খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। বিশিষ্ট ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর। ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে সম্প্রতি মুখোমুখি হন জাগো নিউজ’র। বাজেট প্রক্রিয়াকে জনবিচ্ছিন্ন উল্লেখ করে নানা অসঙ্গতি তুলে ধরেন।
দেশের অধিকাংশ সম্পদ শতকরা পাঁচ ভাগ মানুষের হাতে দাবি করে তিনি বলেন, রাষ্ট্র, সরকার ধনিক শ্রেণির কাছে ক্রমাগত জিম্মি হয়ে পড়ছে। আলোচনা করেন ব্যাংক ও শেয়ারবাজার প্রসঙ্গেও। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে শেষটি।
ব্যাংক এখন গোপন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এ রোগ নিরাময়ের উপায় থাকবে না
জাগো নিউজ : আগের পর্বে ব্যাংক খাতের নতুন সমস্যার কথা উল্লেখ করে বলছিলেন, ব্যাংক পশ্চাৎপদ সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। পেছনে ফেরার কী কারণ থাকতে পারে?
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ : যারা ঋণখেলাপি তারা সমাজে, রাজনীতিতে, ব্যবসায় শক্তিশালী এবং ওই পাঁচ ভাগ ধনীর মধ্যে। তারাই সরকারকে প্রভাবিত করছে। এ পশ্চাৎগামিতা ব্যাংক খাতের সংকট আরও বাড়িয়ে দেবে।
দ্বিতীয় সার্কুলারটি মাননীয় হাইকোর্ট স্থগিত করেছেন। ১৯৭২ থেকে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত যারা খেলাপি আছেন, মাত্র ২ শতাংশ টাকা জমা দিয়ে ১০ বছরের জন্য রিসিডিউলের সুযোগ তৈরি করে তাদের জন্য সার্কুলার জারি হয়েছে। এ নিয়ম বাংলাদেশে কখনই ছিল না। অদ্ভুত নিয়ম। এটা অবিশ্বাস্য। এটা চালু হলে ব্যাংকের সর্বনাশ হবে।
মূলত অর্থ মন্ত্রণালয় শীর্ষ খেলাপিদের পক্ষ নিয়ে এমন সার্কুলার জারি করেছে
জাগো নিউজ : ব্যাংক খাত তো আরও অন্ধকারে ডুবছে...
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ : ইতোমধ্যে ব্যাংক খাত অন্ধকারে ডুবে গেছে। তবুও একটু সজাগ থাকার সুযোগ ছিল। ওই দুই সার্কুলার বাস্তবায়ন হলে সংকট স্থায়ী হবে। কারণ তখন ব্যাংক সজাগও থাকতে পারবে না। রোগ প্রকাশ পেলে প্রতীকার মেলে। কিন্তু গোপন রোগের কী প্রতিকার? ব্যাংক এখন গোপন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এ রোগ নিরাময়ের উপায় থাকবে না। ব্যাংকগুলো অত্যন্ত খারাপ অবস্থায় পড়বে অচিরেই।
জাগো নিউজ : কোনো উপায় কি দেখছেন না?
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ : আপাতত না। উচ্চ আদালত স্থগিত করে রেখেছেন বটে, কিন্তু শুনানির পর কী হবে সেটাই দেখার বিষয়। যদি ওই সার্কুলার চিরতরে বাতিল করা হয় তাহলে হয়তো ব্যাংকগুলো বেঁচে যাবে। কোনো সমন্বয় নেই। অর্থ মন্ত্রণালয় যা ইচ্ছা তা-ই করতে চাইছে।
সরকারের শীর্ষপর্যায়ের হস্তক্ষেপ না হলে এবং ব্যাংক খাতকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে না দিলে সংকট কাটবে না
জাগো নিউজ : তার মানে বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্ষমতা একেবারেই খর্ব করা হয়েছে?
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ : হ্যাঁ। বাংলাদেশ ব্যাংককে মোটামুটি পোষ্য করে রাখা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংককে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয়া হচ্ছে না। আমি মনে করি, অর্থ মন্ত্রণালয় বেআইনিভাবে এ সার্কুলার জারি করেছে। কারণ, আইনত অর্থ মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ ব্যাংককে নির্দেশ দিতে পারে না। মূলত অর্থ মন্ত্রণালয় শীর্ষ খেলাপিদের পক্ষ নিয়ে এমন সার্কুলার জারি করেছে।
জাগো নিউজ : এ পরিস্থিতির শেষ কোথায়?
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ : বলা মুশকিল। সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে হস্তক্ষেপ করা না হলে এ সংকট কাটবে বলে মনে হয় না।
এখন আবারও নগদ ভর্তুকির সময় এসেছে। কারণ কৃষক তার ফসলের দাম পাচ্ছে না
জাগো নিউজ : ১০ বছর ধরে ব্যাংকের সংকট। সরকারের শীর্ষ পর্যায়ও অবগত...
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ : হ্যাঁ। কিন্তু ধোঁয়াশায় রাখা সব। বাজেটে ব্যাংকের সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে। এ সংস্কার যদি উল্লেখিত দুই সার্কুলারের মতো হয়, তাহলে তো কুসংস্কারে ভরে যাচ্ছে ব্যাংক খাত।
এ কারণে আমি মনে করছি, এ পরিস্থিতি জিইয়ে রাখলে ব্যাংক খাত অস্তিত্ব সংকটে পড়বে। ব্যাংকের প্রতি মানুষের আস্থা এমনিতে কমে গেছে। হয়তো আরও কমবে। মানুষ হয়তো বাধ্য হয়ে কিছু আমানত রাখবে। তবে একসময় তা-ও থাকবে না। আবার ঋণের সুদ কমানোর কথা বলছে সরকার। সব মিলে ব্যাংকে এখন অরাজক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এ কারণে বলছি, সরকারের শীর্ষপর্যায়ের হস্তক্ষেপ না হলে এবং ব্যাংক খাতকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে না দিলে সংকট কাটবে না।
ধনীদের কোনো ছাড় নয়। গরিবদের নানা প্রণোদনা দিয়ে এগিয়ে আনার নীতি এখন সময়ের দাবি
জাগো নিউজ : একই পরিস্থিতি শেয়ারবাজারেও…
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ : শেয়ারবাজারের মূল সমস্যা সমাধানে সরকার যেতে চাইছে না। উপরিতলের কিছু সমাধানের কথা বলছে। এতে শেয়ারবাজারে কোনো সমাধান আসবে না।
আমার মতে, শেয়ারবাজারে দুটি সমস্যা আছে। প্রথমটি হচ্ছে বিশেষ সিন্ডিকেট। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের মতো প্রতিষ্ঠানে মাত্র ২৫০ সদস্য। এ অল্পসংখ্যক মানুষের মধ্যে সিন্ডিকেট করা সহজ। আমরা সদস্য সংখ্যা অন্তত এক হাজার করার সুপারিশ করেছিলাম। রাজি হলো না। সরকারও পারল না। ফলে সিন্ডিকেটও ভাঙা গেল না।
এ পরিস্থিতি ভারতেও ছিল। মনমোহন সিং সরকার সংস্কার করে সমাধান করেছিলেন। দ্বিতীয়ত, শেয়ারবাজারের পরিচালনা বোর্ডের সংস্কার জরুরি। যারা শেয়ার প্লে করেন, তারা কোনোভাবেই প্রশাসনে থাকতে পারেন না এবং এ নিয়ম করলে সিন্ডিকেট এমনিতেই ভেঙে যাবে।
জাগো নিউজ : বেসরকারি বিনিয়োগে স্থবিরতা। এবারের বাজেটেও বেসরকারি বিনিয়োগ নিয়ে বিশেষ কোনো তাগিদ নেই…
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ : সরকার বড় বড় প্রকল্প হাতে নিয়েছে এবং সেখান থেকেই উন্নয়ন দৃশ্যমান হচ্ছে। কিন্তু ব্যক্তিগত খাতের বিনিয়োগ থমকে গেছে। মানুষের হাতে টাকা নেই, তা নয়। কিন্তু বিনিয়োগের জন্য কোনো আস্থা পাচ্ছে না।
জাগো নিউজ : আস্থা সংকটের কী কারণ?
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ : আসলে বেসরকারি বিনিয়োগ কেন হচ্ছে না, তা নিয়ে গবেষণা দরকার। তবে আমার কাছে মনে হয়, এর প্রধান কারণ হচ্ছে সুশাসনের অভাব। মানুষ যখন দেখে কোনো নিয়ম-কানুন নেই, আইনের শাসন নেই, তখন নিজের টাকা বাইরে আনতে ভয় পায়। তবে আমি মনে করি, বিষয়টা আরও খতিয়ে দেখা জরুরি।
জাগো নিউজ : এবারের বাজেটে কৃষি বীমা এবং তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ ফান্ড রাখা হয়েছে। এ দুই বিষয় নিয়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ : কৃষি খাতে ভর্তুকি নতুন নয়। ১৯৯৭-৯৮ অর্থবছর থেকে শুরু। আমরা তখন সারে ভর্তুকি দিতে দেখেছি এবং সেটা এখনও আছে।
তবে ছোট ছোট কৃষককে নগদ ভর্তুকি দেয়া হয়েছিল একসময়। সেটি আর নেই। আমি মনে করি, সেটা ভালো একটা উদ্যোগ ছিল এবং এ কারণে খাদ্যে স্বনির্ভরতা এসেছে। এখন আবারও নগদ ভর্তুকির সময় এসেছে। কারণ কৃষক তার ফসলের দাম পাচ্ছে না। তবে ৮০০ বা এক হাজার টাকা ভর্তুকি দিলে হবে না। একেবারে ছোট কৃষককে তিন হাজার টাকা এবং আরেকটু বড় কৃষককে চার হাজার টাকা ভর্তুকি দেয়া জরুরি। তাহলে চলমান সংকটের কিছুটা সমাধান হবে। হাতে নগদ টাকা থাকলে ফসল কিছুটা সময় ঘরে ধরে রাখতে পারবে। ঘরে ধরে রাখতে পারলে কৃষক ফসলের মূল্য পাবে।
বর্তমান বাজেটে বিষয়টা উপেক্ষিত হয়েছে। যেহেতু শেখ হাসিনার সরকারই এটা করেছিল, সেহেতু ফের তিনি চালু করতে পারেন।
অন্যদিকে নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য প্রণোদনার ব্যবস্থা, এটা ভালো দিক। তবে ১০০ কোটি টাকা এখানে কিছুই না। অন্তত এক হাজার কোটি টাকার একটি ফান্ড গঠন করে যাত্রাটা শুরু করা যেত।
জাগো নিউজ : শিক্ষা-স্বাস্থ্যে বরাদ্দ বেড়েছে। পরিবর্তন নিয়ে কী বলবেন?
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ : শিক্ষা-স্বাস্থ্যে যে বরাদ্দ বেড়েছে, তা অপ্রতুল। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন ঘটাতে হলে বরাদ্দ আরও বাড়াতে হবে। এ বরাদ্দে শিক্ষার হার বাড়তে পারে, কিন্তু মান বাড়বে কি না, সন্দেহ আছে।
মূলত সরকারের হাতে টাকা দরকার। ঘাটতি থাকলে কিছুই সম্ভব নয়। ট্যাক্স ঠিক মতো আদায় করতে পারলে শিক্ষায় বরাদ্দ বাড়ানো সম্ভব। এ ক্ষেত্রে সরকারের ইচ্ছাশক্তির ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে।
জাগো নিউজ : দারিদ্র্য বিমোচনে বাজেট বক্তৃতায় কী পেলেন?
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ : সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বেড়েছে এবং এটা ইতিবাচকভাবে দেখতে হবে। উপকারভোগীর সংখ্যাও বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে। আমি মনে করি, এবারের বাজেটে এটাই সবচেয়ে সন্তোষজনক বিষয়।
তবে এ খাতের বরাদ্দ আরও সম্প্রসারণ এবং বণ্টনে সমতা আনা না হলে বৈষম্য কমানো যাবে না, দারিদ্র্যও বিমোচন হবে না।
বৈষম্য কমাতে হলে রাষ্ট্রের আয় বাড়াতে হবে। সেটা করতে হবে ধনীদের কাছ থেকে কর আদায় করে। কল্যাণ অর্থনীতির কথা তা-ই বলে। স্ক্যান্ডেনেভিয়ার দেশগুলোতে আমরা এমন অর্থনীতি দেখতে পাই। ধনীদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করে সমতা তৈরি করা। জার্মানিতেও এ নীতি আছে। অথচ আমরা কল্যাণ অর্থনীতি থেকে ধনতন্ত্রের দিকে যাচ্ছি।
বাংলাদেশ আমেরিকার পুঁজিবাদকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। অথচ ইউরোপের নীতিটাও আমরা রক্ষা করতে পারতাম। ধনীদের কোনো ছাড় নয়। গরিবদের নানা প্রণোদনা দিয়ে এগিয়ে আনার নীতি এখন সময়ের দাবি।
আজ এ পরিস্থিতির জন্য যে শক্তি দায়ী তার মূলে আঘাত করা জরুরি। এটা করতে না পারলে বৈষম্য ভয়াবহ রূপ নেবে। সামাজিক অস্থিরতাও বাড়বে। এজন্য পলিটিক্যাল কমিটমেন্ট দরকার। যেখানে জনগণেরও অংশগ্রহণ জরুরি।
জাগো নিউজ : সেই পলিটিক্যাল কমিটমেন্টের জন্য পলিটিক্যাল সেটেলমেন্টও দরকার...
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ : অবশ্যই। ধনীদের বাইরে যদি সাধারণ জনগণকে নিয়ে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা গড়ে তোলা যায়, তাহলে রাষ্ট্র শক্ত অবস্থানে দাঁড়াতে পারে।
জাগো নিউজ : কিন্তু ভোট, নির্বাচনে তো সাধারণ জনগণই এখন বাইরে থাকছে...
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ : সমস্যার মূলে যেতে হবে। নইলে জোড়াতালি দিয়ে স্থায়ী সমাধান হবে না।
মানুষ রাষ্ট্রের সবকিছুতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলছে। আগে বাজেট নিয়ে মানুষের মাঝে হৈ-চৈ পড়ে যেত। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও নানা আলোচনা হতো। এখন বলতে পারেন ‘টুঁ’ শব্দটাও নেই। তার মানে, রাষ্ট্রীয় বাজেটের প্রক্রিয়াটা এখন গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এ পরিস্থিতি থেকে মুক্ত হতে না পারলে, রাষ্ট্র জনগণের থাকে না।
জাগো নিউজ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন