প্রয়াত কবি আল মাহমুদের এই সাক্ষাৎকারটি গৃহীত হয়েছিল বাংলা ১৪০৩ সনে, তার মগবাজারের বাসায়।
সাক্ষাৎকারটি এখনও গ্রন্থভুক্ত হয়নি। গুরুত্বপূর্ণ এই সাক্ষাৎকারটি পাঠকদের জন্য পুনর্মুদ্রণ করা হলো।
সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন রাজু আলাউদ্দিন ও ব্রাত্য রাইসু
ব্রাত্য রাইসু : বলেন।
আল মাহমুদ : কি বলবো ?
রাইসু : কবিজীবন সম্পর্কে বলতে পারেন। কবি-বন্ধুদের নিয়ে।
মাহমুদ : যেমন হয়ে তাকে, খুব দুঃখপূর্ণ জীবন। একটা দরিদ্র লোকের জীবন যেমন হয়।
রাজু আলাউদ্দিন : এখনও কি আপনি নিজেকে দরিদ্র মনে করেন ?
মাহমুদ : না, সেটা অবশ্য ঠিক, আমি এখন আর মনে করি না। নিজের পরিশ্রমে আমি খানিকটা স্বাবলম্বী। কিন্তু আমার কৈশোরকালটা তো– বিভিন্ন বইয়ে আছে, লিখেছি আমি– সেটা যে এমন সুখকর কিছু একটা ছিলো সেটা নয়। কবির মতোও নয়। এই কবিতা লিখবো এরকম চিন্তা নিয়ে কিন্তু জীবন শুরু করিনি। আমি পড়তে পড়তে হঠাৎ লেখার দিকে–
রাইসু : মানে আপনার লেখাকে একটা দুর্ঘটনাই বলা যায় ?
মাহমুদ : ঠিক দুর্ঘটনা আমি বলবো না। পরে প্রস্তুতি নিয়েই আমি এসেছি। যেটা হলো, কৈশোরকালটা আমার, তখনকার বিচারে বাজে বই পড়ে কাটানো।
রাইসু : পর্নোগ্রাফি ?
মাহমুদ : না। ঐ বিভিন্ন উপন্যাস। রহস্য রোমাঞ্চ সিরিজের।
রাজু : কাদের লেখা ছিলো এগুলো ?
মাহমুদ : এখন তো আর মনে করতে পারছি না। সে সময়ের লেখা, সেকি রোমাঞ্চময় লেখা। ‘প্রহেলিকা সিরিজ’।
রাইসু : আপনার কবিতা মোটামুটি এ সবের মাধ্যমেই তৈরি হয়েছে ?
মাহমুদ : আমার ভাষাটা তৈরি হয়েছে প্রকৃতপক্ষে শুধু সুসাহিত্য পড়েই তৈরি হয়েছে এটা ঠিক না। অনেক কু-সাহিত্য পড়েও হয়েছে। সবরকম সাহিত্যের মধ্যদিয়ে এসেছি এবং সবসময় কবিতা ভালোবেসেছি। কবিতা পড়তে একটা আলাদা আনন্দ পেয়েছি।
রাইসু : আপনি রাজনীতি আগে শুরু করেন, নাকি কবিতা ?
মাহমুদ : আমি কখনো রাজনীতি করি নি।
রাইসু : তো আপনি বামপন্থী রাজনীতি করতেন বলে বলা হয় ?
রাজু : জাসদের রাজনীতি ?
মাহমুদ : না, এটা বলা হয় ঠিকই, আমি কিন্তু প্রফেশনাল জার্নালিস্ট হিসেবে কাজ শুরু করি এবং যখন আমি দৈনিক গণকণ্ঠের সম্পাদক তখনও আমি, হ্যাঁ তখন হয়তো মার্ক্সবাদ দ্বারা খুবই আপ্লুত ছিলাম। কিন্তু, ডাইরেক্ট পলিটিক্সে আমি কখনো অংশগ্রহণ করিনি।
রাইসু : মার্ক্সবাদ দিয়ে কি আপনি এখন আর আপ্লুত নন ?
মাহমুদ : না।
রাইসু : কেন ?
মাহমুদ : আমি মনে করি যে মার্ক্সবাদ ব্যর্থ হয়েছে। মানবসমাজের কল্যাণে, সমসমাজ গঠনের ফর্মুলা, যে ফর্মুলা কার্ল মার্ক্স দিয়েছেন তা ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে।
মশিউল আলম : প্রথম দিকে মার্ক্সবাদের কোন জিনিসটা আপনাকে সবচে আকর্ষণ করেছিলো ?
মাহমুদ : সব তরুণদেরই যেটা আকর্ষণ করে। সেটা হলো যে ‘কম্যুনিস্ট ইশতেহার’ পড়ে মানবসমাজ যে এরকম হতে পার– ‘কম্যুনিস্ট ইশতেহার’কে আমি খুব বাস্তবসম্মত একটি বিবৃতি বলে ধরে নিয়েছিলাম। কিন্তু পরে আমি বুঝতে পেরেছি এটিও একটি ইউটোপিয়া।
রাইসু : এখন আপনি কোন পর্যায়ে আছেন ?
মাহমুদ : আমি মনে করি যে মানবমঙ্গল ইসলামেই সম্ভব।
রাইসু : এটাও যে একটা ইউটোপিয়া না আপনি কিভাবে বুঝবেন ?
মাহমুদ : এটা এজন্য যে, এটা মানুষের দ্বারা তৈরি কোনো ধর্ম নয়। এটা হলো আল্লাহর নির্দেশিত ধর্ম এবং পবিত্র কোরআন যে সময় অবতীর্ণ হয়েছে তখন হলো সামন্ততন্ত্রের একেবারে উজ্জ্বল সময়। এ সময়ে ধনতন্ত্রেরও স্ফূরণ হচ্ছে ইহুদীদের হাতে। এই সময়ে ইসলাম এসেছে। ইসলামের কোরআন পাঠ, প্রাথমিক পাঠেই একটা লোক তার জায়গা থেকে নড়ে যাবে। যদি সে বোঝে। যদি তার কনটেমপোরারি, সেই সময়কার ইতিহাস, সমাজ, অন্যান্য পরিস্থিতি, ধর্ম সম্বন্ধে পরিচ্ছন্ন জ্ঞান থাকে, মুহূর্তের মধ্যে সে অভিভূত হয়ে যাবে যে এগুলি ইঙ্গিতময় ভাষায় বলা হচ্ছে, কিন্তু প্রত্যেকটির একটি বাস্তবনির্দেশিত পথনির্দেশ রয়েছে। আমি মনে করি যে পৃথিবীতে এখন সামাজ্যবাদ গত হয়েছে, এখন পুঁজিবাদের যুগ। বিশ্ববিচরণশীল পুঁজিতে আমরা এখন। ধনতন্ত্রের এটা হয়তো একেবারে অন্তিম একটা সময়। ধনতন্ত্রকে পরাজিত করে একটা মঙ্গলময়, কল্যাণময় মানবসমাজ করতে পারে এরকম যদি কোনো নীতি থাকে, তাহলে সেটা আমি মনে করি পবিত্র কোরআন। এটা আমি বিশ্বাস করি। এতে আমার ঈমান রয়েছে। তবে এর জন্য যে ঠিক আমি রাজনৈতিক সংগ্রাম করি, তা আমি করি না। কারণ আমার সংগ্রামটা হলো–
রাইসু : ‘সংগ্রাম’ পত্রিকায় ?
মাহমুদ : এটা ঠিক না। আমি ‘সংগ্রাম’ পত্রিকায়ই লিখি এমন কোনো কথা না। আমি এদেশের অনেক পত্রিকাতেই লিখি। যেহেতু আমি একজন রিটায়ার্ড পারসন, দশটা কাগজে লিখে খাই।
রাইসু : বামপন্থা থেকে আপনি হঠাৎ করে ঝুঁকলেন কিভাবে ইসলামের দিকে ?
মাহমুদ : হঠাৎ করে ঝুঁকি নাই। আমার বই যেভাবে বেড়ে উঠিতে আছে। আমার কৈশোরকালে আমি একটা পাঠাগারে কিছু লোকের সঙ্গে পরিচিত হই। ওরা সবাই ছিলেন কম্যুনিস্টপার্টির লোক। এরা একটা পাঠাগার চালাতেন। লালমোহন স্মৃতি পাঠাগার। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। সেই পাঠাগারে গিয়ে আমি জগৎ এবং জীবন সম্পর্কে এমন বিচিত্র কিছু বইয়ের সন্ধান পাই এবং কম্যুনিস্ট মতবাদ সম্পর্কে ক্লাস করে এরা কম্যুনিস্ট অর্থনীতি বোঝাতে চেষ্টা করেছে। আমি বুঝতে পেরেছি এবং তাদের সাথে ঐকান্তিকতা বোধ করেছি। শুধু তাই না, আর একটা জিনিস তাদের মধ্যে দেখেছি, সেটা হলো আত্মত্যাগ। তারা নিজকে কিভাবে উৎসর্গ করে দিয়েছে কম্যুনিস্ট সমাজব্যবস্থা গড়বার জন্যে। অধিকাংশ লোকই ধ্বংস হয়ে গেছে পরিবারের। এসব দেখে আমার মনে একটা গভীর আকর্ষণ সৃষ্টি হয়। কিন্তু এখন মনে হচেছ যে কী ভুল পথেই না এই এতগুলো জীবন ধ্বংস হয়েছে।
রাইসু : এটা কি সামজতন্ত্রের ব্যর্থতার কারণেই হয়েছে বলে আপনার মনে হয় ?
মাহমুদ : নিশ্চয়ই। সমাজতন্ত্রের ব্যর্থতার কারণেই সেটা হয়েছে। রাশিয়াতে দু’কোটি মানুষকে মেরে ফেলেছে যোশেফ স্টালিন।
রাইসু : এটা কি সমাজতন্ত্রের ব্যর্থতা ?
মাহমুদ : নিশ্চয়ই। সমাজতন্ত্র যে ক’জন বড় মানুষ তৈরি করেছিলো তাদের মধ্যে নিশ্চয়ই স্টালিনও একজন ছিলেন। এখন দেখা যাচ্ছে তিনি একজন রুশ কসাই ছিলেন। আর কিছুই না।
রাজু : কিন্তু হিটলারের হাত থেকে যে এতগুলো মানুষকে, গোটা রাশিয়ান জনগোষ্ঠীকে, রক্ষা করলেন এটা তো কসাইয়ের কাজ না ?
মাহমুদ : হিটলার কে এবং হিটলার কেন বিশ্বজয়ের পরিকল্পনা করেছিলো সেটা তাহলে জেনে নিতে হয়।
রাইসু : বলেন সেটা কী ?
মাহমুদ : এই অল্প সময়ের মধ্যে আমি সেটা বলতে পারবো না। বহু জায়গায় বলেছি। আমার প্রবন্ধ আছে ‘কবির আত্মবিশ্বাস’ প্রবন্ধটা পড়ে দেখতে পারেন।
রাজু : আপনি নিজে একটু বলেন।
মাহমুদ : না, আমি এর কার্যকারণ পুরো ব্যাখ্যা করেছি। মনে রাখতে হবে যে হিটলার সারা পৃথিবী থেকে ইহুদী নিকেশ করে ফেলতে চেয়েছিলেন।
রাইসু : আপনি কি এটার পক্ষে ?
মাহমুদ : আমি এর ঘোর বিপক্ষে। কিন্তু কেন করতে চেয়েছিলেন সে কার্যকারণগুলি জানি। জানতে হবে যে ইহুদীরা সারা ইউরোপকে ঋণের জালে বেঁধে ফেলেছিলো এবং এটা থেকে বেরুবার কোনো উপায় ছিলো না। এর হাত থেকে মুক্তির জন্যে হিটলার এটা চেয়েছিলেন। যেটা কখনো সম্ভবপর ছিলো না, যে, একটা পুরো মানবগোষ্ঠীকে উচ্ছেদ করে দিয়ে– এটা অমানবিক। না, সেকথা বললে তো আমরা শেকসপীয়রের কবিতায় দেখি শাইলক দি জু– সবসময় ইউরোপ জু’দের কী দৃষ্টিতে দেখেছে, সেটা দেখলে তো বিস্ময়ে অভিভূত হতে হয়। সবসময়ে দেখিয়েছে এরা মানুষের রক্তশোষক, একখণ্ড মাংস চায় মুখ থেকে।
রাইসু : তাহলে তো বলতে হয় হিটলার মোটামুটি বেশ ‘মানবিক’ই একটা কাজ করেছে ইউরোপীয়দের ঋণের বোঝা হালকা করে দিয়ে ?
মাহমুদ : এটা নিশ্চয়ই নয়। হিটলার কেন মানবিক কাজ করেছেন? হিটলার এইভাবে এটা না করলেও পারতেন। ইহুদী মেরে ইহুদীদের ঋণের বোঝা হালকা করা এটা আমি বিশ্বাস করি না। এটা কখনো সম্ভবপর নয়, কেউ এটা কামনা করে না।
রাইসু : এখন ইসলামপন্থী কোনো রাজনৈতিক দলে আছেন ?
মাহমুদ : না, আমি, কোনো রাজনৈতিক দলের লোক নাই।
রাইসু : জামাতে ইসলামীর লোক বলা হয় আপনাকে ?
মাহমুদ : লোকজন কিভাবে কী বলে। তারা হয়তো জামাতে ইসলামী সম্পর্কে ভালো করে জানে না বলেই। এবং জামাতে ইসলামীতে যে কোনো লোক ইচ্ছে করলেই–
রাইসু : প্রবেশ করতে পারে না।
মাহমুদ : প্রবেশ করতে পারে না সেটা আমি বলছি না। কিন্তু তাদের কতগুলা পদ্ধতি আছে। আমি কবি মানুষ। এর বেশি কিছু নই।
রাইসু : মানে কবি হওয়াটাই যথেষ্ট নয় জামাতে ইসলামীতে প্রবেশের জন্য ?
মাহমুদ : না আমি তো একটা রাজনৈতি দলে..
রাইসু : এই রাজনৈতিক দলের সাথে কি আপনার কোন সংযোগ নাই ?
মাহমুদ : থাকবে না কেন? সংযোগ বলতে আমি যখন ইসলামপন্থী, শুধু জামাতে ইসলামের কথা বা বলছেন কেন? এদেশের যতগুলো রাজনৈতিক দল আছে সবাই আমাকে মোটামুটি ভালোবাসে। যেহেতু আমি ইসলামের পক্ষের লোক।
রাজু : তার মানে এই যে জামাতে ইসলামীও ইসলামের পক্ষের লোক এবং আপনিও ইসলামের পক্ষের লোক– এই অর্থেই সম্পর্কটা গড়ে উঠেছে ?
মাহমুদ : হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।
রাইসু : বলা হয়, আপনারা ইসলামের পক্ষের লোক না, কিন্তু ইসলামের নাম ধারণ করেছেন আপনি কিংবা জামাতে ইসলামী, এরকম হতে পারে কিনা ?
মাহমুদ : এ ধরনের প্রশ্নের জবাবা দেওয়া তো আমার উচিৎ হনয়। এগুলো হলো তর্কের উদ্দেশে বলা।
মশিউল: আমাদের এখানে নাইনটি ফাইভ পার্সেন্ট লোক মুসলমান। ধর্মভীরু মুসলমান। ইসলামের প্রতি তাদের একটা দুর্বলতা আছে। ইসলামের বিরুদ্ধে অবমাননাকর কথা কেউ সহ্য করে না। সে কারণে সবার রাজনৈতিক সমর্থনটা ইসলামের প্রতি হওার কথা ছিলো। ইসলামী রাজনৈতিক সংগঠনগুলো এখানে সবচে জনপ্রিয় হওয়ার কথা ছিলো, কিন্তু এটা হয় নি। সবচে বৃহৎ রাজনৈতিক দলটি ইসলামী সংগঠন নয়। এটা না হওার কারণ কী বলে আপনার মনে হয় ?
মাহমুদ : এটার জবাবটা হলো, যদি এদেশের লোককে এ সুযোগ দেয়া হয় যে তারা ইসলামী রাষ্ট্র চায়, না অন্য কোনো রাষ্ট চায়…
রাজু : সে সুযোগ দেয়া হল নির্বাচনের মাধ্যমে।
মাহমুদ : না, যদি সুযোগটা দেয়অ হয় তাহলে অধিকাংশ মানুষ ইসলামের পক্ষে রায় দেবে। এটা আমার ধারণা।
রাজু : এই ধারণাটা আপনার কীভাবে গড়ে উঠলো ?
মাহমুদ : গড়ে উঠেছে কারণ আমি জনগণের মধ্যেই অবস্থান করি।
মশিউল : বর্তমান যে ইলেকশন সিস্টেম আপনাদের ইসলামী সংগঠনগুলির অধিকার আছে তাদের কর্মসূচিগুলি জনগণের কাছে দেয়ার। জনগণ মোটামুটি জানে এবং তারা সে অনুযায়ী ভোটকেন্দ্রে ভোট দিতে যায়। তারা, আপনার কথামতো মাক্সিমাম মানুষ ইসলামী শাসনব্যবস্থা চাইতো। দেখা যায় তারা ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারছে না।
মাহমুদ : এটার মানে এই না যে মানুষ সেটা চায় না। মানুষের মধ্যে ইসলামী রাষ্ট কী, ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হলে মানুষের কী কী কল্যাণ এবং সুবিধা হবে এটা রাজনৈতিকভাবে প্রোপাগাণ্ডা এবং ডেমোক্রেটিক সাপোর্ট টেনে আনার জন্য জনগণকে যে ধরনের শিক্ষা দেওয়ার দরকার সেটা কমপ্লিট না। আমাদের দেশে অধিকাংশ লোক ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞ, যদিও মুসলমান। ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থায় সমাজব্যবস্থায় কী হতে পারে এ সম্বন্ধে অজ্ঞ। এটা যদি ঠিকমত জনগণকে বোঝানে যায়, যখন সময় আসবে, তাহলে নিশ্চয়ই ইসলামের দিকে মানুষ আসবে।
রাজু : কিন্তু মাহমুদ ভাই, এটা দেখা গেছে জামাতে ইসলামীর যে সাংগঠনিক প্রক্রিয়া, এদের যে রাজনৈতিক…
মাহমুদ : আমি তো আগেই বলেছি এই প্রশ্ন করা আমাকে বৃথা। কারণ আমি তো রাজনীতিক নাই, আমি কবি মাত্র। জামাতে ইসলামীর সাথে আমার সম্পর্ক হলো যে একটা ইসলামি পার্টি বলে আমি তাদের সমর্থন করি।
রাইসু : তাদের রাজকবি আপনি ?
মাহমুদ : আমি তাদের রাজকবি কিনা সেটা তাদের জিজ্ঞেস করে আপনি দেখতে পারেন। আমি মনে করি সারা মুসলিম বিশ্বেরই একজন কবি আমি। এবং শুধু মুসলমানদের কথাই আমি বলি না, সমস্ত পৃথিবীর মানুষের কথাই আমি কবিতায় বলতে চেষ্টা করি। কিন্তু আমি মনে করি ইসলামি জীবনব্যবস্থা যদি প্রবর্তিত হয় মানবঙ্গল হবে। সবাইকে মুসলমান হতে হবে ইসলামী রাষ্ট্রে–এমন কোনো কথা নেই।
রাজু : কিন্তু আমি বলতে চাচ্ছিলাম যে, জামায়াতে ইসলামীর যে প্রচারকৌশল তা কম্যুনিস্ট পার্টিগুলোর চেয়েও ইফেক্টিভ এবং আধুনিক। কিন্তু তারপরও বেশি মানুষের কাছে তারা পৌঁছাতে পারছে না কেন ?
মাহমুদ : এ দেশে প্রকৃত অর্থে ইসলামি রাষ্ট্র কায়েমের জন্য কেউ তো রাজনীতি করে নি। করেছে কি ?
রাইসু : জামাতে ইসলামী কী করছে তাহলে ?
মাহমুদ : নিশ্চয়ই আমি মনে করি শুধু জামাতে ইসলামী একই করছে না, আরও দল আছে। আপনারা তো কেবল দেখছি জামাতে ইসলামী সম্পর্কেই আমাকে প্রশ্ন করছেন।
রাইসু : আচ্ছা, আপনার যে জীবনপ্রণালী অর্থাৎ আপনি ইসলামি প্রণালী মেইন্টেন করছেন কি না?
মাহমুদ : সম্পূর্ণ হয়তো পারি না। কিন্তু চেষ্টা তো করি।
মশিউল : এইখানে একটা প্রশ্ন আমি করতে চাচ্ছিলাম যে ইসলামী সংগঠনগুলোর জনপ্রিয়তা তত বেশি নয়, মানে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পড়ে না, যদিও হওয়ার কথা ছিলো।
মাহমুদ : হওয়ার কথা ছিলো না। কারণ ইসলামী শিক্ষা ঠিকমত প্রচারিত না হলে মানুষ কেন ইসলামকে সমর্থন করবে ?
রাইসু : সেক্ষেত্রে বৌদ্ধ শিক্ষা প্রচার করা হলে বৌদ্ধরাও তো পাস করে যাবে–এইটা তে ঠিক ?
মাহমুদ : আমি এখনও মনে করি হোয়েন দ্য টাইম কামস্, নানা ধাক্কা খেয়ে এদেশে, নানারকম প্রক্রিয়ার মধ্যে বাস করতে করতে একটা সময় আসবে যখন তারা ইসলামী…
রাইসু : তার মানে ঐ অবস্থায় পৌঁছানোর আগে মানুষের ধাক্কা খাওয়া দরকার ?
মাহমুদ : ধাক্কা খাওয়া বলতে আমি বোঝাচ্ছি যে মানুষের নানারকম প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মানুষ যখন ব্যর্থ হয়ে যাবে তখন তারা…
রাইসু : তাদের ব্যর্থতাটা চান আপনি ?
মাহমুদ : আমি চাই কি চাই না– এটা বড় কথা না তো। এই যে এই দেশে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বড় বড় দলগুলো বিভিন্ন সময় ক্ষমতায় এসেছে, আবার ক্ষমতা থেকে সরে যাচ্ছে, আবার ক্ষতায় আসবে, এই প্রক্রিয়া চলতে থাকবে। তার মধ্যে পাশাপাশি ইসলাম থাকবে, ইসলামী দলগুলোও থাকবে। আমি শুধু জামায়াতে ইসলামীর কথাই বরছি না, ইসলামী দলগুলোও থাকবে।
রাইসু : এখন তো ইসলামী দল বলতে আর আলদা কিছু নাই, বিএনপিও ইসলামী দল, আওয়ামী লীগও ইসলামী দল?
মাহমুদ : তাই নাকি? সেটা তো আমার জানা ছিলো না।
রাইসু : কেন না? এরা তো বিসমিল্লাহ দিয়েই শুরু করছে ?
মশিউল : ইসলামী দলগুলো সবচে বেশি জনপ্রিয়তা না পাওয়ার পেছনে কারণ কি এই যে ৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের পক্ষে ভূমিকাটা রাখে নাই ?
মাহমুদ : এর উত্তর আমি দেব না। এটা আমি দেব না এই জন্যে, আমি আগেই বলেছি যে, দেখেন আমি রাজনীতির লোক না।
রাজু : আপনার একটা রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গী তো থাকতে পারে, কবি হিসেবে ?
রাইসু : প্রোগ্রাগাণ্ডার ক্ষেত্রে তো আপনি রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গীই অবলম্বন করছেন ?
মাহমুদ : আমি কোনো প্রোপাগাণ্ডায়ই যাই নি।
রাজু : মাহমুদ ভাই, আমি বলতে চাচ্ছিলাম একজন কবি হিসেবে আপনি যেমন স্যোশালিজমের পতন সম্পর্কে বলতে পারেন, একইভাবে আপনি অন্যসব কিছুর পতন বা উত্থান সম্পর্কেও বলতে পারেন। তাই না ? তাহলে সেভেনটি ওয়ান তো একটা বড় ঘটনা, নাকি এটা আপনি স্বীকার করেন না ?
মাহমুদ : নিশ্চয় এটা একটা বড় ঘটনা।
রাজু : যদি এটা একটা বড় ঘটনা হয় তাহলে এটা আপনাকে আলোড়িত করেছে। এবং এ বিষয়ে আপনার বলার অধিকার আছে।
মাহমুদ : না, আসলে…
রাজু : তার মানে আপনার কি এ বিষয়ে কথা বলতে কোনো সমস্যা হবে বলে আপনি বলতে চাচ্ছেন না ?
মাহমুদ : না, আমার কোনো সমস্যা হবে এইজন্যে না। এর আগে আমি যতগুলো ইন্টারভিউ দিয়েছি, আমি আগেই বলে নিয়েছি এমন কতগুলো বিষয় আছে যেসব নিয়ে আমি বলবো না।
রাজু : জাতির এরকম একটা বড় ঘটনা নিয়ে আপনি কিছু বলবেন না ?
মাহমুদ : এসব ব্যাপারে বলতে গেলে অনেক কিছুই বেরিয়ে আসবে যেগুলি আমি এড়িয়ে যেতে চাই। তোমরা যদি ইনসিস্ট করো তাহলে একটা কথাও তোমরা বের করতে পারবে না। এই বিষয়ে আমি কোনো কথা বলতে চাই না।
মশিউল : মাহমুদ ভাই, একটা জিনিস, আমার মনে হচ্ছে, আমি যতটুকু আপনার সম্পর্কে জানি, ৭১ সালে আপনার একটা ভালো ভূমিকা ছিল, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। এবং তার পরবর্তী সময়েও মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা সংরক্ষণের ক্ষেত্রে আপনার যে ক্রিটিক্যাল ভূমিকা ছিল…
মাহমুদ : ছিল ? আমি মনে করি এখনো তা আছে। আমাকে আপনি বলুন, মুক্তিযুদ্ধের সময় আপনি কোথায় ছিলেন, কী করছিলেন ?
রাইসু : একটা সাক্ষাৎকারের জন্য এটা কি দরকারী ?
মাহমুদ : অবশ্যই, এটা দরকারী।
মশিউল : তো আমার মনে হচ্ছে এই প্রসঙ্গটা ওঠাতে আপনার ভেতরে একটা প্রচণ্ড অভিমান কাজ করছে। আমার মনে হচ্ছে এটা একটা অভিমান, যে আমি এ বিষয়ে কিছুই বলবো না।
মাহমুদ : আমি তো বই লিখে বলেছি। আমি একজন লেখক, আমার বই আছে। মুক্তিযুদ্ধের উপর আমার একটা উপন্যাস আছে। নাম হলো উপমহাদেশ। পড়ে দেখতে পারেন। আমি মনে করি যে আমি দেখে-লিখেছি। আমি এর মধ্যে দিয়ে গমন করেছি। আমাদের দেশে কোনো মুক্তিযুদ্ধের লেখক নেই।
রাজু : মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস আছে অনেক।
মাহমুদ : একজনও লেখক নাই, নট এ সিঙ্গল। একমাত্র আমি ছাড়া কোনো মুক্তিযোদ্ধা লেখক বাংলাদেশে নাই।
রাইসু : আপনি যে বললেন আপনি ছাড়া আর কোনো মুক্তিযোদ্ধা লেখক নেই, কিভাবে বলেন? সৈয়দ হক তো লিখেছেন?
মাহমুদ : উনি কি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন?
রাইসু : হুমায়ূন আহমেদ লিখেছেন?
মাহমুদ : মুক্তিযুদ্ধ সম্বন্ধে হুমায়ূন আহমেদের যে একটি বই আমি দেখেছি যে, মুক্তিযুদ্ধের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত… একমাত্র আমিই।
রাইসু : হাসান আজিজুল হকের গল্পগুলি? ‘নামহীন গোত্রহীন’?
মাহমুদ : এগুলো কিচ্ছু হয়নি।
রাইসু : এটা বললেন মাহমুদ ভাই !
মাহমুদ : আমি বলবো থার্ড ক্লাস লেখক। খুবই নিম্নপর্যায়ের থার্ডক্লাস গল্পকার।
রাইসু : ভালো গল্পকার তাহলে কে ?
মাহমুদ : আমাদের দেশে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বলে একজন লেখক আছে, আমি তার গল্পকে শ্রেষ্ঠতম লেখা মনে করি।
রাইসু : উপন্যাস না গল্প ?
মাহমুদ : গল্প এবং উপন্যাসও আমি তার পছন্দ করি। তার আগে আলাউদ্দীন আল আজাদ বলে একজন লেখক…
রাইসু : তেইশ নম্বর ?
মাহমুদ : কয়েকটি ভালো লেখা লিখেছেন। কিন্তু আপনারা হাসান আজিজুল হকের কথা বলছেন, আমি তার মোটামুটি সবগুলি গল্প পড়েছি।
রাইসু : পড়ে আপনার কী অনুভূতি হয়েছে ?
মাহমুদ : আমার মনে হয়েছে একে তো সাবস্ট্যান্ডার্ড, নিচু মানের রচনা।
রাইসু : কোন মানের তুলনায় ?
মাহমুদ : বাংলা সাহিত্যের ছোটগল্পের যে মান।
রাইসু : কেন নিচু বলছেন? এর দোষটা কোথায় ? সাহিত্যগত আলোচনায় যদি আসেন।
মাহমুদ : সাহিত্যগত আলোচনায় যদি আসি তাহলে তো এমন কথা বলবো যে, হাসান আজিজুল হকের গল্প কিছুই হয়নি। গল্পের বাঁধুনিই হয়নি। একটি গল্পও কোনো নিশ্চয়তা পর্যন্ত পৌঁছেনি। একটা গল্প গল্প হয়ে উঠতে হবে প্রথমে। যদি গল্পের বিষয়কে গল্প করে তোলা না যায়, তাহলে সেটা গ্রাহ্য হয় না, এক। দুই নম্বর কথা হলো যে, গল্পের ভাষা। গ্রাহ্য ভাষা হতে হবে, সমাজের। হাসান আজিজুর হক যে গদ্য ভাষা ব্যবহার করেছেন ছোটগল্পে সেটা গ্রাহ্য ছোটগল্পের ভাষা নয়। প্রায় অপাঠ্য। আমি যেহেতু রাজনৈতিক প্রশ্নের জবাব দিতে বসি নাই, আমি সাহিত্যের প্রশ্নের জবাব দেব।
রাইসু : হাসান আজিজুর হক যদি বাজে লেখেন এটা তো শেষ পর্যন্ত একটা রাজনৈতিক কার্যক্রমই। বাজে রাজনৈতিক কার্যক্রম নিশ্চয়ই?
মাহমুদ : আমি একজন লেখকের রাজনীতিকে বড় করে দেখছি না এখানে।
রাইসু : কিন্তু লেখার একটা রাজনীতি আছে না ?
মাহমুদ : আমি লেখক হিসেবেই এদেরকে বড় লেখক মনে করি না। গল্পলেখক হিসেবে আমার কাছে মনে হয়েছে অত্যন্ত…
রাইসু : তুচ্ছ ?
মাহমুদ : তুচ্ছ আমি বলতে চাই না। তুচ্ছই বা বলবো কেন একজন লেখককে, কিন্তু যেহেতু আমি যে ধরনের গল্পের সাথে অন্তত, বাংলা সাহিত্যে যেসব গল্প আমি পড়ে এসেছি সেসব গল্পের তুলনায় বা আমাদের দেশে অনেক শ্রেষ্ঠ লেখক যেসব গল্প লিখেছেন, সেসবের তুলনায় কিছুই না। একজন লোক যদি মার্ক্সবাদী হয়, তাহলে তাকে মহাআধুনিক প্রগতিশীল গদ্য গল্প লেখক হিসেবে চালিয়ে দেয়া হয়। শোনেন মিয়া…
রাইসু : বলেন।
মাহমুদ : মার্ক্সবাদী সাহিত্য ইস্ট ইউরোপে সব ড্রেনে ফেলে দেয়া হয়েছে, জানেন কি সেটা ?
রাইসু : আবার মার্কবাদীরা চলেও আসছে।
মাহমুদ : আসতে দিন, আসুক, আসুক। সমস্ত কিছু ফেলে দিয়ে ক্ষমতায় আসতে হচ্ছে।
রাইসু : তাহলে কি প্রাক্তন মার্ক্সবাদীরাই বড় লেখক ?
মাহমুদ : সেটা তো আমি বলিনি।
রাইসু : আচ্ছা, হাসান আজিজুল হককে যে এখানে বড় লেখক হিসেবে ট্রিট করা হয়, এটা কি লেখকদের রাজনীতি ?
মাহমুদ : নিশ্চয়ই, লেখকদের রাজনীতি।
রাইসু : লেখকদের রাজনীতিতে তাহলে আপনি বিশ্বাস করেন ?
মাহমুদ : বিশ্বাস করার সাথে তো প্রশ্ন না। এখানে যারা তৎকালীন মার্ক্সিস্ট ছিলেন তারা একটি প্রগতিশীল দলে ভিড়তে পারলেই, তাকে মহা লেখক করে তোলা হতো।
রাইসু : আপনার সময়কালীন যে-সব লেখকরা ছিলেন, আপনার ভাই-লেখক তাদের সঙ্গে আপনার বিচ্ছেদটা কেন হলো ?
মাহমুদ : সেটা অনেক কারণ। সেটা যে ঠিক ব্যক্তিগত বিদ্বেষ থেকে হয়েছে এমন না। সাহিত্যিক কারণেও হয়েছে। যাদের কথা বলা হয়, যেমন শহীদ কাদরী, শামসুর রাহামন– এদের সাথে কিন্তু আমার কোনো ব্যক্তিগত বিরোধ কখনও হয়নি। শহীদ কাদরী বিদেশ চলে গেছে, শামসুর রাহমান এখানে আছেন, মৌলিক মতবিরোধ সৃষ্টি হয়ে গেছে, হয়তো আমি ইসলামে বিশ্বাস করি বলেই সেটা হয়েছে।
রাইসু : আচ্ছা, মাহমুদ ভাই, আমরা ঐ জায়গাটায় আসতে চাই।
মাহমুদ : কী, হুমায়ন আজাদের ব্যাপারটায় ?
রাজু : হুমায়ুন আজাদ আপনার সম্পর্কে যেটা বললেন আর কি।
মাহমুদ : আমি মোটামুটি জানি ও কী বলবে। আমার প্রতি অনেকদিন ধরেই সে বিদ্বিষ্ট।
রাইসু : তাহলে তো আপনাদের সম্পর্ক খুব ভালো ? আপনারা পরস্পরকে জানেন মোটামুটি।
মাহমুদ : সম্পর্ক ভালো এটা বলা যাবে না। আমি তাকে চিনিই না ভালো করে।
রাইসু : কে কারে চিনতে পারে।
মাহমুদ : চেনা যে জিনিসটাকে বলে এ রকম কখনোই তার সঙ্গে ছিলো না। তার সাথে আমার প্রথম– তিনি তখন গিয়েছিলেন তার স্ত্রীকে নিয়ে– আমি তখন শিল্পকলাতে চাকরি করি। সেখানে তার স্ত্রীল একটি চাকরির ব্যবস্থা করে দেয়ার জন্যে। আমি অ্যাপয়েন্টিং অথরিটি নই তাকে বিনয়ের সাথে জানাই। তাতে তিনি সম্ভবত আমার উপর খানিকটা ক্রুদ্ধ হন– এটা হতে পারে। দুই নম্বর কথা হলো যে তিনি শামসুর রাহমানের উপর একটা গ্রন্থ রচনা করেছেন।
রাইসু : কেমন, বইটা কেমন ?
মাহমুদ : সেটাই বলছি। নিঃসঙ্গ শেরপা। বইটা তিনি আমাকে আলোচনা করতে দিয়েছিলেন। আমি বইটি পাঠ করে বিস্মিত হয়ে যাই যে, এটা কোনো কিছুই হয়নি। একটি আবর্জনা ছাড়া কিছু নয়। আমি বিনয়ের সাথে তাকে বলি যে, আমি বইটির উপর কোনো আলোচনা করবো না, কারণ শামসুর রাহমান এমন একজন মানুষ যে আলোচনাটা যদি আমি আপনার বইয়ের করি তাহলে তার বিরক্তির কারণ হতে পারে। আমি এ জন্যে তার কাছে রেহাই চাই। এতে তিনি আমার উপর খুব ক্রুদ্ধ হন। তিন নম্বর কারণ হলো, তিনি একটি গ্রন্থ সংকলন করেছেন কাব্যের।
রাইসু : আধুনিক বাংলা কবিতার ?
মাহমুদ : হ্যাঁ। সেটার জন্যে একটা লোককে আমার কাছে পাঠিয়েছিলেন। সেই লোকটি আমার কাছে গিয়ে তার বইয়ে আমার কবিতা অন্তর্ভুক্ত হতে দিতে রাজি আছি কিনা আমার কাছে জানতে চায়। আমি তাকে নিষেধ করে দেই। আমি বলি যে আমার কবিতা গ্রন্থে নেয়া হলে আমি মামলা দায়ের করবো, এক। দুই নম্বর কথা হলো হুমায়ুন আজাদ কে, হু ইজ দ্যাট ম্যান!
রাইসু : কবি তো উনি।
মাহমুদ : কিছু নন উনি।
রাজু : প্রবন্ধকার।
মাহমুদ : হুমায়ুন আজাদ প্রবন্ধকার হিসেবে বা গবেষক হিসেবে যেসব গ্রন্থ রচনা করেছেন বলে আপনাদের ধারণা অধিকাংশ হলো চৌর্যবৃত্তি। তাকে তার এইসব গবেষণা চুরির অপরাধে, আমি যতটুকু জানি যে, বাংলা একাডেমী তার একটি গ্রন্থ প্রকাশ করতে সক্ষম হয়নি। এবং পশ্চিমবঙ্গের চতুরঙ্গ পত্রিকায় তার চৌর্যবৃত্তি সম্বন্ধে একবার একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হচ্ছিলো। আমি তাকে একটি সাহিত্যিক চোর মনে করি।
রাইসু : সাহিত্যে তো একজনের জিনিস আরেকজন নিতে পারে। সাহিত্যের তো উদারতা এটাই।
মাহমুদ : সাহিত্যে একজনের জিনিস আরেকজন নিতে পারে, কিন্তু মৌলিক সাহিত্কর্ম হিসেবে কখনো তা চালাতে চায় না। যেটা সব সময় এই লোকটি করে এসেছে।
রাইসু : মৌলিক সাহিত্য বলতে কিছু আছে ?
মাহমুদ : নিশ্চয়ই, মৌলিক সাহিত্য বলতে কিছু আছে। আমি মনে করি কাব্যে এবং গবেষণায় এমন অনেক বই আছে যা নতুন চিন্তার উদ্রেক করেছে। এ কথা বললে তো চলবে না যে আমি যতই চুরি করবো এবং চুরি করে বলবো যে দুনিয়াতে সবাই চোর, আমিও চোর।
রাইসু : রবীন্দ্রনাথের লেখায়ও তো আমরা কবীর এবং উপনিষদ-এর অনেক জিনিসপত্র পাই, আমরা কি বলবো রবীন্দ্রনাথ চোর ?
মাহমুদ : উপনিষদ আর ইয়ের জিনিসপত্র পাই মানে এই নয় রবীন্দ্রনাথ সেটা চুরি করেছেন। রবীন্দ্রনাথ উপনিষদ-এর যে বাণীতে মুগ্ধ সে বাণীটি হলো যে, অন্তি সর্ন্তং ন যহতি, অন্তি সন্তং ন পশ্যতি, দেবস্য পশ্য কাব্যং, ন মমার, ন জির্জতি– এই তো তিনি, দেখো কী অদৃশ্য, এই তো তিনি দেখো কী অনিবার্য, দেখো রে দেবতা, অমৃত কবিতা, মরে না কখনো, জীর্ণ হয় না। এটা ছিলো রবীন্দ্রনাথের আদর্শ। উপনিষদ একটি ধর্মগ্রন্থ মনে রাখতে হবে। আর ধর্মগ্রন্থ হলো সমস্ত সৌন্দর্যের আকর।
রাইসু : মানে, সেখান থেকে চুরি করলে অসুবিধা নাই!
মাহমুদ : না, চুরি না, সেখান থেকে মানুষ অনুপ্রাণিত হয়। চুরি এবং অনুপ্রেরণা দান করা অন্য জিনিস। হুমায়ুন আজাদ একটি সাহিত্যিক তস্কর ছাড়া কিছু না। সবাই জানে। কী করে লোকটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে স্থান পেতে পারে!
রাজু : উনি বাংলা জানেন তো, এ জন্যে।
মাহমুদ : বাংলা উনি জানেন না।
রাজু : বাংলাও জানেন না?
মাহমুদ : তিনি যে বাংলা জানেন না তার প্রমাণ তার কবিতা পড়লেই বোঝা যায়।
রাইসু : কী রকম ?
মাহমুদ : সেটা এই মুহূর্তে… আমি তো তার কবিতা গ্রন্থ নিয়ে বসে থাকি না যে আপনাদের রেফারেন্স খুঁজে দেবো। হুমায়ুন আজাদের কিছু গালিগালজ আমরা সব সময় পড়ে থাকি। আমি লোকটাকে একটা নোংরা লোক মনে করি। আমাদের সাহিত্যে এবং সামাজিক আবহাওয়ায়, পঠনপাঠনের আবহাওয়ায় সে সবসময় একটা বিপর্যয়কর দুর্গন্ধ ছড়িয়ে যাচ্ছে। হুমায়ুন আজাদ নামটি শুনলেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের জনৈক মরহুম অধ্যাপক বলতেন, এটি হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের একটি বিষ্ঠাগার। তারপর তিনি পকেট থেকে রুমাল খুলে নাকে চেপে ধরতেন। আমি মনে করি এ ধরনের লোক কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরির সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত। তিনি আমাদের দেশের একজন শ্রেষ্ঠ কবিকে, কাজী নজরুল ইসলাম, যিনি উপনিবেশ, বৃটিশ ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সারা জীবন সংগ্রাম করে গেছেন, তাকে কোনো কবি বলেই স্বীকার করেন না। এই ধরনের লোক বাংলা ডিপার্টমেন্টে চাকরি করবে! যদি করে তাহলে বুঝতে হবে আমাদের ছেলেমেয়েরা কী শিখছে এদের কাছে!
রাইসু : কিন্তু আপনাকে তো তিনি স্বীকার করেন। আপনার ’৭০ পর্যন্ত কবিতা তিনি স্বীকার করছেন।
মাহমুদ : আমাকে স্বীকার করা বা না করা সেটা হুমায়ুন আজাদের মত লোকের অপেক্ষা করে না। এটা মনে রাখতে হবে।
রাইসু : নজরুলের করে কেন তাহলে ?
মাহমুদ : নজরুলেরও করে না। কিন্তু নজরুলকে যেভাবে প্রকাশ্যে অপমান মঞ্চে দাঁড়িয়ে সে করেছে সেটার একটা প্রতিবাদ হওয়া উচিত বলে আমি বলছি।
রাইসু : এতদিন পরে বললেন!
মাহমুদ : আমি সব সময়ই বলে এসেছি।
রাজু : আপনি একটু আগে বলছিলেন যে এরা কেউ মুক্তিযুদ্ধ করেন নাই, ফলে এদের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে উপন্যাস লেখা সম্ভব না।
মাহমুদ : আপনি বলেন, এ দেশে কোন লেখক মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে তার মধ্যে অবস্থান করে একটি কিছু লিখেছে ? এত বড় একটা মুক্তিযুদ্ধ, আপনারা সব সময় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে বেড়ান, এ দেশে সমস্ত লেখক বলে বেড়ায়– তারা মুক্তিযুদ্ধের অংশগ্রহণ করে নি কেন আপনাকে যদি প্রশ্ন করি। করে নি তো কেউ।
রাজু : কেউ করে নি ?
মাহমুদ : না, কোনো লেখকই করে নি।
রাইসু : আপনি করেছিরেন ?
মাহমুদ : আমি করেছিলাম। বিচিত্র মনে হয় ? একটু বেশি মনে হয় ?
রাইসু : না, বেশি মনে হচ্ছে না।
মাহমুদ : বলেন, আপনাদের দেশে শ্রেষ্ঠ লেখকদের একটা একটা করে নাম বলেন। এরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলো? অধিকাংশ লোক মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলো। আর কিছু লোক আত্মরক্ষার জন্যে গ্রামে পালিয়ে গিয়েছিলো। কিছু লোক নিশ্চুপ ছিলো।
রাইসু : আপনি কি করেছিলেন তখন, মাহমুদ ভাই ?
মাহমুদ : আমি চলে গেছি দেশ ছেড়ে। আমি তখন ইত্তেফাক-এ চাকরি করতাম। ইত্তেফাক তখন জ্বালিয়ে দিলো, আমাকে খোঁজা হচ্ছে শুনে আমি তখন পালিয়ে গেছি। কী করবো আমি ?
রাইসু : কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখতে হলে মুক্তিযুদ্ধ করতে হবে এমন তো আর না।
মাহমুদ : হ্যাঁ। নিশ্চয়ই। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে নি এমন লেখকও হতে পারে– সেটা একশ’ বছর পরে। পঞ্চাশ বছর পরে। কয়েকটা ডিকেড চলে গেলে। নিশ্চয়ই তখন অবস্থাটা থিতিয়ে দানা বাঁধবে। তখন এর উপর একজন একটি গ্রন্থ রচনা করতে পারেন মুক্তিযুদ্ধের বিষয়গুলো জেনে। কিন্তু তরতাজা মুক্তিযুদ্ধ দেখে এসেছি বলে–কিন্তু দেখি নি আসলে–আমি একটি বই লিখে ফেললাম। হ্যাঁ, এবং সেটা চালিয়ে দিলাম– এটা হলো নকল। সে জন্যে এ-দেশে মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্য বলে কোনো কিছু দাঁড়ায় নি।
রাইসু : সাহিত্যকে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক হতে হবে কেন ?
মাহমুদ : সে প্রশ্ন আপনি করুন। আমি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সাহিত্য হতে হবেÑ এমন তো বলি নি। এ প্রশ্ন তো আপনারাই তুলেছেন। আমি শুধু বলেছি যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখকরা এ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ছিলেন না। আপনি প্রমাণ করুন যে তারা ছিলেন। আমি শুধু বলতে চাই তারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি। কেউ কেউ মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে।
রাজু : এই কেউ কেউ কে কে ?
মাহমুদ : আমি নামগুলো আপনাদের বলতে চাই না, কারণ আমি কোনো বিদ্বেষের জন্ম দিতে চাই না।
রাজু : এটা বিদ্বেষ না মাহমুদ ভাই, মুসলমান হিসেবে আপনার সততার ব্যাপার আছে!
মাহমুদ : ওসব ফালতু কথা বলে তো কোনো লাভ হবে না।
রাইসু : ইসলাম আপনার কাছে ফালতু ?
মাহমুদ : না, ইসলাম ফালতু না।
রাজু : ইসলাম তো সততার কথা বলে মামুদ ভাই।
মাহমুদ : আমি তো বললাম মুক্তিযোদ্ধা লেখক বলতে আমি আমাকেই জানি। আর কাউকে তো দেখি না।
মশিউল : একজন মুক্তিযুদ্ধের জীবন্ত দলিল হিসেবে আপনার এটা বলা উচিত। কারণ আমরা নতুন প্রজন্ম, আমরা জানি না, অনেককে মুক্তিযোদ্ধা বলে মনে করি। কিন্তু আপনি রিয়েল চিত্রটা জানেন।
মাহমুদ : আমি কারোর বিরুদ্ধে বলতে চাচ্ছি না। আমি শুধু বলছি যে আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা লেখক। আর অধিকাংশ আমাদের দেশের বড় লেখক– আমি কারো নাম বলতে চাই না, আমি তো আগেই অস্বীকার করেছি তাদের নাম বলতে– তারা অধিকাংশই আমাদের দেশে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন নি। মুক্তিযুদ্ধের ওপর তাদের রচনা হলো নিতান্তই আন্দাজ করে লেখা। আন্দাজ করে লিখলেই যে সেটা সাহিত্য হয় না আমি সেটা বলি নি কিন্তু।
রাজু : আপনি যে বললেন, তাদের নাম বলবেন না। নাম না বলাতে যেটা হবে সেটা হলো জনমনে বিভ্রান্তিটা আরো দীর্ঘদিন টিকে থাকবে।
মাহমুদ : মোটেই বিভ্রান্তি হবে না, কারণ জনগণও এটা জানে।
রাজু : আপনি না বললে কী জানবো মাহমুদ ভাই ?
মাহমুদ : এ দেশের সচেতন অংশ সবাই জানে যে মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের লেখকদের ভূমিকা সম্পর্কে সবাই মোটামুটি অবহিত।
রাজু : সবাই অবহিত হলে তো আর এই বিভ্রান্তি থাকে না।
মাহমুদ : বিভ্রান্তির কথা কেন বলছেন ?
রাইসু : কার কথা বলছেন ?
মাহমুদ : যেই হোক, ব্যক্তিবিশেষ লিখেছে। এখন তিনি সবচে বেশি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কতা বলছেন, যেখানেই যাচ্ছেন সেখানেই। কথাটা কি মিথ্যা? আমি যুতটুকু জানি আপনারা খুবই অবহিত লোক। আমাকে আর অনর্থক প্রশ্ন করে সময় নষ্ট করার তো কোনো মানে হয় না।
রাইসু : আমাদের সময় অত দামী না।
মাহমুদ : আমার অবশ্য সময় অত্যন্ত দামি।
রাজু : মাহমুদ ভাই আমি বলি, সেটা হলো যে আপনার কথাবার্তার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক চেতনা বেরিয়ে আসছে…।
মাহমুদ : আসতে পারে। বাট আই এ্যাম নট এ পলিটিশিয়ান।
রাইসু : আপনি খুবই রাজনীতি সচেতন একজন ব্যক্তি।
মাহমুদ : না। আমি অত রাজনীতি সচতেন নই।
রাইসু : রাজনীতি সচেতন যদি না হন তাহলে হুমায়ুন আজাদ আপনাকে প্রতিক্রিয়াশীল বললো কেন ?
মাহমুদ : সেটা তার খুশি।
রাজু : আমি বলতে চাচ্ছিলাম যে রাজনৈকিত সজ্ঞানতা তো আপনার নিঃসন্দেহে আছে। এবং সেই চেতনার প্রকাশও আছে। আমার কথা হলো সেভেনটি ওয়ানে এমন একটি দল যারা স্বাধীনতার বিরোধিতা করলো, এই দলটিকে আপনি কিভাবে দেখেন?
মাহমুদ : আমি তো আগেই বলেছি, বারবার একটা প্রশ্ন ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে করে লাভ নেই। আমি বলছি কতগুলো ব্যাপারে ইন্টারভিউয়ার হিসেবে আপনার যেমন কতগুলো প্রশ্ন করার স্বাধীনতা আছে, তেমনি আমারও কিন্তু কতগুলো বিষয়ের উত্তর না-দেয়ার অধিকার আছে। দ্বিতীয়বার এই প্রশ্ন করবেন না। না এই প্রশ্নটি আর করবেন না। আপনি অন্য এলাকায় যান।
মশিউল : আমি একটা প্রশ্ন করতে চাই। আপনি তো বাসিক্যালি শিল্পী। কবি আর কি। কবি এবং
মাহমুদ : এর বেশি কিন্তু কিছু নই। আমি একজন কবি ছাড়া এক সুতোও উপরে কিছু নই।
রাজু : গল্পকার নন ?
মাহমুদ : গল্পকার মানে ?
রাইসু : ঔপন্যাসিক ?
মাহমুদ : সব মিলিয়েই আমি একজন কবি।
মশিউল : আমার মনে হচ্ছে, যে প্রশ্নটা আমি করতে চাচ্ছিলাম, ইসলাম কিন্তু কবিতা, গান এই শিল্পগুলোকে আবার অন্যভাবে দেখে, এগুলো অ্যাপ্রিশিয়েট করে না।
মাহমুদ : এটা ঠিক নয়। এটা হলো আপনার অজ্ঞতা। আপনি যে কিছই জানেন না এটা থেকেই বোঝা যায়। ইসলাম কবিতাকে, মানুষের কবিতাকে অত্যন্ত মূল্য দিয়েছে। তবে একটি কথা বলেছে যে, কবিতা অবশ্যই মানুষের মঙ্গলকামী হবে। কবিতা মানুষকে বিভ্রান্ত করবে না। এবং আপনি দেখেন যে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কবিরা, অধিকাংশ
রাইসু : মুসলিম ?
মাহমুদ : না, অধিকাংশ মুসলিম এ কথা আমি বলছি না। অধিকাংশ লোকই ধার্মিক। আর ধরেন এই ইরানে ধরেন, বিশ্ব কবি, আমরা দেখি যে ছয়জন বিশ্বকবি ইরানে জন্ম গ্রহণ করেছেন। শেখ সাদী, জামী, ওমর খৈয়াম, ফেরদৌসী, তার পরে রুমী।
রাজু : ফরিদ উদ্দীন আত্তার ?
মাহমুদ : না, আরেকজন কবি। বিশুদ্ধ কবি। না আত্তারও কবি, তবে তাকে অন্য একটি বিষয়ের সাথে জড়িত করা হয়।
মশিউল : তবে তারা যে রিলিজিয়াস, একদম রিলিজিয়াস সেটা বলা বোধহয় ঠিক হবে না।
মাহমুদ : এটা আপনি কী করে বলবেন? এটা তো আপনি আন্দাজ করে বলছেন। যেমন আমি, আমার সম্বন্ধে আপনি কতটুকু জানেন, আমি রিলিজিয়াস কিনা ?
রাইসু : মাহমুদ ভাই, এই যে ওমর খৈয়াম, উনি কি ইরানী কবি ?
মাহমুদ : হ্যাঁ, ইরানী কবি।
রাইসু : উনি যে রুটি, মদ এইসব চাইছেন, তারপরে আবার রিলিজিয়াস কিভাবে থাকেন ?
মাহমুদ : এগুলো, ইরানী ভাষার কতগুলো ইঙ্গিতময়তা আছে। ইরানী ভাষার মধ্যে সুফিতাত্ত্বিক কতগুলো ইঙ্গিতময়তা, যেখানে মদকে মদ অর্থে ব্যবহার করা হয় না। অনেক সময়। এটা আবার ইরানী সাহিত্য সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান না থাকলে বোঝা যাবে না।
রাইসু : প্রতীকবাদী সাহিত্য তাহলে এটা ?
মাহমুদ : খানিকটা। খানিকটা, তবে সবটা না।
রাইসু : একই সঙ্গে, তাহলে তো হাসান আজিজুল হকও প্রতীকবাদী সাহিত্য নির্মাণ করছেন। দুই জনের মধ্যে ফারাকটা কি ?
মাহমুদ : কোথায় ইরানী সাহিত্য আর কোথায় হাসান আজিজুল হক। ভাই কি লিখেছে বলেন, একটা গল্প বলেন যে গল্পটি আধুনিক বাংলা সাহিত্যের পর্যায়ক্রমিক গল্পের মধ্যে দাঁড়াতে পারে ? বলতে পারবেন ?
রাইসু : এই যে ‘আত্মজা ও একটি কবরী গাছ’।
মাহমুদ : পড়ে দেখেছি। খুব উত্তমরূপে পড়েছি। এ ধরনের গল্প, খুবই সাধারণ একটি গল্প।
রাইসু : সামান্যের মধ্যেই তো অসামান্য পাওয়া যায়।
মাহমুদ : হাসান আজিজুল হককে নিয়ে অযথা লাফালাফি করে লাভ নেই।
রাইসু : না, আমরা আপনারে নিয়াও লাফালাফি করতে চাই।
মাহমুদ : আমাকে নিয়ে লাফাতে হবে না। আমি তো প্রায় একজন নিঃসঙ্গ মানুষ।
রাইসু : আপনি নিঃসঙ্গ বললেন নিজেরে ?
মাহমুদ : খুবই নিঃসঙ্গ লোক।
মশিউল : আচ্ছা মাহমুদ ভাই, একটু আগে আপনি বললেন যে, স্যোশালিস্ট ইকোনোমিক সিস্টেম, স্যোসাল সিস্টেম যেটা সেটা ব্যর্থ। এটা আমাদের চোখের সামনে প্রমাণিত।
মাহমুদ : ওটা আর ভাই আসবে না, কবর থেকে উঠে আসবে না। একটা কথা আছে না, একটা গল্প পড়েছিলাম যে ইল্লোল আর বাতাপি বলে দুটো রাক্ষস ভেবেছিলো যে সমস্ত ব্রাহ্মণদের নিকেশ করে ফেলবে। তো ইল্লোল নিজে একটা ভেড়া সাজতো, বাতাপিকে একটা ভেড়া সাজিয়ে দিতো, সে ভেড়া হয়ে যেতো যাদুমন্ত্র বলে। আর ইল্লোল সেটাকে কেটে-টেটে ব্রাহ্মণদের নিমন্ত্রণ করে খাওয়াতো। যখন ব্রাহ্মণরা খেয়ে-দেয়ে ঢেকুর তুলছে তখন সে আড়ালে গিয়ে ডাকতো : বাতাপি, বাতাপি! আর বাতাপি পেট ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতো। তো এই কথা শুনে অগস্ত্য মুনি একদিন বললেন যে, এই দুই বদমাইশের হাত থেকে তো ব্রাহ্মণদের রক্ষা করতে হয়। তখন তিনি গেলেন, তাকে দাওয়াত করা হলো। তিনি আহার করলেন। ইল্লোল পেছনে গিয়ে ডাকলো, বাতাপি, বাতাপি। অগস্ত্য এদিক থেকে বলছে, আর আসবে না, হজম করে ফেলেছি। তো সেরকম কার্ল কম্যুনিজমকে মার্ক্সবাদকে হজম করে ফেলেছে, আর ডাকলেও আসবে না।
মশিউল : হ্যাঁ, ওটা একটা ইউটোপিয়া ছিলো।
মাহমুদ : এতদিন পরে বলছেন ইউটোপিয়া। কোটি কোটি মানুষকে খুন করে। আপনাদের কোনো সাজা হবে না ভাই ?
মশিউল : অবশ্যই সাজা হবে। অবশ্যই সাজা হবে।
মাহমুদ : এই যে অসংখ্য মার্ক্সবাদী লেখক স্টালিনকে সমর্থন করে কবিতা লিখেছিলো, কোটি কোটি মানুষকে ঐ কসাইটা মেরে ফেলেছিলো। এই লেখকদের সাজা হবে না ভাই ? এদের ফাঁসি হবে না? কিন্তু হয় নি। খুনীদের সমর্থকদের কোনো সাজা হয় নি। কিন্তু বিশ্ব তার সাজা দেবে। আজকে তাদের অবস্থা দেখেন।
রাইসু : এই অগস্ত্য মুনিটা কে মাহমুদ ভাই ?
মাহমুদ : কী একটা পুরান থেকে পড়েছিলাম, হাঃ হাঃ হাঃ।
রাইসু : অগস্ত্য মুনিটা আপনি কারে ভাবেন ?
মাহমুদ : কাল-কে, অগস্ত্য হচ্ছে সময়। সময় এসে খেয়ে ফেলেছে। বলছে, হজম করে ফেলেছি, আর আসবে না। হাঃ হাঃ…
মশিউল : এই প্রসঙ্গে যেটা বলতে চাচ্ছি তা হলো স্যোশালিস্ট আইডোলজিটা ইউটোপিয়া এটা আমরা দেখতে পাচ্ছি। এখন এটার কারণ হচ্ছে যে আমরা এর বাস্তবায়ন পৃথিবীতে দেখতে পাই নি।
মাহমুদ : কেন, দেখতে পান নি ? সত্তর বছর মানুষের উপর দিয়ে রোলার চালিয়ে দিয়েও দেখতে পান নি ? তারপরও বলছেন জানেন না কিছু ? কোটি কোটি মানুষকে মেরে ফেলেছেন জানেন না কিছু ? এখনও বলছেন কম্যুনিজম ফিরে আসবে ? আপনাদের কোনো জায়গা নেই। আপনারা মাথা থেকে আল্লাহকেও সরিয়ে ফেলেছেন। ফিরবেন কোথায় ?
রাইসু : এইটা কাদের উদ্দেশে বলছেন, মাহমুদ ভাই ?
মাহমুদ : সমস্ত মার্ক্সিস্টদের উদ্দেশে।
রাজু : কিন্তু সত্তর বছর তেমন কিছু না মাহমুদ ভাই।
মাহমুদ : সত্তর বছর একটা শতাব্দী।
রাজু : আমি বলতে চাচ্ছিলাম, সত্তরটা বছর কিন্তু ঐ তুলনায় কম, যেমন ডেমোক্রেসির যে আইডিয়া আসছে এবং যতদিন যাবত এটার প্রাকটিস হয়েছে– এই তুলনায় কি সত্তর বছর কম না ?
মাহমুদ : ডেমোক্রেসি তো এর আগে থেকেই ছিলো। কেরিনেস্কী সরকারকে সরালো কী করে ? কেরিনেস্কী সরকার কিভাবে এসেছিলো ? শোনেন, কম্যুনিস্টরা বলতো যে পার্লামেন্ট হচ্ছে শুয়োরের খোয়াড়। এখন ঘোঁৎ ঘোঁৎ শব্দ করে এরাই ঢুকে পড়ছে।
রাজু : আচ্ছা একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে আসি। মওলানা ভাসানীকে আপনি কিভাবে দেখেন ?
মাহমুদ : আমি তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে খুব শ্রদ্ধা করি। দুইটা কারণে। এক হলো যে তিনি অসাধারণ মানুষ ছিলেন। একজন খুব ধার্মিক মানুষ ছিলেন। দু’নম্বর কারণ পারিবারিক। আমার ভগ্নিপতি তাঁর খুব ভক্ত ছিলেন। মাঝে-মধ্যে তিনি অসুস্থ হলে আমি তাঁকে দেখতে গিয়েছি। আমি তাঁকে শ্রদ্ধা করতাম।
রাজু : আপনি তো বললেন যে উনি খুব ধার্মিক মানুষ ছিলেন। ওনার রাজনীতির মধ্যে কি ধর্মের কোনো ব্যাপার ছিলো ?
মাহমুদ : উনি ইসলামের কথাই বলতেন।
রাজু : উনি যদি এটাই বলে থাকেন তাহলে চীনের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কটা গড়ে উঠলো কিভাবে ?
মাহমুদ : যে কোনো দেশে তার ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে।
রাজু : কিন্তু ওই যে চীনা সমাজতান্ত্রিক আদর্শ ?
মাহমুদ: কিন্তু চীনা আদর্শ কখনো গ্রহণ করতে কাউকে বলেন নি। তাঁর উদারতার আশ্রয়ে, তাঁর ছাতার নিচে অসংখ্য মার্ক্সিস্টরা এসে আশ্রয় গ্রহণ করেছে।
রাইসু : কারা এরা ? নাম বলেন।
মাহমুদ : এদের নাম বলতে চাই না।
রাইসু : এদেরও নাম বলবেন না, মাহমুদ ভাই ?
মাহমুদ : নাম আপনারা সবাই জানেন। অনর্থক এদের নাম বলে লাভ নেই।
রাজু : আচ্ছা শেখ মুজিবের রাজনীতি এবং দূরদৃষ্টি সম্পর্কে আপনার কী ধারণা ?
মাহমুদ : আমি নিজে মুখে কিছু বলতে চাই না। কারণ আমি তো আগেই বলেছি আই এ্যাম নট এ পলিটিশিয়ান। আমার একটা বই আছে কাবিলের বোন। ওখানে আমি শেখ মুজিবকে যেভাবে দেখেছি, আপনি তো বোধ হয় শেখ মুজিবের সাথে কখনো কথা বলেন নি। আমি তাঁর নিকটে যাবার বারবার সুযোগ পেয়েছি। তাঁর সাথে আমার যে বিনিময় হয়েছে–
রাজু : সৌহার্দ্য বিনিময় ?
মাহমুদ : আমি সাংবাদিক হিসেবে তার এক সম্মেলনে উপস্থিত থেকেছি। সাংবাদিক সম্মেলন ভেঙে গেলেও, তিনি অনুগ্রহ করে আমাকে বসতে বলেছেন। আমি একমাত্র বিরোধী দলের পত্রিকার এডিটর। অকপটে আমার সাথে কথা বলেছেন। অনেক সমস্যার কথাও আমি জানতাম।
রাজু : তাঁর না আপনার ?
মাহমুদ : তাঁর। তিনি অনেক সময় আমাকে বলতেন– এটা অফ দ্য রেকর্ড।
রাইসু : রেকর্ডটা খোলেন নাই আপনি কখনো ?
মাহমুদ : না। আমি কখনো এ কাজ করি নি তিনি যেটা নিষেধ করেছেন। আমাকে বিশ্বাস করে যা বলেছেন আমি তা কখনো প্রকাশ করি নি।
রাজু : এ জন্যই কি আপনাকে জেলখানায় নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি ?
মাহমুদ : জেলখানায় নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি, এটা আমি মনে করি তাঁর ভুল সিদ্ধান্ত ছিলো। যেদিন জেলখানায়, তার দুইদিন আগেও তাঁর সাথে আমার কথা হয়েছিলো। তাঁর সাথে দীর্ঘ পরিচয়ের যে সূত্র রয়েছে তিনি চেয়েছিলেন যে একজন কবিকে, আমার পত্রিকাও বন্ধ করে দিয়েছিলেন তো।
রাইসু : মানে জেলখানায় বসে যাতে আপনি ভালো ভালো কবিতা লিখতে পারেন এই জন্য নেয়া হয়েছিলো ?
মাহমুদ : না, এটা ঠিক না। জেলখানায় নিয়েছিলেন ক্রুদ্ধ হয়ে নিশ্চয়ই। তবে আমি মনে করি এই সিদ্ধান্তটা ভুল ছিলো। কারণ আমি ঐরকম কোনো কাজই করি নি যাতে তিনি আমাকে…। কে জানে যদি আমি বাইরে থাকতাম, গণকণ্ঠ ঠিকমত কথা বলতে পারতো, তাহলে তার উপকার হতো। হতেও পারতো। আমি যদি ঠিকমত বিরোধিতা করতে পারতাম তাঁর তাহলে হয়তো সবকিছু অন্যরকম হতো। কাবিলের বোন-এ শেখ সাহেবের যে চরিত্রটি আছে সেখানে আমি তাকে যেভাবে দেখেছি সেটারই বর্ণনা দিতে চেষ্টা করেছি। এবং শত গ্রন্থ রচনা করেও এরকম একটি চরিত্র দাঁড় করানো যাবে না।
রাইসু : অন্তিম প্রশ্ন, শামসুর রাহমানের সঙ্গে আপনার আর দেখা-সাক্ষাতের কোনো সম্ভাবনা দেখেন কিনা ?
মাহমুদ : এমন তো কোনো সম্ভাবনা দেখছি না। শামসুর রাহমানের সঙ্গে দেখা হলে আমি খুশিই হবো, এবং দেখা না হওয়াটা নিশ্চয়ই খুবই বেদনাদায়ক। আমাদের কালের একজন উল্লেখযোগ্য কবি তার সঙ্গে দেখা না হওয়াটা কি ভালো ?
বিডিআর্টস
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন