গণতন্ত্র আ’লীগের সংজ্ঞা অনুযায়ী চলছে
23 December 2017, Saturday
‘গণতন্ত্র হচ্ছে আপনি আপনার কথা বলবেন। আমি আমার কথা বলব। জনগণের যারটা ভালো লাগে তারটা শুনবে। আপনি মত প্রকাশের কোনো সুযোগই দিবেন না তাহলে এটা তো গণতন্ত্র হল না। এখন গণতন্ত্র আওয়ামী লীগের সংজ্ঞা অনুযায়ী চলছে।’ পরিবর্তন ডটকমকে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেছেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও ডক্টরস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ড্যাব) মহাসচিব প্রফেসর ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আশিক মাহমুদ। ছবি তুলেছেন রাফিয়া আহমেদ।
পরিবর্তন ডটকম : দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিবেশ কেমন দেখছেন?
ড. জাহিদ হোসেন : বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি যদি বলতে হয় তাহলে, আপনি দেখেন এটা বিজয়ের মাস। এই মাসেই তো আমরা ৯ মাস যুদ্ধ করার পর স্বাধীনতা পেয়েছিলাম। কিন্তু স্বাধীনতার এতো বছর পরও আজ আমরা যা দেখলাম এই বিজয়ের আনন্দের মধ্যেও ভাগাভাগি হয়ে গেছে। যেটা সত্যিকার অর্থে একটা জাতিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায় না। আজ বিএনপিকে রাজপথে নামতে দেয়া হয় না। এটা গণতান্ত্রিক কোনো দেশের নিয়ম হতে পারে না। আজ দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ খুব নাজুক অবস্থানে রয়েছে। বিনা ভোটের সরকার গায়ের জোরে দেশ চালালে যা হয়, দেশে এখন তাই হচ্ছে। কে কখন হারিয়ে যাচ্ছে কেউ বলতে পারছে না।
পরিবর্তন ডটকম : বর্তমান সরকার বলছে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন দিয়ে দেশে গণতন্ত্র রক্ষা করেছে। আপনি কি মনে করেন?
ডা. জাহিদ : গণতন্ত্র হচ্ছে আপনি আপনার কথা বলবেন। আমি আমার কথা বলবো। জনগণের যারটা ভালো লাগে তারটা শুনবে। আপনি মত প্রকাশের কোনো সুযোগই দিবেন না তাহলে এটা তো গণতন্ত্র হল না। এখন গণতন্ত্র আওয়ামী লীগের সংজ্ঞা অনুযায়ী চলছে। সঠিক যে গণতন্ত্র সেটা আর এখন নেই।
গণতন্ত্রের অবস্থা যদি দেখেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কোথায় হারিয়ে যায়, সাংবাদিক উৎপল দাস কোথায় হারিয়ে যায়, সাগর-রুনি কেন মারা গেল, কিভাবে মারা গেল। এটার আজ পর্যন্ত একটা চার্জশিট হল না। ইলিয়াস আলীর মত রাজনৈতিক নেতা ২০১২ সালের এপ্রিল থেকে হারিয়ে কোথায় গেল? অর্থাৎ এই যে একটা কালচার যেটা শুরু হয়েছে এটা গণতন্ত্রের জন্য অশনি সংকেত।
পরিবর্তন ডটকম : স্বাধীনতার ৪৬ বছর পর আমরা কি স্বাধীনতার মূল উদ্দেশ্য সফল করতে পেরেছি?
ডা. জাহিদ : পাকিস্তানিদের অত্যাচার ও বঞ্চনা থেকে মুক্তির জন্য, গণতন্ত্রের জন্য ও অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য মূলত আন্দোলন শুরু হয়। সেই আন্দোলনই এক সময় স্বাধীনতার আন্দোলনে রূপ নেয়। তার পরই তো আমরা একটা লাল সবুজের পতাকা পেয়েছি। স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়েছি। কিন্তু আজও আমরা স্বাধীনতার মূল উদ্দেশ্য সফল করতে পারিনি। আজ সুশাসনের কথা বলেন, তাহলে সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশে সুশাসন বলতে কিছু নেই। আজকে দ্রব্যমূল্যের যে ঊর্ধ্বগতি তা কল্পনাই করা যায় না। যে চালের কেজি দশ টাকা খাওয়াবে বলেছে সেটা এখন ৭০ টাকা। বর্তমান সময়ের সব কিছু হিসেব করেও যদি বলি চালের দাম ২৫ থেকে ৩০ টাকার বেশি হওয়ার কথা না। আজ যারা মধ্যবিত্ত, যারা লিমিটেড আয়ের মধ্যদিয়ে চলে তারা কিভাবে চলবে, কিভাবে খাবে? এক মন আলু বিক্রি করে আপনি এক কেজি পেয়াজ কিনতে পারছেন না। এটা কোন ধরনের সুশাসন হল?
বিদ্যুতের কথাই ধরুন। ঢাকা শহরের বিদ্যুৎ দেখে মনে হয় বিদ্যুৎ আছে। কিন্তু আপনি স্থানীয় জেলা শহরে গিয়ে দেখেন সেখানে কোনো বিদ্যুৎ থাকে না। আমি যেটা বলতে চাই, সুশাসনের যে দুরবস্থা এটার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হচ্ছে বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারিদের যে পদোন্নোতি দেয়া হচ্ছে সেটা কতটা যৌক্তিক। আপনি দেখেন পদ থাকলেও দেয়া হচ্ছে, না থাকলেও দেয়া হচ্ছে। আবার অন্যদিকে অনেক সরকারি কর্মকর্তাকে শুধু রাজনৈতিক কারণে বসিয়ে রাখা হয়েছে। তাদেরকে চাকরি থেকে বিদায় করে দেয়া হয়েছে। এগুলো তো আমাদের স্বাধীতার উদ্দেশ্য ছিল না।
পরিবর্তন ডটকম : বিএনপির সহায়ক সরকার বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি যদি সরকার মেনে না নেয় তাহলে বিএনপির করণীয় কী?
ডা. জাহিদ : নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন এটা শুধু বিএনপির দাবি না। এটা সকল জনগণের দাবি। দলীয় সরকারের অধীনে যেহেতু সুষ্ঠু নির্বাচনের কোনো নজির নেই। বিশেষ করে এই সরকার ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি যেটা প্রমাণ করেছে তাদের অধীনে নির্বাচন হলে কখনও জনগণ ভোট দিতে পারবে না। নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। কাজেই এই সরকারের অধীন জাতীয় নির্বাচন কোনো অবস্থাতেই দেশের জনগণ মেনে নেবে না। নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে তাদেরকে বাধ্য করা হবে। এই দাবি আদায় করেই নির্বাচন হবে সেখানে বিএনপি অংশগ্রহণ করবে।
পরিবর্তন ডটকম : নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আদায়ে বিএনপির আন্দোলন সংগ্রামের চিন্তা আছে কি?
ডা. জাহিদ : বিএনপি সব সময়ই কিন্তু আন্দোলনের প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে। আমরা আলোচনায় বিশ্বাস করি। যদি আলোচনার টেবিলে সব কিছু সমাধান হয়ে যায় তাহলে আর রাজপথের আন্দোলনের প্রয়োজন হবে না। আন্দোলনে যাওয়ার আগে বিভিন্ন প্রক্রিয়া আছে সেই প্রক্রিয়ার মধ্যে বিএনপি আছে। যদি দাবি আদায়ে রাজপথে নামতে হয় তাহরে বিএনপি প্রস্তুত রয়েছে।
পরিবর্তন ডটকম : কেন্দ্রীয় নেতাদের সাথে বিএনপির তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের সাথে কিছুটা দূরত্ব আছে বলে অভিযোগ রয়েছে আপনি কী মনে করেন?
ডা. জাহিদ : তৃণমূলই হচ্ছে বিএনপির মূল শক্তি। ১/১১ এর পর বিএনপিকে ধ্বংস করার অনেক ষড়যন্ত্র হয়ছে। সেটা তৃণমূলের নেতারাই রুখে দিয়েছে। বিএনপির উপরে যারা আছে তারা অনেকে, সরকারের সাথে, ফখরুদ্দিন, মঈনদ্দিনের সাথে আঁতাত করে চলে। আমি মনে করি তৃণমূলের সাথে বিএনপির সর্বোচ্চ নেতৃত্বের কোনো গ্যাপ নেই। তারা ইচ্ছা করলেই গুলশান কার্যালয় ও নয়া পল্টন কার্যালয়ে এসে নেতাদের সাথে দেখা করতে পারে কথা বলতে পারে।
পরিবর্তন ডটকম : গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিএনপির অংশ না নেয়ার সিদ্ধান্ত কী ঠিক ছিল? আপনি কী মনে করেন?
ডা. জাহিদ : অবশ্যই সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল। সেদিন তো কোনো নির্বাচন হয়নি। কেউ ভোট দেয়নি। যে সরকারের অধীনে নির্বাচনে দেশের মানুষ ভোট দিতে পারে না সে নির্বাচনে অংশ নেয়ার প্রশ্নই আসে না। এটা তো প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন। জনগণ এই নির্বাচন মানে না। নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে ছাড়া বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে না। আর বিএনপিকে ছাড়া বাংলাদেশে কোনো নির্বাচন দেশের জনগণ মেনে নিবেও না। বিএনপির নির্বাচনে না যাওয়া যে যথার্থ হয়েছে সেটা সরকার নিজেই প্রমাণ করেছে। কারণ এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না।
পরিবর্তন ডটকম : আপনি রাজনীতির সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত, সেই সাথে ডাক্তরি পেশার সাথেও যুক্ত। রাজনীতি করতে গিয়ে ডাক্তরি পেশায় কোনো ধরনের ব্যাঘাত ঘটে কী?
ডা. জাহিদ : আমি মনে প্রাণে একজন ডাক্তার। আমার রোগীদের চিকিৎসা দেয়া এবং রোগীদের প্রয়োজনে যতক্ষণ পর্যন্ত সহযোগিতা করা প্রয়োজন সেটা করতে আমি সাচ্ছন্দ্যবোধ করি। আমি একজন মেডিকেল শিক্ষকও। ২০০৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আমি সরকারের চাকরি করেছি। তারপর আমি চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়েছি। যেহেতু আমি একজন মানুষ, রাজনৈতিক সচেতন মানুষ। আসলে সক্রিয়ভাবে রাজনীতি করতে গিয়ে নিজের পেশায় কিছুটা বাধাগ্রস্ত হয়। অনেক সময় রোগীরা কষ্ট পায়। সবকিছু ম্যানেজ করা আসলেই কষ্টকর হয়ে যায়। আমার পেশা সত্যিকার অর্থে রাজনীতির জন্য ক্ষতির সম্মূখীন। তবে আমি কিছুটা সময় ভাগ করার চেষ্টা করি।
পরিবর্তন ডটকম : আপনাকে সঠিক সময়ে না পেয়ে রোগীরা অভিযোগ করে কী?
ডা. জাহিদ : সবসময় রোগীরা অভিযোগ করে। সবার একই কথা স্যার আপনাকে আমরা পাই না। আপনার সাথে কথা বলতে পারি না। যেহেতু এটা আইটির যুগ তাই আমি রোগীদের সাথে মোবাইল ফোনে কথা বলার চেষ্টা করি।
পরিবর্তন ডটকম : অন্যান্য যেকোনো দেশের তুলনায় বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা অনেক উন্নত। কিন্তু আমরা দেখি রাজনীতিবিদরা সামান্য চিকিৎসার জন্য বিদেশে চলে যায়। এটা উচিত কী না?
ডা. জাহিদ : সামান্য কারণে বাইরে যাওয়াটা মোটেও ঠিক না। এতে ডাক্তারের ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা কমতে পারে। আমাদের দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা তো আগের চেয়ে অনেক ভালো। তবে আগের চেয়ে সামান্য চিকিৎসার জন্য মানুষের দেশের বাইরে যাওয়ার প্রবণতা কমেছে। আমি আশা করি আরো কমে যাবে। মূলত আমাদের দেশের রাজনীতিবিদরা দেশের বাইরে যায় শুধু চিকিৎসার জন্য না। তার সাথে অনেক কাজও থাকে। তবে তাদের উচিৎ দেশের ডাক্তারের ওপর আস্থা রাখা। আপনি দেখেন অনেক মানুষ বিয়ের বাজার করতেও বাইরে যায়, শপিং করতেও বাইরে যায়। এগুলো এক ধরনের বিলাসিতা।
পরিবর্তন ডটকম : বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসলে আপনি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাবেন বলে আশা করা হচ্ছে। আপনি দায়িত্বে আসলে সামান্য চিকিৎসা করাতে দেশের বাইরে যাবেন নাকি দেশের ডাক্তারের প্রতি আস্থা রাখবেন?
ডা. জাহিদ: আমি এখনও আমার চিকিৎসা দেশেই করাই। আমার পরিবারের সবার চিকিৎসা আমি ঢাকাতে করাই। আমি বা আমার পরিবারের কারো চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা কখনও অনুভব করিনি। আর সামান্য চিকিৎসার কারণে দেশের বাইরে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। দেশের ডাক্তারসহ সবার প্রতি আস্থা আছে। আমি তাদের প্রতি আস্থা রাখতে চাই। কারণ আমি নিজেও মনে প্রাণে একজন ডাক্তার।
পরিবর্তন ডটকম : এতক্ষণ সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
ডা. জাহিদ : আপনাকেও ধন্যবাদ।
পরিবর্তন
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন