মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ বীরবিক্রম। সাবেক পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী। ছয় বারের সংসদ সদস্য। বর্তমানে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান। পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী থাকা অবস্থায় ভারতের সঙ্গে ৫৪টি অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন নিয়ে মাঠ পর্যায়ে কাজ করেছেন তিনি। যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকে পানির ন্যায্য হিস্যার জন্য ভারত সরকারের নীতি নির্ধারকদের সঙ্গে বাকযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছেন বার বার। সেই অভিজ্ঞতা থেকে তিনি মনে করেন, বিএনপি ক্ষমতায় এলে তিস্তা সমস্যার আংশিক সমাধান হবে! সেটি কীভাবে-?
সম্প্রতি বনানীর বাসায় একান্ত স্বাক্ষাৎকারে বাংলানিউজের স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট আসাদ জামান-কে সেই গল্পই শুনিয়েছেন সাবেক এ পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী ।ছবি তুলেছেন বাংলানিউজের সিনিয়র ফটো করেসপন্ডেন্ট দেলোয়ার হোসেন বাদল। নিচে সাক্ষাতের চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো।
বাংলানিউজ: স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ পাওয়ার পর থেকেই ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের যে পানি বণ্টন সমস্য, সেটা রয়েই গেছে। এর নেপথ্য কারণটা কী?
মেজর (অব.) হাফিজ: ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে সমস্যা মাত্র একটি-সেটি হলো অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন। ৫৪টি নদী ভারতের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। প্রায় প্রত্যেকটি নদীর উজানে ভারত একাধিক বাঁধ দিয়ে পানি আটকে রেখেছে। যাকে বলা যায়, একতরফা পানি প্রত্যাহার।
বাংলানিউজ: এতে বাংলাদেশের ক্ষতির দিকগুলো কী?
মেজর (অব.) হাফিজ: আমাদের পানির শেয়ার অনেক কমে গেছে। বাংলাদেশের প্রায় বিশটি নদী এরইমধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বাকি নদীগুলো মৃত প্রায়। জনগণ শুধু দু’টি নদীর কথাই জানে- গঙ্গা ও তিস্তা। আরো যে ৫২টি নদী-সেগুলোর ব্যাপারে তারা অন্ধকারে আছে।
১৯৯৬ সালে ভারতের সঙ্গে শেখ হাসিনা যে পানি চুক্তি করেছিলেন- সেটি হয়েছিলো শুধু গঙ্গা নদীর ওপরে। সেখানে বলা হয়েছিলো বাকি ৫৩টি নদীর ওপরও নো হার্ম ব্যাসিসে পানি বণ্টন চুক্তি হবে। এ জন্য প্রথম ধাপে বেছে নেওয়া হয়- তিস্তা, ধরলা, রূপকুমার, মধুমহুরী, গোয়াই ও গোমতী নদীকে। এরমধ্যে এক তিস্তাতেই গত ২০ বছর ধরে আমরা আটকে আছি।
বাংলানিউজ: এর কারণ কী?
মেজর (অব.) হাফিজ: এর কারণ হলো ভারতের অনমনীয় মনোভাব। তারা পানি দেবে না। মমতা বন্দোপাধ্যায় যে কথাগুলো বললেন-তিনি রেখে ঢেকে বলতে পারেন নি; চাচাছোলাভাবেই বলেছেন। এছাড়া পানি সম্পদমন্ত্রী হিসেবে ভারতের পানিসম্পদ মন্ত্রী ও যৌথ নদী কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করে আমার এ ধারণা হয়েছে-ভারত পানি দেবে না।
বাংলানিউজ: ভারত কী বলে?
মেজর (অব.) হাফিজ: যখনই আমরা পানি চাই, তখনই তারা বলে, নদীতে কত পানি আছে-তা আমরা নিজেরাই জানি না। সুতরাং এখানে একটা কারিগরি সমীক্ষা করা হোক। আমরা বলি যে, করিগরি সমীক্ষা করেন, যত দিন লাগে। তার আগে আসুন এডহক ভিত্তিতে পানি ভাগাভাগি করি। ভারত নানা রকম ধানাই, পানাই করে- পানি দেয় না।
যখন আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য দল (বিএনপি) ক্ষমতায় থাকে, তখন তারা (ভারত) চাপের মধ্যে থাকে। আমরা চিঠি দিই, মন্ত্রীকে টেলিফোন করি। আর যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে তখন তারা (ভারত) নিশ্চিন্তে থাকে, যেন ছুটি পেয়ে গেল।
উদাহরণ স্বরূপ, আমরা যখন ক্ষমতায় ছিলাম, তিস্তা নদীতে শুষ্ক মৌসুমে পানি ছিলো গড়ে চার হাজার কিউসেক। এখন আওয়ামী লীগের আমলে দেড় শ’ থেকে দুই শ’ কিউসেক। সুতরাং আমাদের সময় বাধ্য হয়েও তারা কিছু পানি দেয়।
বাংলানিউজ: তাহলে যৌথ নদী কমিশনের কাজ কী?
মেজর (অব.) হাফিজ: দুই দেশের পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা হচ্ছে যৌথ নদী কমিশন। এই সংস্থার মিটিংগুলোতে ভারতের পানিসম্পদ মন্ত্রী প্রথমে তাদের সমস্যার কথা তুলে ধরে এজেন্ডা ঠিক করেন।পরে বাংলাদেশের পানিসম্পদ মন্ত্রী তাদের সমস্যার কথা তুলে ধরে এজেন্ডা ঠিক করেন।
বাংলানিউজ: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সর্বশেষ ভারত সফরে সে দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন- বিজেপি ও আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই তিস্তা চুক্তি হবে-এ বক্তব্যে কতটা আস্থা রাখা যায়?
মেজর (অব.) হাফিজ: ভারতের এ বক্তব্য ছেলেভুলানো। আমাদের কাছে এগুলো মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। মোদির আশ্বাস হলো কথার কথা। আসল কথা হলো মমতা যেটা বলেছেন। পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে সে বেঈমানি করবেন না। তাদের জল নেই, এখানে জল দেবেন কীভাবে?
বাংলানিউজ: যে কাজটি আওয়ামী লীগ পারছে না, ক্ষমতায় এলে বিএনপি কি সেটা পারবে?
মেজর (অব.) হাফিজ: তিস্তা সমস্যার আংশিক সমাধান বা বর্তমানের চেয়ে ভালো অবস্থায় থাকবে। তারা যদি পানি না দেয় আমরা আন্তর্জাতিক আদালতে যাব।
বাংলানিউজ: কিন্তু বাংলাদেশ তো জাতিসংঘের ‘অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন নীতিমালা ১৯৯৭’-এ স্বাক্ষর করে নি।
মেজর (অব.) হাফিজ: আমরা ক্ষমতায় এলে জাতিসংঘের এই নীতিমালায় অনুস্বাক্ষর করব।
বাংলানিউজ: ১৯৯৭ সালে এই নীতিমালা প্রণয়নের পর ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এসেছে; পাঁচ বছর দেশ চালিয়েছে। তখন জাতিসংঘের ওই নীতিমালায় স্বাক্ষর করে নি কেন?
মেজর (অব.) হাফিজ: ভারতের তীব্র বিরোধিতার পরও বিষয়টি আমরা মন্ত্রিসভায় তুলেছিলাম। নীতিগত সিদ্ধান্তও হয়েছিলো স্বাক্ষর করার। কিন্তু তার আগেই আমাদের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়।
বাংলানিউজ: এর আগেই কাজটি সেরে ফেলেন নি কেন?
মেজর (অব.) হাফিজ: নীতিমালাটি আইনে পরিণত হওয়ার জন্য ৩৫টি দেশের স্বাক্ষর প্রয়োজন ছিলো। কিন্তু তখন পযর্ন্ত ৩৫টি দেশ স্বাক্ষর করে নি। এখন ৩৫টি দেশ স্বাক্ষর করায় এটি আইনে পরিণত হয়েছে। আমরা ক্ষমতায় গেলে অনুস্বাক্ষর করব।
চলবে ....
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন