রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এমাজউদ্দীন আহমদ প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, বিএনপির সংসদে যাওয়া ও রাজনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজানুর রহমান খান।
প্রথম আলো: বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের একটা দুর্দিন অবস্থা চলছে, বাংলাদেশ যাচ্ছে কোথায়?
এমাজউদ্দীন আহমদ: প্রজাতন্ত্র হিসেবে ৫০ না পেরোলেও এটা সাড়ে চার হাজার বছরের পুরোনো সমাজ। এর মধ্যে একাত্তরই বড় অর্জন। সাধারণ মানুষের তখনকার ও এখনকার মধ্যকার চাওয়ার মিলটা এক, সেটা নির্বাচন, আইনের শাসনে প্রত্যেকের থাকা।
প্রথম আলো: সরকারের বিরোধিতা, সমালোচনা ও ভিন্নমতের ধারণাগুলো বাঁচিয়ে রাখার উপায় কী?
এমাজউদ্দীন আহমদ: সূচনা বক্তব্যটা শেষ হয়নি। স্বাধীনতার তিন বছর না যেতেই জাতি গণতন্ত্র ধারণ করতে পারল না। একদলীয় শাসন হলো। ইদানীং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বলছেন, বাকশাল হলে ক্ষতি কী ছিল।
প্রথম আলো: এখন কেমন আছি?
এমাজউদ্দীন আহমদ: একটাই দল থাকবে, এমন একটি জায়গায় সম্ভবত আমরা চলে গেছি। হয়তো চীনের উদাহরণ টানা হবে। কিন্তু জনগণকে দূরে ঠেলে নয়, তাকে সঙ্গে নিয়ে চীন সীমাহীন উন্নতি করেছে। ওখানে একধরনের গণতন্ত্র আছে। মাও সে–তুং বলেছিলেন, যারা উন্নয়ন ঘটাবে, তাদেরকে অগ্রসর করে নিতে হবে। বিভিন্ন স্তরেই নেতারা নির্বাচিত হন। একে বলা হয় ডেমোক্রেটিক সেন্ট্রালিজম বা গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা। জনগণকে তারা পূর্ণভাবে প্রস্তুত করেন। মানুষকে আত্মসম্মান, আত্মশক্তি ও আত্মমর্যাদায় বলীয়ান করা হয়। নির্বাচননির্ভর অন্তত ৫০টি ধাপ পেরিয়ে তবে চীনা প্রেসিডেন্ট হন। বাকশালের সঙ্গে চীনা ব্যবস্থার তুলনার প্রশ্ন তাই অবান্তর।
প্রথম আলো: ঠিক কী কারণে বাংলাদেশে গণতন্ত্রহীনতার পরিস্থিতি তৈরি হলো?
এমাজউদ্দীন আহমদ: মূল কারণ দু-তিনটি। গণতন্ত্রের সৌন্দর্য হলো রাষ্ট্র থেকে সরকার এবং রাষ্ট্র ও সরকার থেকে দল আলাদা থাকবে। এখানে আলাদা নেই। কর্মকর্তারা নিযুক্ত হবেন মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে। গত ১০ বছরে তা থাকেনি। সব নিয়োগ ঘটে আনুগত্যে, তাই জনগণ নয়, তাঁদের জবাবদিহি করার দায় তৈরি হয় নিয়োগকর্তাদের প্রতি।
প্রথম আলো: কিন্তু ১০ বছরে কিছু ভালো আইন ও নীতি আমরা পেয়েছি। সেসব জনপ্রশাসন কার্যকর করতে অপারগ কেন?
এমাজউদ্দীন আহমদ: এটা তাদের দিয়ে হবে না। চীনের সঙ্গে তফাতটা এখানেই। অগ্রগতি বা উন্নয়নের জন্য তারা জনগণ ও তাদের চালিকা শক্তিকে আগে তৈরি করে নিয়েছে—উভয়ে অভিন্নবোধ ও চেতনাসম্পন্ন। আর এখানে তার ঘাটতি, কেউ কারও কাছে দায়ী নয়। ৩০ বা ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচন যা-ই বলি, তাতে জনগণ অংশ নিতে না পারায় সরকারের মধ্যে একধরনের ভয়ংকর অনিশ্চয়তা চলছে।
প্রথম আলো: রাজনীতি নাকি কৌশলের খেলা, বিএনপি তাতে হেরেছে। তাদের জেতানোর দায় ক্ষমতাসীন দলের নয়। জনগণ তো প্রতিবাদে মাঠে নামেনি। নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ বিএনপি।
এমাজউদ্দীন আহমদ: কথাটা ঠিক নয়। সত্তরের নির্বাচনের আগে জনগণকে উজ্জীবিত করতে সেভাবে বিরোধী দলকে কিছু করতে হয়নি। কারণ, সর্বস্তরের মানুষ দীর্ঘকাল শোষণ-বঞ্চনায় পর্যুদস্ত ছিল। তাই তারা অন্তর্গতভাবে ফেটে পড়েছিল, আপনি বর্তমান পরিস্থিতিতে নেতাদের উদ্যোগে কিছু সংগঠিত করার যে প্রসঙ্গ তুললেন, সেটি তাই ততটা প্রাসঙ্গিক নয়।
প্রথম আলো: তাহলে কী করে আমরা তেজি জিডিপি নিয়ে মধ্যম আয়ের দেশের দিকে এগোচ্ছি এবং দুনিয়ার সব বড় বড় সংস্থা বাংলাদেশকে অমিত সম্ভাবনার দেশ হিসেবে উল্লেখ করছে?
এমাজউদ্দীন আহমদ: এটা নতুন নয়, সুদূর প্রাচীনকাল থেকেই এই জনপদ সম্পর্কে অনুরূপ উচ্চ ধারণাই পোষণ করা হয়েছে। দারিদ্র্য এখানে কখনো ছিল না, তার প্রমাণ পর্তুগিজ, ওলন্দাজ, ফরাসি ও ব্রিটিশদের ছুটে আসা। সমৃদ্ধি না থাকলে ওরা আসত না। ১৭৫০ সালে বিশ্ব জিডিপির ৫০ ভাগ ছিল এই উপমহাদেশের। সেই ৫০ ভাগের অর্ধেকের বেশি ছিল বৃহত্তর বাংলার। এখানে তাই জাহাজ নোঙর করেছে। যা কিছু পেয়েছে, লুটে নিয়েছে। পলাশীর যুদ্ধের পরে ১০৩টি নৌকায় করে প্রথমে ফোর্ট উইলিয়াম ও পরে লন্ডনে নেওয়া মূল্যবান সম্পদ দিয়েই ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লবের গোড়াপত্তন ঘটে।
প্রথম আলো: বর্তমানের ধারা চলতে থাকলে সামনে কী কী বাধা আসতে পারে, কী করতে হবে?
এমাজউদ্দীন আহমদ: সুশাসনের ভিত্তিতে স্বশাসন মানে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দরকার পড়বে। আইনের শাসনের রাজত্ব লাগবে। যদি ব্যক্তির ইচ্ছা বা খেয়ালখুশির প্রাধান্য থাকে, তাহলে অগ্রসর হওয়ার পথ দেখি না। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে উন্নতি দেখছি, তাকে সংহত করতেও স্বশাসন লাগবে। জবাবদিহিমূলক আমলাতন্ত্র থাকলেই সংবিধানে যে জনগণের মালিকানা লেখা আছে, সেটা কায়েম হবে।
প্রথম আলো: ১০ বছর পরে কী ঘটবে, কীভাবে দেখেন?
এমাজউদ্দীন আহমদ: বর্তমানে কী ঘটছে? ছোট ছোট বাচ্চা, নারী, বা আপনি কি নিজেকে নিরাপদ বোধ করেন? সরকারের এই মেয়াদের প্রথম ১০০ দিন কেটে গেছে। মানুষের নিরাপত্তাবোধ কোথায়? কতজন মানুষ সড়কে, বিভিন্ন স্থানে মরছে? অথচ মানুষের নিরাপত্তা দেওয়া সরকারের দৈনন্দিন কাজ, সেটা করতে তারা ব্যর্থ হচ্ছে। কর্মকর্তারা সরকারি দলকে সেবা দিতেই শশব্যস্ত। গণতান্ত্রিক সরকার না হলে এই কর্মকর্তাদের মনোযোগ মানুষের দিকে ফিরবে না।
প্রথম আলো: ইতিহাস কী এটাই বলে যে সুশাসন শাসকের অনুকম্পার বিষয়? তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা যখন চাপ দিয়ে সেটা আদায়ে ব্যর্থ?
এমাজউদ্দীন আহমদ: আগেই বলেছি, সমাজবদ্ধতার দিক থেকে এই সমাজ চার হাজার বছরের বেশি পুরোনো। রাষ্ট্র গঠনের ৫০ বছরও হয়নি, অতীতে আপনি কী ছিলেন? পদদলিত, অবহেলিত, বঞ্চিত। হাজার বছরের শাসিত অবস্থা থেকে আমরা সীমাহীন ত্যাগ-তিতিক্ষার মধ্য দিয়ে একটি নতুন পর্যায়ে এসেছি। সেই সমাজের শাসকেরা এখন জনগণের কাছে জবাবদিহি করবেন না, তাঁদের কাছ থেকে দায়িত্বশীলতা পাব না? নিজের লাভের জন্য গণতন্ত্র নয়। রাজনীতি হলো সৃজনমূলক প্রক্রিয়ায় জাতীয় অগ্রগতি সাধন। এর বাইরে যা রাজনীতির নামে ঘটে, তা রাজনীতি নয়।
প্রথম আলো: সেই রাজনীতি বিরোধী দলে কেমন? বিএনপি ছাড়াও বাম, ডান, মধ্য ডান বা বাম তারা কেন রাজনীতির নামে যারা অনিষ্ট করছে, তাদের রুখতে অক্ষম?
এমাজউদ্দীন আহমদ: গত ১০ বছরে অনেক কারসাজি ঘটেছে। বিশ্বকে বোঝানো হয়েছে, ২৯ ডিসেম্বরে নয়, ৩০ ডিসেম্বরেই ভোট হয়েছে। এ বিষয়ে অন্যরা চুপ করে আছে, তার অর্থ এই নয় যে স্বাধীন বাংলাদেশে মানুষ তার নিজের বাড়িতে ঘুমাতেও পারবে না। বাইরে বেরোলে প্রতিদিনই দু-চারজন ঘরে ফিরবে না।
প্রথম আলো: এখন আপনি কী ধরনের মেরুকরণ আশা করছেন?
এমাজউদ্দীন আহমদ: মেরুকরণ? ডাকসু নির্বাচনে তরুণেরা ডানে-বামে একত্র হয়েছে।
প্রথম আলো: আশা যেটুকু তৈরি হলো, তাতে মনে হয় ওরা মূলধারায় জায়গা করে নেবে?
এমাজউদ্দীন আহমদ: নেবে কি না—এভাবেই সূচনাটা ঘটে, এটা বলতে পারি। আমাদের সন্তানেরা অনেক বেশি দুর্ভোগ সইছে। যত বেশি সইবে, ততই তারা বুঝবে। পরিত্রাণের পথ খুঁজবে।
প্রথম আলো: আপনার পাশেই দেখলাম একটি বই, হাউ ডেমোক্রেসিস ডাইজ। কী আছে এতে?
এমাজউদ্দীন আহমদ: পেঙ্গুইন প্রকাশিত এই বইয়ের লেখকদ্বয় পেশায় শিক্ষক। স্টিভেন লেভেস্কি, ড্যানিয়েল ডিব্লাক। তাঁরা দেখিয়েছেন, সত্তরের দশকের দিকে সামরিক শাসকেরা গণতন্ত্রের ক্ষতি করতেন। গণতন্ত্রকে বিধ্বস্ত করে তাঁরা নিজেরা শাসনক্ষমতা হাতে তুলে নিতেন। এখন গণতন্ত্রের ক্ষতি করতে সামরিক বাহিনীর প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়েছে।এখন রাজনৈতিক নেতারাই এই দুষ্কর্মগুলো করছেন। তাঁরাই নিজেদের লোক দিয়ে নানা কলাকৌশলে নিজেরাই নিজেদের নির্বাচিত ঘোষণা করিয়ে নিচ্ছেন। বইটি আরও বলেছে, এভাবে নির্বাচিতরা রাষ্ট্রের অর্থনীতিকে এমনভাবে পরিচালিত করছেন, যাতে সম্পদ অল্প লোকের হাতে পুঞ্জীভূত হবে আর দারিদ্র্যের বিস্তৃতি ও গভীরতা বেড়ে যায়। এর লক্ষ্য হলো শাসকের ওপর নির্ভরশীল গোষ্ঠী তৈরি করা। এই প্রক্রিয়াতেই রাষ্ট্রের আমলাতন্ত্রকে ব্যবহার করার অনুশীলন বিশ্বময় শুরু হয়ে গেছে। আর এভাবে সরকারি কর্মকর্তাদের ব্যবহার করার পরিকল্পনা কার্যকরতা ঘটতে পারে, যদি তাঁদেরকে আনুগত্যের ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হয়। এ রকম একটি অবস্থায় শাসকেরা সহজে নিজেরাই নিজেদের নির্বাচিত করতে পারেন।
প্রথম আলো: আমাদের আসন্ন সংকট কী?
এমাজউদ্দীন আহমদ: কথা হলো, মানুষ ভোট দিতে পারলে শাসকের একটা জায়গা থাকে, সেটা ২৯ ও ৩০ ডিসেম্বরের পরে একেবারে নড়বড়ে হয়ে গেছে। এভাবে চলতে চলতে অবস্থা এমন একটা স্থানে পৌঁছাবে, তখন সাধারণ মানুষ একটা আন্দোলন শুরু করে দেবে।
প্রথম আলো: রাষ্ট্রের তিনটি স্তম্ভ করাই হয়েছিল একটি ব্যর্থ হলে অন্যটি সামলাবে, কী করে সব কটিই দুর্বল হলো, এমনকি চতুর্থটিও রুগ্ণ—
এমাজউদ্দীন আহমদ: সর্বত্র সবটাই কমবেশি নিয়োগ সূত্রে বাঁধা। আরও নিচে দেখেন, হাকিমেরা কীভাবে কর্মক্ষেত্রে ঢুকছেন? বিচারহীনতা তীব্রতর হওয়ার এটাও বড় কারণ। বিচারহীনতা ও দায়মুক্তির সংস্কৃতি নিয়ে যেভাবে চলছি, তাতে আপনারাই একদিন বলবেন, যথেষ্ট হয়েছে। চলুন, ভোটাধিকারের গণতন্ত্রেই ফিরে যাই। অটোক্র্যাসি নিয়ে আর তো পারি না।
প্রথম আলো: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে দুই-তৃতীয়াংশের বেশি রাষ্ট্র একনায়কতান্ত্রিকতার খোলসে সংবিধান ও গণতন্ত্র পেয়েছে। ট্রাম্প, মোদি, পুতিন প্রমুখও গণতন্ত্রের ফল। ব্যবস্থা হিসেবে ওটা আর কতটুকু কার্যকর?
এমাজউদ্দীন আহমদ: এসব দেশ একটা ভয়ংকর স্থিতাবস্থার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু লক্ষণীয়ভাবে তারা ভোট দিয়ে নেতা পরিবর্তনের বিকল্প ভাবছে না। গণতন্ত্রের বিকল্পের জন্য হয়তো আরও এক শ বছর অপেক্ষা করতে হবে।
প্রথম আলো: বিএনপি এখন সংসদীয় বিরোধী দল বা গ্রুপ হলো, বিএনপি বা জাতীয় পার্টি কী করবে?
এমাজউদ্দীন আহমদ: জাতীয় পার্টি কি বিরোধী দল? তারা তো শাসকদেরই একটি ছোট্ট গোষ্ঠী। বিএনপি এখন এমন একটি দল, যার মুখ্য নেতাদের একজন বিদেশে, অন্যজন কারাগারে। বিএনপি যেভাবে সংসদে থাকল, তা নিয়ে খুব বেশি মন্তব্য করতে চাইব না।
প্রথম আলো: নির্বাচনের আগে আপনি বলেছিলেন ৫০-৬০টি হলে বিএনপি সংসদে ভূমিকা রাখতে পারত....
এমাজউদ্দীন আহমদ: সেটা হলে হতো, তা তো হয়নি। এখন স্থায়ী কমিটির যাঁরা আছেন, তাঁরা চাপে, প্রলোভনে হয়তো থাকবেন, কিন্তু তাঁদের সিদ্ধান্তই দল চালানোর জন্য বড়।
প্রথম আলো: খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তির বিষয়টি তো রাজনীতির বাইরে নয়, দল এ নিয়ে কিছু বলবে না কেন?
এমাজউদ্দীন আহমদ: এটা দলের নয়, খালেদা জিয়া, তাঁর ছেলে বা পরিবারের সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়।
প্রথম আলো: গোড়াতে রাজি না হলেও শেখ হাসিনা প্যারোলে বিদেশে গিয়েছিলেন।
এমাজউদ্দীন আহমদ: এক-এগারোর কুশীলবদের ভূতাপেক্ষ বৈধতা দিতে রাজি হওয়ার কারণেই তিনি ওই সুযোগ পেয়েছিলেন। এখন আমার কথা হলো, খালেদা জিয়া একজন বয়স্ক মানুষ। বয়স পঁচাত্তরের বেশি হবে। আমি উপাচার্য ছিলাম, আমার আগে ও পরে যাঁরা হয়েছেন, তাঁদের সঙ্গে একটা সহকর্মী বা সহযোগীর সম্পর্ক রাখি। এখানেও তা-ই। আজ খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের বিষয়ে যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে, তাহলে এই সরকার তার দায় এড়াতে পারবে না। তিনি দেশের ইতিহাসের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী, তিনবার প্রধানমন্ত্রীর শপথ নিয়েছেন, আরও দুই মেয়াদে ছায়া প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। শেখ হাসিনাও জীবনে অনেক যাতনা সয়েছেন। সামনে যে তারিখ আছে, সেখানে তিনি জামিন পেতে পারেন। তবে সেটা তাঁকে চাইতে হবে। না চাইলে হবে না। খালেদা জিয়া যেহেতু প্যারোল নাকচ করেছেন, তাই তাতে কাজ হবে না। আমি মনে করি, দেশে যদি একটি রাজনৈতিক সমঝোতার পরিস্থিতি তৈরি হয় এবং খালেদা জিয়া যদি জামিন পান তাহলে দেশের অবস্থা ভালো হবে। প্রধানমন্ত্রী উদার হয়ে যদি এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেন। তাহলে দেশের বিএনপিপন্থী মানুষ, যাঁরা এখনো প্রায় ৪০ ভাগ, তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর প্রতি একটা কৃতজ্ঞতার বন্ধন অনুভব করবেন।
প্রথম আলো: বিভিন্ন সময়ে খালেদা জিয়ার সঙ্গে আপনার অন্তরঙ্গ আলোচনা হয়েছে। সে সময়ে আপনি বঙ্গবন্ধুকন্যার প্রতি তাঁর কেমন ব্যক্তিগত মনোভাব লক্ষ করেছেন?
এমাজউদ্দীন আহমদ: আমার মনে পড়ে, তিনি অত্যন্ত আন্তরিকভাবে এক-এগারোতে শেরেবাংলা নগরের বিশেষ কারাগারে পাশাপাশি তাঁদের দুজনের সময় কীভাবে কেটেছিল, সেটা স্মৃতিচারণা করেছিলেন। আর সে সময় বলেছিলেন যে একদিন শেখ হাসিনা তাঁর খাবার ভাগ করে খালেদা জিয়াকে খাইয়েছিলেন।
প্রথম আলো: অনেকে বলেন, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার ঘটনা দুজনের সম্পর্ক তিক্ত করেছে।
এমাজউদ্দীন আহমদ: পেছনে ফিরলে অনেক ইতিবাচক কিছু দেখতে পাবেন। শেখ হাসিনা যে নিজে রান্না করে খালেদা জিয়াকে খাইয়েছেন, তা বিশ্বাস করেন? এখন তাঁর থেকে প্রবীণ, অসুস্থ একজন সহকর্মীকে যদি একটু সুযোগ না দেন তা হলে তো হবে না। কারণ, আইন, আদালত, বিচার সবকিছুই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে এক জায়গা থেকে।
প্রথম আলো: মাইনাস টু তাঁদের কাছাকাছি এনে দিয়েছিল।
এমাজউদ্দীন আহমদ: হ্যাঁ, তা দিয়েছিল। আমি বলব, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখন এমন একটি পর্যায়ে আছেন, সেখান থেকে উদার হওয়া কাঙ্ক্ষিত বলে মনে করি। জাতীয় পর্যায়ে এর একটা সুফল পাওয়া যাবে। খালেদা জিয়া যদি জামিনে বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা নিয়ে ফেরেনও, তাহলেও তাঁর রাজনীতি আর আগের জায়গায় থাকবে না। রাজনীতি আরও বেটার হবে। বিএনপি আর অন্য পথে যাবে না, সরকারটা আরেকটু ভালো চলুক, এটাই বলব। বর্তমানে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা জাতীয় রাজনীতিতে যে অবস্থায় আছেন, সেখানে দুই সহযোগীর মধ্যে একটা পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের যদি বহিঃপ্রকাশ দেখতে পাই, তাহলে আমি ব্যক্তিগতভাবে খুশি হতাম। খালেদা জিয়া জামিন পেলে সারা দেশের বিএনপির নেতা-কর্মীরা দারুণভাবে খুশি হতেন এবং এই সরকারও অনেক শক্তিশালী হতো।
প্রথম আলো: কীভাবে শক্তিশালী হতো?
এমাজউদ্দীন আহমদ: এর ফলে জনগণের কাছে সরকারের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ত।
প্রথম আলো: অনেকে বলছেন, দল বাঁচাতে বিএনপি সংসদে, পদ বাঁচাতে মহাসচিব সংসদের বাইরে।
এমাজউদ্দীন আহমদ: এটা ঠিক যে মহাসচিবের সংসদে যাওয়াটাই অধিকতর সমীচীন ছিল। কারণ, কী সিদ্ধান্ত দলের স্থায়ী কমিটি নিয়েছে, সেটা তাঁরই ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে জানানোর কথা। এখন তাঁর (তারেকের) সঙ্গে যোগাযোগ না করে কোনো কথা বলা যাবে না। তবে মির্জা ফখরুলের যোগদান না করাটাই হয়তো ভালো হয়েছে। কারণ, তিনি যোগ দিলে দলটাই ভেঙে যেতে পারত। মির্জা ফখরুল সংসদে গেলে আমি খুশি হতাম। সংসদের বিরোধী দলে বিএনপির একটি ইউনিট হতো, তিনি সবাইকে সংগঠিত করতেন এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে শক্ত কথা বলতে পারতেন।
প্রথম আলো: ইতিহাসে নতুন ও অভিনব। যোগদান ও বর্জন—দুটোরই আমেজ থাকছে।
এমাজউদ্দীন আহমদ: ৩০ ডিসেম্বর তো একটি সম্পূর্ণ নতুন ঘটনা। দেশের বৃহত্তম বিরোধী দল, বিপুল জনসমর্থন নিয়েও মোটে ছয়টি আসন পেল। এটা তো অদ্ভুত ঘটনা।
প্রথম আলো: নারী আসনে জোবাইদা (তারেকের স্ত্রী) ও সিঁথির (কোকোর স্ত্রী) কথা শোনা যাচ্ছে?
এমাজউদ্দীন আহমদ: জোবাইদাকে আমি স্বাগত জানাব।
প্রথম আলো: তাঁকে বিএনপির সংসদীয় গ্রুপে মুখ্য ভূমিকায় দেখতে চাইবেন?
এমাজউদ্দীন আহমদ: মির্জা ফখরুল থাকলে ভিন্ন কথা ছিল। সে ক্ষেত্রে জোবাইদা মুখ্য থাকবেন।
প্রথম আলো: গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলছেন, সংসদে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে মির্জা ফখরুল সার্কাসের জোকার হয়েছেন। তারেকের নির্দেশ পাঠ করছেন। এসব বিএনপিতে ভাঙনের সানাই...
এমাজউদ্দীন আহমদ: বিএনপি ভেঙে যাচ্ছিল। ভেঙে যাওয়াটা ঠেকানো হয়েছে। যত দূর জানি, তারেক দলের ভাঙন রোধ করতে পেরেছেন। দল ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা হয়তো থাকে, আছে। এই মুহূর্তে তা তিনি বন্ধ করতে পেরেছেন। যাঁরা অংশ নিলেন, তাঁদের এক কক্ষে বসিয়ে তাঁদের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করলেন। এরপর সিদ্ধান্ত দিলেন।
প্রথম আলো: মির্জা ফখরুল যেভাবে ‘কৌশল’ বলে দাবি করেছেন, তা মুখরক্ষা, আসলে সিদ্ধান্তটা বাধ্যবাধকতা।
এমাজউদ্দীন আহমদ: এটা ঠিক। হি হ্যাড টু ওয়ার্ক আন্ডার সাম কমপালসন। আপাতত তিনি বিষয়টি মোকাবিলা করেছেন।
প্রথম আলো: বেইজিংয়ে ভারত ও ভুটানবিহীন ওয়ান বেল্ট অ্যান্ড রোড সামিটে বাংলাদেশের থাকাটা কীভাবে দেখছেন?
এমাজউদ্দীন আহমদ: জিয়াউর রহমানের নীতির প্রতিফলন দেখি। তিনি একই সঙ্গে ভারত ও চীনের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখাটা বাংলাদেশের জন্য অপরিহার্য ভেবেছিলেন। আমি শেখ হাসিনার পররাষ্ট্রনীতির এই দিকটিকে স্বাগত জানাই।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
এমাজউদ্দীন আহমদ: ধন্যবাদ।
প্রথম আলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন