খালেদা জিয়া-তারেক রহমানের জনপ্রিয়তাই কাল, মামলা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক ও ভিত্তিহীন
25 July 2018, Wednesday
শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ সরকার নৈতিক, আইনগত এবং মূল্যবোধের সব নীতি বিসর্জন দিয়েছে মন্তব্য করে বৃটেনের হাউস অব লর্ডসের সদস্য লর্ড অ্যালেক্স কার্লাইল বলেছেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এবং তার বড় ছেলে তারেক রহমানের জনপ্রিয়তাই মূল সমস্যা। তাঁদের বিরুদ্ধে করা মামলাগুলো ভিত্তিহীন ও পুরোটাই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেপ্রণোদিত।
সম্প্রতি লন্ডনে জাস্ট নিউজ সম্পাদক মুশফিকুল ফজল আনসারীকে দেয়া এক বিশেষ সাক্ষাতকারে এমন মন্তব্য করেছেন বৃটেনের উচ্চ কক্ষ-হাউস অব লর্ডসের প্রবীণ এই সদস্য।
বিএনপি চেয়ারপারসনের মামলা ছাড়াও সাক্ষাতকারে নিজের ভারত সফরের তিক্ত অভিজ্ঞতা, বাংলাদেশের রাজনীতি, নির্বাচন, মানবাধিকার লংঘন, আইনের শাসনের হুমকিসহ বিভিন্ন বিষয়ে খোলামেলা কথা বলেছেনে বৃটেনের বর্ষীয়ান পার্লামেন্টারিয়ান এবং প্রাজ্ঞ আইনবিশারদ লর্ড কার্লাইল।
ধারণকৃত সাক্ষাত্কার পর্বটি এরকম:
মুশফিক: আমরা মুখোমুখি হয়েছি বৃটেনের স্বনামধন্য রাজনীতিবিদ, খ্যাতিমান আইনজ্ঞ এবং উচ্চ কক্ষ-হাউস অব লর্ডসের সদস্য লর্ড কার্লাইলের। দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি বৃটিশ পার্লামেন্ট- হাউস অব কমন্সের সদস্য হিসেবে ভূমিকা রেখেছেন।পুরো পৃথিবীতেই তিনি মানবাধিকার এবং গণতন্ত্রের অধিকার প্রতিষ্ঠার পক্ষে সোচ্চার এক কন্ঠস্বর। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিরোধী দল বিএনপি’র চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মামলায় আইনী সহায়তা দিতে সংযুক্ত হয়েছেন। আমরা কথা বলেছি অতি সম্প্রতি ভারতের নয়াদিল্লি বিমানবন্দরে অবতরণ করার পর তাঁকে দেশটিতে প্রবেশের বাধা দেবার অভিজ্ঞতা নিয়ে। যেখানে তিনি চেয়েছিলেন বেগম খালেদা জিয়ার একজন আইনজীবী হিসেবে মামলার বিষয়ে দেশ-বিদেশের সাংবাদিকদের অবগত করার জন্য একটি সংবাদ সম্মেলন করতে। মামলা নিয়ে কি ঘটছে বাংলাদেশে, সরকার এ বিষয়ে কি ধরনের আচরণ করছে তা অবগত করতে চেয়েছিলেন তিনি। কার্লাইল এ মামলাটিকে বলেছেন-রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, যেটা আমরা সবাই জানি। তিনি কেনো নয়া দিল্লিতে যেতে চেয়েছেন সে বিষয়টি নিয়ে অবশ্যই আমরা তাঁর মতামত জানবো, তবে তার সংক্ষিপ্ত উত্তর হলো- বাংলাদেশ সরকার কার্লাইলকে ভিসা দেয়নি। একইসঙ্গে তিনি যেনো খালেদা জিয়ার মামলা নিয়ে অগ্রসর হতে না পারেন সে প্রতিবন্ধকতাও তৈরি করেছে। আর এ কারণেই কার্লাইল পরিকল্পনা নিয়েছিলেন বাংলাদেশের পাশের বৃহৎ প্রতিবেশি দেশ, একিসঙ্গে বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ ভারত সফরে যাবেন। যাতে করে বাংলাদেশে কি ঘটছে তা নিয়ে মিডিয়ায় কথা বলা যায়। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় কিভাবে ভূমিকা রাখা যায়, বিশেষ করে বিএনপি চেয়ারপারসনের মামলার বিষয়টি নিয়ে তিনি বক্তব্য উপস্থাপন করতে চেয়েছিলেন। এশিয়ার সংবাদমাধ্যমগুলোর, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার সাংবাদিক এবং সংবাদমাধ্যমগুলোর একটি বড় সংযোগস্থল হলো নয়াদিল্লি। লর্ড কার্লাইল শহরটিকে এজন্যই পছন্দ করেছিলেন। চলুন আলোচনা শুরু করা যাক লর্ড কার্লাইলের সাথে-
মুশফিক: আপনি কেমন আছেন মি: কার্লাইল?
কার্লাইল: আমি ভালো আছি। আপনার সাথে দেখা হওয়ায় ভালো লাগছে। ধন্যবাদ।
মুশফিক: আপনাকেও ধন্যবাদ। আমি এখন সরাসরি চলে যাচ্ছি ১১ জুলাই ঘটে যাওয়া ঘটনাটির দিকে। নয়া দিল্লি বিমানবন্দরে আপনাকে এক ভয়ংকর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। ঐ দিনটিতে কি ঘটেছিলো?
লর্ড কার্লাইল: ১১ জুলাই আমি স্বাভাবিক নিয়মেই বিজনেস ভিসা নিয়ে নয়া দিল্লিতে গিয়েছিলাম। ভিসার যাবতীয় প্রশ্নের উত্তর সঠিকভাবেই দিয়েছিলাম। ভারতে এসেছিলাম একজন আইনজীবী হিসেবে। ভিসার আবেদনে আমি নিজেকে আইনজীবী হিসেবেই বর্ণনা করেছি, দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ঐদিন আমাকে ভিসার পরচিতিতে আইনজীবী হিসেবেই সম্ভাষণ করেছেন। আমি সেখানে গিয়েছিলাম বাংলাদেশের প্রধান বিরোধীদল বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মামলা নিয়ে একটি সংবাদ সম্মেলন করতে। আমি তাঁর মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবীদের একজন। এটা নয়া দিল্লিতে করতে চেয়েছিলাম এ কারণেই যে দক্ষিণ এশিয়ার বিশেষজ্ঞ সাংবাদিকদের একটা বড় অংশ নয়া দিল্লিতে অবস্থান করেন। এ সংবাদ সম্মেলনটা আমি ঢাকাতেও করতে পারতাম কিন্তু বাংলাদেশ সরকার আমাকে ভিসা দেয়নি। কোনো কারণ ছাড়াই ঢাকা যেতে বাধা দিয়েছে, যার পেছনে কোনো কারণ আমি খুঁজে পাইনি। বিষয়টি আমি বৃটিশ হাইকমিশনকে অবগত করেছি। ১১ জুলাই সকালে এয়ার ইন্ডিয়া বিমানে করেই নয়া দিল্লিতে রওয়ানা করি। বিমানে ভেতরে কোনো ইন্টারনেট সুবিধা ছিলো না। সন্ধ্যায় যখন বিমানবন্দরে পৌঁছালাম তখন মোবাইল ফোন অন করার পর অনেকগুলো মেসেজ দেখতে পেলাম- দেখলাম তাতে লেখা আছে আমার ভারতের ভিসা বাতিল করা হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের চাপেই ভারত এটি করেছে। এসময় একদল অফিসারের সঙ্গে বিমানবন্দরে কথা হয়, তাদের সঙ্গে মেসেজ প্রসঙ্গে বললাম আমাকে জানানো হয়েছে-আমি ভারতে থাকতে পারবো না। ভারত স্বাগত জানাচ্ছে না-বিষয়টিতে আমি খুবই অপমান বোধ করলাম। ফরেন অফিস এবং বৃটিশ হাইকমিশন থেকে জানতে পারলাম ভারত তাদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করবে না। আমার লন্ডনের ব্যক্তিগত সহকারি ছিলেন খুবই দক্ষ। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। তাই কম সময়ের নোটিশেই বৃটিশ এয়ারওয়েজের ফিরতি একটি টিকেটও করে দিয়েছিলেন। ভিসা কেনো বাতিল করা হলো সেটা নিয়ে সুস্পষ্ট কোনো উত্তর দিতে পারেননি বিমান বন্দরের কর্মকর্তারা। তারা উত্তরে বলেছে-আমাদেরকে কোনো কারণ জানানো হয়নি। আমাকে একজন তরুণ খুবি সহযোগিতা করেছে, সে আমার ব্যাগ বহন করে বিমানবন্দরের লাউঞ্জে নিয়ে যায়, যেখানে আমাকে বসে থাকতে হয় ফিরতি ফ্লাইটের জন্য। ভাবলাম দেশে ফিরে বিশ্বকাপের সেমিফাইনালটা দেখতে পাবো, নিজ দেশের খেলা বলে বিষয়টাতে খুবি আগ্রহী ছিলাম। বিরতির পর রাতেই ফিরতি ফ্লাইটে লন্ডনে ফিরে আসি। আর দেশে ফেরত আসার পর ফোনে এ ঘটনা নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আমার কথা হয়। ঐদিন ভারতের মুখপাত্রের আচরণে আমি খুবি মনোক্ষুন্ন হয়েছি। তিনি যেটা করেছেন তা খুবি লজ্জাজনক একটা কান্ড। এ ঘটনায় যেটা ধারণা করতে পারলাম সেটা হলো- ভারত সরকার পুরোপুরিভাবেই বাংলাদেশের চাপের মুখে নতি স্বীকার করেছে। একটি মামলার আইনগত বিষয়ে এটা ছিলো একধরনের নগ্ন হস্তক্ষেপ।
মুশফিক: আপনি বিমানবন্দরে অবতরণের সময়ে বৃটিশ হাইকমিশনের কোনো প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন কি? আপনিতো বৃটেনের একজন সিনিয়র রাজনীতিবিদ, এছাড়া হাউস অব লর্ডস’র সদস্য।
কার্লাইল: বৃটিশ কোনো প্রতিনিধি বিমানবন্দরে উপস্থিত থাকুক এটা আমি প্রত্যাশা করিনা। আমি বিমানবন্দরে থেকে বৃটিশ ডেপুটি হাইকমিশনার ড. আলেক্সজান্ডার অ্যাভেন্সের সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি খুবি আন্তরিক একজন মানুষ। বৃটিশ হাইকমিশন আমার সঙ্গে যথাযথ আচরণ করেছে, তবে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের এরকম অসামঞ্জস্যপূর্ণ আচরণের বিপরীতে হাইকমিশনের কিছুই করার ছিলোনা। বৃটিশ কুইন্স কাউন্সিলের একজন সিনিয়র আইনজীবী এবং পার্লামেন্টের একজন সদস্যকে ভারত হয়রানি করে ফেরত পাঠিয়েছে। যা ঘটেছে আমি তাতে খুবই উদ্বিগ্ন ছিলাম। যখন লন্ডনে পৌঁছাই তখন খুবই ক্লান্ত ছিলাম, যা ঘটেছে তা ছিলো অপ্রত্যাশিত, এছাড়া আমার ব্যয়বহুল যাতায়াতটাও বৃথা গেলো।
মুশফিক: ভারত যুক্তরাজ্যের অন্যতম ভালো মিত্র। আপনি কি মনে করেন এ ঘটনা ভারত এবং যুক্তরাজ্যের সম্পর্কে প্রভাব ফেলবে? ফরেন এবং কমনওয়েলথ অফিস থেকে এ বিষয়টিতে কি ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে? আপনি হাউস অব কমন্সে প্রতিনিধিত্ব করেছেন, এখন প্রতিনিধিত্ব করছেন হাউস অব লর্ডসে, এছাড়া আপনি একজন স্বনামধন্য আইনজীবী, প্রিন্সেস ডায়নার মামলাতেও আপনি লড়েছেন। এ বিষয়ে বৃটেনের ফরেন এন্ড কমনওয়েলথ অফিস কি ভূমিকা নিয়েছে?
কার্লাইল: বিষয়টি নিয়ে আপনি ফরেন এন্ড কমনওয়েলথ অফিসকে প্রশ্ন করতে পারেন। সর্বোপরি আমি যেটা বলবো সেটা হলো ভারতের এ ঘটনায় আমার প্রতিক্রিয়া কি সেটা নিয়ে ভেবে দেখতে পারে ফরেন এন্ড কমনওয়েলথ অফিস।
আমরা প্রতিক্রিয়া হলো- ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ সরকারের চাপে পুরোই নতি স্বীকার করেছে। আমার ভিসা বাতিল করে ফেরত পাঠালো। ১৮ ঘন্টা বিমান যাত্রায় কাটানোর পর শুনতে হলো ভিসা বাতিল করা হয়েছে, এটা সম্পূর্ণ অন্যায় একটা আচরণ। এটি কিছুতেই নীতির কাজ হতে পারে না। ভারতের এ বিষয়টি আমাকে অসন্তোষ্ট করেছে। অনেক পার্লামেন্টারিয়ানই ভারতের এ আচরণ দেখেছেন এবং ব্যাথিত হয়েছেন। আমি এতে অপমানিত হয়েছি। আইনজীবী হিসেবে যুক্তরাজ্যে এটা আমার সম্মানকে ক্ষুন্ন করেছে। একটি বন্ধুপ্রতিম সভ্য দেশ থেকে আমাকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। কোনো গণতান্ত্রিক দেশ থেকে এধরনের আচরণ কখনো প্রত্যাশিত নয়। কোনো দেশকে মূল্যায়ন করার একটা উপায় হলো- জটিল মামলাগুলো পরিচালনার ক্ষেত্রে আইনজীবীর সঙ্গে তারা কি ধরণের আচরণ করে থাকে। বাংলাদেশে অন্যায়ভাবে গ্রেফতার অব্যাহত রয়েছে, অনেককে চিরতরে গুম করা দেয়া হচ্ছে, এমনকি আইনজীবীদের অফিসেও আইনশৃঙ্খলাবাহিনী তল্লাসি চালিয়ে থাকে, কোনো কারণ ছাড়াই এটা করা হচ্ছে। বাংলাদেশে মামলা পরিচালনা সহজ কাজ নয়। এছাড়া দেশটিতে আইনজীবীরা খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে করা মামলার মতো জটিল মামলাগুলো লড়ে যাচ্ছেন, তারা খুবি সাহসী এবং আন্তর্জাতিক মান সম্পন্ন আইনজীবী। এজন্য এসব আইনজীবীদেরকে সত্যিকারঅর্থেই ধন্যবাদ দিতে হয়। তাদের খুবই জটিল মামলা নিয়ে কাজ করতে হয়। আর বাংলাদেশে যারা ডিফেন্সের পক্ষে কাজ করেন তাদেরকে অনেক অবমাননার মুখোমুখি হতে হয়। বাংলাদেশে যা করছে ভারত তা করতে পারেনা। এটা সত্যিকার অর্থে হতাশার। আমি পার্লামেন্টারিয়ান হিসেবে ৩৪ বছর পাড়ি দিয়েছি। অনেক সম্মানও অর্জন করেছি। আমি যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত ভারতের হাইকমিশনারকে বিষয়টি অবগত করেছি। আশা করছি তারা ক্ষমা চাইবে এবং যেটুকু আর্থিক ক্ষতি হয়েছে সে জন্য ক্ষতিপূরণ দিবে ভারত। ভারতে যাবার পর আমাকে সেখান থেকে ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। এখন এটাই প্রত্যাশা করবো আমি যে উদ্দেশ্য নিয়ে ভারতে গিয়েছিলাম সেজন্য দেশটির সরকার আবার আমাকে আমন্ত্রণ জানাবে। সবচাইতে অবাক এবং তাক লাগার মতো আরো যেটা ঘটেছে সেটা হলো ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সাপ্তাহিক ব্রিফ্রিংয়ে আমার বিষয়ে জঘণ্য রকমের দুটি মিথ্যা বলেছেন।
মুশফিক: আমরা যেটা জানি যুক্তরাজ্য বাংলাদেশের অন্যতম বড় উন্নয়ন অংশীদার দেশ। দেশটি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে। এছাড়া যুক্তরাজ্য গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের স্বপক্ষে সোচ্চার একটি দেশ। ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বে গণতন্ত্র এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য আপনি কাজ করে যাচ্ছেন। তাহলে কেনো বাংলাদেশ সরকার আপনাকে সে দেশে যাবার অনুমতি দিচ্ছেনা? আর যুক্তরাজ্য বিষয়টি নিয়ে গুরুত্বের সঙ্গে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছেনা কেনো?
কার্লাইল: বাংলাদেশের এসব বিষয়গুলোতে যুক্তরাজ্য জোরালোভাবেই তাঁর অবস্থান তোলে ধরেছে। আর এখন মানবাধিকার ঘটনাগুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করছে। কমনওয়েলথভুক্ত যতো দেশ রয়েছে তার মধ্যে সবচাইতে খারাপ অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি। দেশটিতে কোনো কারণ ছাড়াই মানুষকে গ্রেফতার করা হয়ে থাকে, যেটার রেকর্ড কমনওয়েলথভুক্ত ৫৩ দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ। সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ নেই তবুও বাংলাদেশে মানুষকে কারাগারে আটকে রাখা হচ্ছে। আমি বিশ্বাস করি এই রেকর্ডটা সত্যিই বেদনাদায়ক।
বিশ্বের স্বনামধন্য মানবাধিকার সংস্থা অ্যামেনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল তাদের সাম্প্রতিক রিপোর্টে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির ভয়াবহ চিত্র তোলে ধরেছে। বাংলাদেশ সরকার এসব বিষয়গুলোকে আমলে নিচ্ছেনা। এমনকি একজন আইনজীবী হিসেবে বিএনপি চেয়ারপারসনের মামলার সঙ্গে জড়িত হওয়ায় আমাকে নিয়ে পর্যন্ত সমালোচনা করা হচ্ছে। আমার অভিযোগ হচ্ছে সাধারণ আইনগত একটি মামলার বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ করছে। বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল যখন ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনারকে বলেন-আমাকে যেনো ভারতে আসার অনুমতি না দেয়া হয়, তখনি আমার অভিযোগের সত্যতা যথার্থতার সঙ্গে প্রমাণিত হয় যে বাংলাদেশ সরকার আদালতের মামলাগুলোতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ করছে।
একজন সচেতন আইনজীবি হিসেবে বেগম খালেদা জিয়ার মামলার বিস্তারিত আমি খতিয়ে দেখেছি, যেসব অভিযোগে তাঁকে ৫ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে এগুলো আসলে-স্পষ্ট ধোঁকাবাজি। দোষী সাব্যস্ত করার নূন্যতম কোনো প্রমাণ সেখানে নেই। ‘সোকল্ড জিয়া অরফানেজ’ মামলা পুরাটাই ভিত্তিহীন। ‘জিরো অ্যাভিডেন্স’ এর ভিত্তিতে সাজা দেয়া হয়েছে। ছোটোখাটো প্রতারণা মামলায় যেসব তথ্য-প্রমাণ থাকে এতে তাও নেই। একজন আইনজীবী হিসেবে আমি অনেক প্রতারণামূলক মামলা নিয়ে কাজ করেছি। আমরা এ মামলা খতিয়ে দেখতে একটি টিমকে আহবান করেছিলাম যেটাকে বলা হয় ‘ফরেনসিক অ্যাকাউন্টেট’। তারা অভিযোগের বিষয়গুলো তন্ন তন্ন করে খতিয়ে দেখেছে আর বলেছে এখানে যাদের অভিযুক্ত করা হয়েছে তাতে প্রতারণা করার মতো কিছুই পাওয়া যায়নি। এ মামলা নিয়ে কাজ করার মতো কিছু নেই। বেগম খালেদা জিয়া কোনো অর্থ আত্মস্বাৎ করেছেন বা কোনো উপায়ে প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছেন বা কোনো অপরাধ করেছেন এর স্বপক্ষে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এটা কিভাবে মামলা হতে পারে? আমি বিষয়টি নিয়ে শংকিত। পুরো মামলাটাই সাজানো হয়েছে রাজনৈতিকভাবে। এ মামলাটা তৈরি করা হয়েছে দেশটির একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে। এটা যে রাজনৈতিক কাজ তা বুঝাই যায়। এটা বাংলাদেশ সরকারের তৈরি করা একটা মামলা। আমার ধারণা হচ্ছে খালেদা জিয়াকে নির্বাচন থেকে সরিয়ে রাখতেই এ মামলা করা হয়েছে।
মুশফিক: খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দিতেই এ মামলা করা হয়েছে?
কার্লাইল: হ্যাঁ। তাঁকে (খালেদা জিয়াকে) জাতীয় রাজনীতি থেকে সরিয়ে দিতেই এ মামলা করা হয়েছে। খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে একইভাবে মামলার আশ্রয় নেয়া হয়েছে। তাঁকে হয়রানি করতে বাংলাদেশ সরকার ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড নোটিশ জারি করার পায়তারা করেছিলো। বিষয়টি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বুঝতে পেরে এবং মামলার অভিযোগ মিথ্যা জানার পর ইন্টারপোল পরে সে নোটিশ প্রত্যাহার করে নেয়। এটা এখন সার্বিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে আইনের শাসনের সব ধরনের বাধ্যবাধকতা থেকে ক্ষমতাসীন বাংলাদেশ সরকার বিচ্যুতি ঘটেছে।
মুশফিক: আপনি যেমনটা বলেছেন এটা একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যমূলক মামলা। শুধু প্রধান বিরোধী দলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়াই নয়, তাঁর বড় ছেলে এবং বিএনপির বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নামেও রয়েছে অসংখ্য মামলা, যিনি বাংলাদেশে ব্যাপক জনপ্রিয়। আপনি কি মনে করেন, এ ক্ষেত্রে জনপ্রিয়তাই তাঁদের জন্য বড় সমস্যা?
কার্লাইল: বাংলাদেশ তারেক রহমান জনপ্রিয় নেতা এটা আমিও বিশ্বাস করি। এর উত্তর খুবি সাধারণ। মূল সমস্যাটাই জনপ্রিয়তা। বিএনপি এবং বিশেষ করে তারেক রহমানের জনপ্রিয়তাই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটা ‘সিম্পলি’ বুঝা যাচ্ছে। আর বিষয়টা এরকম হওয়াটা দুর্ভাগ্যজনক। কারণ বর্তমান সরকার নৈতিক, আইনগত এবং মূল্যবোধের সব নীতি বিসর্জন দিয়ে বসেছে। আইনের শাসনের ক্ষেত্রে এ সরকার চরম নিষ্ঠুর আচরণ করছে। সরকার সাধারণ আইন মেনে চলছে এমন ভণিতা করছে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আইন অবজ্ঞা করে লজ্জাজনক পরিস্থিতি তৈরি করেছে। কারণ এ সরকার মামলাগুলো নিয়ে আক্রমণাত্মক আচরণ করেছে।
মুশফিক: আপনি নিশ্চয় অবগত আছেন যে বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন আসন্ন। ২০১৪ সালে আমরা একতরফা নির্বাচন হতে দেখেছি, নির্বাচনটি অংশগ্রহণমূলক ছিলোনা, বিএনপি সে নির্বাচনে অংশ নেয়নি। পুরো বিশ্ব তা দেখেছে এবং নিন্দা জানিয়েছে। আপনি নিশ্চয় আমার সঙ্গে একমত হবেন যে, বিগত নির্বাচন শুধু বিএনপি বয়কট করেনি, বহিঃবিশ্বও বয়কট করেছে। অর্থাৎ জাতিসংঘ, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা সে নির্বাচনে কোনো পর্যবেক্ষক পাঠায়নি। বিষয়টি কিভাবে দেখছেন?
কার্লাইল: সবদিক থেকেই নির্বাচনটি ছিল অস্বচ্ছ। একজন আইনজীবী হিসেবে আমি রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে চাইনা। তবে একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ এবং রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক হিসেবে আমি বলতে বাধ্য- যদি আগামী নির্বাচন বিগত নির্বাচনের মতোই হয়, আর তাতে যদি আন্তর্জাতিক মানের নির্বাচনী গ্রহণযোগ্যতা না থাকে তাহলে সেটা হবে হাস্যকর। বাংলাদেশ যদি অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করতে চায়, আমার ধারণা দেশটিতে সম্ভাবনাময় ‘টাইগার ইকোনমি’ বলে দাবি করা হয়। আর সেটা ভারতের অর্থনীতির সঙ্গে তুলনা করলে আশব্যাঞ্জকই বলতে হবে। তাদেরকে রাজনৈতিকভাবেও সমৃদ্ধ অর্থনীতির দেশের মতোই আচরণ করতে হবে। রাজনৈতিক প্রসঙ্গে বলতে গেলে যদি বৃটিশ সরকারের কথা বলি, আর আমি নিশ্চিতভাবে এখানকার যেসকল রাজনৈতিক নেতাদের জানি তাঁরা বাংলাদেশের বিষয়ে তাঁদের অবস্থান ও জবাবদিহিতার জায়গাটিতে দৃঢ়। কারণ আইনের শাসনের প্রতি সবার একটি কমিটমেন্ট রয়েছে।
মুশফিক: বিষয়গুলো নিয়ে বর্তমান সরকারের সঙ্গে বৃটিশ সরকার কি নিজেদের অবস্থান তোলে ধরেছে? কারণ যুক্তরাজ্য বাংলাদেশের বড় অর্থনৈতিক অংশীদার।
কার্লাইল: বৃটিশ সরকার কোনো দেশের রাজনৈতিক বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার নীতি গ্রহণ করে না। যুক্তরাজ্য সব দেশের নীতিগতভাবে বৈধ সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলছে। যেসব দেশকে আমরা পছন্দ করিনা বৃটেন তার সঙ্গেও কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাজ্য আন্তরিক সম্পর্ক বজায় রাখে। কারণ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশি এ দেশে বসবাস করছে। বাংলাদেশিদের সঙ্গে বৃটেনের বন্ধন দীর্ঘ দিনের। আমার যেখানে বেড়ে উঠা অর্থাৎ উত্তর-পশ্চিম ইংল্যান্ডে ১৯৬০ সাল হতে বাংলাদেশীরা বসতী স্থাপন করেছে। এখানে যারা আছে তারা কোনো চাপ বা হুমকি ব্যতীতই স্বাধীনভাবে চলা ফেরার সুযোগ পাচ্ছে। কিন্তু এসব কিছুর পরেও একটি দেশের মানবাধিকার লংঘনের চিত্রটিও স্পষ্ট। বাংলাদেশে মানবাধিকার লংঘন অব্যাহত রয়েছে, আর এটা এভাবেই চলছে। মানবাধিকার নিয়ে কনফিউশনের পরও বাংলাদেশে কারখানার পরিবেশের উন্নয়নে সহযোগিতা করে যাচ্ছে যুক্তরাজ্য। আর এটি বৃটিশ ক্রেতাদের জন্য খুবি গুরুত্বপূর্ণও বটে। মানবাধিকারের উন্নয়ন হচ্ছে কিনা এ নিয়ে বৃটেন সরকারের অনুমোদনও তাদের নিতে হয়, কিন্তু বাংলাদেশে এর উন্নতি হচ্ছেনা। মানবাধিকার পরিস্থিতির কোনো ধরনের অবনতিকে বৃটিশ সরকার কখনো সমর্থন করেনা।
মুশফিক: আপনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং বিএনপি চেয়ারপারর্সন বেগম খালেদা জিয়ার পক্ষে আইনি পরামর্শ দিচ্ছেন। একইসঙ্গে বাংলাদেশের পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। বিগত সেনাসমর্থিত সরকারের সময়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামে ১৫টিরও অধিক মামলা করা হয়েছিল। অথচ সরকার নিজেদের সব মামলা প্রত্যাহার করে নিলেও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া, তাঁর বড় ছেলে তারেক রহমানসহ অন্যান্য নেতাদের বিরদ্ধে মামলা অব্যাহত রেখেছে এবং নতুন মামলা দায়ের করেছে। আপনি কি মনে করেন বাংলাদেশে আইনের শাসন রয়েছে?
কার্লাইল: বাংলাদেশে কোনো আইনের শাসন নেই। মনে রাখতে হবে সরকার কেবল নিজের জন্য নয় জনগণের জন্য। জনগণের মঙ্গলের কথা ভেবে ভবিষ্যতের পথে অগ্রসর হতে হবে। বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলগুলো যদি প্রতিহিংসা থেকে সরে এসে এক হতে পারে, যেটা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে, তাহলে সবার জন্য মঙ্গল হবে। বাংলাদেশের জনগণ নিশ্চিতভাবে একটা ভালো সরকার প্রত্যাশা করে।
মুশফিক: সাক্ষাতকারে সময় দেবার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
কার্লাইল: আপনাকেও ধন্যবাদ।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন