আগে থেকে চার লাখের মতো রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে ছিল। মিয়ানমারে জাতিগত নিপীড়নের কারণে সম্প্রতি আরও তিন লাখ শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছে। এখনো তাদের আসা অব্যাহত রয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের করণীয় নিয়ে কথা বলেছেন সাবেক রাষ্ট্রদূত ও বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের সহসভাপতি হুমায়ুন কবির।
প্রথম আলো l রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় এ মুহূর্তে আমাদের করণীয় কী?
হুমায়ুন কবির l আমাদের অনেক কিছুই করার আছে। এই মানবিক সমস্যা কীভাবে সামাল দেওয়া যায়, সেটি প্রথম চিন্তার বিষয়। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাংলাদেশে ঢুকতে দেওয়া হয়েছে, আমি মনে করি, এটি সঠিক সিদ্ধান্ত। মিয়ানমারের সংকটের কারণে তাদের সাময়িক থাকার ব্যবস্থা করায় আমরা আন্তর্জাতিক মহলের সমর্থন-প্রশংসা পেয়েছি। এটি সম্বল করেই সংকট সমাধানের দিকে যেতে হবে।
প্রথম আলো l রোহিঙ্গাদের থাকার ব্যবস্থাটি যে সাময়িক, তার নিশ্চয়তা কী?
হুমায়ুন কবির l এটি কতটা সাময়িক হবে, সেটি অনেকাংশে নির্ভর করছে মিয়ানমারের নীতিগত অবস্থানের ওপর। তবে আমাদের আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রাখতে হবে। একই সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার দরজাও খোলা রাখতে হবে।
প্রথম আলো l রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যাটি তো বেশ পুরোনো। এত দিনেও এর সমাধান হলো না। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কূটনৈতিক তৎপরতার কোনো ঘাটতি ছিল কি?
হুমায়ুন কবির l যদি চার দশকের কথা বলেন (১৯৭৮ থেকে ২০১৭), সব সময় একই রকম তৎপরতা ছিল না। কখনো আলোচনা এগিয়েছে, তখনো থমকে গিয়েছে। অন্তত দুবার শরণার্থীদের ফেরত পাঠানো গেছে, ১৯৭৮ ও ১৯৯২ সালে। ১৯৯২ সালে শরণার্থীদের একাংশ চলে গেলেও অনেকে এখানে থেকে যায়। নিবন্ধিত শরণার্থীর সংখ্যা ৩৩-৩৪ হাজার। কিন্তু প্রকৃত সংখ্যা কয়েক লাখ ছাড়িয়ে গেছে। সমস্যাটি প্রকট হয়েছে ২০১২ সালে, যখন মিয়ানমারে বড় ধরনের দাঙ্গা হলো, তখন থেকে শরণার্থীদের স্রোত আসতে থাকে। এরপর আর মিয়ানমার তাদের গ্রহণ করতে রাজি হয়নি। অথচ শরণার্থীদের বিষয়ে আমাদের কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। এই প্রেক্ষাপটে সরকার যে এবার মিয়ানমার থেকে আসা শরণার্থীদের নিবন্ধনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেটি অত্যন্ত ইতিবাচক। বালুখালীতে শরণার্থী শিবির করার কথা বলা হয়েছে। শরণার্থীরা এক জায়গায় থাকলে হিসাব রাখতে সুবিধা হবে। এর মাধ্যমে তারা যখন দেশে ফেরত যাবে, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখানো যাবে। কাগজপত্র ছাড়া মিয়ানমার কাউকে নিতে চাইবে না।
প্রথম আলো l রোহিঙ্গা সমস্যাটিকে আন্তর্জাতিক ফোরামে তুলে ধরার ক্ষেত্রে আর কী করণীয় আছে?
হুমায়ুন কবির l প্রথম থেকে বাংলাদেশ বিষয়টি দ্বিপক্ষীয়ভাবেই সমাধানের চেষ্টা করে আসছে। ১৯৭৭ সালের পর কোনো বিষয়েই কিন্তু আমরা এখন সমস্যাটি অনেক বেশি গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। মিয়ানমার যাতে শরণার্থীদের ফেরত নিতে রাজি হয়, সে জন্য আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করতে হবে।
প্রথম আলো l শরণার্থীদের বিষয়ে আমাদের কি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা আছে? থাকলে কেন আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারলাম না?
হুমায়ুন কবির l সরকারের একটি নীতিমালা তো আছেই। আগে থেকেই আমাদের নীতি ছিল শরণার্থীদের ফেরত নেওয়ার ব্যাপারে মিয়ানমারকে রাজি করানো। ২০১৬ সালেও আরেক দফা আলোচনা শুরু হয়েছিল। এখন নিবন্ধনের কাজটা দ্রুত শেষ করা প্রয়োজন। শরণার্থীদের ফেরত পাঠাতে হলে তো দালিলিক প্রমাণ লাগবে। ২০১৬ ও ২০১৭ সালে যখন নতুন করে সংকট দেখা গেল, তখন মনে হলো, দ্বিপক্ষীয়ভাবে সমাধান সম্ভব হবে না। মিয়ানমারকে রাজি করাতে হলে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার পাশাপাশি তাদের ওপর চাপ বাড়াতে হবে। এ ব্যাপারে বন্ধুদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে। কাজ করতে হবে দুই স্তরে।
প্রথম আলো l আমরা আগে কেন জাতিসংঘের সহায়তা চাইলাম না?
হুমায়ুন কবির l জাতিসংঘের সহযোগিতা চাইলেই হবে না। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ফোরাম হচ্ছে নিরাপত্তা পরিষদ। সংশ্লিষ্ট দেশকে কোনো বিষয়ে রাজি করাতে হলে নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব পাস করাতে হবে। যারা নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য আছে, প্রথমে তাদের বোঝাতে হবে। এরপর অস্থায়ী সদস্যদের কাছেও যেতে হবে। তাদের সঙ্গে সম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে। পেশাগত কূটনৈতিক দক্ষতা কাজে লাগাতে হবে। আবার রাজনৈতিক পর্যায়েও সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সে ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে বিশেষ দূত ও জ্যেষ্ঠ মন্ত্রীদের পাঠানো যেতে পারে। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত পাওয়া গেলে কূটনৈতিক তৎপরতাও বাড়বে। শরণার্থী সমস্যা নিয়ে মিয়ানমার জাতিসংঘে বিরূপ অবস্থায় পড়লে তারাও কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়াবে। বন্ধুদেশের সমর্থন চাইবে। তাদের তৎপরতার জবাব দিতে হবে উত্তম কূটনীতি
দিয়ে। আমরা যে ন্যায়, সত্য ও মানবতার পক্ষে আছি, এ কথাটি বিশ্ববাসীর কাছে জোরালোভাবে তুলে ধরতে হবে।
প্রথম আলো l এ ক্ষেত্রে আমাদের যে বন্ধুদেশ, বিশেষ করে ভারত ও চীনের সহায়তা কতটা পাব বলে ধারণা করেন? ওই দুটি দেশের সঙ্গে মিয়ানমারেরও ভালো সম্পর্ক আছে।
হুমায়ুন কবির l যেহেতু মিয়ানমারকে কেন্দ্র করে সমস্যাটি আবর্তিত, সেহেতু আমাদের সাবধানে এগোতে হবে। ভারতের কাছ থেকে আমাদের যতটুকু প্রত্যাশা ছিল, গত তিন সপ্তাহের কার্যক্রমে সেটা পাইনি। ভারত জঙ্গিগোষ্ঠী আরসার হামলার নিন্দা জানিয়েছে। জঙ্গিদের বিরুদ্ধে মিয়ানমার সরকারের অবস্থান সমর্থন করেছে। কিন্তু সেখানে যে মানবিক বিপর্যয় তৈরি হয়েছে, সে বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদির ইয়াঙ্গুন সফরের সময় কোনো কথা ছিল না। পরে দিল্লিতে সরকারের একজন মুখপাত্র উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। আমরা আশা করি, ভারতের অবস্থান পরিবর্তন হবে। অন্যদিকে চীন যে বিবৃতি দিয়েছে, তা অনেকটা ভারসাম্যপূর্ণ। চীন নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য বলে বাড়তি গুরুত্ব বহন করে। আমরা কোনো প্রস্তাব নিলে তার সমর্থন প্রয়োজন হবে। মনে রাখতে হবে, সব দেশই ভূরাজনৈতিক স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে।
প্রথম আলো l রোহিঙ্গাদের নিয়ে মিয়ানমার বারবার নিরাপত্তাঝুঁকির কথা বলে আসছে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ কী করতে পারে?
হুমায়ুন কবির l এই প্রশ্নে দুই দেশের বিশ্বাসের ঘাটতি আগেই ছিল। সাম্প্রতিক শরণার্থী সমস্যা সেই ঘাটতিকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। মিয়ানমার সরকার যদি সন্ত্রাসী বা জঙ্গিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিত, আমাদের বলার কিছুই থাকত না। বাংলাদেশ জঙ্গিবাদকে সমর্থন করে না। কিন্তু তারা তো জঙ্গিদের নাম করে একটি জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করছে। শরণার্থীদের সঙ্গে কোনো জঙ্গি আসছে কি না, সেটা খতিয়ে দেখার কথা বলেছেন কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান। এর আগে বাংলাদেশ সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে যৌথ অভিযানেরও প্রস্তাব দিয়েছিল।
প্রথম আলো l আগের শরণার্থী সংকট থেকে এবারের সংকটের মাত্রা কি ভিন্ন বলে মনে করেন?
হুমায়ুন কবির l এবারের সংকটের পেছনে জাতিগত বিদ্বেষের বিষয়টি প্রধান বলে মনে করি। ২০১১ সালে যখন মিয়ানমারে রাজনৈতিক পরিবর্তন হয়, তখন সেখানে একটি পরিচয়সংকট দেখা দেয়। রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে নাগরিক বা সিভিক পরিচয়ের ওপর ধর্মীয় পরিচয়কে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। অনেক আইন পরিবর্তন করা হয়েছে। সেখানে যে বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটেছে, তাতে সংখ্যালঘু, বিশেষ করে মুসলমানদের শত্রু ভাবা হচ্ছে। এর ফলে সামাজিক বৈরিতা বেড়েছে। রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধান চাইলে কেবল রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তই যথেষ্ট নয়, এই সামাজিক বৈরিতা-বিদ্বেষও কাটাতে হবে।
প্রথম আলো l এ ধরনের সমস্যা তো বাংলাদেশেও আছে।
হুমায়ুন কবির l অনেক দুর্বলতা সত্ত্বেও বাংলাদেশের সমাজে নাগরিক বা সিভিক জাতীয়তাবাদকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়। সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম থাকা সত্ত্বেও সামাজিক বোধ ধর্ম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়। দীর্ঘদিন ভারতীয় সমাজেও এই সিভিকবোধ নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় ছিল। কিন্তু বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর সেখানে সামাজিক মেরুকরণ ঘটেছে। এটি ভারতের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। ভারতে হিন্দু জাতীয়তাবাদ ও মিয়ানমারে বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদ বাংলাদেশেও বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
প্রথম আলো l ধন্যবাদ।
হুমায়ুন কবির l ধন্যবাদ।
প্রথম আলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন