ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায় নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক দুই সভাপতি আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান খন্দকার মাহবুব হোসেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজানুর রহমান খান
প্রথম আলো: ক্ষমতা জবরদখলকারী, নোংরা রাজনীতির তল্পিবাহক, প্রহসনের গণভোট করার প্রতিভূ হিসেবে জিয়াউর রহমানকে চিহ্নিত করা সত্ত্বেও বিএনপি ষোড়শ সংশোধনীর রায়কে ঐতিহাসিক হিসেবে গণ্য করছে। কী বলবেন?
খন্দকার মাহবুব হোসেন: একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা হলো মৌল স্তম্ভ। ষোড়শ সংশোধনী দিয়ে এর ওপর আঘাত এসেছিল।
প্রথম আলো: জিয়ার বিরুদ্ধে যা বলা হয়েছে, তার এক্সপাঞ্জ চাইবেন কি না? তিনি কি দেশকে মর্যাদাহীন ‘ব্যানানা রিপাবলিক’ করেছিলেন?
খন্দকার মাহবুব হোসেন: রায়ের পর্যবেক্ষণ বিচারকদের নিজস্ব মতামত। এর দোষ-গুণ থাকতে পারে। আমরা রায় এখনো পর্যালোচনা করে দেখছি। আমি মনে করি, এ বিষয়ে বিএনপি অবশ্য একটি সিদ্ধান্ত নেবে। কতটা গ্রহণ করব আর কতটা প্রতিবাদ জানাব, সেটা দেখা হবে। তবে এ রায়ে এমন কিছু রয়েছে, যাতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক অবস্থার একটা সার্বিক প্রতিফলন ঘটেছে।
প্রথম আলো: তাহলে বিএনপি কী করে মিষ্টি খায়? এটা তো শুধু সরকারের সমালোচনা নয়?
খন্দকার মাহবুব হোসেন: আমার জানামতে, বিএনপি এটা নিয়ে রাজনীতি করেনি। আমরা মনে করি, রায়ের পর্যবেক্ষণসমূহ অত্যন্ত সময়োপযোগী। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে অনিয়ম-অনাচার-অবিচার বাসা বেঁধেছে, তা-ই তিনি তুলে ধরেছেন। সেখানে বঙ্গবন্ধুর প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে, কোনো শুভ কাজই এক ব্যক্তির দ্বারা হয় না। সামরিক সরকার প্রসঙ্গে জিয়ার কথা এসেছে।
প্রথম আলো: না, রায়ের ৩২৩ পৃষ্ঠায় প্রধান বিচারপতি লিখেছেন, এটা সত্যি যে অবৈধভাবে একজন ক্ষমতা জবরদখলকারী সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল সংবিধানে এনেছিলেন।
খন্দকার মাহবুব হোসেন: তিনি তো সেটা ভালো কাজই করেছিলেন। তিনি কখনো ক্ষমতা জবরদখল করেননি। জনগণের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তিনি সময়ের প্রয়োজনে ক্ষমতাসীন হয়েছিলেন।
প্রথম আলো: বিচারপতি মো. ইমান আলী জিয়া-এরশাদের ফরমানগুলোকে গোড়া থেকে বাতিল ও অবৈধ বলে দেখেছেন।
খন্দকার মাহবুব হোসেন: বাতিল ও অবৈধ থাকার পরও তাঁরা তা গ্রহণ করেছেন। তাহলে তর্কের খাতিরে বলতে হবে, তাঁরা তাঁদের নিজেদের স্বার্থে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বহাল রেখেছেন। তাঁর সম্পর্কে যা বলা হয়েছে, সে বিষয়ে আমরা অবশ্যই প্রতিবাদ করি। যথাসময়ে আমরাও এসব এক্সপাঞ্জ করার উদ্যোগ নেব।
প্রথম আলো: বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী লিখেছেন, জিয়া-এরশাদের স্বৈরশাসনে বাংলাদেশের সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী চরিত্র হারিয়েছিল।
খন্দকার মাহবুব হোসেন: এই পর্যবেক্ষণের ব্যাপারেও আমরা ক্ষুব্ধ। কারণ, তিনি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করার জন্য প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে সর্বাত্মক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। আমরা এসব বিষয় খুঁটিয়ে দেখছি। আমাদের দল হয়তো রায় থেকে একটি রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করছে।
প্রথম আলো: তাহলে আওয়ামী লীগ ঠিকই বলছে, বিএনপি রাজনীতি করছে?
খন্দকার মাহবুব হোসেন: ঠিক রাজনীতি নয়, বর্তমান রায় সরকারকে যেভাবে হেস্তনেস্ত করেছে, আমরা সে সুযোগটা নিতে চাইছি।
প্রথম আলো: আপনারা গত সংসদ নির্বাচনের বৈধতার কথা বলছেন, যা রায়ে নেই।
খন্দকার মাহবুব হোসেন: আমরা মনে করি, বর্তমান সংসদ যেহেতু অনির্বাচিত, তাই তিনি তাদেরই বুঝিয়েছেন। বর্তমান সংসদের ৭০ শতাংশ রাজনীতিকের আইন প্রণয়নে ভূমিকা নেই।
প্রথম আলো: আপনাদের ভিশন ২০৩০-এ প্রধানমন্ত্রীর নিরঙ্কুশ ক্ষমতা হ্রাস করার কথা বলা হলেও ৭০ অনুচ্ছেদ সম্পর্কে সেখানে কিছু বলা নেই। অথচ রায় বলছে, সংসদের শক্তিশালী হওয়ায় এটাই বড় বাধা।
খন্দকার মাহবুব হোসেন: ৭০ অনুচ্ছেদ আমার মতে, গণতন্ত্র ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য একটি বিষফোড়া।
প্রথম আলো: আওয়ামী লীগের দলীয় গঠনতন্ত্রের চেয়ে বিএনপির গঠনতন্ত্রে খালেদা জিয়াকে বেশি নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দিয়েছে। সুতরাং আমিত্ববাদ জাতীয় রাজনীতির অংশ?
খন্দকার মাহবুব হোসেন: আসলে সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীকে সর্বময় ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, সেটাই আমিত্ববাদের সংস্কৃতি ডেকে এনেছে। প্রধানমন্ত্রীর অমতে প্রশাসন চলতে পারে না। বিচারপতি নিয়োগেও রাষ্ট্রপতি তাঁর পরামর্শের বাইরে যেতে পারেন না। তাই তাঁর অধীনে কোনো নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে পারে না। বিএনপি কিন্তু সে কারণেই প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার বিধান সংশোধনের প্রস্তাব রেখেছে।
প্রথম আলো: তাহলে সংসদীয় গণতন্ত্রকে অপরিপক্ব বলার উত্তাপ কেন শুধু আওয়ামী লীগ নেবে? ২০০৬ সালে বিএনপি কি পরিপক্ব সংসদীয় গণতন্ত্র রেখে এসেছিল?
খন্দকার মাহবুব হোসেন: এর উত্তরে আমি বলব, তখনকার অবস্থার সঙ্গে বর্তমানের একটি মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। সেই সংসদ অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। বর্তমান সংসদের ১৫৩টি আসনে কোনো ভোট হয়নি।
প্রথম আলো: বিএনপি কোন যুক্তিতে আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগ দাবি করছে? ভারতের ৯৯তম সংশোধনী বাতিলের পরে কেউ সেখানে সরকারের পতন আশা করেনি।
খন্দকার মাহবুব হোসেন: আমার মনে হয়, এটা বিএনপির দলীয় অবস্থান নয়। কেউ কেউ ব্যক্তিগতভাবে অভিমত দিয়ে থাকতে পারেন। তবে এই সরকার যেহেতু ব্যর্থ হয়েছে, তাই তারা যত তাড়াতাড়ি চলে যায়, নতুন নির্বাচন হয়, ততই দেশের জন্য মঙ্গল।
প্রথম আলো: প্রধান বিচারপতির বাসভবনে প্রধান বিচারপতি নিজেই কথিতমতে, একজন জ্যেষ্ঠ মন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। গণমাধ্যমের রিপোর্ট মতে, রায় সম্পর্কে আওয়ামী লীগের দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখ্যা করতেই তিনি সেখানে গিয়েছিলেন।
খন্দকার মাহবুব হোসেন: এর থেকে দুঃখজনক ঘটনা আর হতে পারে না। এটা আমাদের বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে। রায় নিয়ে প্রধান বিচারপতির বাসভবনে একজন মন্ত্রী আলোচনা করেছেন, আমি মনে করি, এটা অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা এবং তা জনসমক্ষে প্রকাশিত হওয়ার ফলে আদালত অবমাননা ঘটেছে।
প্রথম আলো: সেই আদালত অবমাননা কোন দিক থেকে ঘটেছে?
খন্দকার মাহবুব হোসেন: যদি তাঁদের আলোচনার বিষয় সুপ্রিম কোর্টের রায় হয়ে থাকে, তাহলে আমি বলব, যিনি ডেকেছেন তিনিও অন্যায় করেছেন। যিনি গেছেন তিনিও অন্যায় করেছেন। প্রতিকারের জন্য আমাদের সংবিধানে রিভিউ করার বিধান আছে। রায় নিয়ে কেউ সংক্ষুব্ধ হলে আইন অঙ্গনের মধ্যে থেকেই তার সুরাহা হতে পারে।
প্রথম আলো: যদি তা-ই হয়, তাহলে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম কেন আন্দোলনের কর্মসূচি দিয়েছে?
খন্দকার মাহবুব হোসেন: এটা হয়তো দলীয় নীতির প্রতিফলন। আমি আমার বক্তব্যে বলেছি, আদালতের বিষয় যথাযথ ফোরামেই নিষ্পত্তি হতে হবে। বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের সংবাদ সম্মেলনের বিষয়ে আমি বলেছি, আজকের রাজনৈতিক অঙ্গনে যে হানাহানি, তার জন্য তিনিই দায়ী।
প্রথম আলো: আপনারা কীভাবে এক্সপাঞ্জ চাইবেন?
খন্দকার মাহবুব হোসেন: সরকার তার আপত্তির বিষয়ে রিভিউ চাইতে পারে। আবার আমরা যদি মনে করি, কিছু অংশের এক্সপাঞ্জ চাইব, তাহলে আমরা পৃথক রিভিউর দরখাস্ত দেব। দুটি রিভিউর শুনানি একসঙ্গে হতে পারে।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
খন্দকার মাহবুব হোসেন: প্রথম আলোকেও ধন্যবাদ।
প্রথম আলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন