বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি এম এ মতিন ষোড়শ সংশোধনীর রায়কে সমর্থন করলেও রায়ে আমিত্বের সমালোচনায় বঙ্গবন্ধুর প্রতি কোনো ইঙ্গিত রয়েছে বলে মনে করেন না। দেশের গণতন্ত্রকে মেকি অভিহিত করাসহ কিছু পর্যবেক্ষণকে তিনি অনভিপ্রেত বলে অভিহিত করেছেন। তিনি ইতালির ফ্লোরেন্স থেকে গতকাল শনিবার টেলিফোনে প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এসব অভিমত দেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজানুর রহমান খান
প্রথম আলো: কোনো দেশ বা জাতি কোনো একজন ব্যক্তির দ্বারা বা কোনো একজনকে নিয়ে গঠিত হয় না বলে (সবকিছু করেননি-সংক্রান্ত) যে কথা রায়ে আছে, তাতে বঙ্গবন্ধুকে ইঙ্গিত করার দাবির ভিত্তি আছে কি?
এম এ মতিন: আমি তা মনে করি না। বরং তাতে সংবিধানের ১ অনুচ্ছেদেরই প্রতিফলন ঘটেছে। বাংলাদেশ হবে একটি রিপাবলিক। আর রিপাবলিক হওয়া মানেই সংবিধানের প্রাধান্য, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা থাকবে। ব্যক্তিকেন্দ্রিক কোনো ব্যবস্থা এটা নয়, সেটাই বলা হয়েছে, এটা কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি সম্পর্কে কিছু বলা নয়।
প্রথম আলো: যুক্তি এসেছে, এটাও তো এই মামলায় প্রাসঙ্গিক নয়।
এম এ মতিন: এটা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক, সংবিধান কী, এই রাষ্ট্রের রিপাবলিকান চরিত্র কী, সেটা বোঝাতেই এটা লেখা।
প্রথম আলো: কিন্তু কিছু বিষয়ে সরকার ক্ষুব্ধ হয়েছে, সেই যুক্তিতে এটা এক্সপাঞ্জ করা যায় কি না?
এম এ মতিন: মোটেই না। সুপ্রিম কোর্ট যা বলবেন, সেটাই সংবিধান। বিচারকদের কাজই হচ্ছে বিস্তারিত বর্ণনার সাহায্যে সংবিধানের অর্থ পরিষ্কার করা। মার্কিন প্রধান বিচারপতি জন মার্শাল মারব্যারি বনাম মেডিসন মামলায় এ কথাই বলেছেন। সংবিধানে কিছু লেখা থাকবে আর বাকিটা বলবেন বিচারকেরা।
প্রথম আলো: পঞ্চম, সপ্তম, ত্রয়োদশ ও ষোড়শ সংশোধনী মামলার রায়গুলো দীর্ঘ। রাজনৈতিক বিষয়সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দীর্ঘ রায় লেখার ক্রমবর্ধমান প্রবণতাকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
এম এ মতিন: রায় লেখার নীতি হলো, যেখানে রাজনৈতিক বিতর্কের বিষয় থাকবে, সেখানে আমরা কোনো হাতই দেব না।
প্রথম আলো: প্রধান বিচারপতি নিম্ন আদালতের বিচারকদের শৃঙ্খলাবিষয়ক ১১৬ অনুচ্ছেদের সংশোধিত পাঠকেসংবিধান পরিপন্থী বলেছেন। কিন্তু অন্য চার বিচারক সেটা প্রাসঙ্গিক মনে করেননি।
এম এ মতিন: বিচার বিভাগের স্বাধীনতা যেখানে মূল বিচার্য, সেখানে ১১৬ অনুচ্ছেদসংক্রান্ত আলোচনা খুবই প্রাসঙ্গিক। ডেনমার্কের যুবরাজের চরিত্রকে বাদ দিয়ে কি হ্যামলেট নাটকের মঞ্চায়ন সম্ভব? বিচারকেরা স্বাধীন থাকতে চান বলেই সংসদের কাছে অপসারণের ক্ষমতা দেবেন না। তাহলে অধস্তন আদালতের বিচারকদের অপসারণ সরকারের কাছে থাকে কী করে?
প্রথম আলো: উচ্চ আদালতের বিচারকদের স্বাধীনতা থেকে নিম্ন আদালতের বিচারকদের স্বাধীনতাকে আলাদাভাবে দেখার সুযোগ কতটুকু?
এম এ মতিন: কোনো সুযোগ নেই। রাষ্ট্রের বিচার বিভাগ স্তম্ভে নিম্ন আদালত অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই স্তম্ভের পুনরায় বিভাজনের প্রশ্নই অবান্তর। ১০ বিচারকের মামলায় আমার লেখা রায়ে উল্লেখ ছিল, ১১৬ অনুচ্ছেদকে বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরিয়ে না নেওয়া হলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা দূরবর্তী বাদ্যযন্ত্রের শব্দ হয়ে থাকবে।
প্রথম আলো: আইনমন্ত্রীসহ অনেকেই মানছেন যে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল এখন দেশের আইন। কিন্তু রায়বলে সংবিধানে তা ছাপানো আইনসিদ্ধ কি না, তা প্রশ্নসাপেক্ষ।
এম এ মতিন: আপিল বিভাগের রায় সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদমতে ঘোষিত আইন। আমাদের বিচার বিভাগীয় রেওয়াজও তা-ই বলছে। পঁচাত্তরের আগে বেরুবাড়ি মামলায় যা বলা হলো, তাই সংবিধানে পরিণত হলো। তবে তাঁরা চাইলে বিলও পাস করাতে পারেন।
প্রথম আলো: তাহলে আপনি বলছেন, চারটি অনুচ্ছেদ পাল্টে নতুন করে সংবিধান ছাপাতে বাধা নেই?
এম এ মতিন: নেই। দেশের প্রচলিত রেওয়াজ সংবিধানের ১৫২ অনুচ্ছেদমতেও আইন। আমরা এটাও দেখছি, যখন কিছু সরকারের পক্ষে যায়, তখন তারা দ্রুত পদক্ষেপ নেয়। আর না গেলে তর্ক তোলে, যা অভিপ্রেত নয়। পক্ষে গেলে করব, বিপক্ষে গেলে করব না। এই ধারণা পরিত্যাগ করা উচিত।
প্রথম আলো: বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক মনে করেন, সংবিধানের ৯৬(৪) অনুচ্ছেদ শুধু সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলকেই আচরণবিধি করার ক্ষমতা দিয়েছে। তাই রায়ের মধ্যে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ বৈধ হয়নি।
এম এ মতিন: আচরণবিধি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বৈঠকেই তৈরি করা উচিত। এটা রায়ের বিষয় নয়। এই ফাঁকটিও (লেকুনা) আদালত নিজ থেকে কিংবা অন্যের দরখাস্তের পরিপ্রেক্ষিতে রিভিউ করতে পারেন।
প্রথম আলো: রায়ে বিচারকদের পদত্যাগের বিধান বাদ পড়েছে?
এম এ মতিন: আদালত যদি ৯৬ অনুচ্ছেদে ষোড়শ সংশোধনী দ্বারা আনা পরিবর্তনকে পূর্ব অবস্থায় ফিরিয়ে নেন, তাহলে পদত্যাগের বিধান রয়ে গেছে।
প্রথম আলো: প্রায় তিন বছর সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ছিল না। রায়ে সংশোধনীকে ভয়েড অ্যাবিনিশিও বা গোড়া থেকে বাতিল বলেনি। এখন এটা কবে থেকে কার্যকর ধরে নেব?
এম এ মতিন: রায়ে কি ষোড়শ সংশোধনীকে আলট্রা ভায়ার্স (আইনগত এখতিয়ারবহির্ভূত) বলা হয়েছে?
প্রথম আলো: হ্যাঁ, প্রধান বিচারপতির রায়ে এই শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে।
এম এ মতিন: তাহলে ধরে নিতে হবে, ষোড়শ সংশোধনী ২০১৫ সালের যে তারিখে পাস করা হয়েছিল, সেই তারিখে তা বাতিল বলে গণ্য হবে এবং তার আগে, অর্থাৎ পঞ্চদশ সংশোধনীকালে যে অবস্থায় ৯৬ অনুচ্ছেদ ছিল, সেই অবস্থায় ফিরে আসবে। তাই তাঁরা ৯৬-এর দুই থেকে সাত উপদফা পুনরুজ্জীবিত করেছেন। এক এবং দুই দফা যেহেতু ষোড়শ সংশোধনীতে কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি, তাই এই দুটো পঞ্চদশ সংশোধনীর অবস্থায় রূপ লাভ করবে। এ জন্য তাঁরা ভেবেচিন্তেই এই দুটির উল্লেখ করা দরকার মনে করেননি। এখন আইনের চোখে ষোড়শ সংশোধনী যেন কখনো পাসই হয়নি।
প্রথম আলো: ইতিহাসে প্রথমবারের মতো প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি অসদাচরণের অভিযোগ তদন্তে কমিটি করা হয়েছে। বিচারপতি খায়রুল হক মনে করেন, এটা অকার্যকর থাকবে।
এম এ মতিন: আমি মনে করি, এই পদক্ষেপ যথাযথ হয়েছে। এটা কার্যকর না হওয়ার কারণ দেখি না। এটা অনেক আগেই সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের আওতায় করা উচিত ছিল। এখন রায়ের মধ্যে এটা করে একটি ঠিক কাজ করা হয়েছে।
প্রথম আলো: তারা নির্বাচন কমিশনারসহ অন্যদের আচরণ খতিয়ে দেখতে প্রাথমিক তদন্ত কমিটি করবে? অন্যদের আচরণবিধির দরকার নেই?
এম এ মতিন: তারাই করবে। যেহেতু সংবিধানের একই স্কিমের (ব্যবস্থার) মধ্যে অন্যরা রয়েছেন।
প্রথম আলো: বিচারপতি সৈয়দ আমীরুল ইসলামসহ অনেকেই মত দিয়েছেন, ৯৬ অনুচ্ছেদ পুনরুজ্জীবিত হওয়ার ফলে সংবিধানের নির্বাচন কমিশন, পিএসসি ও সিঅ্যান্ডএজি-সংক্রান্ত তিনটি অনুচ্ছেদেও পরিবর্তন আসার কথা। অথচ রায়ে কিছু বলা নেই। এটা বলা উচিত ছিল।
এম এ মতিন: আমি তা মনে করি না। রায়ের পরিণাম হিসেবে আপনাআপনি ওই পরিবর্তনগুলো সূচিত হয়েছে এবং তা আইনে পরিণত হয়ে গেছে।
প্রথম আলো: রায়ে সংসদীয় গণতন্ত্রকে অপরিপক্ব বলা হয়েছে। দেশের গণতন্ত্রকে বলা হয়েছে মেকি গণতন্ত্র।
এম এ মতিন: এটা অনভিপ্রেত পর্যবেক্ষণ। এটা বলা সমীচীন হয়নি। রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা থাকতে হবে। তারা একই রাষ্ট্রের সমন্বিত অঙ্গ। প্রত্যেক অঙ্গ প্রত্যেকের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবে।
প্রথম আলো: এসব এক্সপাঞ্জযোগ্য?
এম এ মতিন: আমি তা-ই মনে করি। এখানে এক্সপাঞ্জ করা চলে। গণতন্ত্রকে আমি যদি এ রকম কোনো নাম দিই, তাহলে তার কিছুটা বিচার বিভাগের ওপরও এসে পড়ে। বিচার বিভাগ একা তো কোনো কার্যক্রম চালাতে পারে না। রাষ্ট্রের অপর দুটির অঙ্গের অস্তিত্ব অস্বীকার করা যাবে না। তাদের ছোট করা যাবে না। তাদের ছোট করলে নিজেদের ছোট হতে হবে।
প্রথম আলো: এসব পর্যবেক্ষণ শুধু প্রধান বিচারপতির রায়ে আছে। আবার অন্য বিচারকেরা তাঁর সঙ্গে নির্দিষ্টভাবে ভিন্নমত পোষণ করেননি। তাহলে কি এই পর্যবেক্ষণ আপিল বিভাগের ধরে নেব?
এম এ মতিন: আমার মনে হয় না। অন্যরা তো কেউ এমন পর্যবেক্ষণ দেননি। তবে এ প্রসঙ্গে আমি বলব, এত বড় গুরুত্বপূর্ণ মামলায় একটি কণ্ঠে আদালতের বক্তব্য প্রতিফলিত হওয়া উচিত ছিল। মার্কিন সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া ব্রাউন বনাম বোর্ড অব এডুকেশন রাষ্ট্রীয়ভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সরকারি স্কুল কালো ও শ্বেতাঙ্গদের জন্য আলাদা ছিল। এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ হলে প্রধান বিচারপতি আর্ল ওয়ারেন সবার সঙ্গে বসে ঠিক করেছিলেন, আদালত শুধু একটি রায়ের মধ্য দিয়ে কথা বলবেন। এই মামলাতেও তা-ই হলে বিতর্ক এড়ানো সম্ভব ছিল।
প্রথম আলো: রায়দানকারী বিচারকের কাছেই কি রিভিউ করা উচিত?
এম এ মতিন: সংশ্লিষ্ট বিচারক থাকতে থাকতেই করা ভালো। পরে করতেও বাধা নেই।
প্রথম আলো: বিচার বিভাগ ও সংসদের সম্পর্ক নিয়ে কোনো মন্তব্য?
এম এ মতিন: পরস্পরের মধ্যে শ্রদ্ধাপূর্ণ সম্পর্ক থাকতে হবে।
প্রথম আলো: প্রধান বিচারপতির দ্বারা একটি রাজনৈতিক দলের সাধারণ সম্পাদকের সাক্ষাৎকে কীভাবে দেখছেন?
এম এ মতিন: কোনো মন্তব্য করব না।
প্রথম আলো: প্রধান বিচারপতি মনে করেন, কিছু বিচারক কিছু অসদাচরণে লিপ্ত হয়েছেন।
এম এ মতিন: এটা তিনি কোথায় বলেছেন?
প্রথম আলো: ৮ আগস্ট সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বৈঠকে এই অভিমত এসেছে, যা সব বিচারকের কাছে বিলিও করা হয়েছে। এর প্রতিকার তো সংসদ বা সরকারের কাছে নেই।
এম এ মতিন: সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল যদি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছে থাকে, তাহলে জনগণের জানার অধিকার আছে, ওই বিচারকেরা কারা এবং তাঁদের বিষয়ে ইতিমধ্যে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে? তাঁদের বিষয়ে প্রাথমিক তদন্ত করা এখন প্রধান বিচারপতি তথা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের নৈতিক দায়িত্ব।
প্রথম আলো: প্রধান বিচারপতি বলেছেন, বিচার বিভাগ অন্য দুটি স্তম্ভের থেকে অপেক্ষাকৃত ভালো। তা-ও ডুবুডুবু অবস্থায়, পানির ওপরে নাক উঁচু করে আছে।
এম এ মতিন: এটা আমি সমর্থন করি না। যে চেয়ারে বসে প্রধান বিচারপতি সংসদের পাস করা একটি আইনকে আলট্রা ভায়ার্স বা বাতিল ঘোষণা করতে পারলেন, সেখানে ওই মন্তব্য করা মানে নিজেকেই খাটো করা। এটা স্ববিরোধিতা। বিচার বিভাগ কেন ডুবে যাবে? নিজেদের শিরদাঁড়া খাড়া করে রাখা বিচারকদেরই দায়িত্ব। সমগ্র জাতির কাছে বিচার বিভাগকে সত্য বলে যেতে হবে এবং আদালত তো প্রতিনিয়ত তা-ই করে যাচ্ছে। আমরা আশাবাদী, নিরাশাবাদী নই।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
এম এ মতিন: ধন্যবাদ।
l বিচারপতি এম এ মতিন: ১৯৯৬ সালের জুনে হাইকোর্ট বিভাগে অতিরিক্ত বিচারক নিযুক্ত হন। ২০১০-এ অবসরে যান। ২০১১ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত প্রশাসনিক আপিল আদালতের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন।
প্রথম আলো
পাঠক মন্তব্য
জাজাকাললা
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন