি বলেন,‘‘ইউ মে বি দ্যা গভর্নমেন্ট, ইউ মে নট বি ইন দ্যা পাওয়ার’- যত টাকা আছে তাঁকে দুইভাবে ভাগ করো। একটা হচ্ছে অর্থ, যেটা ইনভেস্টেড ইন এনি ফর্ম। যে ইনভেস্টমেন্টে কোন না কোন রিটার্ন আছে। আরেকটা হচ্ছে টাকা যেটা ইনভেস্টেড না। এই দুটি টাকা দুইপাশে রাখুন, ধরে নিন এরা দুটো পাহাড়। একটা ইনভেস্টেড টাকার পাহাড়, আরেকটা নন ইনভেস্টেড টাকার পাহাড়। ইনভেস্টেড টাকার পাহাড়ের শৃঙ্গটা অন্যটির থেকে উঁচু হলে বা সমান-সমান হলেও তাহলে আপনি যেমন গভর্নমেন্টে থাকবেন, সেই সঙ্গে ক্ষমতাতেও থাকবেন। কিন্তু দ্বিতীয় পাহাড়টি অর্থাৎ নন ইনভেস্টেড টাকার পাহাড়ের শৃঙ্গটা প্রথমটির থেকে উঁচু হলে আপনি হয়তো গভর্নমেন্টে থাকবেন, তবে ক্ষমতায় নয়। তখন কে থাকবে ক্ষমতায়? তখন ক্ষমতায় থাকবে ঐ যে নন ইনভেস্টেড টাকার মালিকরা। এটাকে আমি বলেছি ফাইনান্সিয়ালাইজেশন অফ ক্যাপিটাল। টাকা আছে কিন্তু এটা ক্লিয়িয়ারলি ফাইনান্সিয়ালাইজড না। অর্থাৎ নতুন এক ধরণের পুজি, যা আগে দৃশ্যমান হয়নি।’
বিশিষ্ট এই অর্থনীতিবিদ উদাহরণ টেনে বলেন, ‘এখন থেকে ৫০-৬০ বছর আগে আমেরিকান ফিলোসফার হাওয়ার্ড জেনকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে, তুমি এত কথাবার্তা বলছো যখন তখন তুমি কেন তোমার ছাত্র, তোমার সরকার বা তোমার সিভিল সোসাইটিকে বলছো না যে, সরকারের উচিত সরকারের করপোরেশনগুলোকে রেভ্যুলেট করা। তখন হাওয়ার্ড জেন হাসি দিয়ে বলে, হোয়াই শ্যুড আই? কারণ করপোরেটই তো সরকার।’
বাংলা ইনসাইডার
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন