‘তিস্তার পানিতে আমাদের অধিকার ভারত অস্বীকার করতে পারে না’
01 April 2017, Saturday
বাংলাদেশের প্রখ্যাত পানিবিজ্ঞানী ড. আইনুন নিশাত তিস্তা নদীর পানিবন্টন নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বহুল আলোচিত চুক্তি নিয়ে ঢাকা ট্রিবিউন পত্রিকার সঙ্গে কথা বলেছেন। তার অভিমত সাক্ষাতকার আকারে নিচে তুলে ধরা হলো:
প্রশ্ন: আমরা যতদূর জেনেছি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন ভারত সফরে তিস্তা’র পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর হচ্ছে না। এতে বাংলাদেশের কি ক্ষতি হবে?
উত্তর: শুষ্ক মওসুমে আমরা তিস্তা থেকে কতটুকু পানি পাচ্ছি তা জানার জন্য আমাদের এই চুক্তি প্রয়োজন। তখন সে অনুযায়ী আমরা আমাদের কৃষি প্রকল্পগুলোর পরিকল্পনা করতে পারবো।
ভারত শুষ্ক মওসুমে গজলডোবা ব্যারেজের সবগুলো গেট বন্ধ করে দিয়ে আমাদের প্রান্তে তিস্তাকে একেবারে শুকিয়ে ফেলে। একটি বন্ধুপ্রতীম দেশের কাছ থেকে এ ধরনের আচরণ প্রত্যাশা করা যায় না।
চুক্তি একটি আনুষ্ঠানিকতা হলেও নদীর পনির ওপর আমাদের অধিকার ভারত কোনভাবেই উপেক্ষা করতে পারে না।
আদর্শগতভাবে এই চুক্তিতে দুটি ব্যবস্থা থাকতে হবে: শুষ্ক মওসুমে পানির প্রবাহ নিশ্চিত করা এবং বছরের বাকি সময়ের জন্য পুরো নদী অববাহিকার জন্য পানি ব্যবস্থাপনা। এছাড়া বর্ষাকালে যেন বন্যা ও নদীভাঙ্গন প্রতিরোধ করা যায় চুক্তিতে তাও নিশ্চিত করতে হবে।
অক্টোবরে তিস্তার শুষ্ক মওসুম শুরু হয়, আর বর্ষা শুরু হয় এপ্রিল-মে’র দিকে। আমি মনে করি সেপ্টেম্বর-অক্টোবর সময়কাল তিস্তার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এ সময়টিতে নদী অববাহিকা অঞ্চলের কিছু এলাকায় সম্পূরক সেচকাজের প্রয়োজন হয়।
শুষ্ক মওসুমে তিস্তায় পানিপ্রবাহ থাকে ৬ হাজার কিউসেক [১ কিউসেক=২৮.৩২ লিটার/সে.]। অথচ বাংলাদেশে ৮ হাজার এবং ভারতে ১৬ হাজার কিউসেক পানি প্রয়োজন। নদীতে অতিরিক্ত পানি ছাড়া না হলে এসব চাহিদা মেটানো সম্ভব নয়।
আমার দ্বিতীয় উদ্বেগ হলো বন্যা নিয়ে। বর্ষাকালে তিস্তা প্লাবিত হয়। এর পানি প্রবাহ সাধারণভাবে ৩ লাখ কিউসেক ছাড়িয়ে যায়। এক বছর সাড়ে ৪ লাখ কিউসেক পানি প্রবাহের রেকর্ডও রয়েছে। এছাড়া তিস্তা অববাহিকায় বর্ষাকালে ব্যাপক ভাঙ্গন দেখা দেয়।
এসব সমস্যা মোকাবেলার জন্য আমাদের প্রয়োজন কার্যকর বন্যা ব্যবস্থাপনা। উজানে একটি জলাধার তৈরি করে সহজেই এ সমস্যার সমাধান করা যায়।
প্রশ্ন: আমরা শুনেছি কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি একমত না হওয়ায় চুক্তি স্বাক্ষর পিছিয়ে গেছে . . .
উত্তর: তিস্তা চুক্তির বিস্তারিত বিষয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার মমতা ব্যানার্জি’র সঙ্গে আলোচনা করেনি বলে আমরা খবরে শুনেছি। তবে আমি মনে করি এটা পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে জড়িত কোন ইস্যু নয়। এটা দুই কেন্দ্রীয় সরকারের বিষয়। এর মানে হলো দিল্লিকে ঢাকার সঙ্গে আলোচনা করতে হবে এবং পানির ন্যায্য বণ্টনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
কিন্তু বলা হচ্ছে যে পশ্চিম বঙ্গের সম্মতি ছাড়া ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার বাংলাদেশের সঙ্গে কোন চুক্তি করতে পারে না। এ কথা একেবারেই ভুল। বাংলাদেশ ও ভারত যখন আন্ত:সীমান্ত নদীগুলোর পানি বণ্টন নিয়ে আলোচনা করবে রাজ্য সরকারের সেখানে বলার কিছু নেই। কারণ, এটি দুই কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যকার ইস্যু।
প্রশ্ন: ২০২৬ সালে গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে। এই চুক্তির ব্যাপারে পরবর্তী পদক্ষেপ কি হতে পারে?
উত্তর: গঙ্গা চুক্তিটি প্রতি পাঁচ বছর অন্তর পর্যোলোচনা করার কথা থাকলেও তা কখনোই হয়নি। কোন শর্ত ছাড়াই চুক্তিটি নবায়নযোগ্য। বাংলাদেশ তা নবায়ন করতে পারবে বলে আমার বিশ^াস। কিন্তু এ ব্যাপারে আগামী দু’বছরের মধ্যে আলোচনা শুরু হতে হবে। যদিও এবারের চুক্তিতে কোন সময়সীমা রাখা ঠিক হবে না।
প্রশ্ন: আমরা জানি যে ফারাক্কা পয়েন্টে পানি প্রবাহের ওপর ভিত্তি করেই গঙ্গা চুক্তি। আরো জানা যায় যে শুষ্ক মওসুমে ফারাক্কা পয়েন্টে পানি প্রবাহ ক্রমাগত কমছে। চুক্তিটি নবায়ন করা হলে আমরা কি আগের মতো একই পরিমাণ পানি প্রাপ্তির ওপর জোর দেবো?
উত্তর: এই মুহূর্তে গঙ্গার উজানে কি হচ্ছে তা জানার কোন উপায় বাংলাদেশের নেই। কিন্তু ২০১১ সালে বাংলাদেশ ও ভারত যে সহযোগিতা চুক্তি করেছে সে অনুযায়ী দু’দেশ নদীর পানি ব্যবস্থাপনার শর্তগুলো নিয়ে আলোচনা করতে পারে।
কিছু শর্ত নিয়ে আলোচনার সময় এসেছে আমাদের। গঙ্গা চুক্তি অনুযায়ী পানিপ্রবাহ যেন ক্রমাগত বৃদ্ধি পায় উজানের দেশ তা নিশ্চিত করবে। গঙ্গায় পানি প্রবাহ বেশ ভালো ছিলো। ১৯৭৫ সালে পর থেকে নদীর বিভিন্ন অংশে ভারত পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। কিন্তু চুক্তিতে বলা হয়েছে যে উভয় দেশ নদীতে পানির প্রবাহ নিশ্চিত করবে। যথাযথ অববাহিকাভিত্তিক নদী ব্যবস্থাপনার জন্য এটা তারা করবে। বাংলাদেশ সকল অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যেতে পারলে আন্ত:সীমান্ত নদীগুলোর পানিবণ্টন সমস্যার সমাধান হতে পারে।
প্রশ্ন: অববাহিকাভিত্তিক নদী ব্যবস্থাপনা এই অঞ্চলের জন্য সবচেয়ে ফলদায়ক হতে পারে বলে আপনি প্রায়ই বলে থাকেন। বিষয়টি কি একটু বিস্তারিত বলবেন?
উত্তর: অববাহিকাভিত্তিক নদী ব্যবস্থাপনা একটি ক্লাসিক্যাল ধারণা। রাইন, কলোরাডো, মেকং-এর মতো সকল আন্তর্জাতিক নদীর ক্ষেত্রেই এই ধারণা গ্রহণ করা হয়েছে। উজান ও ভাটির দেশগুলোতে পানির চাহিদা ও প্রাপ্তির মধ্যে পার্থক্য থাকে। সাধারণত উজানের দেশগুলোতে পানির প্রবাহ চাহিদার তুলনায় বেশি হয়। নিম্ন অববাহিকায় ঠিক উল্টো। পানির পরিমাণ ও মানের ভিত্তিতে নদীগুলোর যথাযথ মডেল তৈরির মাধ্যমে সরবরাহ ও চাহিদার মধ্যে ভারসাম্য আনা যায়। এর মাধ্যমে আমরা কোন একটি নদীর পুরো অববাহিকাজুড়ে বন্যা, নৌচলাচল, সেচ, পানিবিদ্যুৎ ও মৎস্য সম্পদের মতো ইস্যুগুলোর সমাধান করতে পারি। এ সবকিছুই অববাহিকা-ভিত্তিক নদী ব্যবস্থাপনার অন্তর্ভুক্ত।
প্রশ্ন: আপনি কি মনে করেন যে এই অঞ্চলের সবগুলো দেশ এই ইস্যুতে ঐকমত্যে পৌছাবে?
উত্তর: সবগুলো দেশকে একই মে নিয়ে আসার দরকার নেই। কোন সুনির্দিষ্ট আন্ত:সীমান্ত নদীর সমস্যাগুলো নিয়ে কাজ করবে এমন একটি কমিশন গঠন করা যেতে পারে। ব্রহ্মপুত্রের কথা বলা যেতে পারে। ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা ব্যবস্থাপনার জন্য চীন, ভুটান, ভারত ও বাংলাদেশকে নিয়ে একটি কমিশন গঠন করা যায়।
প্রশ্ন: বাংলাদেশ রাজবাড়ির গোয়ালন্দে গঙ্গা ব্যারেজ তৈরি করতে চায়। কেন? আপনি কি মনে করেন যে এতে নদীর উজানে, তথা ভারতের বিহারের মতো রাজ্যে বন্যা দেখা দেবে?
উত্তর: শুষ্ক মওসুমে ফারাক্কা ব্যারেজ থেকে বাংলাদেশ সুনির্দিষ্ট পরিমাণ পানি পেয়ে থাকে। আমরা যদি এই পানির এক-তৃতীয়াংশ দেশের দক্ষিণ পশ্চিমা লের জেলাগুলোতে সরবরাহ করতে পারি তাহলে তা ওই অঞ্চলে পানির লবনাক্ততা কমাতে সাহায্য করবে। গোয়ালন্দে ব্যারেজ তৈরি করার মাধ্যমেই কেবল তা সম্ভব। আমার জানা মতে এর কোন বিকল্প নেই।
এই ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা থেকে আমি বলতে পারি যে ফারাক্কা ব্যারেজ ও বিহারের বন্যার মধ্যে কোন সম্পর্ক নেই। ব্যারেজের গেট খুলে দেয়ার দাবি জানিয়েছেন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নিতীশ কুমার। ফারাক্কা ব্যারেজের ১০৮টি গেটের মধ্যে কারিগরি সমস্যার কারণে ৪-৫টি গেট সবসময় বন্ধ থাকে। তারা যদি এই ৫টি গেটও খুলে দেয় তাতে পানি প্রবাহের তেমন হেরফের হবে না। কুমার আসলে মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গেটগুলো খুলে রাখার দাবি করেছেন। তিনি ফারাক্কার উজানে নদীর পলি অপসারণেরও দাবি করেছেন। এটা একটি কারিগরি বিষয়।
প্রশ্ন: নিতীশ কুমার কেন ফারাক্কার সবগুলো গেট কেন খুলে রাখার দাবি করেছেন?
উত্তর: কোনভাবে তার ধারণা জন্মেছে যে বর্ষাকালেও ব্যারেজের গেটগুলো বন্ধ রাখা হয়। আর, এতে বিহারে বন্যা দেখা দেয়। কিন্তু এ কথা ঠিক নয়। সমস্যা হলো রাজনৈতিক নেতারা ভুল সিদ্ধান্তেও পৌছাতে পারেন।
প্রশ্ন: গঙ্গা ব্যারেজ নির্মাণের বিষয়টি কি ভারতের অনুমতির ওপর নির্ভর করে?
উত্তর: আপনি যদি কারো কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে কিছু করেন তাহলে সে চাইবে যেন প্রকল্পটিতে তার দাবি মতো কাজ করা হয়। কিন্তু নিজের টাকায় কাজটি করলে তা হবে না। ভারত নিজের টাকায় ফারাক্কা ব্যারেজ করেছে। তাই এর উপর তার পুরো নিয়ন্ত্রণ। তবে, গঙ্গা ব্যারেজ ভারতের সঙ্গে যৌথভাবে নির্মাণ করা উচিত বলে আমি মনে করি।
.southasianmonitor.com
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন