নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতি নিয়ে প্রথম আলোর মুখোমুখি হয়েছেন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি, সাংসদ ও সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক মিজানুর রহমান খান।
প্রথম আলো: বিএনপি সংসদে এলে খুব অবাক হবেন?
রাশেদ খান মেনন: আমি অবাক হব না। সুলতান মনসুর যোগ দিয়েছেন। দু-একজন বাদে বাকিরাও হয়তো যোগ দেবেন। যদি তাঁদের কাণ্ডজ্ঞান বা কৌশলজ্ঞান থাকে, তাহলে তাই মনে হয়।
Eprothom Aloপ্রথম আলো: খালেদা জিয়া বাইরে এলে স্থিতির জন্য হুমকি হবে বলে মনে করেন?
রাশেদ খান মেনন: না। বাইরে আসাটা আমাদের নয়, আদালতের ওপর নির্ভর করছে।
প্রথম আলো: খালেদা জিয়া জামিনে বের হলে রাজনীতিক হিসেবে খুশি হবেন?
রাশেদ খান মেনন: তিনি আসতে পারলে আপত্তির কিছু দেখি না। তিনি বাইরে এলেও রাজনীতিকে অস্থিতিশীল করার মতো রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক জায়গায় তিনি নেই।
প্রথম আলো: প্রধান বিরোধী দলকে জনগণ যেভাবে ‘নাকচ’ করেছে, তাতে ভবিষ্যতে বিরোধী দল থাকার দরকার আছে কি না?
রাশেদ খান মেনন: বিরোধী দল থাকেই। কোনো সরকার আইন করে বিরোধী দল নিষিদ্ধ করলেও থাকবে। বাকশালে সব দল বিলুপ্তির পরও আমরা তো ছিলাম।
প্রথম আলো: অনেকের মতে, আপনারা মন্ত্রিত্ব না নিয়ে বিরোধী দলে থাকলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বেশি লাভবান হতো।
রাশেদ খান মেনন: বিএনপি-জামায়াতের চরম দুঃশাসন ও বাংলা ভাইয়ের উত্থানের প্রতিবাদ করার প্রেক্ষাপটে আমরা ১৪ দল করেছিলাম। সেটাকে বাদ দিয়ে সরাসরি আজকের প্রেক্ষাপটে দেখলে সঠিক মূল্যায়ন হবে না। ২০০৩ সালে মুক্তাঙ্গনে ওয়ার্কার্স পার্টিই প্রথম বিএনপি-জামায়াতকে না বলেছে। যদিও আওয়ামী লীগের সঙ্গে আমাদের আদর্শগত তফাত আছে।
প্রথম আলো: ধরুন, লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে। আগামী সাধারণ নির্বাচনেও কি আপনাদের নৌকা প্রতীকে দেখব?
রাশেদ খান মেনন: আমাদের দল মনে করে, ১৪-দলীয় জোটে থাকার প্রাসঙ্গিকতা আছে। কারণ, সাম্প্রদায়িক শক্তিকে সাংগঠনিকভাবে পর্যুদস্ত করতে পারলেও রাজনৈতিকভাবে আমরা পারিনি। ওই শক্তিগুলো এখনো সক্রিয়। তবে ঐক্য ধরে রাখতে হবে পারস্পরিক সম্মান ও মর্যাদার ভিত্তিতে।
প্রথম আলো: আপনাকে মন্ত্রিত্ব না দেওয়াটা কি অমর্যাদার? আবার ডাক পেলে যাবেন?
রাশেদ খান মেনন: না, মন্ত্রিত্ব নয়, ১৪ দলে থেকেও একসময় মন্ত্রিত্ব নিইনি। বিএনপির লাগাতার সন্ত্রাস মোকাবিলায় অসাম্প্রদায়িক সরকারকে সহায়তা দিতেই মন্ত্রিত্ব নিয়েছিলাম। তবে আমার মন্ত্রী হওয়ার খায়েশ নেই। মর্যাদার যে জায়গা সেটা মন্ত্রিত্ব নয়, আমার বাক্স্বাধীনতা ও সংগঠন করার সুযোগ দিতে হবে।
প্রথম আলো: আপনার বাক্স্বাধীনতা কি ঝুঁকিতে?
রাশেদ খান মেনন: নিশ্চয়ই। আমি উপজেলা নির্বাচনের কথাই বলতে পারি। যারা বর্জন করেছে, করেছে। আমরা তো বিভিন্ন স্থানে প্রার্থী দিয়েছি। তানোরে আমাদের প্রার্থী একটি ইউনিয়ন বাদে বাকি সব কেন্দ্রে পাঁচ হাজার ভোটে এগিয়ে থাকল। তাদের ঘেরাও দিয়ে রাখতে হয়েছিল। কিন্তু ওই একটি ইউনিয়ন, যা আওয়ামী লীগের সাংসদের এলাকা, সেখান থেকে ফল আসছিল না। বহুক্ষণ বন্ধ ছিল। ওই এলাকায় ৮৫ ভাগ ভোট, আর শত বাধার পরেও বাকি সব ইউনিয়নে ৫৬ ভাগ ভোট পড়েছে। আমরা ৩০০ ভোটে হারলাম।
প্রথম আলো: আপনি ভোটে কারচুপির অভিযোগ তুলছেন?
রাশেদ খান মেনন: শুধু কারচুপিই নয়, আমাদের কর্মীরা সেখানে দাঁড়াতে পারেনি। ইসির কাছে নালিশ করতে হয়েছে।
প্রথম আলো: ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন সম্পর্কে বিএনপির অভিযোগের সঙ্গে আপনার অভিযোগের মধ্যে একটি মিল পাচ্ছি! ইসির হিসাবেই উপজেলায় মাত্র ৪৩ ভাগ ভোটার ভোট দিয়েছেন, এটা কি স্থায়ী অনাস্থা আনছে?
রাশেদ খান মেনন: না, মিল নেই। তার কারণ তারা দাঁড়ানোর চেষ্টাই করেনি। তারা নির্বাচন নিয়ে বাণিজ্য করেছে, কৌশল করেছে। একে প্রশ্নবিদ্ধ করতে তারা নানা খেলা খেলেছে।
প্রথম আলো: সংসদে বলেছেন, ভোটের প্রতি মানুষের ‘নেগেটিভ পারসেপশন’ এবং ভোটে অনীহা দেখা দিয়েছে। নিউইয়র্ক টাইমস বলেছে প্রহসন।
রাশেদ খান মেনন: নিউইয়র্ক টাইমস-এর পারসেপশন দিয়ে আমি চলি না। তাদের মতামত আমি গ্রহণ করিনি। আমি আমার পারসেপশন দিয়ে চলি। আমি আমাদের জনগণ যেভাবে দেখে, তার ভিত্তিতে বলেছি।
প্রথম আলো: তানোরের কৌশলের সঙ্গে ডাকসু নির্বাচনের মিল পান?
রাশেদ খান মেনন: না, দুই প্রেক্ষাপটের বিষয়।
প্রথম আলো: একটি মিল, যেকোনো মূল্যে জিততেই হবে।
রাশেদ খান মেনন: এটা তাদের (সরকারি দল) মানসিকতার ব্যাপার। তবে ডাকসুতে ঢাবি কর্তৃপক্ষ ছাত্রদের প্রত্যাশা পূরণে একেবারেই ব্যর্থ হয়েছে, মানুষের প্রত্যাশা মাটিতে লুটিয়ে গেছে।
প্রথম আলো: এবার ডাকসুর সাবেক ভিপি হিসেবে বলুন, নতুন ডাকসু নির্বাচন চান?
রাশেদ খান মেনন: এটা ছাত্ররা ঠিক করবে। (হাসি) আমাদের দল-সমর্থিত ছাত্রসংগঠন অবশ্য পুনর্নির্বাচন চাইছে।
প্রথম আলো: সংসদের বক্তৃতায় আপনি তেঁতুল হুজুর, কওমি জননী শব্দগুলো ব্যবহার করেছেন। আবার ‘মূল ধারায় ফিরিয়ে আনতে প্রধানমন্ত্রীকে সাধুবাদ’ জানিয়েছেন। হাসানুল হক ইনুও তা-ই বলছেন। এটা স্ববিরোধী নয় কি?
রাশেদ খান মেনন: আপনি সাধুবাদ দেখেছেন। কিন্তু পরের বাক্যটি দেখেননি।
প্রথম আলো: আপনি সরকারকে সতর্ক করেছেন। কিন্তু মূলধারায় কী করে আনা হলো, সেটা বলুন। প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় না আসাটাই তাদের অপরিবর্তনীয় নীতি। তারা শুধুই স্নাতকোত্তরের স্বীকৃতি চায়। এটা পাকিস্তান করেছে।
রাশেদ খান মেনন: আমি বলছি, সরকারের একটা উদ্যোগ তো ছিল। ওপরের দিকে হয়েছে, নিচের দিকে হয়নি। সে কারণেই আমি সরকারের প্রতি এই সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছি। তাদের মূলধারায় আনতে হলে সামগ্রিকভাবে আনতে হবে।
প্রথম আলো: অনেকে মনে করেন, নির্বাচনব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত করাসহ নানা কারণে সাম্প্রদায়িকতা ও তার হুমকি আগের থেকে আরও বেড়েছে।
রাশেদ খান মেনন: নির্বাচনের সঙ্গে সম্পর্ক নেই। রাজনৈতিক ও সামাজিকতায় সামগ্রিকভাবে যে চর্চা চলছে, এটা সেখান থেকে এসেছে। সাম্প্রদায়িক মানসিকতার বিস্তৃতি ঘটেছে।
প্রথম আলো: শিক্ষানীতি আট বছরেও বাস্তবায়িত হলো না।
রাশেদ খান মেনন: এটা হয়নি। বহুমুখীর পরিবর্তে আমরা একমুখী শিক্ষা চেয়েছি, সেটাও হয়নি, এখন বহুমুখিতা আরও ডালপালা বিস্তার করছে। শিক্ষা আইনটি করা হয়নি। অষ্টম শ্রেণিবিষয়ক সিদ্ধান্ত নিয়ে দুই মন্ত্রণালয়ে রশি টানাটানি চলছে।
প্রথম আলো: সরকারের সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জ কী?
রাশেদ খান মেনন: উন্নয়নে বৈষম্য দূর করা। দেশে অতি ধনী চীনের থেকেও বেড়েছে। দেশের শীর্ষ ৫ শতাংশ ধনীর সম্পদ ১২১ গুণ বেড়েছে, অন্যদিকে সব থেকে গরিব ৫ শতাংশের কাছে থাকা মাত্র ১ শতাংশ সম্পদও কমে চার ভাগের এক ভাগের কমে দাঁড়িয়েছে। ক্রমবর্ধমান বৈষম্য ও বছরে ৮ লাখ করে বেকার বাড়া সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতির জন্য বিরাট হুমকি। দুর্নীতি দমন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার চ্যালেঞ্জ গুরুত্বপূর্ণ। দুর্নীতি দমনের শুরু করতে হবে সমাজের ওপর স্তর থেকে। অভাব থেকে যারা দুর্নীতি করে, তার থেকে লোভ থেকে যারা করে তাদের ধরাটা জরুরি।
প্রথম আলো: পররাষ্ট্রনীতি, সৌদির সঙ্গে সামরিক চুক্তি?
রাশেদ খান মেনন: প্রধানমন্ত্রী যদিও বলেছেন, চুক্তি নয়, সমঝোতা স্মারক হয়েছে। এটা পরীক্ষার ব্যাপার। ইয়েমেন সীমান্তে মাইন সরানোটাও বহির্বিশ্বে আমাদের প্রশ্নবিদ্ধ করবে। বাংলাদেশে সৌদি বিনিয়োগকে স্বাগত। কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতা হলো, এর সঙ্গে আরও অনেক কিছু চলে আসে, সে বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। সার্বিকভাবে আমাদের পররাষ্ট্রনীতিতে ভারসাম্য আছে বলেই মনে করি। রোহিঙ্গা সংকট নিরসন দ্বিপক্ষীয়ভাবে হওয়ার নয়, আন্তর্জাতিক সুরাহা লাগবে।
প্রথম আলো: হেফাজত আপনার পদত্যাগ দাবি করছে, আপনি কী বলবেন?
রাশেদ খান মেনন: সংসদে আমি সাধারণ শিক্ষা পাঠ্যক্রম নিয়ে বলেছি। বিভাজন সৃষ্টি প্রসঙ্গে পাকিস্তান আমলের উদাহরণ টেনেছি। ধর্ম সম্পর্কে কিছুই বলিনি। ১৯৯২ সালে আমার বিরুদ্ধে অনুরূপ প্রচারণা চলেছিল, যা আদালতে মিথ্যা প্রমাণিত হয়। সংগ্রাম সম্পাদক আবুল আসাদের
সাজা হয়েছিল।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
রাশেদ খান মেনন: ধন্যবাদ।
প্রথম আলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন