গত মার্চে অ্যামাজন ডটকমে লজিক ক্যাটাগরিতে সবচেয়ে বেশি বিক্রীত বই ‘দ্য ডার্ক সায়েন্স অব লজিক্যাল ফ্যালাসিস: ৩০ মিনিটস টু ন্যাচারালি রিপ্রোগ্রাম ইওর মাইন্ড অ্যান্ড স্টপ দ্য মিডিয়া, পলিটিশিয়ানস অ্যান্ড লায়ার্স ফ্রম স্টিলিং ইওর মানি, ইওর মাইন্ড অ্যান্ড ইওর পাওয়ার’। কৌশলে উত্থাপিত যুক্তির কাছে হেরে না যাওয়ার দীক্ষা রয়েছে এর প্রাঞ্জল উপস্থাপনায়। ক্রেতা তালিকায় সবার উপরে যুক্তরাষ্ট্রের পাঠকরা। বইটির লেখক বাংলাদেশী ব্যবসায়ী কাজী খুররম আহমেদ। কম্পিউটার প্রকৌশলে যুক্তরাষ্ট্রের পারড্যু বিশ্ববিদ্যালয়ের এ স্নাতককে ২০১০ সালে ‘ম্যান অব দ্য ইয়ার’ ঘোষণা করে আমেরিকান বায়োগ্রাফিক্যাল ইনস্টিটিউট। একই বছর ইন্টারন্যাশনাল বায়োগ্রাফিক্যাল সেন্টার, ইউকে তাকে একজন ‘লিডিং প্রফেশনালস অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। সিঙ্গাপুরভিত্তিক ট্রেডিং কোম্পানি অস্ট্রিন প্রাইভেট লিমিটেডের এ ব্যবস্থাপনা পরিচালক দেশেও বিভিন্ন পারিবারিক ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত আছেন। ২০১৫ সাল থেকে ঢাকায় গাম্বিয়ার অনারারি কনসালের দায়িত্বও পালন করছেন তরুণ এ ব্যবসায়ী। বণিক বার্তার সঙ্গে তার একান্ত আলাপচারিতায় বইয়ের বিষয়বস্তু, নিজের ক্যারিয়ার ও জীবনদর্শন, দেশে ব্যবসার পরিবেশ, প্রত্যক্ষ বিনিয়োগে স্থানীয়দের আন্তর্জাতিক সংযুক্তির গুরুত্বের মতো নানা বিষয় উঠে এসেছে। স্থানীয় একটি মার্চেন্ট ব্যাংকের পরিচালক হিসেবে দেশের পুঁজিবাজার সম্পর্কেও কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মাহফুজ উল্লাহ বাবু
প্রথমেই আপনার বেস্ট সেলার বই সম্পর্কে জানতে চাইব। একজন কম্পিউটার প্রকৌশলীর লেখা বই লজিক ক্যাটাগরিতে অ্যামাজনে বেস্ট সেলার হলো কীভাবে?
শুরুতেই বলে নিই, আমার মেজর কিন্তু যুক্তিবিদ্যা বা দর্শন ছিল না। আমি পারড্যু বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার প্রকৌশল নিয়ে স্নাতক পর্যায়ে পড়াশোনা করেছি। মাইনর হিসেবে সেখানে আমি বিজনেস ম্যানেজমেন্ট ও জেনারেল সাবজেক্ট হিসেবে দর্শন পড়েছিলাম। দর্শন আমাকে প্রবলভাবে আকৃষ্ট করে। একপর্যায়ে দেখা গেল কোর্সের বাইরে আমি দর্শনের অনেক বই পড়ছি। নিজের চিন্তার জগতে বেশ বড়সড় আলোড়ন ঘটে যাচ্ছে। বিষয়গুলো খুব মজার। পাশাপাশি আমি আমার মূল পড়াশোনাও শেষ করি এবং ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হই।
আমি আমার দর্শন অধ্যয়নের কিছু উপসংহার খুব সহজ ভাষায় সংক্ষেপে ‘ডার্ক সায়েন্স অব লজিক্যাল ফ্যালাসিস’ শিরোনামের আওতায় উপস্থাপন করেছি। পশ্চিমের, বিশেষ করে মার্কিন পাঠকরা অ্যামাজন থেকে বইটি কিনে বেশ পড়েছেন। বাংলাদেশের পাঠকদের কাছে কোনোভাবে বইটি পৌঁছে দিতে পারলে ভালো লাগবে।
বইয়ের বিষয়বস্তু সম্পর্কে বিস্তারিত জানাবেন?
সমাজে প্রচলিত কিছু যুক্তি বা নিজের দৃষ্টিভঙ্গির কাছে প্রতিদিনই আমরা হেরে যাই, যা শেষ পর্যন্ত আমাদের ক্ষতির কারণ হয়। একটু ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখলে আমরা সেখানে জয়ী হতে পারি। আকারে অত্যন্ত ছোট বইটি পড়লে বোধহয় আপনারা আরো সহজে বিষয়বস্তুগুলো অনুধাবন করতে পারবেন। স্বল্প পরিসরে আমি শুধু পয়েন্টগুলোর কথা উল্লেখ করতে পারি— ন্যাস্টি পিপল অলওয়েজ প্রমোট ন্যাস্টি থিংস, আই অলওয়েজ নিউ হি ডিড নট মিন ওয়েল, হিয়ার কামস দ্য অথরিটি, মেজরিটি রুলস, ইউ থিংক আই অ্যাম স্টুপিড?, ওহ, দ্য হরর!, অ্যান্ড দ্যাটস হাউ ইট’স ডান, পিওরিটি গ্যারান্টেড, সিন ওয়ান, সিন দেম অল, গ্রেট ম্যান হ্যাভ নো ফ্লজ, ব্যাড থিংস ক্যান নট লাস্ট ফরএভার, দ্য সারফেস ইজ ডিপ এনাফ, থ্রো আউট দ্য ইমপোস্টার, দিস ইজ দ্য হোল ট্রুথ, বাট শি ইজ স্পেশাল, মাই ওয়ে অর দ্য হাই ওয়ে, গোয়িং ডাউন? সি ইউ অ্যাট দ্য বটম, উড ইউ বিলিভ হোয়াট হি জাস্ট সেইড, রং আরগুমেন্টস ইকুয়াল রং কনক্লুশনস, দিস ইজ ওয়ান্ডারফুল সো ইট মাস্ট বি অসাম, আই ক্যান নট হেল্প ইট ক্যান ইউ হেল্প? প্রুভ ইট অর লুজ ইট, নাউ হোয়ার ইজ দ্য রেড ফিশ? ইজ দ্য স্কাই ক্রায়িং ফর মি?
দু-একটি বিষয় উদাহরণসহ বলবেন?
মেজরিটি রুলস সম্পর্কেই বলি। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ সবসময়ই সঠিক হবেন— এমনটি ভেবে নেয়া আমাদের একটি ভুল। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত অবশ্যই মান্য এবং এটিই যৌক্তিক। তার মানে কখনই এই নয় যে, সবাই একযোগে ভুল করতে পারে না। বর্তমান বিশ্বেই আমরা এর হাজারো উদাহরণ দেখছি।
দুই হাজার বছর আগের কথা ধরুন, সবাই একসঙ্গে বিশ্বাস করত, মানত যে, পৃথিবী স্থির এবং সূর্য তাকে প্রদক্ষিণ করছে। সে সময় সংখ্যাগরিষ্ঠের মতকে ফ্যাক্ট ধরলে আমরা ভুল করতাম।
এক কথায় বললে, আপাতচোখে যৌক্তিক কিছু বিষয়ের দুর্বলতাগুলোই আমি বইয়ে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আমি বিশ্বাস করি, জীবনকে সঠিক চোখে দেখতে হলে সবারই এ বিষয়ে সচেতন হওয়া দরকার। পেশাগত জীবনে বিষয়গুলোর গুরুত্ব আরো বেশি। তাহলে আমরা সহজে ঠকব না। আমি মনে করি, এটি সংবাদকর্মী, ব্যবসায়ী, বিনিয়োগকারী, ম্যানেজার, রাজনীতিক, কূটনীতিক, গৃহিণী সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
তরুণ চিন্ত্যক হিসেবে আপনি পশ্চিমে একাধিক ইনস্টিটিউটের সম্মাননা পেয়েছেন। দেশে-বিদেশে আপনার ব্যবসায়িক জীবন সম্পর্কে জানতে চাই?
স্নাতক পর্যায়ের পড়াশোনা শেষ করে আমি পরিবারের ইচ্ছায় দেশে ফিরে আসি এবং পারিবারিক ব্যবসাগুলোর সঙ্গে যুক্ত হই। ্আপনারা জানেন, আমার বাবা কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদ এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি। তিনি স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন।
২০০৪ সালে দেশে ই-বের একটি প্রোটোটাইপ প্রতিষ্ঠান দাঁড় করাই। সে সময়ের প্রেক্ষাপটে গ্রাহক-ব্যবহারকারীদের সাড়াটা খারাপ ছিল না। তবে ইন্টারনেটের ব্যবহার এত কম ছিল যে, প্রতিষ্ঠানটিকে আর্থিকভাবে লাভবান করা কঠিন হয়ে পড়ে। ঝোঁকের মাথায় একপর্যায়ে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করে দিই। এখন মাঝে মাঝেই হিসাব করে দেখি, বন্ধ না করলে কোম্পানিটির মূল্য এখন ১০ কোটি টাকার বেশি হতে পারত। সিদ্ধান্তটি সত্যিই ভুল নিয়েছিলাম।
যাই হোক, এখন আমি সিঙ্গাপুরে একটি ট্রেডিং কোম্পানি চালাচ্ছি। দেশে পারিবারিক ব্যবসাগুলোর মধ্যে একটি কনস্ট্রাকশন কোম্পানির দায়িত্ব নিতে হয়েছে। উদ্যোক্তাদের মধ্য থেকে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক লিমিটেডের শরিয়াহ কমিটিতে আমাকে বেছে নেয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকিং সাবসিডিয়ারি এসবিএল ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট লিমিটেডের পরিচালকের দায়িত্বও পালন করছি। সর্বোপরি, প্রিয় বিষয়গুলোয় পড়াশোনাটাও চালিয়ে যাচ্ছি আর সবার জন্য কিছু লেখার চেষ্টা করছি।
আপনি ঢাকায় গাম্বিয়ার অনারারি কনসালের দায়িত্ব পালন করছেন। এ সম্পর্কে জানাবেন?
আফ্রিকার দেশটি কৃষি উৎপাদনের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। সেখানকার অন্য অনেক দেশের মতো রাজনৈতিক ঝুঁকিও নেই। দেশটির সরকার বিদেশী কোম্পানিগুলোর সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করার চেষ্টা করছে। সহজ শর্তে সেখানে ফার্মিংয়ের অবারিত সুযোগ রয়েছে। দেশটির সবচেয়ে ইতিবাচক দিক হলো, ইউরোপ-আমেরিকা উভয় মহাদেশেই তারা শুল্ক সুবিধা পায়।
আমি দেখেছি, চীন, ভারত ও আরো কয়েকটি দেশের অনেক কোম্পানি সেখানকার কৃষিতে বিনিয়োগ করেছে। ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে সেখানে উৎপাদিত কৃষিপণ্যগুলো কত সহজে ইউরোপে ভালো দামে বিক্রি হচ্ছে। কোম্পানিগুলো লাভবান হচ্ছে। বেগবান হচ্ছে স্থানীয় অর্থনীতিও। যাদের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বাড়ছে, সেসব দেশের রফতানিকারকরাও গাম্বিয়ার বাজারে অবস্থান নিচ্ছেন।
গাম্বিয়ার সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করে বাংলাদেশও এ সুবিধা নিতে পারে। আমাদের অনেক কোম্পানি এখন বিদেশে বিনিয়োগ করার জন্য প্রস্তুত। সরকারের নীতিগত অবস্থান আর সমর্থন পেলে আফ্রিকার দেশটির কৃষিজমি ব্যবহার করতে পারবে দেশের করপোরেটরা।
গাম্বিয়ার প্রতিনিধিরা ঢাকায় এসে এসব নিয়ে সবার সঙ্গে কথাও বলে গেছেন। তবে কেন জানি আমরা বিষয়গুলো এগিয়ে নিতে পারছি না। আমি অনুভব করি, আগামীর কথা মাথায় রেখে এখনই এ ধরনের আদান-প্রদানের ওপর গুরুত্বারোপ করা উচিত।
দেখুন, একটা সময় ছিল যখন দেশের টাকা বাইরে চলে যাওয়টাই ছিল অর্থনীতির জন্য একটি বড় সমস্যা। এখনো নিশ্চয়ই তাই। তবে আধুনিক বিশ্বে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলো বহুমাত্রিকতা পেয়েছে। এখন আগামীর প্রস্তুতি নেয়ায় পিছিয়ে থাকাটা বোধকরি আরো বড় সমস্যা।
মূল প্রতিষ্ঠানের একজন উদ্যোক্তা হিসেবে আপনি স্থানীয় মার্চেন্ট ব্যাংক স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক ক্যাপিটালের পর্যদে আছেন। দেশের পুঁজিবাজারকে কীভাবে দেখেন?
আমাদের সমাজ যেমন, অর্থনীতি ও আর্থিক খাত তা থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। একই কথা পুঁজিবাজারের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ব্যক্তিগতভাবে আমি পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখি। কারণ যথেষ্ট জ্ঞান ও দক্ষতা থাকলে এখানে শুধু প্রদর্শিত তথ্য বিশ্লেষণ করেও ভালো মুনাফা করার সুযোগ রয়েছে। প্রত্যক্ষ ব্যবসার দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডে অনেক কাজ করতে হয়, অনেক আপস করতে হয়, যেগুলো না করলেই ভালো লাগবে। পোর্টফোলিও বিনিয়োগে এর চাপটা কম।
অন্য সব খাতের মতো পুঁজিবাজারেও বেশি প্রাপ্তির একটি তাড়না আমার চোখে পড়ে। তবে নন-কমপ্লায়েন্স থেকে সে প্রাপ্তি আদতে আমার কাছে তৃপ্তিদায়ক মনে হয় না।
আপনাকে ধন্যবাদ
বণিক বার্তাকেও ধন্যবাদ।
কাজী খুররম আহমেদ
লেখক, উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী
বণিক বার্তা
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন