লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক সাংসদ। ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও বিএনপির রাজনীতি নিয়ে তিনি কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান
প্রথম আলো: বিএনপির এখন কোন পথে?
Eprothom Aloমাহবুবুর রহমান: বিএনপি অত্যন্ত কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আমি বলব, প্রতিষ্ঠার পর থেকে নানা চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে বিএনপি চললেও এখনই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জে পড়েছে। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া জেলে। বিএনপি নির্বাচনে গেল। কিন্তু সেই নির্বাচনে সাংঘাতিক বিপর্যয় ঘটল। যে ফলাফল এসেছে, তা ছিল অচিন্তনীয়। নেতা-কর্মীদের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছে। তবে এই হতাশা কাটিয়ে উঠতে হবে। আমি আশাবাদী মানুষ। এখনো দলটির প্রতি দেশের ব্যাপকসংখ্যক মানুষের আস্থা আছে। সেই আস্থাকে সম্বল করেই আমাদের এগোতে হবে। আর ফলাফল বিপর্যয়ের জন্য পুরোপুরি বিএনপিকে দায়ী করাও ঠিক হবে না। যে নির্বাচন কমিশন নির্বাচনটি পরিচালনা করেছে, প্রতিটি ক্ষেত্রে তারা ব্যর্থ হয়েছে। তারা জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে পারেনি।
প্রথম আলো: আপনারা বলেছিলেন, ভোটবিপ্লব হবে। কিন্তু ভোটবিপ্লবটা হলো না কেন?
মাহবুবুর রহমান: প্রথমেই স্বীকার করতে হবে নেতৃত্বের ব্যর্থতা। যেভাবে নির্বাচনী লড়াইটা চালানো উচিত ছিল, সেটি আমরা অনেক ক্ষেত্রেই পারিনি। দলের হাইকমান্ড বা শীর্ষ নেতৃত্ব অনেক দূর থেকে বিষয়টি দেখেছেন, পরিচালনা করেছেন। এ ক্ষেত্রে যোগাযোগেরও ঘাটতি ছিল, সমন্বয়ের অভাব ছিল, আস্থাহীনতাও ছিল। বহুদূর থেকে দল পরিচালনা করা হয়েছে, যা বাস্তবে সম্ভব নয়।
প্রথম আলো: আপনিও তো বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য। এ ব্যর্থতার দায় তো আপনাকেও নিতে হবে?
মাহবুবুর রহমান: স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে আমার যে দায়িত্ব পালন করার কথা, সেটি করতে পারিনি। অনেকেই পারেননি। আমরা হয়তো হাইকমান্ডকে বাস্তব অবস্থাটা বোঝাতে পারিনি।
প্রথম আলো: বিএনপি এই বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে পারবে বলে মনে করেন?
মাহবুবুর রহমান: বিএনপি মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান প্রতিষ্ঠিত দল। তাঁকে অনেক কাছ থেকে দেখেছি। তাঁর প্রচণ্ড সাহস ও নৈতিক জোর ছিল। দুর্নীতির সঙ্গে তিনি কখনো আপস করেননি। যারা ছোটখাটো দুর্নীতি করেছে, তিনি তাদেরও ছাড় দেননি। আমি মনে করি, জিয়াউর রহমানের নীতি
ও আদর্শ মেনে চললে এই বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠা অসম্ভব নয়।
প্রথম আলো: নির্বাচনে মনোনয়ন-বাণিজ্যের অভিযোগ এসেছিল। আমরা নয়াপল্টনে বিএনপির অফিস ও গুলশানে দলীয় চেয়ারপারসনের অফিসে বিক্ষোভের ঘটনা ঘটতে দেখেছি।
মাহবুবুর রহমান: জিয়াউর রহমান যে দলটি প্রতিষ্ঠা করেছেন, সেই দলের মনোনয়ন-বাণিজ্যের অভিযোগ ওঠা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। মনোনয়ন-বাণিজ্য হোক বা না হোক, জনগণের মধ্যে সেই ধারণা পোক্ত হয়েছে। ভবিষ্যতে দলীয় নেতৃত্বকে আরও বিচক্ষণতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে, যাতে এ ধরনের অভিযোগ না ওঠে।
প্রথম আলো: নির্বাচনী ব্যর্থতার জন্য কি হাইকমান্ডকে দায়ী করবেন?
মাহবুবুর রহমান: এ ব্যাপারে হাইকমান্ড দায়ী কি দায়ী নয়, সে কথা আমি বলব না। তবে যেভাবে মোকাবিলা করার কথা ছিল, তাঁরা সেটি করতে পারেননি।
প্রথম আলো: স্থায়ী কমিটির সদস্য হয়েও আপনি নিজে কেন প্রার্থী হলেন না?
মাহবুবুর রহমান: দল থেকে আমাকে প্রার্থী হতে বলেছিল। আমি রাজি হইনি। আমার বিশ্বাস ছিল, নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে না। সে ক্ষেত্রে নির্বাচনে গিয়ে কী হবে। অতীতেও নির্বাচন কমিশন সরকারের নিয়ন্ত্রণে ছিল। কিন্তু বর্তমান নির্বাচন কমিশন আরও বেশি নিয়ন্ত্রিত ছিল। সরকার যা চেয়েছে, তা-ই তারা করেছে। সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশই ছিল না।
প্রথম আলো: নির্বাচনী পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে আপনারা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সংলাপ করেছিলেন।
মাহবুবুর রহমান: সংলাপ তো ভালো বিষয়। সমস্যার সমাধানে এটাই উত্তম উপায়। এ কারণে আমরা সংলাপে গিয়েছি। কিন্তু ফল হয়েছে উল্টো। সরকার কথা রাখেনি। নির্বাচন কমিশন সরকারের ইচ্ছের বাইরে কিছু করেনি। সিইসিসহ পাঁচজন নির্বাচন কমিশনের মধ্যে মাহবুব তালুকদার ছাড়া কেউ চাননি নির্বাচন সুষ্ঠু হোক।
প্রথম আলো: কিন্তু শেষ দিকে মাহবুব তালুকদারও তো পিছু হটেছেন। তিনি বলেছেন, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হয়েছে, এটাই বড় অর্জন।
মাহবুবুর রহমান: আমি মনে করি, তাঁর আন্তরিকতা ছিল, চেষ্টা ছিল। কিন্তু তিনি একা তো কিছু করতে পারেন না। টিমের সবাই বিপরীতে গেলে, তিনি কী করবেন। তবু তিনি সত্য তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।
প্রথম আলো: আপনারা বলেছেন, নির্বাচনে ভোট ডাকাতি হয়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক মহল তো নির্বাচনে জয়ী দলের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছে।
মাহবুবুর রহমান: বিএনপির ব্যর্থতা হলো আন্তর্জাতিক মহলের কাছে আমরা প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরতে পারেনি। কিছু কিছু চেষ্টা হয়েছিল। এখানে অবস্থানরত বিদেশি কূটনীতিকদের ব্রিফ করা হয়েছে। আমার ধারণা, আন্তর্জাতিক মহলকে বোঝাতে পারলে আমরা তাদের সমর্থন পেতাম। এ নির্বাচনে মহা অন্যায় হয়েছে। কিছু কিছু পত্রপত্রিকায়ও এসেছে। তারপরও বলব, এই হতাশা কাটিয়ে উঠতে হবে। নেতা-কর্মীদের মধ্যে অনেক প্রশ্ন আছে। দলের বহু ত্যাগী নেতা-কর্মী এখনো জেল-জুলুমের শিকার হচ্ছেন। কিন্তু দলের ভাগ্য নির্ভর করবে হাইকমান্ডের ওপর।
প্রথম আলো: হাইকমান্ডের ভুল কোথায়?
মাহবুবুর রহমান: আমি বলব, যদি দলের নেতৃত্ব দিতে হয়, তারেক রহমানকে দেশে এসেই নেতৃত্ব দিতে হবে। দল পরিচালনা করতে হবে। অন্য দেশ থেকে সেটি সম্ভব নয়। ইরানের আয়াতুল্লাহ খোমেনিই শেষ উদাহরণ, যিনি বিদেশ থেকে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। বিএনপি আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি বলেই নির্বাচনে জয়ী হতে পারেনি। তবে বিএনপির এই বিপর্যয় সাময়িক। আমরা যদি জিয়ার চিন্তা-চেতনায় বিশ্বাস করি, তাহলে হতাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই। তাঁকে নেতা মানলে তাঁর নীতি ও আদর্শও মেনে চলতে হবে।
প্রথম আলো: নির্বাচনের প্রশ্নে দলে মতভেদ ছিল বলে গণমাধ্যমে এসেছে। এ ব্যাপারে দলের চেয়ারপারসন ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের মধ্যে কোনো মতভেদ ছিল কি?
মাহবুবুর রহমান: চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাবন্দী। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান লন্ডনে। তারপরও তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। তাঁরা দুজনই নির্বাচনের বিষয়ে একমত ছিলেন। খালেদা জিয়ার অমতে কিছু হয়নি। দলীয় ফোরামে অনেক রকম আলোচনা হয়েছে। অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন। আমিও বলেছি, নির্বাচনে গিয়ে লাভ কী। পরাজিত হবেন। যাঁরা জয়ী হবেন, তাঁদের স্বীকৃতি দেওয়া হবে। তবে যখন নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হলো, তখন কেউ বিরোধিতা করেননি।
প্রথম আলো: নির্বাচনের পর তো কেউ কেউ বলছেন, তাঁরা নির্বাচনে যাওয়ার পক্ষে ছিলেন না।
মাহবুবুর রহমান: পরে বলতে পারেন। আগে বলেননি। আলোচনার সময় হয়তো স্থায়ী কমিটির দু-একজন সদস্যের দ্বিমত ছিল। কিন্তু নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত যখন হলো, কেউ এর বিরোধিতা করেননি।
প্রথম আলো: বিএনপির এখনকার বিপর্যয়ের জন্য দলটির শাসনামলের ভুল কতটা দায়ী বলে মনে করেন?
মাহবুবুর রহমান: বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে, বিশেষ করে শেষ শাসনামলে (২০০১-০৬) অনেক ভুল করেছে। একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলার ঘটনা ভালো করে তদন্ত করেনি। আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটলেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কোনো পদক্ষেপ নেননি। গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীরা ব্যর্থ ছিলেন।
প্রথম আলো: একসময় বলা হতো, চীন বিএনপির সহজাত বন্ধু। তাদের সমর্থন হারালেন কেন?
মাহবুবুর রহমান: চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয় জিয়াউর রহমানের আমলে। আমাকে চীনে পাঠানো হয়েছিল। সহায়তার ব্যাপারে তারা উদার ছিল। চীনের নীতি হলো ‘এক চীন’। তাইওয়ান চীনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিএনপির আমলে এখানে তাইওয়ানের বাণিজ্য অফিস করা হলো, প্রতিনিধি পাঠানো হলো। এতে চীন ক্ষুব্ধ ও আহত হয়েছে। পরবর্তী কালে সরকার তাইওয়ানের বাণিজ্য অফিস বন্ধ করলেও চীনের আস্থা অর্জন করতে পারেনি। দূরত্ব রয়েই গেছে।
প্রথম আলো: বিএনপির ভারতনীতির কি কোনো পরিবর্তন হয়েছে?
মাহবুবুর রহমান: ভারত আমাদের প্রতিবেশী দেশ। আমাদের তিন দিকেই তাদের সীমান্ত। এই বাস্তবতা মেনে নিয়েই ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। আমরা ভারতের সঙ্গে প্রতিবেশী দেশ হিসেবে থাকব, অঙ্গরাজ্য হব না। আমি বলব, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় আমাদের একটু সচেতন থাকা উচিত। অসচেতনতা বিপদ ডেকে আনতে পারে। ভারতের সঙ্গে বিএনপির যে দূরত্ব হয়েছে, তারও দায় নেতৃত্বের।
প্রথম আলো: তাহলে বিএনপির ভবিষ্যৎ নেই?
মাহবুবুর রহমান: ভবিষ্যৎ আছে। পরাজয়ের গ্লানি মুছে বিএনপিকে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। দলের সর্বস্তরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। দলীয় ফোরামে আলোচনা করে দলীয় নেতৃত্ব নির্বাচন করতে হবে।
প্রথম আলো: বিএনপির অভ্যন্তরে গণতন্ত্র নেই। দলীয় প্রধানের আছে অপরিসীম ক্ষমতা। তিনি চাইলে যে কাউকে যেকোনো পদে বসাতে পারেন। আবার বাদও দিতে পারেন।
মাহবুবুর রহমান: দলে গণতন্ত্রচর্চা হতে হবে। সব পদে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হতে হবে। সর্বময় ক্ষমতা একজনের হাতে থাকা উচিত নয়। কেন্দ্রীয় কমিটিতেও সদস্যসংখ্যা কমানো উচিত। দলে সংস্কার প্রয়োজন। জিয়াউর রহমানের চিন্তা-চেতনা থেকে বিএনপি দূরে সরে গেছে। জনগণের মধ্যে জিয়াউর রহমানের যে আবেদন আছে, সেটি কাজে লাগিয়ে দলকে সংগঠিত করতে হবে।
প্রথম আলো: জামায়াতে ইসলামী নিয়ে এত সমালোচনা সত্ত্বেও আপনারা কেন দলটিকে বিএনপির নির্বাচনী সঙ্গী হিসেবে নিলেন? জামায়াত ছাড়া কি বিএনপি চলতে পারে না?
মাহবুবুর রহমান: বিএনপি একটি জাতীয়তাবাদী দল। তার নিজস্ব নীতি-আদর্শ আছে। তাই আমি মনে করি, এমন কোনো দলের সঙ্গে বিএনপির জোট করা উচিত নয়, যে দলটির নীতি-আদর্শ সম্পূর্ণ বিপরীত। বিএনপি জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত দল। এই দল কেন স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতের সঙ্গে ঐক্য করবে? বিএনপির উচিত জামায়াতের সঙ্গে জোটগত সম্পর্ক ছিন্ন করা। এ ক্ষেত্রে আমি জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা ড. কামাল হোসেনের অবস্থানকে সমর্থন করি। জামায়াত বিএনপির শক্তি নয়, বোঝা। বিএনপি কেন বোঝা বহন করে চলবে, এই প্রশ্ন দলের নেতা-কর্মীদেরও।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
মাহবুবুর রহমান: আপনাকেও ধন্যবাদ
প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
No sir , I respectfully disagree. Pretending minus but in reality those wanted minus one appeared to be succeeding , are still active . Those 1/11 planners and those abused , AL general secretary Mr. Abdul Jalil and BNP general secretary Mr. Khondker Delaware Hussein are sill active. Those tortured Tarek Zia , tortured Mahudur Rahman while in police custody are still active. When Army served under police (during election) , you have no Chain of Command. When Supreme Court Chief Justice is thrown out of the country , the country is not free country . Those of us were jumping around for freedom after hearing BongoBondu's speeches are disheartened by destruction of freedom by his party and his daughter . No confidence in court system. It would be a Stupid Decision for Tarek Rahman to come to Bangladesh now. ( Sir . Read George Orwell's 1984) . Country is under a serious cauldron .
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন