জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার পাঁচ বছর কারাদণ্ড হয়েছে। জাতীয় রাজনীতি এবং নির্বাচনে এর সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক মাহবুবউল্লাহ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান
প্রথম আলো: জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়ার কারাদণ্ড হয়েছে। আপনি কীভাবে দেখছেন?
মাহবুবউল্লাহ: খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ৩০টির মতো মামলা আছে। এই মামলায় যদি উচ্চ আদালতে সাজা স্থগিতও থাকে, তাহলে অন্য মামলায় তাঁকে বিচারের মুখোমুখি করা হবে। জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টসহ বাকি মামলাগুলোও দ্রুত এগোবে বলে ধারণা করি। সে ক্ষেত্রে তাঁর জনগণের কাছে ফিরে যাওয়া কঠিন হবে। তবে খালেদা জিয়া যে দলের নেতা-কর্মীদের শান্ত থাকা এবং নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের পরামর্শ দিয়েছেন, সরকারের উসকানিতে পা না দেওয়ার কথা বলেছেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দেশবাসীর সঙ্গে আমারও আশা, আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে খালেদা জিয়া জনগণের মাঝে ফিরে আসবেন। আমি বিশ্বাস করি না, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের মাধ্যমে তিনি ব্যক্তিগত সুবিধা নিয়েছেন।
আইনি লড়াইয়ের পাশাপাশি বিএনপি নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন চালাতে পারলে তিনি জনগণের সহানুভূতি পাবেন। এ জন্য দলকে আরও ব্যাপক পরিসরে কাজ করতে হবে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাল্মীকির উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘কবি, তব মনোভূমি রামের জনমস্থান, অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো’। খালেদা জিয়ার রায়ের ক্ষেত্রেও দেখার বিষয়, মানুষ এটাকে কীভাবে নিল। মানুষ দেখছে সব অপরাধের বিচার হচ্ছে না। ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে, সেগুলো টিকিয়ে রাখতে জনগণকে অর্থ ঢালতে হচ্ছে। সরকারি দলের নেতাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা বছরের পর বছর ঝুলছে। জনগণ এসব পাশাপাশি রেখে বিচারের চেষ্টা করবে। আমার ধারণা, এই মামলার রায় রাজনীতিতে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে। বাংলাদেশে অনেক সমস্যা আছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার মনোভাব পরিহার করে সমঝোতার বিকল্প নেই। আলোচনার বিকল্প নেই। প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে পড়েছে। বিচার বিভাগ নিয়েও গর্ব করা যায়, এ কথা বলা যাবে না। সম্প্রতি অ্যাটর্নি জেনারেল উচ্চ আদালতের দুর্নীতির কথা বলেছেন।
প্রথম আলো: এই রায় জাতীয় রাজনীতিতে কী রকম প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন?
মাহবুবউল্লাহ: রায়কে কেন্দ্র করে এক সপ্তাহ ধরে বিএনপির নেতা-কর্মীদের যেভাবে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, বাড়িতে বাড়িতে তল্লাশি চালানো হচ্ছে, সেটি মোটেই সুস্থ রাজনীতি নয়। বহু নিরীহ মানুষ গ্রেপ্তার হয়েছেন। এগুলোর প্রভাব নিশ্চয়ই রাজনীতিতে পড়বে। বিএনপি যৌথ নেতৃত্বে পরিচালনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এই যৌথ নেতৃত্ব কতটা যৌথতা ও দৃঢ়তার সঙ্গে দল পরিচালনা করতে পারে, সেটা দেখার বিষয়।
মামলার বিষয়টি আন্তর্জাতিক মহল কীভাবে গ্রহণ করে, বিশ্ব গণমাধ্যম কী প্রতিক্রিয়া দেখায়, সেটাও বিবেচনায় নিতে হবে। রায়ের বিষয়টি সবার নজরে এসেছে। কোনোভাবেই জাতির বিভক্তি ও সুশাসনহীনতা কাম্য নয়।
প্রথম আলো: খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে তারেক রহমান দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হয়েছেন। তিনিও মামলায় দণ্ডিত ও নির্বাসিত।
মাহবুবউল্লাহ: আমার মনে হয়েছে, টেকনিক্যালি তাঁকে এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। বিদেশে থেকে বাংলাদেশে প্রতি মুহূর্তে কী ঘটছে, সে বিষয়ে নজর রাখা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। বাংলাদেশে অবস্থানকারী নেতাদেরই দল পরিচালনার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা নিতে হবে।
প্রথম আলো: বিএনপির প্রথম ও দ্বিতীয় সরকারের মধ্যে কোনো পার্থক্য করবেন কি?
মাহবুবউল্লাহ: বিএনপির লোকেরাও মনে করেন, প্রথম সরকার যতটা ভালোভাবে দেশ পরিচালনা করতে পেরেছে, পরবর্তীকালে পারেনি। তবে এর পেছনে অনেক কারণ ছিল। প্রথমত, বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসা। বাংলাদেশে যে দলই এ ধরনের সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে, তাদের ভুলভ্রান্তি বেশি হয়েছে। সেটি বর্তমান সরকারের জন্যও প্রযোজ্য।
প্রথম আলো: আগামী নির্বাচনে এই রায় কী ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে?
মাহবুবউল্লাহ: আমি মনে করি, এই রায় একটি অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ক্ষেত্রে পথের কাঁটা হয়ে থাকবে। যদি সেটি সরানোর চেষ্টা না থাকে, জাতি হিসেবে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হব। রাজনৈতিক মামলার সঙ্গে নির্বাচনের সম্পর্ক আছে। ভারতে ইন্দিরা গান্ধী, পাকিস্তানে জুলফিকার আলী ভুট্টোর উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। রায়ের পর সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে সংশয় বেড়েছে।
প্রথম আলো: বিএনপি নেতৃত্বের বর্তমান সিদ্ধান্তের সঙ্গে ২০১৩-১৪ সালের ঘটনাবলি কীভাবে মেলাবেন?
মাহবুবউল্লাহ: ২০১৩-১৪ সালের ঘটনা কাঙ্ক্ষিত ছিল না। প্রশ্ন হলো, ঘটনার জন্য দায়ী কারা। মহাত্মা গান্ধী চোরিচোরার ঘটনার পর আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। বিএনপিও গান্ধীর মতো সে ধরনের ঘোষণা দিতে পারত।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
মাহবুবউল্লাহ: আপনাকেও ধন্যবাদ।
প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন