মাহবুবউল আলম হানিফ। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। জন্ম ১৯৫৯ সালে কুষ্টিয়া জেলার ভেড়ামারা উপজেলা ষোলদাগ গ্রামে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকপর্যায়ে লেখাপড়া করেন ঈশ্বরদীর পাকশীতে। ঢাকা কলেজে পড়ার সময় সক্রিয় ছিলেন ছাত্রলীগের রাজনীতিতে। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবস্থাপনা বিভাগে সম্মানসহ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন। ব্যবসায়ের মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু। ১৯৮৯ সালে হন ভেড়ামারা থানা আওয়ামী লীগের সদস্য। ১৯৯১ সালে জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও ১৯৯৬ সালে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং ২০০২ সালে জেলা সহসভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। কুষ্টিয়া-২ আসন থেকে ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ প্রার্থী হিসেবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন তিনি। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর তাকে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারীর দায়িত্ব দেয়া হয়। একই বছর দলের ১৮তম জাতীয় কাউন্সিলে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রথম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান। ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ কাউন্সিলেও তৃতীয়বারের মতো প্রথম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মনোনীত হন। পাশাপাশি তিনি চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগীয় দায়িত্ব পালন এবং দলের মনোনয়ন বোর্ডের সদস্যসহ বিভিন্ন ফোরামে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে তিনি নয়া দিগন্তের সাথে খোলামেলা কথা বলেন।
নয়া দিগন্ত: নির্বাচন কমিশনের সাথে রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপের পর নির্বাচন নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রস্তুতি কেমন চলছে?
হানিফ: আওয়ামী লীগ নির্বাচন এবং আন্দোলন এই দুটি বিষয়ে সব সময় প্রস্তুত। আলাদা প্রস্তুতির কোনো প্রয়োজন নেই। তবে নির্বাচনের জন্য বাড়তি প্রস্তুতির কিছু থাকে। যেমন, প্রার্থী বাছাইয়ে মাঠপর্যায়ে কিছু তথ্য-উপাত্ত দরকার হয়। সেই তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের কাজ চলছে। আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে ও বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় সেই তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করি। ইতোমধ্যেই সেই সব তথ্য চলে আসছে। এর বাইরে প্রায় তিন মাস পর পর একটা জরিপ করা হয়। এর মাধ্যমে মাঠপর্যায়ে সর্বশেষ আমাদের অবস্থান এবং সম্ভাব্য প্রার্থীদের অবস্থান সম্পর্কে দলের হাইকমান্ড অবগত হন। তার ওপর ভিত্তি করেই আমাদের প্রার্থী চূড়ান্ত করা হবে।
নয়া দিগন্ত: আপনাদের তো প্রস্তুতি আছে। কিন্তু দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নির্বাচনের সার্বিক পরিবেশ আছে কী?
হানিফ: আমরা মনে করি নির্বাচনের সাথে সংশ্লিষ্ট সবাই প্রস্তুত আছে। বিশেষ করে সংসদের বাইরে সবচেয়ে বড় বিরোধী দল হিসেবে পরিচিত বিএনপিও নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত। তাদের প্রার্থী বাছাইয়ের কাজও চলছে এবং তা চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। তাদের শীর্ষপর্যায়ের একাধিক নেতাও নির্বাচনে প্রস্তুতির কথা জানিয়েছেন। এ ছাড়া নির্বাচনের প্রস্তুতির জন্য সার্বিক বিষয় নিয়ে নির্বাচন কমিশনও সুশীলসমাজ, সাংবাদিক, পেশাজীবী ও রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনা করেছে। এসব বৈঠকের মাধ্যমে আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে যেসব প্রস্তাব বা পরামর্শ উঠে এসেছে তার মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন তাদের কর্মপন্থা ঠিক করছে। বলা যায়, নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক দলসহ সব মহলেই প্রস্তুতি চলছে।
নয়া দিগন্ত: বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী বা সংসদ বহাল রেখে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। এর মাধ্যমে সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা যাবে না। বিএনপির এই দাবিকে কিভাবে দেখেন?
হানিফ: আসলে নির্বাচনের সময় এগুলো খুব বেশি গুরুত্ব বহন করে না। কারণ, নির্বাচনের সময় প্রশাসনিক সব ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের হাতে চলে যায়। নির্বাচন কমিশনের হাতে ক্ষমতা থাকার অর্থ সবার জন্যই সমান। এখানে সরকারের কিছুই করার থাকে না। সরকার শুধু নির্বাচন কমিশনকে সহযোগিতা করতে পারে। এ সরকারের সময় যেসব সিটি করপোরেশন নির্বাচন হয়েছে এগুলোতে বেশির ভাগই বিএনপির প্রার্থী জয়লাভ করেছে। নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু হয়েছে বলেই তো তারা জয়ী হয়েছে। এতেই প্রমাণিত হয় নির্বাচনের সময় সরকারের কিছু করার থাকে না। নির্বাচন কমিশন স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে। সুতরাং জাতীয় নির্বাচনে নির্বাচন কশিনের ভূমিকা বা নিরপেক্ষতা নিয়ে সংশয় বা সন্দেহ থাকার কোনো অবকাশ নেই।
নয়া দিগন্ত: তাহলে নির্বাচন কমিশনকে আরো শক্তিশালী করতে কী ধরনের পদক্ষেপ নেবে সরকার?
হানিফ: নির্বাচন কমিশন বর্তমানে অনেক বেশি স্বাধীন ও শক্তিশালী। তাদের প্রধান দুর্বলতা ছিল আর্থিক সঙ্কট বা নিজস্ব বাজেট। ফলে সরকারের প্রতি তাদের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার তাদের সেই দুর্বলতা থেকে মুক্তি দিয়েছে। সরকার আলাদাভাবে তাদের অর্থ বরাদ্দ দিয়েছে এবং নির্বাচন কমিশন আলাদা নিজস্ব বাজেট দিতে পারে। সুতরাং তারা এখন অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি স্বাধীন ও শক্তিশালী। তাদের সক্ষমতা নিয়ে আর কোনো প্রশ্ন থাকতে পারে না।
নয়া দিগন্ত: বিএনপি নির্বাচনকালীন নির্দলীয় বা সহায়ক সরকার দাবি করছে এই দাবিকে আপনারা কিভাবে দেখছেন?
হানিফ: বিএনপির এই দাবির পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। হতে পারে এটা তাদের রাজনৈতিক কৌশল। এর মাধ্যমে দরকষাকষি করে তারা একটু বাড়তি সুবিধা পেতে চায়। বিএনপি একাধিকবার ক্ষমতায় বা সংসদে ছিল। তারা সংবিধান এবং আইন জানে। একটি দায়িত্বশীল ও বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে তারা এটা বেশ ভালো করেই জানে, সংবিধানের মধ্যে থেকেই নির্বাচন হতে হবে। এর বাইরে যাওয়ার কারো কোনো সুযোগ নেই। অহেতুক সংবিধান ঘষামাজা, কাটাছেঁড়া, পরিবর্তন বা সংশোধনের কোনো প্রয়োজন নেই। সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সরকার সহায়ক সরকার হিসেবে নির্বাচন কমিশনকে সহযোগিতা করে যাবে এবং অতীতের স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোর মতো আগামী জাতীয় নির্বাচনও অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করা সম্ভব এবং সেটিই হবে। সুতরাং তাদের দাবি যে যৌক্তিক নয়, এটা তারাও জানে। তবুও রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে তারা সহায়ক সরকারের দাবি করছে বাড়তি কোনো সুবিধা নেয়ার জন্য।
নয়া দিগন্ত: কিন্তু ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপিকে নির্বাচনকালীন সরকারে থাকারও প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। অর্থাৎ এক ধরনের নির্বাচনকালীন সরকারের ব্যাপারে আপনাদের অবস্থান ছিল।
হানিফ: দেখুন ২০১৪ সালের পরিস্থিতি আর বর্তমান প্রেক্ষাপট এক নয়। ওই সময় সরকারের আন্তরিকভাবে বারবার আহ্বানের পরও বিএনপি সংলাপে আসেনি এবং গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়সহ নির্বাচনকালীন সরকারে থাকার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিল। তাদের ওই ভুল ও একগুঁয়েমি সিদ্ধান্তের কারণে দেশের অনেক ক্ষতি হয়েছিল। নির্বাচন ঠেকানোর নামে বহু মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছিল। নির্বাচন প্রতিহতের নাম করে দুইজন প্রিজাইডিং অফিসারসহ ৪৭ জন সাধারণ ভোটারকে গুলি ও কুপিয়ে হত্যা করেছিল। ৫০০-রও বেশি স্কুলে আগুন দিয়েছিল। বাড়িঘর ও গাড়িতে আগুন দিয়েছিল। এটা কিন্তু শুধু নির্বাচনের সময়ই নয়, সরকারের প্রথম বর্ষপূর্তিকে কেন্দ্র করে ৯৩ দিন অবরোধের নামে পেট্রল বোমায় ২৩১ জন মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছিল এবং সবাই নিরীহ ও নিরপরাধ মানুষ। এর সবই হয়েছে বিএনপির ওই ভুল সিদ্ধান্তের কারণে এতগুলো মানুষের জীবন দিতে হয়েছিল। এখন আর সেই প্রেক্ষাপট নেই। আগামী নির্বাচনের সময় সর্বদলীয় সরকার গঠনের কোনো প্রয়োজন হবে না। আমরা আশা করি, বিএনপি মুখে যাই বলুক এ সরকারের অধীনেই শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে অংশ নেবে।
নয়া দিগন্ত: কিন্তু আওয়ামী লীগ একসময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য আন্দোলন করেছে?
হানিফ: তখনকার পরিস্থিতি দেখতে হবে। বিএনপি ৯১ সালে ক্ষমতায় আসার পর বিভিন্ন উপনির্বাচনে কিভাবে কারচুপি করেছিল। ভোটাররা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি। ১৯৯৪ সালে মাগুরা উপনির্বাচনে কারচুপি ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ। সেটা এতটাই ভয়ঙ্কর অবস্থায় ছিল যে তখনকার প্রধান নির্বাচন কশিনার বিচারপতি আব্দুর রউফ নিজেই ভোটের দিন সকাল বেলা নির্বাচনী এলাকা থেকে চলে আসতে বাধ্য হলেন। সন্ত্রাসী দিয়ে কিভাবে গ্রামের মানুষকে ভয়ভীতি দেখিয়ে ভোটকেন্দ্রে যেতে বাধা দেয়া হয়েছিল। এই চিত্রটাই তখন প্রমাণ করেছিল, বিএনপি সরকারের অধীনে নির্বাচন আর সুষ্ঠু হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কারণ, তারা পরপর কয়েকটি উপনির্বাচনে ভোটডাকাতি আর অনিয়মের কারণে এটা জনমনে প্রতীয়মান হয়েছে। স্বাভাবিক কারণেই আমরা বলেছিলাম, যে সরকার এ ধরনের ভোটডাকাতি করতে পারে তার অধীনে নির্বাচন সম্ভব নয়। সে হিসেবে আমাদের দাবি ছিল সরকার পরিবর্তন করে নির্বাচন দিতে হবে। এর পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি তখন জনগণের দাবি ছিল।
কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে তিনটা নির্বাচন হয়েছিল। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে তিনটি নির্বাচনেই পরাজিত রাজনৈতিক দল নির্বাচনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। তার মানে এটা প্রমাণ হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলেই যে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হিসেবে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে, সেরকম তো হয়নি। দ্বিতীয়ত হলো: আমাদের হাইকোর্টে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানটাকেই অসাংবিধানিক উল্লেখ করে তার বিরুদ্ধে রায় দিয়েছে। তাই পুনরায় এ পদ্ধতিতে ফিরে আসার সুযোগ নেই।
নয়া দিগন্ত: নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনা বা সংলাপের প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন কি না?
হানিফ: হ্যাঁ সংলাপ যেকোনো সময় যেকোনো বিষয়েই হতে পারে। এটা অযৌক্তিক কিছু নয়, বরং হওয়াটাই স্বাভাবিক। তবে এ মুহূর্তে বিএনপির সাথে সংলাপের কোনো সম্ভাবনা নেই। তারা যেভাবে আক্রমণাত্মক ও উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছে, তাতে বলা যায় দুই দলের সাথে সংলাপের সম্ভাবনা কম। সেই পরিবেশও নেই।
নয়া দিগন্ত: বিএনপি অভিযোগ করছে বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলা নিয়ে সরকারের অভিসন্ধি আছে, এ অভিযোগ কিভাবে দেখেন?
হানিফ: দেখুন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে সরকার কোনো মামলা দেয়নি। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মালাগুলো এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়কার। এর দায়ভার আমরা নিতে পারি না। আর বিভিন্ন নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে উসকানি ও নির্দেশের কারণে তার বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মামলা করেছে। এখানে সরকারের কোনো হাত নেই। তবে একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ কখনোই খালেদা জিয়ার সাজা কামনা করে না। কারণ, দুর্নীতির অভিযোগে দেশের সাবেক তিনবারের প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে সাজা হলে রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের জন্যও লজ্জাজনক হবে। এ ছাড়া বিশ্বে বর্তমানে বাংলাদেশের একটি উজ্জ্বল ভাবমূর্তি রয়েছে। আর সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সাজা হলে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের সেই ইমেজ চরমভাবে নষ্ট হবে। তাই আমরা চাই বেগম খালেদা জিয়া আদালতে যুক্তি প্রমাণের ভিত্তিতে নির্দোষ প্রমাণিত হোন। এতে বিএনপি নেতাকর্মীরা যেমন খুশি হবে তেমনি আমরাও খুশি হবো।
নয়া দিগন্ত: ক্ষমতাসীন দল বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের কথা বলছে, কিন্তু টেকসই উন্নয়নের জন্য টেকসই গণতন্ত্র দরকার। বৃহত্তর বিরোধী দল ছাড়া কিভাবে সম্ভব?
হানিফ: একটা বিষয় সবাইকে জানা উচিত। ১৯৭৫ সালে জাতির পিতাকে হত্যার মধ্য দিয়ে এ দেশে যে বিভাজনের রাজনীতি শুরু হয়েছে, সেই বিভাজনের রাজনীতির কারণে কিন্তু দেশের মধ্যে এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে চরমভাবে দূরত্ব তৈরি হয়। আর সে জন্য জাতীয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ঐকমত্য হয়নি। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় আমাদের দেশে সঙ্ঘাতময় পরিবেশ ছিল। আর সঙ্ঘাতময় পরিবেশে কোনো দেশে কখনোই টেকসই উন্নয়ন করা যায় না। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বিশেষ করে ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর আমরা বহুবার চেষ্টা করেছিলাম যাতে শান্তিপূর্ণ পরিবেশের মাধ্যমে দেশটাকে এগিয়ে নেয়া যায়। বিশেষ করে ২০০১ থেকে ২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত ৫ বছর রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকতে তাদের দুঃশাসন, অপশাসন বা ব্যর্থতা যেটাই আমরা বলি এর কারণে দেশ অনেক বেশি পিছিয়ে গেছে। বাংলাদেশ চরম দুর্নীতিবাজ দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল। বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিকভাবে সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল। ১২৫টি উগ্র মৌলবাদী জঙ্গি সংগঠনের উত্থান হয়েছিল ওই ৫ বছরে। এরকম একটা পরিবেশে দেশ কখনোই সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। দেশ অন্ধকারে তলিয়ে যায়। সেখান থেকে আমাদের প্রধানমন্ত্রী একটা আলোর পথে নিয়ে এসেছেন। আজকে বাংলাদেশ ৫০০ ডলারের নিচে যেখানে মাথাপিছু আয় ছিল সেখান থেকে ১৬০০ ডলার ছাড়িয়ে গেছে। দেশ আজ নিম্ন মধ্যবিত্ত রাষ্ট্রে উন্নীত হয়েছে। সে জায়গায় কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ়তা ও জিরো টলারেন্সের কারণে আন্তর্জাতিক মহলে প্রশংসিত হয়েছে এবং বাংলাদেশকে জঙ্গি দমনের ক্ষেত্রে সরকারের ভূয়সী প্রশংসা করছে।
আমাদের অতীতের এই ব্যর্থতা কাটিয়ে আমরা সমনে এগিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছি। আমরা বারবার বিএনপিকে অনুরোধ করেছিলাম ২০০৯ থেকে ২০১৪ সালের আগ পর্যন্ত মেয়াদে দেশের উন্নয়নের জন্য সরকারের সাথে সহায়তামূলক একটি রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি করুক। আপনারা যদি লক্ষ করে দেখেন কোনো কারণ ছাড়াই শুধু যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে কেন্দ্র করে বিএনপি-জামায়াত যৌথভাবে এই বিচারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলো। প্রথমে আন্দোলন সংগ্রাম এবং পরে ধ্বংসযজ্ঞে মেতে উঠে তারা। ২০১৩ সালে বিচারের রায় ঘোষিত হওয়ার পর সারা দেশে তাণ্ডবলীলা চালিয়েছিল। যানবাহন, পুড়িয়ে, রেললাইন উপড়ে আগুন দিয়ে, রাস্তাঘাট কেটে, গাছাপালা কেটে, সারা দেশে সড়কব্যবস্থা ধ্বংস, মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করে, পুলিশকে হত্যা করে একটা তাণ্ডবলীলা ও অরাজকতা চালায়। সেই অবস্থায় সরকারের তখন আর কী করার থাকতে পারে। গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে এভাবে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ শুরু করলে তখন সরকার শুধু গণতন্ত্রের কারণে যদি এসব অপরাধীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিতো, তাহলে দেশটা এত দিনে ধ্বংস হয়ে যেতো।
নয়া দিগন্ত : কিন্তু বিরোধী দলের রাজনৈতিক অধিকার সঙ্কুচিত করা হয়েছে।
হানিফ : আমাদের সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে এই বোধটুকু থাকা দরকার, গণতন্ত্র মানেই এটা নয় যে আপনি রাজপথে মিছিল করার নাম করে গাড়ি-বাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেবেন, অন্যের মাথায় বাড়ি দেবেন, পেট্রল দিয়ে, বোমা মেরে উড়িয়ে দেবেন এটা কখনো হতে পারে না। এর বিরুদ্ধে যখনই ব্যবস্থা নেয়া হলো তখন বলা হলো আমাদের গণতন্ত্র হরণ করা হচ্ছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নাকি দুই বছরে বিএনপি সমাবেশ করার অনুমতি পেয়েছে। কেন এই দুই বছর পর সভা করতে হবে। রাজনৈতিক দল হিসেবে যেকোনো সময় চাইলেই সভা-সমাবেশ করার অনুমতি পাওয়া উচিত এটা তাদের অধিকার। আওয়ামী লীগ সেই গণতন্ত্রেই বিশ্বাস করে; কিন্তু বিএনপির অতীতের যে রেকর্ড বা কর্মকাণ্ড তা হচ্ছে সভা-সমাবেশের নাম করেই তারা নাশকতা বা ধ্বংসলীলা শুরু করে। সে জন্য তাদেরকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও বিশ্বাস করে না। সরকারের তো দায়িত্ব আছে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দেয়া। সেই আশঙ্কা থেকেই তারা অনুমতি পায়নি।
আওয়ামী লীগ সব সময় গণতন্ত্রে বিশ্বাসী দল। মনে করে গণতন্ত্র একটা দেশের জন্য অপরিহার্য এবং আমরা সেই গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। আমাদের সংগঠনের মূল আদর্শ ও নীতির মধ্যে গণতন্ত্রকেই সবচেয়ে বেশি জোর দিয়ে থাকি।
নয়া দিগন্ত : জাতীয় পার্টিকে বিরোধী দলে নিয়ে সংসদ কতটুকু কার্যকর হয়েছে বলে মনে করেন।
হানিফ : সংসদ সদস্য হিসেবে প্রথমবারের মতো এবারই আমার সংসদে যাওয়া। একজন নবীন সদস্য হিসেবে এই মেয়াদের পুরোটা সময়ে আমার মনে হয়েছে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে এবারের সংসদ বেশি কার্যকর ছিল। এই কার্যকরের কারণেই দেশের স্বার্থে অনেক আইন করা হয়েছে। জনগণের জন্য আরো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হয়েছে। আপনারা লক্ষ করেছেন গত বাজেটে আমরা অর্থমন্ত্রীর কিছু প্রস্তাবের তীব্র সমালোচনা করেছি। অবশেষে অর্থমন্ত্রী তার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতেও বাধ্য হয়েছেন। সংসদে এটাই হওয়া উচিত। সংসদ জনগণের জন্য। জনগণের ভোটে নির্বাচিত সদস্যরা জনগণের পক্ষেই কথা বলবেন। জনগণের বিরুদ্ধে কিছু গেলে প্রতিবাদ করাটাই বিরোধী দল হিসেবে দায়িত্ব। তবে আমরা সরকারি দলের সদস্য হিসেবেও সেই দায়িত্ব পালন করেছি। দেশের স্বার্থে, জনস্বার্থে আমরা অনেক কিছুর প্রতিবাদ করেছি এবং সরকারকে বাধ্য করেছি সেসব বিষয় সংশোধন করতে। সেই হিসেবে বলা যায়, অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় সবচেয়ে বেশি কার্যকর বর্তমান সংসদ।
নয়া দিগন্ত : নির্বাচনের ঠিক আগ মুহূর্তে মহাজোট নেতাদের কিছু ক্ষোভ প্রকাশ পাচ্ছে। তাহলে কি কোনো টানাপড়েন চলছে?
হানিফ : না, মহাজোটে কোনো টানাপড়েন নেই। তবে চলার পথে অনেক সময় অনেক ছোটখাটো ভুলভ্রান্তি বা কেউ ভুল বুঝতে পারে। এ ছাড়া রাজনৈতিক কৌশল হিসেবেও অনেক সময় অনেক কথা বলা হতে পারে; কিন্তু মহাজোটে টানাপড়েন আছে বলে আমরা মনে করি না।
নয়া দিগন্ত : নির্বাচন সামনে রেখে মহাজোটের কলেবর বাড়তে পারে কি না।
হানিফ : এ মুহূর্তে বলা যায় না। তবে বাড়তেও পারে। কারণ, আমরা আগেই বলেছি যারা স্বাধীনতার পক্ষে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এখনো বিশ্বাস করে তারা আদর্শিকভাবে আমাদের সাথে জোটে আসতে পারে।
নয়া দিগন্ত : আগামী নির্বাচনে কেমন প্রার্থী মনোনয়ন দেয়া হবে?
হানিফ : আমরা আগেও বলেছি অত্যন্ত সৎ, যোগ্য, এলাকায় গ্রহণযোগ্য, সাধারণ মানুষের সাথে যোগাযোগ ও জনপ্রিয় এবং নেতাকর্মীদের সাথে যার যোগাযোগ আছে এ ধরনের প্রার্থীকে আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন দেয়া হবে। যাদের বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতি ও অনৈতিকতা ও জনবিচ্ছিন্নতার অভিযোগ আছে তাদের কোনোভাবেই মনোনয়ন দেয়া হবে না। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা খুব কঠোর এবং একাধিকবার তিনি নেতাদের সতর্ক করেছেন।
নয়া দিগন্ত : বিএনপি নির্বাচনে আসা আওয়ামী লীগের জন্য চ্যালেঞ্জ মনে করছেন কি না?
হানিফ : আমরা সব সময় চাই, বিএনপি নির্বাচনে আসুক। অতীতে আমরা নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেই জয়লাভ করেছি। একাত্তরে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি। পঁচাত্তরের পর থেকে আমরা দেশী-বিদেশী নানা ধরনের চক্রান্ত ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেই এ পর্যায়ে এসেছি। জননেত্রী শেখ হাসিনা চ্যালেঞ্জ মেকাবেলা করে অনেক চড়াই-উতরাই পার করে তিনবার আওয়ামী লীগকে রাষ্ট্রক্ষমতায় এনেছেন। তিনি সব সময় দেশের উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের জন্য চ্যালেঞ্জ নিয়ে চলতেই পছন্দ করেন। বিএনপি নির্বাচনে আসবে আমরা মনেপ্রাণে তা চাই। গত নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একাধিকবার বেগম খালেদা জিয়াকে ফোন করেছিলেন। তিনি গণভবনে শুধু খাওয়ার জন্যই নয়, বরং দুইজনে বসে ঐকমত্যে পৌঁছানোর প্রস্তাব দিয়ে ফোন করেছিলেন। নির্বাচনী সরকারে যোগ দেয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানান। শেখ হাসিনা যদি বিএনপিকে ভয়ই পেতেন, তাহলে বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে এত আন্তরিকতা বা চেষ্টা করতেন না; কিন্তু বেগম জিয়া তা প্রত্যাখ্যান করে নির্বাচন বর্জন তথা প্রতিহত করার ঘোষণা দেন। এর পেছনে দু’টি কারণ ছিল।
একটি হলো, উচ্চ আদালতের নির্দেশে যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল। কারণ, জামায়াত নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না বলেই বিএনপি নির্বাচনে আসেনি। দ্বিতীয়টি হলো, আওয়ামী লীগের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড আর বিএনপির ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের জন্য দেশের আপামর মানুষ বিএনপির প্রতি ক্ষুব্ধ ছিল। নির্বাচনে জয়ী হতে পারবে না বলেই তারা নির্বাচনে আসার সাহস করেনি।
নয়া দিগন্ত : রোহিঙ্গা সমস্যাকে কিভাবে দেখছেন?
হানিফ : সরকারের পক্ষ থেকে তো কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত আছে। আমরা আশা করছি, এর মাধ্যমেই সমাধান হবে। এ ছাড়া কূটনৈতিক তৎপরতা ছাড়া আর কোনো প্রক্রিয়াও নেই। আমরা তো যুদ্ধ করতে পারি না। আমাদের দরকার কূটনৈতিকভাবে আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করে সমাধান করা। মিয়ানমারের সাথে চীনের একটা গভীর বাণিজ্যিক সম্পর্ক আছে। সে জন্য হয়তো তারা এখন পর্যন্ত মিয়ানমারের পক্ষে। তবে আমাদের সাথেও চীনের বাণিজ্যিক ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। আমরাও একে কাজে লাগাতে চাই। সেই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে আমাদের একটি দলীয় টিম চীন সফর করেছে। সেখানে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি তারা তুলে ধরেছেন। চীন বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের জন্য ত্রাণও পাঠিয়েছে। শিগগিরই আমাদের আরেকটি টিম চীন সফরে যাওয়ার কথা রয়েছে। তারা চীনের শীর্ষপর্যায়ের নেতৃবৃন্দের কাছে বিষয়টি তুলে ধরে দ্রুত মিয়ানমারের এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে তাদের দেশে ফিরিয়ে নিতে চীন কার্যকর উদ্যোগ নেবে বলে আমাদের আবেদন থাকবে। একইভাবে আরো যেসব দেশ এই ইস্যুতে নীরব রয়েছে তাদের সাথে কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত থাকবে।
নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন