বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। তাঁকে বলা হয় আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগর। ২৫ জুলাই তাঁর জন্মদিন। জন্মদিন সামনে রেখে আজ ছাপা হলো তাঁর একটি বক্তৃতা। ২০১৫ সালে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে আয়োজিত নিজের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে তিনি এ কথাগুলো বলেছিলেন
অঙ্ক আমার মাথায় কোনো দিনই ঢোকে না। অঙ্কে আমি সব সময় কাঁচা। এটা প্রথম ধরা পড়ল ক্লাস সিক্সে উঠে। আমাদের ক্লাস টিচার প্রাণকৃষ্ণ সাহা সবার কাছ থেকে বেতন নিয়েছেন। অনেক টাকা, অনেক সিকি, অনেক আধুলি—সব একসঙ্গে আছে। এত কষ্ট করে সেটা তিনি গুনতে আর আগ্রহী নন। আমি প্রিন্সিপালের ছেলে। সেকালে প্রিন্সিপাল রাস্তাঘাটে পাওয়া যেত না। সচ্ছল পরিবারের ছেলে, সুতরাং স্যার ভাবলেন, একে বিশ্বাস করা যায়। বললেন, আয় একটু গুনে দে। আমি গোনা শুরু করলাম এবং বেশ সাফল্যের সঙ্গে গোনা শেষ করলাম। স্যার বললেন, ‘এখন একটা কাজ কর। আবার গোন।’ আমি গুনে দেখি নতুন ফল হয়েছে। এরপর যতবারই গুনলাম, ততবারই নতুন ফল এল। স্যার আমাকে বললেন, ‘অপদার্থ!’ আমি পড়ি ক্লাস সিক্সে, অপদার্থ শব্দটার মানে তখনো বুঝি না। আমি বুঝলাম, উটজাতীয় কোনো একটা প্রাণী বলে তিনি হয়তো আমাকে সম্বোধন করলেন। এভাবে আমার অঙ্ক শুরু। যখন আরও দুচার ক্লাস ওপরে উঠলাম, তখন অবস্থা আরও শোচনীয় হয়ে উঠল। দেখা গেল অঙ্কে নিয়মিত ফেল করতে শুরু করেছি। এখন কী করে ম্যাট্রিক পাস করি? টেস্ট পরীক্ষাতেও অঙ্কে ফেল করলাম।
তো আমি কী করলাম, জাদবের পাটিগণিত, কে পি বোসের অ্যালজেব্রা, আর কার যেন একটা জিওম্যাট্রি ছিল...আমি আগা থেকে গোড়া মুখস্থ করে ফেললাম। তখন আমাদের পরীক্ষকদের বিদ্যা ওই তিনজনের বাইরে যেত না।
সুতরাং কোনো না কোনোভাবে প্রশ্ন এল, আর আমি পরীক্ষা দিয়ে ৭৫ নম্বর পেয়ে গেলাম। বুড়ো বয়সে এসে আবার টের পেলাম যে আমার অঙ্ক বিদ্যা কিছুতেই হচ্ছে না। তার কারণ আমি আমার জন্মদিন মেলাতে পারি না। আমার যে কততম জন্মদিন, এটা কিছুতেই মেলে না। একবার এক মেয়ে ফোন করে বলল, ‘স্যার কেমন আছেন?’ আমি বললাম, ‘ভালো। তবে বুড়ো টুড়ো হয়ে গেলাম আরকি...।’ সে আমাকে বলল, ‘স্যার, আপনি তো বুড়ো হবেন না।’ আমি বললাম, ‘কেন?’ সে বলল, ‘স্যার, বুড়ো হওয়ার একটা বয়স আছে। আপনি সেটা পার হয়ে গেছেন।’
জীবন তো অনেক দিন কাটল। এত দিন বাঁচব, এ কল্পনাও করিনি। আমার ধারণা ছিল যে ৫৫-৫৭ বছরে অবসর নেব। তারপর অল্পস্বল্প গল্প হয়। পার্কে হাঁটব। বুড়োদের সঙ্গে হে হে হো হো করব। কিন্তু দেখলাম আমার জীবন সম্পূর্ণ উল্টে গেল। আমার আশপাশে কোনো বৃদ্ধই নেই। আমার চারপাশে সতেরো থেকে চব্বিশ। এর বেশি হলেই আমি অবসরে পাঠিয়ে দিই!
তো যাহোক, জীবনটা অনেক দিন গেল। ভালোই গেল। কারণ, কোনো বড় রকম বিপর্যয় আমার জীবনে এ পর্যন্ত আসেনি। মা মারা গিয়েছিলেন একেবারে ছোটবেলায়। সেই জায়গাটা শূন্য হয়ে আছে, ওই জায়গাটা আর ভরে না। আমি দুইটা বই মায়ের নামে উৎসর্গ করেছি। এবং আমি সব জায়গাতেই লিখেছি যে মা আমার সারা জীবনের কষ্ট। এটা অপূরণীয়। আব্বা যখন মারা গেছেন, তখন আমার বয়স অনেক। সুতরাং সেটা সহ্য করার মতো শক্তি আমার মধ্যে ছিল। এ ছাড়া আর তেমন কোনো সমস্যা হয়নি।
আমরা এগারো ভাইবোন। সাধারণত আমাদের মতো নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে ১১ ভাইবোন যদি থাকে, আর সেই বাড়ির বড় ছেলে যদি কেউ হয়, আমি তাই। বড় ছেলে মানে বোকা ছেলে। সুতরাং সংসারের কিছু দায়দায়িত্ব তো চলে আসার কথা। কিন্তু আব্বা এমন বয়সেই মারা গেলেন যে তত দিনে আমরা প্রত্যেকেই প্রায় দাঁড়িয়ে গেছি। সুতরাং ওই জায়গা থেকে বেঁচে গেলাম। তারপরে বিপদ যেটা সেটা ওই যে ওইখানে (একটু দূরে বসা স্ত্রীকে দেখিয়ে—বি. স.) হতে পারত। কিন্তু কৌশলে সেটা এড়িয়ে গেলাম। এবং সেই কৌশলটা আমি শিখেছিলাম আমার স্কুলজীবনে।
আমাদের বাসায় যে কাজের ছেলেটা ছিল তার একদিন আলসেমি হলো যে সে বাজারে যাবে না। সে আমাকে দশটা টাকা দিয়ে বলল যে তুমি বাজার করে নিয়ে এসো। ১৯৪৭ সালের ১০ টাকা মানে অনেক টাকা। আমি তো বেশ উৎসাহ নিয়ে বাজারে গেলাম এবং কিছুক্ষণের মধ্যে আবিষ্কার করলাম যে সেই লাল টাকাটা আর আমার পকেটে নেই। বাসায় ফিরে এলাম। আব্বা তো আমাকে চিনতেনই। আমার উন্নত মান সম্পর্কে তাঁর ধারণা এত সুস্পষ্ট যে আব্বা বললেন, ‘আমি ওকে কিছু বলতে চাই না। কিন্তু কোন গাধা ওকে পাঠিয়েছে আমি তাকে চাই।’ সেই গাধা অদূরেই দণ্ডায়মান ছিল। সুতরাং গাধাকে যেভাবে আপ্যায়ন করা হয়, সেভাবে আপ্যায়ন করা হলো। বলা হলো যে আর কোনো দিন যেন আমাকে বাজারে পাঠানো না হয়। আমি একটু অপমানিত বোধ করলাম। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝতে পারলাম, একটা অসাধারণ সৌভাগ্য আমার জীবনে হুট করে চলে এসেছে। আমাকে আর বাজার করতে হবে না!
বিয়ের পরেও তাই হলো। আমার স্ত্রী একটা মুরগি কিনতে আমাকে বাজারে পাঠিয়ে দিলেন। গেলাম। দেখলাম যে বাজারের একদম ভেতরে যেতে হবে। এর আগে আমি কোনো দিন বাজারে যাইনি। কোথায় মুরগি, কোথায় মোরগ কিছুই জানি না। তো যাব দূরে, দেখলাম অত দূরে যাওয়ার দরকার নেই। বাজারের গেটেই দাঁড়িয়ে আছে লোক। মুরগির পাগুলো তাঁর হাতে ধরা, মাথাগুলো নিচে। লোকটা একটা ঝাড়া দিল, মুরগিগুলোও বেশ নড়েচড়ে উঠল। আমাকে যে দাম বলা হয়েছিল, দেখলাম যে দাম তার চেয়ে অনেক কম। আমি ভাবলাম, তাহলে তো আরও গৌরব! বীরের মতো বাসায় ফিরব, আট আনা কম দিয়ে ফিরলাম! তারপর একটা মুরগি নিয়ে দরাদরি হলো এবং দেখলাম যে মুরগিটা আমার দিকে তাকাচ্ছে। সম্ভবত সে তার হত্যাকারীকে দেখে নিচ্ছে।
তো বাসায় পৌঁছানোর পর দেখা গেল যে মুরগিটা মরা। বিদ্যুৎ গতিতে সারা শহরে রটে গেল যে আমি মরা মুরগি নিয়ে বাসায় ফিরেছি। এরপরও কী করে যেন আমার ওপর আস্থা স্থাপন করা হলো। এবং আবার পরদিন আমাকে মুরগি কিনতে পাঠানো হলো। সেবার আমি সারা বাজার খুঁজে সবচেয়ে বলশালী মোরগটা খুঁজে বের করলাম। যাতে মৃত্যুর কোনো সম্ভাবনা না থাকে। মুরগি নিয়ে রিকশায় করে আসছি, কিন্তু তার স্বাস্থ্যই হলো আমার কাল। সে আমার হাত থেকে ঝটকা মেরে পড়ল মাটিতে, আর আমার পেছনের রিকশা তার গলার ওপর দিয়ে চলে গেল। সুতরাং আমি আবার একটি মরা মুরগিসহ...অপমানের চূড়ান্ত! তারপরে বোঝাই যাচ্ছে কী হলো।
‘তোমার আর বাজার করার দরকার নেই!’
আমি তো এই কথা শোনার জন্যই যুগ যুগ ধরে বসে ছিলাম! আমার আর বাজার করতে হবে না!
তো এভাবেই কেটে গেল আমার পারিবারিক জীবন। তারপর এল পেশাগত জীবন। শিক্ষকতা। ছোটবেলায় আব্বাকে দেখেছি, অসাধারণ শিক্ষক! মানুষ এমনভাবে আব্বার কথা বলত যেন কোনো দেবতার কথা হচ্ছে। তখন আমি ঠিক করে রেখেছিলাম যে আমি এই রকম শিক্ষক হব। কিন্তু শিক্ষকতায় যে এত আরাম, এটা তো জানতাম না! আব্বা যে কেন দেবতা হয়েছেন, টের পেলাম। ওখানে কোনো পড়াতে হয় না। প্রতিদিন বড়জোর দুটো ক্লাস। বছরে ছয় মাস ছুটি। আর জাগ্রত ছাত্রসমাজ আরেকটু জাগ্রত হয়ে উঠলে আরও তিন মাস! সুতরাং বছরে নয় মাস! এ তো ঘরজামাইয়ের চেয়ে ভালো! ঘরজামাই একটু লাথিটাথি খায় আরকি! এত ছুটি পেলে একটু আকটু লাথিটাথি খেতে কোনো আপত্তি নেই। সুতরাং এভাবে আরামে ঘরজামাইয়ের মতো জীবন কাটতে লাগল। যা খুশি তাই করতে লাগলাম। কখনো সাহিত্য আন্দোলন করি, কখনো টেলিভিশনে যাই। জীবনকে যত আনন্দে ব্যবহার করা সম্ভব, আমি সেই ব্যবহার করেছি।
খালি একটু আড্ডা বেশি দিয়েছি। কিছু আড্ডাবাজ জুটে যাওয়ায়...অথবা টের পেয়েছিল যে আমার কাছে এলে আড্ডা শুরু হবে। এই একটু ক্ষতি হয়ে গেছে জীবনে। আর ক্ষতি হয়েছে ঘুমে। সেদিন কাগজে পড়লাম, আমরা নাকি খেতে জীবনের ছয় বছর সময় ব্যয় করি। এবং টয়লেটে গিয়ে সাত বছর! খাওয়ার চাইতে একটু বেশি। অল্প বয়সেই টের পেলাম যে আমি একটা ঘোরলাগা মানুষ। যখন যেটা নিয়ে পড়ি তার বাইরে কিছু বুঝতেও পারি না, দেখতেও পাই না।
একটা জিনিস লক্ষ করলাম যে সবকিছু আমার কাছে ভালো লাগে। জীবনে যেকোনো জিনিস আমার কাছে মধুর মতো মিষ্টি লেগেছে। এটা অবন ঠাকুরের একটা লেখার মধ্যে বলা হয়েছে খুব সুন্দর করে। আমি ছাত্রদের প্রায়ই বলি। মানুষ কি ভেরেন্ডাগাছ খেতে পারে? মানুষ আখগাছ খেতে পারে। কেন খেতে পারে? কারণ আখের মধ্যে রস আছে, মাধুর্য আছে। জীবনের সমস্ত জায়গায় আমি মাধুর্য পেয়েছি। মানুষ বলে যে এত কাজ করো তুমি! আমি বলি কাজ করি না, আমি তো মজা করি! আমি তো আনন্দ করি! তাই জীবনে কোনো কষ্ট হয়নি। মোটামুটি ফাঁকি দিয়েই...
কিন্তু...একদিন তোর হইবে রে মরণ, ওরে হাসন রাজা। একদিন কিন্তু জীবনের শেষ এসে দাঁড়ায়। দাঁড়ালেও কিছু এসে যায় না। আমি যদি জীবনটা উপভোগ করে থাকি, তাহলে আমার মৃত্যুটাও উপভোগ্য হওয়া উচিত। এই পৃথিবীতে কোনোকালে কোনো মানুষ কি মৃত্যুকে এড়াতে পেরেছে? আজ যারা বেঁচে আছে এখানে, কেউ কি পারবে? যারা ভবিষ্যতে আসবে, কেউ কি পারবে?
আমি যদি মৃত্যুকে প্রশ্রয় দিই তাহলে মৃত্যু আমার ঘাড় ধরে ফেলবে। সুতরাং আমার যেটা কর্তব্য সেটা আমি টের পেয়েছিলাম একবার মেঘনা নদী দিয়ে চাঁদপুর থেকে আসার সময়। সন্ধ্যার সময় হঠাৎ প্রচণ্ড ঝড় উঠল। আমাদের লঞ্চটাকে সেটা এমনভাবে তোলপাড় করতে লাগল যে ছয়জন লোক ভয়েই ঝাঁপ দিয়ে মারা গেল। সেই সময় আমি সারেংয়ের পাশে দাঁড়িয়ে আছি। আমি দেখলাম যেদিক থেকে ঝড়টা আসছে, সে লঞ্চের মুখটা সোজা সেদিকে ঘুরিয়ে দিল। একদম পুরো গতিতে চালিয়ে দিল মেঘনার মাঝখান দিয়ে। সে ছিল কিন্তু পাড়ে। আমি বললাম, আপনি পাড়ের থেকে মাঝখানের দিকে যাচ্ছেন কেন, আপনি তো ডুবে মরবেন! সে বলল, পাড়ে থাকলে আমি মরে যাব। যেদিক থেকে ঝড়টা আসছে, আমাকে সোজা সেই ঝড়ের বুকের মধ্যে ঢুকে পড়তে হবে। তাহলে আমি বেঁচে যেতে পারি।
তো আমি মনে করি, মৃত্যু যখন আমার সামনে এসেই গেছে, আমি সরাসরি মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়াতে চাই। আমি আমার কাজ করে যেতে চাই, মৃত্যু তার কাজ করুক।
(সংক্ষেপিত ও পরিমার্জিত)
প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন