কেবল উপমহাদেশ নয়, বিশ্বজুড়ে ইসলামের নামে অপপ্রচার, ধর্মের নামে সন্ত্রাসবাদের উত্থানের বিরুদ্ধে যে সব ইসলামিক স্কলার সোচ্চার আওয়াজ তুলছেন তাদের মধ্যে অন্যতম মাওলানা তারেক মনোয়ার। ইংরেজী, বাংলা ও আরবী শিক্ষা’সহ প্রায় সব মাধ্যমে উচ্চতর ডিগ্রি নেয়া তারেক মনোয়ারের স্বপ্ন ছিল ইসলামের শান্তির বার্তা বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরা। একই সাথে ধর্মের নামে বিপন্ন মানবতার অবক্ষয় থেকেও উপমহাদেশের বিপদগামি তরুণ প্রজন্মকে শিক্ষা ও সংস্কৃতির সেতুবন্ধনে আবদ্ধ করা। তার অনেকটাই সফলতার সাথে সম্পন্ন করেছেন তিনি। তবে, এখনো অনেক পথ বাকি আছে বলে জানান তিনি। বলেন, ‘ইসলামের সঠিক ইতিহাস কেবল বাংলাদেশই নয়; বিশ্বজুড়ে বাংলা ভাষাভাষি প্রজন্ম’সহ অন্যান্য জাতিগোষ্ঠির মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে।’ ভালবাসার সেতুবন্ধনে আবদ্ধ করতে হবে সবাইকে।
তারেক মনোয়ার বর্তমান সময়ে আলোচিত ও জনপ্রিয় একজন ইসলাম প্রচারক। যাকে ঘিরে বাংলাদেশ সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অসংখ্য ওয়াজ-মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়েছে বা এখনো হচ্ছে। যেখানে শিশু-কিশোর, নবীন-প্রবীণ’সহ ঘঠছে লাখো মানুষের মিলন মেলা। বাংলাদেশ’সহ উপমহাদেশের এই খ্যাতিমান বক্তা বলেন, ‘ইসলাম ধর্মের নামে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রবাদ বিশ্বের শান্তিপ্রিয় মুসলিম সম্প্রদায়েকে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিয়েছে।’ এর থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হচ্ছে- ‘ইসলামের সঠিক ইতিহাসের চর্চা করা এবং তা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া।’ তিনি জানান, আজকে যারা ইসলামের নামে নিরীহ মানুষ হত্যা করছে তারা মূলত বোকার স্বর্গে বাস করছে। একই সাথে অজ্ঞতা ও মূর্খতার পরিচয় দিচ্ছে। ইসলামে কোন নিরীহ মানুষ হত্যাকে জায়েজ করে না।
উদাহরণ হিসেবে তিনি বিশ্ব নবী হযরত মুহাম্মদ (স.) ধর্মপ্রচার ও ইসলাম বিজয়ের ইতিহাস তুলে ধরেন। জানান, ইসলামের আলো বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে মহানবি যতগুলো যুদ্ধ করেছেন, কাউকে আঘাত করেন নি। রাসুল (স.) নারী-পুরুষদের সম-অধিকার আর অসহায়দের মুখে অন্য তুলে দেয়ার নিদের্শনা দিয়ে গেছেন। কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে মানুষের মাঝে ইসলামের শান্তির বারতা ছড়িয়ে দেয়ার কথা বলেছেন। এসব করতে গিয়েও উল্টো তিনি আঘাতের শিকার হয়েছেন। তবুও কাউকে বিপদে ফেলেন নি।
তারেক মনোয়ার আরো বলেন, ইসলামে স্পষ্ট নির্দেশনা আছে নিজের বিপরীত মত, পথ ও ধর্মের যে কেউ হোক না কেন; তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে হবে। আক্ষেপ করে বলেন, বর্তমানে ধর্মের নামে হচ্ছে উল্টোটা। নারী-শিশুকে নির্যাতন/হত্যা ও প্রকৃতি ধ্বংস করে ইসলামের বিজয় করতে চাইছে কিছু বিপদগামি অজ্ঞদের দল। যারা কখনো প্রকৃত ইসলামের নেতৃত্বে আসতে পারবে না।
একজন টিভি ব্যক্তিত্ব, খ্যাতিম্যান বক্তা ও ইসলামিক স্কলার তারেক মনোয়ারের কাছে প্রশ্ন ছিল আগামির বিশ্ব ব্যবস্থায় ইসলাম ও ধর্মপ্রচারে তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কি? বাংলা পত্রিকার পাঠক’সহ প্রবাসী কমিউনিটর জন্য তা হুবহু তুলে ধরা হলো:
বাংলা পত্রিকাঃ মাওলানা মনোয়ার। বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থায় ইসলামের সঠিক ইতিহাস কি ভাবে তুলে ধরা সম্ভব?
তারেক মনোয়ার ঃ খুবই ভালো প্রশ্ন। আমাদের আদর্শিক শক্তি নবী করিম (স.)। মহাগ্রন্থ আল কোরআনের পথ ধরেই যিনি আমাদের চলার দির্কনির্দেশনা দিয়ে গেছেন। এর থেকে বেরিয়ে বিপথগামি হওয়ার কোন সুযোগ নেই। আর যারা ধর্মের নামে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ করছে, তাদের ধ্বংস অনিবার্য। তারা অজ্ঞতার মাঝে বাস করছে। মূর্খতাই তাদের এসব বিপদমুখি করে তুলছে।
বাংলা পত্রিকাঃ আপনি বলছেন, ধর্মের নামে গড়ে উঠা, তালেবান, আইএস, বোকো হারাাম এরা সঠিক পথে নেই?
তারেক মনোয়ার ঃ অবশ্যই তারা সঠিক পথে নেই। কারণ তারা যে ব্যবস্থায় ইসলাম প্রচারের কথা বলছে, তা ইসলামের সঠিক নির্দেশনা নয়। কারণ, ইসলাম নিরীহ কাউকে হত্যা সমর্থন করে না। ইসলামে ক্ষমতার লোভ নয়, ত্যাগ ও মানুষের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করার তাগিদ দিয়েছে।
বাংলা পত্রিকাঃ এর থেকে উত্তরণের উপায় কি তাহলে?
তারেক মনোয়ার ঃ খুব সহজেই এর থেকে উত্তরণ হয়তো সম্ভব হবে না। তবে, যারা বিজ্ঞ আলেম ও ইসলামিক স্কলারস রয়েছেন, তাদেরও থেমে থাকলে হবে না। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের মাঝে কোরআন ও রাসুলের দেয়া নির্দেশনা পৌঁছে দিতে হবে। আমরা যে যার অবস্থানে রয়েছি; প্রত্যেকের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে হবে। কেবল শিক্ষাই নয়, সু-শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে।
বাংলা পত্রিকাঃ আপনি তো বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের দেশেও ইসলামের নামে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটেছে। বেশ কয়েকজন ব্লগার, লেখক, অ্যাক্টিভিটস হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছে। এটা কেন?
তারেক মনোয়ার ঃ ঠিকই বলেছেন। খুবই হতাশাব্যঞ্জক এসব ঘটনা। আমাদের ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশে এসব হত্যাকান্ড কাম্য ছিল না। এসব বিষয়ে আমি নিজেও বেশ কয়েকটি ওয়াজ-মাহফিল এবং টিভির আলোচনায় তুলে ধরেছি। আমি বলবো কিছু বিপদাগামি ভুল পথে পা বাড়াচ্ছে। তাদের এসব পথ থেকে পরিহারে কেবল ইসলামিক স্কলারদের কাজই নয়; দেশের রাষ্ট্র ব্যবস্থা/প্রশাসন এবং পিতা-মাতারও ভূমিকা থাকতে হবে। আমার বিশ্বাস ইসলামের সঠিক ধারণা তাদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারলে আগামিতে, বিপরীতি মতের হলেও একে অন্যকে হত্যা করবে না।
বাংলা পত্রিকাঃ আপনার জন্মস্থানতো একসময়ে সংখ্যালঘুদের তীর্থস্থান ছিল। স্বাধীনতার পরে আস্তে আস্তে সেখানে মুসলমানেদর অবস্থান বৃদ্ধি হয়। এর কারণ কি?
তারেক মনোয়ার ঃ দেখেন আমার জন্মস্থান লক্ষèীপুর জেলার সদরে। চারটি উপজেলা নিয়ে গড়া আমাদের জেলা। পুরো জেলার নামই সংখ্যালঘুদের নামে পরিচিত। আমার পূর্ব পুরুষরা ছিলেন বৃটিশ আমল থেকেই শিক্ষিত। আমার দাদার পর আমার বাবাও ছিলেন একজন সমাজ সেবক, রাজনীতিবিদ এবং দক্ষ মানুষ গড়ার কারিগর। যিনি দেশ ভাগের সময়েও প্রায় ৮০ হাজার হিন্দু পরিবারকে রক্ষায় সচেষ্ট ছিলেন।
বাংলা পত্রিকাঃ স্বাধীনতা পরবর্তী আপনার পরিবার ও আপনার বাবার অবস্থান কি ছিল?
তারেক মনোয়ার ঃ ১৯৭০ সালের পর পাকিস্তকান থেকে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র গঠন হয়। আমরা পাই লাল-সবুজের একটি পতাকা। ওই সময়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পাশে আমার বাবা ছিলেন। তাদের যান-মাল রক্ষার করেছেন। যার ফলশ্রুতিতে ১৯৭০ সালের পর থেকে একাধিকবার তিনি পার্লামেন্টের এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। সবচেয়ে বড় বিষয় ছিল আমার বাবা প্রয়াত আবুল হোসেন মোহাম্মদ শফিউল্যা হিন্দু তথা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একচেটিয়া সমর্থনের কারণেই বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন।
বাংলা পত্রিকাঃ আপনার বাবা রাজনীতির মানুষ ছিলেন। আপনি কেন এ পেশায় এলেন না।
তারেক মনোয়ার ঃ ধন্যবাদ। আমার বাবা কেবল রাজনীতির মানুষ ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন দক্ষ সমাজ সেবকও। অনেক মসজিদ মাদরাসা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় উপসানালয় রক্ষার কারিগর। কিন্তু আমি চাইতাম ভিন্ন আঙিকে নিজেকে মেলে ধরতে। কারণ রাজনীতির বাইরে গিয়ে সমাজ সেবা ও মানবতার কল্যাণে কাজ করা যায়। যা এখনো আমি অব্যাহত রেখে চলেছি।
বাংলা পত্রিকাঃ আমরা জানি যে আপনি ধর্মীয় লেখা পড়ার পাশাপাশি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। কিন্তু কেন?
তারেক মনোয়ার ঃ ধর্মীয় এবং সংস্কৃতি উভয়ে অঙ্গনেই আমার বিচরণ ছিল। ফলে, আমি মানুষকে যেমনি ভাবে ইসলামের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরার চেষ্টা করে যাচ্ছি, একই ভাবে অপ-সংস্কৃতির নামে যাতে তরুণ প্রজন্মরা বিপদগামি না হয় সে দিক থেকেও তাদের ফেরাতে কাজ করে গেছি এবং যাচ্ছি।
বাংলা পত্রিকাঃ আপনি এখন নিউইয়র্কে অবস্থান করছেন। এখানে দিনকে দিন বাড়ছে বাংলাদেশী কমিউনিটি। এদের জন্য আপনার পরমার্শ কি?
তারেক মনোয়ার ঃ অনেক ভালো একটি প্রশ্ন করেছেন। এখানকার বাংলাদেশী প্রজন্মদের মেধা এবং যোগ্যতা দেখে আমি তাদের আগামি নিয়ে অনেক আশাবাদি। কারণ তারা মিথ্যার সাথে নেই। এখানকার রাষ্ট্র এবং সমাজ ব্যবস্থা অনেক উন্নত। মনাবিক মূল্যবোধের প্রতি সবাই সচেতন। তাই, যে যার ধর্ম পালনে অনেক স্বাধীন। এটাই প্রকৃত ইসলামের শিক্ষা। আপনি জোর করে কাউকে ধর্মান্তরিত কিংবা ধর্মপালনে বাধ্য করতে পারবেন না। ইসলামের শান্তি ও প্রকৃত ইতিহাসের কর্মফল দেখে আপনার ধর্মের প্রতি অন্যের আস্থা অর্জনই সফলতা। আমি বিশ্বাস করি আমাদের প্রজন্ম সঠিক পথে পরিচালিত হবে।
বাংলা পত্রিকাঃ নিউইয়র্কে সভা-সেমিনার কিংবা মসজিদ ও ইসলামিক সেন্টারে আপনি দাওয়াতের কাজে অংশ নিয়েছেন কি?
তারেক মনোয়ার ঃ অবশ্যই। আমি প্রায়ই যুক্তরাষ্ট্রে আসি। কেবল নিউইয়র্কেই নয়। বেশ কয়েকটি রাজ্য ঘুরে বেড়াই। বিভিন্ন মজসিদ ও ইসলামিক সেন্টারের আমন্ত্রণে একজন বক্তা হিসেবে অংশ নিয়ে আমি অভিভূত। কারণ এখানকার অভিবাসীদের শেখার আগ্রহ অনেক।
বাংলা পত্রিকাঃ এর আগে কোন দেশে বক্তা হিসেবে গিয়েছিলেন।
তারেক মনোয়ার ঃ আমি মালয়েশিয়া’সহ মধ্যপ্রাচ্যের অনেকে দেশেই গিয়েছি। তবে, দীর্ঘ সময় ছিলাম যুক্তরাজ্যে। লন্ডনের একটি মসজিদে খতীবের দায়িত্বে ছিলাম। এছাড়াও বিভিন্ন সভা-সেমিনার ও ওয়াজ-মাহফিলে বক্তা হিসেবে ব্যাপক সাড়া পেয়েছি। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রেও পাচ্ছি।
মাওলানা তারেক মনোয়ারের শিক্ষা ও কর্মজীবন:
১৯৬০ সালে লক্ষীপুরে জন্মগ্রহণকারি তারেক মনোয়ার। প্রাইমারি শিক্ষার গন্ডি পেরিয়ে তিনি চলে আসেন রাজধানী ঢাকা। ঢাকা থেকেই উচ্চমাধ্যমিক ও মাধ্যমিক শেষ করে প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্র বিজ্ঞান নিয়ে উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেন। এছাড়া ঢাকা আলিয়া থেকে আদিস ও আদবে বিষয়ে কামিল’সহ তৎকালিন ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পারেটিভ রিলিজিয়নেও উপর উচ্চর ডিগ্রি নেন তিনি। একই সাথে ঢাকার সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯৯০ সালে যুক্তরাজ্যে পাড়ি জামান। এরপর থেকেই মূলত একসময়ে তারেক মনোয়ার বনে যান খ্যাতিমান ইসলামিক বক্তা। বাংলাদেশের বেসরকারি টিভি চ্যানেল এটিএন বাংলার ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে ইসলামিক অনুষ্ঠানের সার্বিক দেখভালও করতেন তারেক মনোয়ার। সাক্ষাৎকার গ্রহণে: শিবলী চৌধুরী কায়েস
বাংলা পত্রিকা
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন