সিনহা বাবুর দুই বন্ধু গা ঢাকা দিয়েছেন
19 October 2017, Thursday
সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে প্রধান বিচারপতি করা সরকারের ভুল সিদ্ধান্ত ছিল বলে মনে করেন আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী (মানিক)। তিনি মনে করেন, এসব অভিযোগের বিষয়ে সরকারও জানত। তার পরও তাকে প্রধান বিচারপতি করা হয়। এটা সরকারের ভুল সিদ্ধান্ত ছিল।
ঢাকাটাইমসকে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে বিচারপতি শামসুদ্দিন এই অভিমত প্রকাশ করেন। এই দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে ওঠা সাম্প্রতিক অভিযোগ, তার ছুটি এবং বিদেশ যাওয়া, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার পরবর্তী পরিস্থিতিসহ নানা বিষয় উঠে এসেছে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মহিউদ্দিন মাহী। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে প্রথম অংশ।
এখন তো প্রধান বিচারপতি ইস্যু নিয়ে দেশ বেশ সরগরম...
হুম। এখন দেশে দুইটা ইস্যু। একটি রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ, অন্যটি প্রধান বিচারপতি কেন্দ্রিক। প্রধান বিচারপতি খারাপ দিক থেকে দেশে নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। সর্বোচ্চ আদালতের প্রধানের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছে সেটি কল্পনাতীত।
এমন অভিযোগ কি বাংলাদেশে আর কোনো প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে উঠেছিল?
কখনো না। এমন গুরুতর অভিযোগ বাংলাদেশে আর কোনো প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে ওঠেনি। তবে অনেকের বিরুদ্ধে দলীয় আনুগত্য বা তারা একটি বিশেষ দলের অনুসারী- এ রকম অভিযোগ ছিল। কিন্তু এবার যেটি উঠেছে, এমন জঘন্য অভিযোগ কারো বিরুদ্ধে ছিল না। বিষয়টি খুবই হতাশাজনক।
সুপ্রিম কোর্টের বিবৃতিতে প্রকাশিত অভিযোগগুলো সম্পর্কে আপনি কী জানেন?
তার বিরুদ্ধে ১১টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উঠেছে। সবগুলো আমি জানি না। তবে যেগুলো আমি জেনেছি তার মধ্যে একটি হলো ফার্মার্স ব্যাংকের চার কোটি টাকার চেক। দুই কোটি করে দুটি চেক তিনি ফার্মার্স ব্যাংক থেকে তুলেছেন। কিন্তু এই টাকার উৎস কী সেটি তিনি জানাননি। টাকাটা কীভাবে এল? তিনি তুলে নিলেন, কোথায় কী করলেন? সেটি নিয়ে তিনি কিছুই বলেননি। এই অভিযোগ কিন্তু তিন মাস আগেই প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু তিনি প্রতিবাদও করেননি।
আরেকটি হলো ট্যাক্স রিটার্নে ভুল তথ্য দিয়েছেন। ওনার ভাইয়ের বাড়ির জায়গা নিজের জায়গা দেখিয়ে তিনি নয়তলা ভবন করলেন। ট্যাক্সে দেখিয়েছেন ছয়তলা। এই নয়তলা ভবন করতে তো অনেক টাকা লেগেছে। কিন্তু এই টাকা কোথা থেকে এসেছে। সেটির কোনো হিসাব নেই।
আরেকটি হলো রঞ্জিত সেন। রঞ্জিত সেন ওনার বন্ধু। ঘটনা জানাজানি হওয়ার আগেই রঞ্জিত পালিয়ে গেলেন সিঙ্গাপুর। এই রঞ্জিত অনেকগুলো তথ্য দিয়েছে। আরেকজন সিনহা বাবুর বন্ধু অনুরুদ্ধ কুমার রায়। তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। অনেকে বলছেন তিনি গা ঢাকা দিয়েছেন। তার কাছে সিনহা বাবুর অনেক দুর্নীতির তথ্য আছে। সিনহা বাবুর দুটি অ্যাকাউন্ট রয়েছে অস্ট্রেলিয়া ও কানাডায়। এই দুই অ্যাকাউন্টে তিনি কোটি কোটি টাকা পাচার করেছেন অনুরুদ্ধ কুমার রায়ের মাধ্যমে।
সিঙ্গাপুরে অর্থ পাচারের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এটি ১১ অভিযোগের একটি। নৈতিক স্খলনের অভিযোগও আছে। সেটি হলো সুপ্রিম কোর্টের এক মহিলা কর্মকর্তার সঙ্গে তার অনৈতিক সম্পর্ক।
এসব অভিযোগ কি নতুন?
না, তার এস কে সিনহার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ বেশ পুরনো। ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থার সময় তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল। ওই সময় তিনজনকে দুর্নীতির অভিযোগে বঙ্গভবনে ডাকা হয়েছিল। তাদের পদত্যাগ করতে বলা হয়েছিল। এর মধ্যে একজন ওই সময়ই পদত্যাগ করেন। কিন্তু সিনহা বাবু বলেছেন তাকে মায়ের সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। পরে তিনি যে কোনোভাবে বিষয়টি ম্যানেজ করেছেন।
এ তথ্য কি সরকার জানত?
তার বিরুদ্ধে সব অভিযোগই সরকার জানত। এটা তো আইন অঙ্গনে অনেকেই জানেন। তারপরেও কেন তাকে প্রধান বিচারপতি করা হয়েছে এটা আমার বোধোদয় হয় না। কারণ প্রধান বিচারপতি একটি প্রতিষ্ঠান। এখানে কাকে দেয়া হবে সেটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাকে প্রধান বিচারপতি করা যে ভুল সিদ্ধান্ত ছিল, সরকার সেটা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। তাকে নিয়ে সরকার এখন বিব্রত।
প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে এমন অভিযোগের কারণে নিশ্চয় বিচার বিভাগের ভাবমূর্তির ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে?
আমি মনে করি না কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কারণ এসব অভিযোগ এক ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে। প্রতিষ্ঠানকে নয়। সুতরাং এটা যেহেতু ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাই সেটা বিচার বিভাগকে প্রভাবিত করবে না। এ কারণেই অন্য পাঁচ বিচারপতি তার থেকে আলাদা হয়ে গেছেন।
প্রধান বিচারপতির দুই চিঠিতে দুই রকম বক্তব্য। এক চিঠিতে বলেছেন তিনি অসুস্থ। অন্য চিঠিতে বলেছেন তিনি সুস্থ।
উনি একটি রাজনৈতিক দলের হাতে কিছু অস্ত্র দিতে চেয়েছেন। উনি তো ছুটিতে যেতে বাধ্য। কারণ পাঁচজন বিচারপতি ওনার সঙ্গে না বসলে উনি কীভাবে বিচারকাজ করবেন। পাঁচজন পরিষ্কার ভাষায় বলে দিয়েছেন- যত দিন ১১ অভিযোগের সুরাহা না হবে তত দিন এক বেঞ্চে তারা বসবেন না। ওনার (সিনহা) বসার কোনো সুযোগ ছিল না। ওনার দুটি সুযোগ ছিল- একটি পদত্যাগ করা, আর অন্যটি ছুটি নেয়া। তিনি ছুটি নিয়েছেন। কারণ তিনি যদি পদত্যাগ করেন তাহলে পরের দিনই দুদক তার বিরুদ্ধে মামলা করত। তিনি ধরা খেতেন।
ছুটি নিয়ে ইতিমধ্যে তিনি বিদেশে গেছেন।
আমি বলব ছুটি দেয়াটা ঠিক হয়নি। তাকে বিদেশ যেতে দেয়াও কোনোভাবেই ঠিক হয়নি বলে আমি মনে করি। কারণ তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছে সেগুলো নিয়ে আজ হোক কাল হোক মামলা হবেই। এ ছাড়া তাকে বিদেশ থেকে আনা কঠিন হয়ে পড়বে। তিনি হয়তো রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে বসতে পারেন। আমরা এখনো বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের ফেরাতে পারিনি।
বিচারপতি সিনহা বিদেশ যাওয়ার আগে বলেছেন তিনি আবার ফিরবেন। পালিয়ে যাচ্ছেন না...
আমার মনে হয় তিনি আসবেন না। কারণ হলো তিনি যাওয়ার আগে বলেছেন তিনি পালিয়ে যাচ্ছেন না। ওই যে একটা কথা আছে না- ঠাকুর ঘরে কে? আমি কলা খাই না। তার তো বলা দরকার ছিল না আমি পালিয়ে যাই না। পালিয়ে গেছেন বলেই তিনি এমন কথা বলেছেন।
তার স্ত্রীরও সঙ্গে যাওয়ার কথা ছিল।
হুম। এটা নিয়েও দুই রকমের তথ্য আছে। একটি হলো তিনি যাওয়ার আগে তার সঙ্গে স্ত্রীর ঝগড়া হয়েছে সুপ্রিম কোর্টের ওই নারী কর্মকর্তার ভিডিও নিয়ে। আবার কেউ কেউ বলছেন তিনি বাসা বদলের কারণে থেকে গেছেন। এমনটি হতে পারে। কারণ বাসা বদল তো খুব সহজ কাজ না। অনেক বিষয় এর সঙ্গে জড়িত। আমি আসলে নিশ্চিত নয় কেন তিনি থেকে গেছেন।
কোনো অভিযোগে প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে কি আইনি ব্যবস্থা নেয়া যায়?
তার বিরুদ্ধে দুদক ব্যবস্থা নিতে পারে। তার বিরুদ্ধে ইতোমধ্যেই আইনি পদক্ষেপ চলমান আছে। তিনি একজন বিচারপতির দুর্নীতির মামলা না করতে দুদকে চিঠি দিয়েছিলেন। সেটি নিয়ে রুল আছে। রুলটি আদালতে আছে। দুদক একজন সাধারণ মানুষের বেলায় যতটুকু করতে পারে ঠিক ততটুকু করতে পারবে প্রধান বিচারপতির বেলায়। কারণ তিনি তো আইনের ঊর্ধ্বে নন।
বিষয়টি হলো প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হবে। কিংবা ব্যবস্থা নেয়া হবে কি না। তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা হবে কি না। এসব সম্পূর্ণ দুদকের এখতিয়ার। দুদক ইনডিপেডেন্ট বডি। তবে তাকে প্রধান বিচারপতির পদ থেকে সরানো হবে কি না সেটি রাষ্ট্রপতির এখতিয়ার। প্রধান বিচারপতি থাকাকালেও দুদক চাইলে তার বিরুদ্ধে মামলা করতে পারবে।
প্রধান বিচারপতি বিদেশ যাওয়ার সময় বলেছেন ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি প্রশাসনিক রদবদল করতে পারেন না। আপনি কী বলেন?
অবশ্যই করতে পারবেন। রাষ্ট্রপতি তাকে সব ক্ষমতাই দিয়েছেন। আমি মনে করি বর্তমান ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি যা করেছেন ঠিকই করেছেন। কারণ সিনহা বাবুর কিছু অনুগত লোক ছিল যারা চাটুকার। এদের মাধ্যমে সিনহা অনেক বেআইনি কাজ করেছেন। তাদের সরিয়ে ভালো কাজই হয়েছে।
বিচারপতি এস কে সিনহাকে নিয়ে এই বিতর্কের ফলে তার দেয়া রায়গুলো বিতর্কিত হবে না?
না, সেগুলো বিতর্কিত হবে না। কারণ অভিযোগগুলো তার ব্যক্তিগত বিষয়কে কেন্দ্র করে হয়েছে।
আচ্ছা, প্রধান বিচারপতির সঙ্গে এক বেঞ্চে বসতে না চাওয়ার মধ্য দিয়ে বিচারপতিদের মধ্যে এক ধরনের অনৈক্য প্রকাশিত হলো বলছেন অনেকে।
আমি সেটা মনে করি না। বরং এই ক্ষেত্রে আমি বলব বিচারপতিদের মধ্যে ঐক্য হয়েছে। তারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে একাট্টা হয়েছেন। এতে ঐক্য আরও সুদৃঢ হয়েছে।
ছুটি শেষে প্রধান বিচারপতি পদে এস কে সিনহার দায়িত্ব পাওয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন আইনমন্ত্রী।
আমারও তা-ই মনে হয়। কারণ ওই পাঁচজন বিচারপতি তো অভিযোগ সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত তার সঙ্গে বসবেন না। সুতরাং তার আর ফেরার সুযোগ নেই। পরে তার পরিণতি কী হবে সেটি আমি বলতে পারব না। তবে আমি বলতে পারি আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে।
ঢাকা ছাড়ার আগে বিচারপতি এস কে সিনহা সাংবাদিকদের সঙ্গে যেভাবে কথা বলেছেন তাতে মনে হয়েছে তিনি প্রধানমন্ত্রীর অনুকম্পার আশায় আছেন।
উনি প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে ‘অভিমান’ কথাটা বলে দেশের প্রধানমন্ত্রীকে অবমাননা করেছেন। অভিমান কথাটা কি প্রধানমন্ত্রীর বেলায় খাটে। প্রধানমন্ত্রী কি কারো প্রতি অভিমান করেন। তিনি সরকারপ্রধান। উনি কি অভিমান দ্বারা দেশ চালান। উনি কী দুধের বাচ্চা যে অভিমান করবেন। এই কথাটা কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ বলতে পারে না। প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত ম্যাচিউরড এবং শিক্ষিত একজন মানুষ। তিনি ভালোভাবেই তার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। তিনি নিজে বলেছেন তিনি রায়টি পুরোপুরি পড়েছেন। সুতরাং তাকে ভুল বোঝানোর কোনো সুযোগ নেই। (কাল থাকছে সাক্ষাৎকারের দ্বিতীয় পর্ব)
(ঢাকাটাইমস
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন