প্রখ্যাত আইনজীবী গাজী শামসুর রাহমানের এই দীর্ঘ সাক্ষাতকারটি গৃহীত হয়েছিল ১৯৯৬ সালে। রাজু আলাউদ্দিন ও ব্রাত্য রাইসুর নেয়া এই দীর্ঘ সাক্ষাতকারে তিনি জানিয়েছিলেন আইনের সব জটিল ও কুটিল প্রসঙ্গ– স্বচ্ছ ভাষায় আর উপমার মাধ্যমে। সাক্ষাতকারটি প্রকাশিত হয়েছিল অধুনালুপ্ত দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকায়্।
গাজী শামছুর রহমান ১৯২১ সালে জন্মগ্রহণ করেন। পেশায় তিনি ছিলেন আইনবিদ, গ্রন্থকার এবং জনপ্রিয় টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব। তিনি বাংলায় আইন বিষয়ক গ্রন্থ রচনায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তার রচিত গ্রন্থ সংখ্যা শতাধিক। তিনি ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান একুশে পদক-এ ভূষিত হন। ১৯৯৮ সালের ১২ আগস্ট-এ তিনি মৃত্যু বরণ করেন। বি.স
সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন:রাজু আলাউদ্দিন ও ব্রাত্য রাইসু
গাজী শামছুর রহমান: আমি তো আইনের বিষয় ছাড়া অন্য বিষয় জানি না।
রাজু আলাউদ্দিন: না, তা নয়; আইনের বিষয় যখন আপনি জানবেন, আইন হচ্ছে এমন একটা দর্পণ যা, আমার ধারণা, এর মাধ্যমে আপানি অনেক কিছু দেখে ফেলেন।
গাজী : তোমাদের কোন স্পেসিফিক প্রশ্ন আছে কিনা?
রাজু : হ্যাঁ, আমাদের স্পেসিফিত প্রশ্ন আছে, আবার প্রশ্নের ভিতর থেকে প্রশ্ন তৈরি হবে।
গাজী : আচ্ছা কী প্রশ্ন আছে বলো। আমি তোমাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবো কিনা জানি না, আমি তো রাজনীতি করি না।
ব্রাত্য রাইসু : নরমাল কোশ্চেন সবই।
গাজী : বলো ।
রাইসু : আচ্ছা, আমাদের এখানে যে আইনটা প্রচলিত এটা তো বৃটিশ আইন। সেক্ষেত্রে কি আমরা বৃটিশ উপনিবেশের মধ্যেই নাই আইনগতভাবে?
রাজু : মানে আমরা উপনিবেশিকতা স্বীকার করে নিচ্ছি কিনা?
গাজী : না, নিচ্ছি না, এটা তুমি লিখে নিতে পারবে?
রাজু : না, আমরা তো রেকর্ড করে নিচ্ছি।
গাজী : পরে ট্রন্সক্রাইব করতে পারবে? আচ্ছা ট্রান্সক্রাইব করতে পারলে, এখন আমার কথা যতো কঠিন তোমাদের বিদ্যা অতখানি বিস্তৃত হতে হবে। তা না হলে লিখতে পারবে না, কথা হলো যে আমার অহংকার হলো এই যে আমি কঠিন জিনিসকে সহজ করে বলতে পারি।
রাজু : আমি আপনার লেখার সঙ্গে পরিচিত। আপনার লেডি চ্যাটার্লিজ ট্রায়াল সেগুলো আমি পড়েছি।
গাজী : তো প্রশ্নটা করো।
রাইসু : বৃটিশ আইনের চর্চার মাধ্যমে আমরা কি পক্ষান্তরে ঔপনিবেশিক আমলের বৃটিশ শাসনই বহাল রাখছি না?
গাজী : রাখছি না। কেন মন দিয়ে শোনো। আইন বিষয়টি কী এটা বুঝে নাও। ধরো উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে একটা রাস্তা গিয়েছে আর পুব থেকে পশ্চিম দিকে একটা রাস্তা গিয়েছে। মাঝখানে যে জংশন সেখানে তোমরা দেখেছো ট্রাফিক সিগন্যাল এবং ট্রাফিক পুলিশ দাঁড়িয়ে। কেন? যখন লালবাতি জ্বলে ওঠে তখন গাড়িগুলো থেমে যায়, সবুজ বাতি যখন জ্বলে ওঠে তখন সেই গাড়িগুলো চলে। যদি ঐ লালবাতি এবং সবুজ বাতি এবং ট্রাফিক পুলিশ ওখানে না থাকতো তাহলে উত্তর-দক্ষিণগামী গাড়ির সাথে পূর্ব-পশ্চিমগামী গাড়ির সংঘাত হতে পারতে। এই সংঘাত নিরসনের জন্যে ঐ নিয়ন্ত্রণের বিধান করতে হয়। সেই নিয়ন্ত্রণের ফলে যদিও মুহূর্তের জন্যে, কিছু সময়ের জন্যে একটি গাড়ির চলাচল বিঘ্নিত হয়, মোটামুটিভাবে কিন্তু গাড়ির চলাচল নিরাপদ হয়। তাহলে আমরা দেখছি, আইনের প্রয়োজন হচ্ছে সেখানে যেখানে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের সম্ভাবনা আছে। যেখানে গন্ডগোল বেঁধে যেতে পারে, বিবাদ বেঁধে যেতে পারে সেই বিপদকে নিরসন করবার জন্যে আইনের সৃষ্টি হয়েছে। এই কথাটি যদি বুঝে নেয়া যায় তাহলে দেখতে হবে যে আইন বৃটিশেরই হোক বা আমেরিকারই হোক বা যেখানকারই হোক না কেন আইনের মূল বিষয় কিন্তু একই। এটি যুগে যুগে দেশে দেশে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে পরিবর্তিত হয় বটে কিন্তু বৃহৎভাবে আইনের মূল কাঠামো কিন্তু প্রায় একই থেকে যায়। একটি উদাহরণ দিয়ে বোঝানো যায়। ১৮৫০ সালে লর্ড ম্যাকলের নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠিত হয় যাতে আমাদের উপমহাদেশে-তখনকার ভারতবর্ষে -তার মধ্যে বাংলাদেশেও ছিল-এই আইন কী হতে পারে এই নিয়ে আলোচনা হয়। প্রায় ১০ বছর কাজ করবার পরে সেই কমিশন একটি পূর্ণাঙ্গ আইন তৈরি করেন। যার নাম‘পেনাল কোড’ বা ‘দন্ডবিধি’। দেখো এই যে দন্ডবিধি, এই দন্ডবিধি ১৮৬০ সালে প্রবর্তিত হয়। আর আজ ১৯৯৫। তার মানে দেখা যায় প্রায় ১৩৫ বছর এই আইনটি টিকে আছে। শুধু বাংলাদেশ নয়। ভারতবর্ষে, পাকিস্তানে শ্রীলংকায় সম্ভবত মায়ানমারে। তাহলে কী দেখছি?
রাজু : উপনিবেশ দেশগুলিতে টিকে আছে।
গাজী : তুমি বলছো এটা উপনিবেশিতদের দেশে টিকে আছে। তোমার এ কথার মধ্যে কিঞ্চিৎ উষ্মা আছে। তাহলেও আমি বলছি। হ্যাঁ, তা তো ঠিকই। কিন্তু উপনিবেশবাদ থেকে লড়াইয়ের মাধ্যমে তারা মুক্তি পেয়েছে। সংগ্রামের মাধ্যমে তারা মুক্তি পেয়েছে। ভারতবর্ষের মানুষ, শ্রীলংকার মানুষ, ব্রহ্মদেশের- মায়ানমারের মানুষ, বাংলাদেশের মানুষ- এরা মুক্তি পেয়েছে সংগ্রামের মাধ্যমে। সংগ্রামের মাধ্যমে মুক্তি পাওযায় তারা নিশ্চয়ই এই আইনের কথা বিবেচনা করেছে যে, এই আইন থাকা উচিত কিনা । বাংলাদেশেও বিবেচনা করেছে। যে বিবেচনার মধ্যে আমি নিজেও যুক্ত ছিলাম। সেই বিবেচনা করা হয়েছে ১৯৭৩ সালে। তো করা হয়। আমরা দেখেছি যেমন ভারতবর্ষ দেখেছে ১৯৪৭ সালের পর পাকিস্তান দেখেছে, শ্রীলংকা দেখেছে– এরা দেখেছে এবং দেখে মনে করেছে যে, আইনটি টিকে থাকা উচিৎ।
রাইসু : মানে কিছু ব্যক্তি এটা ঠিক করেছেন যে, আইনটা টিকে থাকা উচিৎ?
গাজী : কিছু ব্যক্তি না, তারা জনপ্রতিনিধি দ্বারা ঠিক করেছে। ‘ল কমিশন’ ঠিক করেছে। ভারতবর্ষে একটি পারমানেন্ট ‘ল কমিশন’ আছে। চিরস্থায়ী। সব সময়ের জন্য তারা কাজ করছে। প্রতিদিন তারা কাজ করছে তারা দেখেছে এটা বেঁচে থাকা দরকার আছে, অস্ট্রেলিয়ায় আছে, সুদানে আছে। এসব দেশে প্রায় একই রকম আইন আছে।
রাইসু : তার মানে আইনের একটা স্থবিরতা আছে।
গাজী : আইনের মধ্যে স্থবিরতা নেই। কতগুলো সত্য, কতগুলো স্থির সত্য সেটি সময়ের কারণে অসত্য হয়ে যায় না। রবীন্দ্রনাথের একটি কথা বারবার করে মনে পড়ে। তিনি একটি চমৎকার কথা বলেছেন। বলেছেন যে, আমি প্রতিদিন জোড়াসাঁকোর বাড়ির সামনে যে পুকুর আছে সেই পুকুরের পাশে ছোট্র একটি বেঞ্চিতে বিকেল বেলায় বসতাম। আর আমি দেখতাম অস্তায়মান সূর্যের স্বর্ণরশ্মি নারকেল গাছের চিরল পাতার মধ্য দিয়ে পুকুরের জলের উপর পড়ে চিকমিক করতো। আমাকে আনন্দে উদ্বেল করে তুলতো। এটা চিরকালই সত্য। যা আনন্দের তা তো চিরকালই সত্য। রবীন্দ্রনাথ বলেন, ভাগ্যিস আমি একে পুরোনো মনে করি নি। যে সত্য সত্য সে তো চিরকালই সত্য। ধরো একটা কথা বলি। যে ব্যক্তি অপর ব্যক্তির দখলস্থিত অস্থাবর সম্পত্তি তার বিনা অনুমতিতে অসৎ উদ্দেশ্যে স্থানান্তর করে সেই ব্যক্তি চুরি করে–এটা ৩৭৮ ধারা ‘পেনাল কোডের’।
রাইসু : যাদের মধ্যে ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারণা নেই তাদের ক্ষেত্রেও কি এটা প্রযোজ্য হবে?
গাজী : সেটা হচ্ছে দ্বিতীয়। তুমি আর একটা বৃহৎ প্রশ্নের মধ্যে এসেছো। হ্যাঁ, তাহলে আমি দেখলাম যে চুরির যে সংজ্ঞা, এটা কিন্তু প্রায় সব দেশেই এক। কোনো ব্যক্তি যদি অপর ব্যক্তির দখলে থাকা কিছু সম্পত্তি তার বিনা অনুমতিতে নিয়ে যায় তবে চুরি হয়। এ তো পরিবর্তনের কোনো স্কোপ নেই। এর তো পরিবর্তনের দরকার আছে, সেগুলো ছিটেফোঁটা আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি বিরোধ হয় জমি নিয়ে। এটি আমাদের কৃষিনির্ভর দেশ। জমি নিয়েই মারামারি। একজন মারা গেলে তার চারটি পাঁচটি সন্তান। নিজেরা মারামারি বাঁধায়। মেয়েরা শ্বশুর বাড়ি যায়, তারা সম্পত্তি দাবি করে। এই নিয়ে অনেক কোন্দল বেড়ে যায়। এখন কিছু কিছু আইন-দার্শনিক বললেন যার মধ্যে মহামতি কার্ল মার্কস অন্যতম– তিনি বললেন, এই যে জমিজমা নিয়ে কোন্দল, এই জমিজমা যদি রাষ্ট্রের করে নেয়া যায় তাহলে তো আর কোন্দল হবে না। এ তো ঠিকই। তাহলে যেখানে এই জমি রাষ্ট্রায়ত্ত হয়ে যায় সেখানে জমি নিয়ে মারামারির যে-ধারাগুলো সেক্ষেত্রে দন্ডবিধি দেয়ার আর প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু জমির মধ্যে যা উৎপন্ন হয় তা যখন একজনের বাড়িতে যায় তখন আর একজন যদি সেটা নিয়ে যায়–সে সোশ্যালিস্ট দেশই হোক আর ক্যাপিটালিস্ট দেশই হোক– তা তো চুরি থেকেই যায়। আরেকটি কথা ধরো। এই কথা নিয়ে যুবকদের মন উদ্বেলিত হতে পারে। আমাদের দেশের, বাংলাদেশের একটি খারাপ আইনের কথা শোনো। খুব খারাপ আইন। আমরা বলি যে আইনটা ঠিক নয়।
রাইসু : তার মানে আইনের ভালো এবং খারাপ আছে?
গাজী : খারাপ তো কিছু আছেই।
রাইসু : সেটা কি দিয়ে বিচার করবেন আপনারা আইনের খারাপ-ভালো?
গাজী : আগে শুনে নাও। খারাপ আইনটা শুনে নাও। আইনটা হচ্ছে ধরো, দবির আর সালেহা স্বামী-স্ত্রী, তারা বিবাহ সম্মন্ধে আবদ্ধ। এখন সালেহা দবিরের বন্ধু সাবেতের সাথে শোয়, তাতে দবিরের কোনো আপত্তি নেই। এতে কারো কোনো অপরাধ নেই। কথা বুঝলে?
রাইসু : আইনে নেই।
গাজী : আইনে নেই, ধর্মে আছে, সমাজে আছে– তা হলে নেই। কিন্তু দবির যদি আপত্তি করে তাহলে সাবেতের অপরাধ আছে, সালেহার নেই। সাংঘাতিক ব্যাপার!
রাইসু : কেন এটা।
গাজী : কেন এটা বলতে পারবো না। এটা আইন।
রাইসু : এটাকে আপনি খারাপ আইন বলছেন?
গাজী : আমি বলছি যে এটা তর্কিত আইন।
রাজু : গাজী ভাই, এই যে আপনি বলতেছেন যে, এটা কেন তা আপনি জানতেছেন না। আইনগুলি তা হলে কিসের ভিত্তিতে তৈরি হয়? মানে এর কোনো মর্যাল ক্রাইটেরিয়া থাকে?
গাজী : এটা আরেকটা প্রশ্ন। তোমার দ্বিতীয় প্রশ্নতে আসবে যে আইনের উৎস কী, ক্রাইটেরিয়া কী– সেটি দ্বিতীয় প্রশ্নের মধ্যে এসো। আমি এখন প্রশ্নে উত্তর দিচ্ছি যে-আইন করা হয়েছে, বেশিরভাগ আইন বৃটিশ আমলে তাতে কি আমরা উপনিবেশিক আইনের ধারায় দাসত্ব করে চলছি কিনা। এই কথাটির উত্তর দিচ্ছি। অন্য কথা তো আসবেই পরে। তাহলে দেখা গেলো যে আমি অন্তত কিছু আইনের কথা বললাম যে, আইনের নিত্যতা অবিসংবাদিত। সে সব ক্ষেত্রে তো পরিবর্তনের কোনো প্রয়োজন নেই, পরিবর্তনের প্রয়োজন যদি থাকতো ভারতীয় ‘ল কমিশন’ যেটি ৩৬৫ দিন প্রতি বছর কাজ করছে তারা কেন পরিবর্তন করে না। শ্রীলংকায় ‘ল কমিশন’ আছে তারা কেন পরিবর্তন করে না। পরিবর্তন যে মোটে করে না তা না। আমরাও ছিটোফোঁটা করেছি। আমরাও দন্ডবিধির মধ্যে ছিটেফোঁটা করেছি। তার পরিপার্শ্বে অনুপূরক, পরিপূরক কিছু আইন করেছি। কিন্তু মোটামুটিভাবে করি নাই। আরেকটা কথা তোমরা জানো উচ্ছ্বাস আইনের ক্ষেত্রে চলবে না। তুমি বলছো যে, ঐ লোক ঐ আইন বানিয়েছে, লোকটি খারাপ, সুতরাং আইনটি খারাপ। নাও হতে পারে। এই দন্ডবিধি যাদের দ্বারা তৈরি হয়েছে তারা ব্যক্তিগতভাবে প্রায় সকলেই ভারতবর্ষের প্রতি গভীরভাবে বিদ্বিষ্ট ছিলেন। তারা ভযানকভাবে ভারতবাসীদের ঘৃণা করতেন। যেমন একটি কথা ম্যাকলের খুব প্রসিদ্ধ, তিনি বলেছেন যে, ভারতবর্ষের, মানে সমগ্র উপমহাদেশে, যার মধ্যে শীলংকা এবং ব্রহ্মদেশ– মায়ানমার তখন ছিল না, এই ভারতবর্ষের সমস্ত মৌলিক বই যদি একত্র করা যায় বৃটিশ মিউজিয়াম লাইব্রেরির একটি আলমারির অর্ধেকখানি শেলফের বেশি ভরবে না।
রাজু : এত ইনফেরিওর ধারণা ছিলো তার?
গাজী : ধারণা ছিলো। অবশ্য ইউরোপীয়দের তুলনায় আমরা বিংশ শতাব্দীতে অনেক নিচে আছি একথা ঠিক। তো অতখানি ঠিক না।
রাইসু : ঐ এক আলমারির ব্যাপারটা ঠিক না।
গাজী : না, এক আলমারির না, এক শেলফের অর্ধেকখানি। তা হলে এটা বোঝা গেলো যে, যার নেতৃত্বে এই আইনটি তৈরি হয়েছিলো তিনি ভারতবর্ষের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন ছিলেন না এবং ভারতবর্ষ সম্পর্কে তার ধারণা খুব নিচু ছিলো, তবু তিনি যে কাজটি করেছেন সেটি প্রায় সোয়া শ’ বছর। ওর উপর আমরা কোনো পরিবর্তন আনতে সাহস পাইনি। এত সুন্দর কাজটি তিনি করেছেন। অবশ্য কিছু কিছু জায়গায় তো পরিবর্তন হয়েছেই। তবে একথা বলা যায় না যে, যেহেতু এই আইনগুলো ঔপনিবেশিক আমলের সেহেতু আমরা ঔপনিবেশিক আইনের ক্ষেত্রে রয়ে গেছি–এরকম ঢালাও মন্তব্য ঠিক নয়। আরও দুয়েকটি কথা বলি। যেমন ধরো চুক্তি আইন, সম্পত্তি হস্তান্তর আইন, কোম্পানী আইন এগুলোর যে মূল ভিত্তি এগুলো এমন যে প্রায় সবদেশে একই রকম। আমি আরেকটি কথা তোমাদের বলি, আমি ইসলামী আইনের ওপর বৃহৎ কজ করেছি এবং করছি। আমি আশ্চর্যজনকভাবে লক্ষ্য করেছি এই যে চুক্তি আইন, সম্পত্তি হস্তান্তরের আইন এগুলো সেই যুগে মধ্যপ্রাচ্যেও যে ধারণা ছিলো আমাদের দেশেও এখন প্রায় একই রকম ধারণা।
রাজু : তার মানে কি এগুলো নবায়ন করবার দরকার হয় না?
গাজী : না, এগুলো এত সার্বজনীন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে যুগের পরিবর্তনে, ভূমি ব্যবস্থার পরিবর্তনে সামান্য এদিক ওদিক পরিবর্তন করা দরকার, কিন্তু এর মূল কাঠামো পরিবর্তনের প্রয়োজন নেই। আচ্ছা আরেকটা কথা হচ্ছে, বারবার কিন্তু যেখানে সেখানে উচ্চারিত হয় যে, আমরা ঔপনিবেশিক আইনের আড়ালে আছি। তারা তো বলে না কোথায় ঔপনিবেশিক কোন আইনটা কিভাবে আমাদের ক্ষতি করছে। তা তো তারা দেখিয়ে দেয় না। সুতরাং এটা উচ্ছ্বাস।
রাইসু : দেখিয়ে দিলে কি আপনারা পরিবর্তন করতে পারবেন?
গাজী : নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই! সে কথা আমি পরে বলবে যে, যেখানে পরিবর্তনের দরকার আছে সেখানে কিভাবে পরিবর্তন করা যায়।
রাইসু : আচ্ছা, যেখানে পরিবর্তনের দরকার আছে সেখানে কিভাবে পরিবর্তন করা যায়?
গাজী : সেটা সম্পর্কে আমি বারবার বলেছি। আমার টিলিভিশন বক্তৃতায় বলেছি, রেডিওতে বলেছি, আমার লেখার মধ্যেও বলেছি যে, বাংলাদেশে একটি স্থায়ী ‘ল কমিশন’ হওয়া দরকার। যেমন ভারতবর্ষে আছে, স্থায়ী ‘ল কমিশন’, পারমানেন্ট বডি সেটা। প্রতিনিয়ত তারা পরীক্ষা করছে যে আজকে যে আইনটা আছে এই আইনটি আজকের জন্য উপযুক্ত কিনা, এবং আজকের জন্য যদি উপযুক্ত না হয় তা হলে কী পরিবর্তন করা যায়, এবং এই পরিবর্তন কতদূর পর্যন্ত বজায় রাখা যায়। প্রতিনিয়ত তারা বিবেচনা করছেন। এবং তারা যথেষ্টভাবে কাজ করে চলেছেন। এরকম একটি ‘ল কমিশন’ বাংলাদেশে হওয়া উটিৎ। এবং মির্জা গোলাম হাফিজ সাহেব আজ দু’বছর ধরে অনবরত বলছেন যে তিনি ‘ল কমিশন’ করবেন। এখন তো আয়ূ শেষ, তো এখনও করেন নি।
রাইসু: আচ্ছা আপনি যে বললেন, খারাপ আইন এবং ভালো আইন, তার মানে আইনের একটি নান্দনিক ব্যাপার আছে?
গাজী : নান্দনিক তো অন্য জিনিস। আইনের মধ্যে কোনো কোনোটি সার্বজনীন। কোনো জিনিস স্থানিক, কালিক আছে। তো সেটা যেখানে স্থানিক-কালিক সেখানে তো পরিবর্তন করতে হয়। যেমন আমাদের বাংলাদেশ কিছুদিন আগে এন্টি টেরবিস্ট ল হয়েছিলো– সন্ত্রাস দমন আইন। এটামাত্র দু’বছর বলবৎ ছিলো। ওকে বলা হয়েছিলো দু’বছর বজায় থাকবে এবং দু’বছরের মধ্যে শেষ হয়ে গেছে সেটি।
রাজু : আর এই যে স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট …..?
গাজী : স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট, সেটা এখনো আছে।
রাজু : আচ্ছা, এই স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট, এটা আমাদের দেশে কিভাবে অনুমোদন পেলো?
গাজী : স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট করা হয়েছে বঙ্গুবন্ধুর আমলে, ১৯৭৪ সালে। এবং যখনই কেউ অপজিশনে যায় বলে এই আইনটা থাকা উচিৎ না। আর যেই পজিশনে যায় তখন আর তারা ওঠায় না। আচ্ছা, এখন তোমার নেক্সট প্রশ্ন বলো।
রাইসু : আইনের কোনো বিকল্প হয় কিনা, অর্থাৎ আইনের জায়গা’য় ধর্ম, আদর্শ, নৈতিকতা, মানুষের শুভবোধ দিয়ে কাজ চালানো যায় কিনা?
গাজী : কঠিন ব্যাপার এটা। আমাদের দেশে যে আইন আছে এটা লিখিত আইন আর বহু দেশে আছে যেখানে আইন লেখা নেই। ইংল্যান্ডে আইন তেমন বেশি লেখা নেই। এগুলো জজেরা যে-সমস্ত সিদ্ধান্ত দেন সেগুলোই আইন হয়ে যায়। ধরো একটা লোক চুরি করেছিলো। এখন চুরি কাকে বলে আমাদের দেশের আইন আছে। ও দেশের আইনে তো থাকবার দরকার নেই। জজ সাহেব দেখে বিচার করে বলবেন লোকটা চুরি করেছে কিনা। তার জন্য তো লিখিত আইনের দরকার নেই। এমনি তারা বিচার বিবেচনা করতে পারেন। এরকম করে সিদ্ধান্তের পর সিদ্ধান্ত জমা হয়ে প্রত্যেক বছর তাদের ল রিপোর্ট বের হয়। তার ওপর ভিত্তি করে তারা এই আইনটাকে নির্ণয় করে। অধুনা কিন্তু সব জায়গায় আইন বিধিবদ্ধ হচ্ছে।
রাইসু : আচ্ছা ধর্মীয় অনুশাসনের সঙ্গে আইনের সম্পর্ক কোথায়? যেখানে ধর্ম এবং আইনের মধ্যে বিরোধ আছে সে সব অবস্থাকে আপনারা কিভাবে গ্রহণ করেন?
গাজী : যেখানে আইনের সঙ্গে ধর্মের বিভেদ আছে সেখানে আইন কার্যকরী, ধর্ম নয়। একটা উদাহরণ দেই। যেমন ধরো, আমাদের দেশে যদি কোনো পুরুষ এমন একটি মেয়ের সাথে মিলিত হয় যে মেয়েটি তার স্ত্রী নয়, এটি ইসলামী আইনে তাকে ১০০ দোররা মারতে হবে– একথা বলা হয়েছে। কোরআন শরীফে আছে। আমাদের দেশের আইনে যদি তারা উভয়ে সম্মত হয়ে করে এবং মেয়েটি যদি কারো সাথে বিবাহিত না হয় তা হলে কোনো অপরাধ হবে না।
রাইসু : আইনজ্ঞ হিসাবে আপনার কী মত, এটা কি ঠিক?
গাজী : ঠিক-বেঠিক আমি বলবো না, আমি তো ফিলসফার না। আমি আইনের কথা বলছি। ধর্ম এই কথা বলছে, আর আমাদের আইন এই কথা বলছে।
রাইসু : আইনের বাইরে মানুষ হিসেবে কোনো মন্তব্য করতে পারেন।
গাজী : না, আমি বলছি যে এটা তো এত সুদূরপ্রসারী প্রশ্ন ব্যাপারটা ভেবে দেখতে হবে। সামাজিক অবস্থাটা এখন কী অবস্থায় দাড়িয়ে আছে। নারী-পুরুষের মিলন কতদূর পর্যন্ত সমর্থন করা যায় সেটি সামগ্রিক অবস্থা বিবেচনা করে দেখতে হবে।
রাজু : আচ্ছা আইনের সঙ্গে ধর্মীয় অনুশাসনের যে একটা বিভেদ আছে বা সংঘাতও হতে পারে কখনো কখনো।
গাজী : অনবরত হয়।
রাজু : আচ্ছা অনবরত হয়। এখন এটা নিষ্পত্তির দায়িত্ব কার?
গাজী : কিসের নিষ্পত্তি? নিষ্পত্তি তো পরিষ্কার। আইন উপরে স্থান পাবে।
রাজু : ধর্মের উপরে?
গাজী : নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই। কোরআন শরীফেই তো আছে কেউ যদি চুরি করে তার হাত কেটে দাও। তুমি কি হাত কাটো?
রাজু : না, তা করি না আমরা। কিন্তু ওদের ওখানে, মধ্যপ্রাচ্যে তো এই আইন বলবৎ আছে। এটা অমানবিক তো।
গাজী : অমানবিক মানবিক এটা তো দার্শনিক প্রশ্ন। আইনের প্রশ্ন না তো।
রাজু : আইনের মধ্যে দার্শনিকতা আছে তো।
গাজী : আইনের মধ্যে দার্শনিকতা সেটা অন্য ব্যাপার। আমার এরিয়া যেটা সেটা হচ্ছে আইন। ফিলসফি না। আইনটা কী আছে, কী প্রতিক্রিয়া হচ্ছে এটা বলতে পারি। ‘কেন’ সেটা তো যারা আইন তৈরি করে তারা বলে। তার পরের প্রশ্নে যাও।
রাইসু : আইন যদি না থাকতো দেশে অপরাধ থাকতো না এরকম বলা হয়, আপনার কী মত?
গাজী : এই ব্যাপারটা তিনভাবে দেখা যায়। একটা হলো অপরাধ কাকে বলে। যা আইন অপরাধ বলে চিহ্নিত করে সেই কর্ম বা কর্মকাণ্ডকে অপরাধ বলে। যা আইন অপরাধ বলে চিহ্নিত করে না সেটি অপরাধ নয়। তুমি যদি ১৬ বছরের মেয়েকে সাথে নিয়ে বেড়াতে যাও তোমার ৩ বছর জেল হতে পারে।
রাইসু : কেন?
গাজী : এটা আইনে আছে। কিন্তু মেয়েটির বয়স যদি ১৬ বছরের উর্ধ্বে হয় তা হলে তোমার কোনে অপরাধ নেই। আইনে তা বলেছে যেমন তুমি যদি ধরো ওই ওপার থেকে একটা জিনিস নিয়ে এসো, পরিমাণ আছে এই এত খানি জিনিস নিয়ে আসলে তোমার অপরাধ নেই।
রাইসু : ওপার বলতে কি পরকাল বোঝাচ্ছেন?
গাজী : না, না, ওই ইন্ডিয়া। আর বেশি আনলে অপরাধ হয়ে গেলো। এরকম তো অনেক আইন আছে। যে এই কাজ এই পর্যন্ত করলে অপরাধ এর কম হলে অপরাধ না। তো আইন বলে দিয়েছে…
রাইসু : তাই অপরাধ?
গাজী : তাই অপরাধ। এই হিসেবে বলা যায়, যদি আইন কিছু না বলতো তো অপরাধ থাকতো না।
রাইসু : তার মানে আমরা যদি অপরাধী হই, এর কারণ হচ্ছে আইন।
গাজী : এটা হলো একটা কথা। এটার উল্টো আরেকটা কথা আছে। সেটা হলো, দেশের মানুষ যখন একটি বিশেষ কর্মকে খারাপ মনে করতে শুরু করে তখন দেশের প্রতিনিধিরা মিলে সেই খারাপটাই অপরাধ বলে চিহ্নিত করে। সেই জন্যই পৃথিবীর সব জায়গায়ই চুরি করা অপরাধ। পৃথিবীর সব জায়গায় প্রতারণা করা অপরাধ। পৃথিবীর সব জায়গায় শঠতা করা অপরাধ। আইন করেছে এরকমভাবে কারণ জনগণের ধারণায় এটা অপরাধ।
রাইসু : আইনের উদ্ভবের কারণ কি?
গাজী : আইনের উদ্ভব হচ্ছে দেশে বিশৃঙ্খলা নিরসন করবার জন্য। ধরো একটি মেয়েকে ৫টি ছেলে বিয়ে করতে চায়, তো ৫টি ছেলেকে দেয়া যাবে না। এর জন্যে দেড় হাজার বছর আগে একটা আইন তারা করলো। আইনটার নাম বিবাহ আইন। ওই মেয়েটার যার দিকে ঝোক আছে তার সাথে তার বিয়ে দিয়ে দিলো! ফলে কী হলো, আর ৪টা ছেলে তার দিকে তাকাতে পারবে না। ওই বিয়ের দলিলটা নিয়ে সে যেখানেই যাক, কাঠমান্ডু যাক আর কামসচাটকা যাক আর অস্ট্রেলিয়া যাক ওই কাগজটা দেখালে তাদের এক জায়গায় থাকতে দেবে, একত্রে খেতে দেবে, এক গাড়িতে চলতে দেবে। তা হলে আইনের উদ্ভব আমরা দেখছি যেখানে কোনো বিরোধ-বিসম্বাদের সম্ভাবনা ছিলো, সেখানে তা নিরসন করে দিলো–আইন তার একটি সূত্র তৈরি করে। তোমার প্রশ্ন কি শেষ হয়েছে?
রাইসু : অল্প আছে। একটু ক্ষীণ রাজনৈতিক একটা কোশ্চেন করি। সেটা হচ্ছে যে ক্ষমতাসীনদের জন্য কি আলাদা কোনো আইনের ব্যবস্থা করা সম্ভব কিনা দেশে?
গাজী : না।
রাইসু : কারণটা কি? আইন কি সবার জন্যই এক?
গাজী : আইন সবার জন্যই এক এই কথাটা মোটামটিভাবে ঠিক। কথা হচ্ছে যে আইনের দৃষ্টিতে সকলেই সমান। তার মানে এই না যে সকলের জন্যে সমান আইন। এরকম বহু আইন আছে যেটা এক এক সমাজের জন্য প্রযোজ্য।
রাজু : সেক্ষেত্রে আইনের মধ্যে বৈষম্য আছে।
রাইসু : সেই ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনদের জন্য আরো সুযোগ সুবিধামূলক আইন আমরা তৈরি করতে পারি কিনা।
গাজী : পারে না, পারা উচিৎ না। কিন্তু মাঝে মাঝে করে ফেলে। যেমন ধরে এবারে শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানি করলো তারা নিজেরা নিজেরা।
রাইসু : কারা করলো, ক্ষমতাসীনরা?
গাজী : ক্ষমতাসীনরা করলো।
রাইসু : এটা কি সমাজের জন্য পজেটিভ আপনি মনে করেন?
গাজী : সমাজের জন্যে কি?
রাইসু : সমাজের জন্যে পজিটিভ কিনা? ক্ষমতাসীনরা যদি কোনো সহজ আইনের সুবিধা পান তাহলে তাতে করে দেশের অর্থনৈতিক বা সামাজিক কোনো উপকার সাধিত হয় কিনা?
গাজী : কথা হল তারা যাতে করতে না পারে তার ব্যবস্থা আছে। ব্যাপারটা বোঝা। আমার দেশেরর আইন আমি তৈরি করবো, যেহেতু বাংলাদেশের বারো কোটি মানুষ এক জায়গায় বসে একটা আইন তৈরি করতে পারে না সেইজন্য সারা সভ্য জগৎ একটা কায়দা বের করেছে, সেটা হলো যে ৫ হাজার মানুষ দিয়ে একটি কন্সটিটিউন্সি তৈরি করে নির্বাচনী এলাকা তৈরি করে একজনকে তার এমপি বানিয়ে দেয়া হলো। সেই এমপি এসে আইন তৈরি করে। আমার যে অধিকার ছিলো সেটি আমি এমপি সাহেবকে দিয়ে দিই। অন্তত সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে যদি তাকে আমি দিই, তা হলে এই আশ্বাস আমি গ্রহণ করতে পারি যে আইনটা আমি তৈরি করছি। কিন্তু কথা হলো যে মুহূর্তে এমপি হয়ে গেলো সে মুহূর্তে তো সে মাসুম হয়ে যায় না, পয়গম্বর হয়ে যায় না।
রাইসু : তার মানে পয়গম্বর হলে আলাদা আইন তৈরি করা যেতো?
গাজী : হ্যাঁ, তা তো যেতোই। তারা তো অন্যায় করবে না– এইটা আমাদের ধারণা।
রাইসু : কিন্তু আইস কি তাদের রেয়াত দেয় কিনা?
গাজী : না, তুমি একটা কথা শেষ করতে দিচ্ছো না। অনেক কথা বলবার আছে।
রাইসু : হ্যাঁ বলেন।
রাজু : তো এমপিরা আইন বা পয়গম্বর না।
গাজী : না আইন বা পয়গম্বর না। সেই জন্য সারা পৃথিবীতে আরেকটা বিধান আছে ওর সঙ্গে। সেটার নাম সংবিধান। আমাদের বাংলাদেশের সংবিধানের ৩য় খন্ডে ২৬ থেকে ৪৭ অনুচ্ছেদের মধ্যে বিশেষ বিশেষ কথা বলে দেযা হয়েছে, মৌলিক অধিকারের কথা। সেই মৌলিক অধিকার ভঙ্গ করে কেউ যদি আইন তৈরি করে সেই আইন বাতিল গণ্য হয়। এই ব্যবস্থাটা রাখা হয়েছে। যেমন ধরো আজকে যদি পার্লামেন্ট আইন করে, যে-িব্যক্তি বিএনপি সর্রের বিরুদ্ধে কথা বলিবে তাহাকে ৭ দিন জেল দেওয়া হইবে, এই আইনটা হবে না। কারণ এটা ফান্ডামেন্টাল রাইট যেটা ৩৯ অনুচ্ছেদ, এই ৩৯ অনুচ্ছেদকে ভঙ্গ করছে। সুতরাং এটা হবে না।
“যখন ধনী এবং দরিদ্রের মধ্যে মামলা হয় তখন দরিদ্র নিঃশেষ হয়ে যায়। আর দরিদ্র এবং দরিদ্রের মধ্যে যখন মামলা হয় তখন দু’জনই নিঃশেষ হয়ে যায়। আর ধনী এবং ধনীর মধ্যে যখন মামলা হয় তখন আইন নিঃশেষ হয়ে যায়।”
রাইসু : আমরা যারা আইন জানি না তাদেরকে আইন অবহিত করাবার দায়িত্ব কার? যে-আইন জানালাম না সে-আইনের জন্য আমরা শাস্তি পাবো কেন?
গাজী : এটাই হচ্ছে খুব কঠিন ব্যাপার। এবং বহু জায়গায় বহু বইতে এটা লিখেছি। বিষয়টা হচ্ছে এই : আইন না জানলে সে আইনের বিপদ থেকে মুক্তি পাবে না। অর্থাৎ তুমি আইন জানো না সেই কথা বললেও আইনের বিপদ থেকে তোমার রেহাই নেই। এটা সারা পৃথিবীর একটি আইনের সূত্র। দি ইগনোরেন্স অব দি ল ইজ নো এক্সকিউস । এখন কথা হচ্ছে এই যে, বাংলাদেশে যত আইন আছে ৫০০ পৃষ্ঠায় রয়াল সাইজের বইতে ৫০ ভল্যুম লাগবে তা প্রকাশ করতে । তা হলে বোঝো কী বিরাট আকারের আইন! তো, এই বিরাট আকারের আইন সকলের পক্ষে জানা সম্ভব নয়। সেই জন্যেই তো লইয়ারের প্রয়োজন পড়ে। আরো কথা হচ্ছে যে, যে যে-এলাকায় কাজ করে সেই এলাকার আইন তার জানা হয়ে যায়, তাতে কাজ অনেকটা চলে যায়। যেমন যারা বন বিভাগে কাজ করে তারা বন আইন জানে। যারা মৎস্য বিভাগে কাজ করে তারা মৎস্য আইন জানে। যারা পুলিশ তারা ফৌজদারী আইন জানে। এরকম ভাবে বিভাগীয় ভাবে অনেক আইন আছে। যারা ট্রেডমার্কে কাজ করে তারা ট্রেডমার্ক ল জানে। তো এই রকম কিছু ভাগ ভাগ আছে, যারা ট্যাক্স-এ কাজ করে ট্যাক্সের ব্যাপারে জানে। এরকম ভাগ ভাগ আছে। আইন না জানা যে মুক্তি পাওয়ার অজুহাত নয় এটা সর্বদেশে স্বীকৃত। তবে অন্য দেশে একটি সুযোগ আছে যেটা আমাদের দেশে নেই।
রাজু : যেমন?
গাজী : আমাদের দেশে হচ্ছে যে-আইন যখনই পাশ হয়, তখন গেজেট হয়ে যায়। ধরে নেয়া হয় তোমরা গেজেটটা নিয়ে পড়ে দেখো। এখন এই গেজেট কেউ কিনে নিয়ে পড়ে না। অন্য কিছু কিছু দেশে এই নিয়ম আছে যে, অল্প দামে হয়তে আমাদের দেশের ৬ আনা ৮ আনা ১০ আনা, ৫০ পয়সা ৮০ পয়সা ১ টাকা এরকম দামে শস্তা কাগজে ছেপে খুব প্রত্যন্ত অঞ্চলে যে সমস্ত স্টল আছে সেখানে সপ্লাই দেয়া হয়। এবং সেখানে থেকে লোক সহজেই এই আইনগুলো গ্রহণ করতে পারে। আমাদের দেশে সে ব্যবস্থা নেই তো, আমার কথা হলো যে এই ব্যবস্থা থাকা উচিৎ। যখন যে আইন পাশ হয় সেটি সংবাদপত্রের মাধ্যমে পত্রপত্রিকার মাধ্যমে লোককে জানিয়ে দেয়া দরকার। এবং থানা পর্যায়ে এর কপি পাঠালে লোকে জানতে পারে।
রাইসু : “আইনের প্রতি শ্রদ্ধা” ব্যাপারটা কী? কেউ ইচ্ছা করলে ইহকালে আইনের আওতার বাইরে থাকতে পারে কিনা?
গাজী : আইন কার্যকর করার দায়িত্ব যাদের আছে তারা যদি সজাগ হয়, তাদের কাছে যদি ধরা পড়ে তাহলে পারবে না।
রাইসু : আর “আইনের প্রতি শ্রদ্ধা”?
গাজী : “আইনের প্রতি শ্রদ্ধা” মানে, আইন যে আমরা মানবো এই মানাটাতেই আমাদের সকলের মঙ্গল।
রাইসু : এইটা তো মান্য, শ্রদ্ধা কেন হবে?
গাজী : শ্রদ্ধা মানেই তো, শ্রদ্ধা মানে হচ্ছে তাকে মানা।
রাইসু : তার মানে আইন হচ্ছে মাননীয়?
গাজী : আইন মাননীয়। আইনের প্রতি শ্রদ্ধা থাকতে হবে। আইনের প্রতি শ্রদ্ধা না থাকলে দেশের শৃঙ্খলা নষ্ট হয়ে যাবে।
রাইসু : এইটা তো মান্য, শ্রদ্ধা কেন হবে?
গাজী : শ্রদ্ধা মানেই তো, শ্রদ্ধা মানে হচ্ছে তাকে মানা।
রাইসু : তার মানে আইন হচ্ছে মাননীয়?
গাজী : আইন মাননীয়। আইনের প্রতি শ্রদ্ধা থাকতে হবে। আইনের প্রতি শ্রদ্ধা না থাকলে দেশের শৃঙ্খলা নষ্ট হয়ে যাবে। এবং সব সময় আইন যে ভঙ্গ করছে তাকে ধরে শাস্তি দেয়া যাবে না। অত পুলিশও নাই, তদন্তকারীও নাই, সাক্ষ্যপ্রমাণও নাই। সেই করণে মানুষের মনের মধ্যে একটি অন্তর্নিহিত শ্রদ্ধাবোধ যদি জাগানো যায় যে না আমি এই কাজটি করবো না। আমাদের দেশে আমরা দেখেছি রাত সাড়ে আটটার পরে যদি ট্রাফিক সিগন্যালে পুলিশ না থাকে তো গাড়ি চালিয়ে চলে যায়। কিন্তু বিদেশে রাত তিনটার সময়ও লালবাতি জ্বললে গাড়িগুলো থেমে যায়।
রাইসু : ঐখানে তাদের তো আইনটা নীতি হয়ে গেছে।
গাজী : আইনটা নীতি হচ্ছে। আইনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জন্মেছে তাদের। আমাদের দেশে যদি এরকম শ্রদ্ধাবোধ না জাগানো যায় তাহলে কিন্তু দেশটাকে টেকানো যাবে না। তো, সেইজন্যেই আইনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জাগাতে হবে। তবে আইন স্ট্যাটিক না। আইন থাকতে হবে, তবে যে-আইন আছে সেটাই থাকতে হবে এর কোনো যুক্তি নেই। একটি চমৎকার কথা আছে : যখন ধনী এবং দরিদ্রের মধ্যে মামলা হয় তখন দরিদ্র নিঃশেষ হয়ে যায়। আর দরিদ্র এবং দরিদ্রের মধ্যে যখন মামলা হয় তখন দু’জনই নিঃশেষ হয়ে যায়। আর ধনী এবং ধনীর মধ্যে যখন মামলা হয় তখন আইন নিঃশেষ হয়ে যায়।
রাজু : বাহ ! চমৎকার !
গাজী : সুতরাং আসল কথা হচ্ছে আইন থাকতে হবে, আইনের প্রয়োগকে স্বার্থক করতে হবে। ল কমিশন করে আইন প্রতিদিন প্রতিনিয়ত নবায়ন করতে হবে। এটিই হচ্ছে আইনের কাজ।
রাইসু : আচ্ছা অন্য প্রশ্ন, মিথ্যা সাক্ষ্য তো আইনকে এক্সপ্লয়েট করতে পারে, এই এক্সপ্লয়টেশনের বিরুদ্ধে আইনের লোকদের কি করার আছে?
গাজী : ব্যাপার হচ্ছে যে-লোক মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়, ধরতে না পারলে কিছুই করবার নেই।
রাইসু : সেক্ষেত্রে এটা আইনের একটা দুর্বলতা।
গাজী : এটা আইনের দুর্বলতা না, প্রয়োগের দুর্বলতা।
রাইসু : আরেকটা জিনিস গাজী ভাই, আইনের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা হয়তো আছে, আইনের লোকের প্রতি শ্রদ্ধা কম। এটার কারণ কি? উকিলদের সাধারণ মানুষ বলে ‘ডাকাত’।
গাজী : কিন্তু উকিলদের যে কাজটা সেটা কিন্তু নোবল। কিন্তু উকিলরা তাদের প্রফেশনকে অনেক সময় খারাপ করে ফেলে। কিন্তু উকিল না থাকলে পৃথিবী কিন্তু চলবে না। লইয়ারদের প্রয়োজনীয়তা সবসময় থাকবে। লইয়ারের বিরুদ্ধে যে কথাটা সবসময় বলা হয় তা হলো এই…
রাইসু : যে, ওঁনারা ‘রাক্ষস’?
গাজী : না, দুটো কথা। একটা হলো যে তারা ফি নেন। এবং ফি নিয়ে মিথ্যাকে সত্য বলেন। এ কথাটা ঠিক নয়। খারাপ মানুষ তো সব প্রফেশনেই আছেন। আর ফি তো তাদের নিতেই হবে। তা না হলে কি খেয়ে বাঁচবে তারা?
রাইসু : কিন্তু বেশি নেয়। এটা হচ্ছে কথা।
গাজী : বেশি নেয়, বেশি নেয়। এটা মনে হয়। তোমার প্রশ্ন শেষ?
রাইসু : না, দুইটা আছে। সেটা হলো আপনারা “আইনের লোক” যারা আছেন তাদের কি কোনো প্রকার মানসিক কিংবা অস্বাভাবিক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয় কিনা মানুষ বা সমাজের ওপর?
গাজী : আমাদের একটা দায়িত্ব আছে। সে দায়িত্ব হচ্ছে এই যে, বিচারক এবং আইনজীবী যারা তাদের কাজ হলো সত্য নির্ণয় করা। এখন ধরো এক পক্ষ একটি কথা বলছে, আরেক পক্ষ তার বিপরীত কথা বলছে। একপক্ষ সাক্ষ্যপ্রমাণ দিয়ে তার কথা প্রমাণ করবার চেষ্টা করছে, আরেক পক্ষ সাক্ষ্যপ্রমাণ দিয়ে তার কথা বিচার করবার চেষ্টা করছে। আইনজীবীর কাজ হলো যার পক্ষে তিনি দাঁড়িয়েছেন তার পক্ষের সব কথা সুন্দরভাবে বহুভাবে আদালতের সামনে উপস্থাপন করা। এবং আদালত হচ্ছে নিরপেক্ষ একটি প্রতিষ্ঠান। নিরপেক্ষভাবে সকলের কথা শুনে সত্য নির্ণয় করা–এটিই তার দায়িত্ব।
রাইসু : আমি জানতে চাচ্ছিলাম সাইকোলজিক্যাল কোনো সমস্যা আপনাদের হয় কিনা? আইনের সঙ্গে থাকতে থাকতে?
গাজী : তা হয় না।
রাইসু : হয় না?
গাজী : আমার হয় না।
রাইসু : কারো কারো হয়?
রাজু : কোনো আইনজ্ঞের এরকম কোনো কেইস জানেন কিনা?
গাজী : নাহ। আমি ফাঁসিও দিয়েছি আমার কোর্টে।
রাইসু : আপনার ব্যাপারে শোনা যায়, আপনি কিশোরদেরও ফাঁসির পক্ষে; কিশোর অপরাধীদের?
গাজী : আমি ফাঁসির পক্ষে কিশোরদের নয়। কিশোরদের ফাঁসি হতেই পারে না।
রাইসু : মানে আপনি পূর্ণবয়স্ক মানবের ফাঁসির পক্ষে? এই জন্য কি আপনাকে নিন্দা করা যাবে?
গাজী : যারা ফাঁসির বিপক্ষে তারা বলতে পারে।
রাইসু : ধরুন আমি ফাঁসির বিপক্ষে, আপনি যে ফাঁসি চাচ্ছেন এই জন্য আমি যদি আপনার নিন্দা করি সেটা আইনের বিরুদ্ধে যাবে কিনা?
গাজী : না না। এ তো দিনরাত হচ্ছে। ধরো ফাঁসির কথা নিয়ে–ডেথ সেনটেন্স–মৃত্যূদন্ড নিয়ে সারা পৃথিবীতে আলোড়ন চলছে। এবং এর বেশি প্রবক্তা হলো সুইডেন। ওরা চারবার ইউনাইটেড নেশনস অর্গানাইজেশনে এই প্রস্তার তুলেছে যে সারা পৃথিবী থেকে মৃত্যূদন্ড তুলে দেয়া হোক। সব বার তারা ফেল করেছে। পাশ করাতে পারে নাই।
রাইসু : আপনি কেন ফাঁসির পক্ষে?
গাজী : আমি এর পক্ষে এই জন্যে, ধরো তোমার বাঁ তাতে ক্যান্সার হয়েছে। এখন ডাক্তার বললো যে এটা কেটে ফেলো, তা না হলে সারা শরীরে ক্যান্সার ঢুকে যাবে। তখন তো কেটেই ফেলতে হবে। সমাজে এরকম দু’চারজন মানুষ জন্মগ্রহণ করে জন্মসূত্রে যারা পাপী। তাদের কেটে ফেলা ছাড়া উপায়ই নাই। সমগ্র জাতিকে বাঁচাবার জন্যে সভ্য সমাজকে বাঁচাবার জন্যে ওই জন্মপাপীদের শেষ করে দিতে হবে।
রাইসু : তাদেরকে আটকে রাখলেই তো যথেষ্ট, কারাগারে?
গাজী : যাদের মৃত্যূদন্ড হয় না তাদের তো সেলে আটকে রাখাই হয়।
রাইসু : না, যাদের মৃত্যূদন্ড দেয়া দরকার তাদেরকে কারাগারে আটকে রাখাটাই কি যথেষ্ট নয়?
গাজী : সারাজীবন কারাগারে আটকে রাখাটা তো আরো বেশি খারাপ।
রাইসু : যাদের প্রাণ আমরা দিতে পারি না তাদের প্রাণ আমরা কিভাবে হরণ করবো?
গাজী : আমরা প্রাণ হরণ করবো অন্যদের রক্ষা করবার জন্যে।
রাইসু : ফাঁসিকে কি আমরা “রাষ্টীয় হত্যা” বলতে পারি কিনা? ফাঁসি কার্যকর করাকে?
গাজী : তা বলতে পারো। তবে কথা হবে এইরকম যে, যখন কোনো মানুষ তোমাকে খুন করতে আসে তুমি কিন্তু তাকে খুন করতে পারো।
রাজু : আত্মরক্ষার্থে?
গাজী : আত্মরক্ষার্থে। এখন তুমি যদি তাকে খুন না করো বা একজনকে খুন করে ফেলেছ তখন সমস্ত সমাজ চায় ওই লোকেরও শাস্তি হওয়া উচিত। রাষ্ট্র সেই শাস্তির ব্যবস্থা করে।
রাজু : কিন্তু গাজী ভাই, এই জিনিসটা কিভাবে বুঝবো, যেমন ধরেন যে, আমাকে খুন করতে আসছে এটা দেখে আমি আত্মরক্ষার জন্যে তাকে খুন করে ফেললাম। ঠিক আছে, আমি যখন খুন করে ফেললাম সে কিন্তু আর ডিফেন্ড করতে পারছে না যে এটা সত্যি কিনা। সত্যটা এই যে, সে খুন করতে এসে খুন হয়ে গেছে। এটা কিভাবে প্রমাণ হবে?
গাজী : প্রমাণের অনেক ব্যাপার আছে। এটা সাক্ষ্য আইনের ধারা। নানান কায়দায় প্রমাণ করা যায়। এটা কষ্ট হয়, কিন্তু অবস্থাঘটিত প্রমাণে প্রমাণ করা যায়।
রাইসু : কিন্তু আমার মনে হয় সবসময় এটা সম্ভব না।
গাজী : সম্ভব না। সম্ভব হবে না। আচ্ছা তোমার প্রশ্ন শেষ?
রাজু : না গাজী ভাই, সম্ভব না। তার মানে সাক্ষীহীনতা কিংবা শুধু অনুমানের ওপর আপনি একজন মানুষকে খুন করে ফেলতে পারেন তাহলে?
গাজী : এই জন্যেই তো, যদি কেউ খুন করে তার সাক্ষ্য প্রমাণ দিতে হয়। এটা আরেকটা এরিয়ার ব্যাপার। সেটা তুমি যদি প্রশ্ন করো খানিকক্ষণ পরে বলবো, তো এই প্রশ্নগুলি শেষ করো।
রাইসু : শেষ প্রশ্ন, আপনি চোখ বন্ধ করে কথা কেন বলেন?
গাজী : ওটা হলো মনঃসংযোগ।
বিডিনিউজ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন