ইকবাল মাহমুদ। প্রশাসনে দীর্ঘ কর্মজীবন তার। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে জ্যেষ্ঠ সচিব হিসেবে অবসরের আগে দায়িত্বে ছিলেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) বিকল্প নির্বাহী পরিচালকও ছিলেন। দেশে-বিদেশে ২৪টি দফতরে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা নিয়ে ২০১৬ সালের ১৩ মার্চ নিয়োগ পান দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান হিসেবে। ১৪ মার্চ যোগ দেন দুদকে। দায়িত্বের প্রথম বছরে দুদককে কতটুকু এগিয়ে নিয়ে গেছেন, কোথায় ব্যর্থতা ছিল কিংবা ভবিষ্যতে কী করতে চান এ নিয়ে তিনি বিস্তারিত কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আলমগীর স্বপন
যুগান্তর : দুদকে দায়িত্বের দ্বিতীয় বছরে পা রেখেছেন। সামনে কীভাবে এগোতে চান, নতুন কোনো লক্ষ্য-পরিকল্পনা আছে কি?
ইকবাল মাহমুদ : প্রথম বছরের কথা এককথায় যদি বলতে হয়, এটা চ্যালেঞ্জিং ছিল। একটা জিনিসের স্টার্টআপ টাইম বা গজিয়ে ওঠার সময় থাকে সেটা আমি বা আমরা সে অর্থে পাইনি। কারণ দুর্নীতির বিষয়টি এত জ্বলন্ত বিষয় যে এর স্টার্টআপের সময় নেই। তাই আমাদের এসেই শুরু করতে হয়েছে। এ এক বছরে আমরা যে খুব একটা কিছু করতে পেরেছি সেটা বোধহয় না। তবে কিছু যে করতে পারিনি সেটা বলাও বোধহয় ঠিক নয়। জনসাধারণ, সুশীল সমাজ এবং যারা দুর্নীতি করতে পারেন বা করেন সবাইকে আমরা একটা বার্তা দিতে চেয়েছিলাম কেউ ধরাছোঁয়ার বাইরে নয়, দুর্নীতি করে পার পাওয়া যাবে- এটা যেন কেউ মনে না করে। আমার মনে হয়, এ ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও সফলতা আছে। আর ব্যর্থতার কথা যদি বলেন, সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা জনগণের আস্থা এখনও আমরা পুরোপুরি অর্জন করতে পারিনি। কাজ করতে গিয়ে আমার মনে হয়েছে, পাবলিক ট্রাস্ট বিল্ড করতে হয়তো একটু সময় লাগবে। তাই আমাদের মূল ফোকাসটা এ বছর থাকবে, হাউ টু বিল্ড পাবলিক ট্রাস্ট।
যুগান্তর : দুর্নীতি প্রতিরোধ সপ্তাহ পালন করছে দুদক। এবারের লক্ষ্য কী?
ইকবাল মাহমুদ : আমরা প্রতিবছর বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার দিন থেকে সপ্তাহব্যাপী দুর্নীতি প্রতিরোধ সপ্তাহ পালন করি। ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস আমাদের জাতীয় জীবনের বিশেষ দিন। আসলে আমাদের স্বাধীনতার বড় সুফল তো হতে পারে দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়া। তবে পুরোপুরি দুর্নীতি নির্মূল কখনও সম্ভব নয়; কিন্তু প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। সেই লক্ষ্যেই আমরা এগোচ্ছি। দুর্নীতির বিরুদ্ধে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ ও সচেতন করতে ঢাকাসহ সারা দেশেই প্রতিরোধ সপ্তাহের কর্মসূচি পালিত হবে। সভা-সেমিনারের পাশাপাশি দুর্নীতিবিরোধী কার্টুন ও পোস্টার প্রদর্শনী এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সততা সংঘের মাধ্যমে দুর্নীতিবিরোধী মূল্যবোধ তুলে ধরা হবে।
যুগান্তর : দুর্নীতিবাজদের কী বার্তা দিতে চান?
ইকবাল মাহমুদ : বার্তা তো সহজ। কেউই মনে করবেন না যে, আপনি আইনের ঊর্ধ্বে এবং আপনাকে স্পর্শ করা যাবে না। আপনার বিত্তবৈভব রয়েছে অথবা আপনি ক্ষমতাবান সেই কারণে আইন আপনাকে স্পর্শ করবে না, এই মনোভাবটা পরিবর্তন করুন। আমার স্পষ্ট কথা- কেউই যেন মনে না করেন আমিসহ আমরা বা আমি আইনের ঊর্ধ্বে।
যুগান্তর : কিন্তু ক্ষমতাবানরা দুদকে পার পেয়ে যায়- এমন ধারণাই প্রচলিত। আপনি এখানে যোগ দেয়ার আগে নিশ্চয়ই শুনেছেন, অনেকেই প্রতিষ্ঠানটিকে ‘দায়মুক্তি কমিশন’ বলে। আগের কমিশনের কাজকর্ম দেখে কি মনে হয়েছে আসলে ওই পর্যায়ে গিয়েছিল?
ইকবাল মাহমুদ : (একটু হেসে, সময় নিয়ে) এত কঠিন প্রশ্ন করলে তো সমস্যা। দায়মুক্তি না, আসলে একেক মানুষের ধারণা একেক রকম। আপনি কোন্টাকে অপরাধ বলবেন, কোন্টাকে বলবেন না, এটা একটা কাইন্ড অব পারসেপসন বা ধারণা। যারা আগে ছিলেন তাদের এক রকমের অবস্থান ছিল, হয়তো আমাদের আরেক রকমের অবস্থান। দায়মুক্তির বিষয়টা ঢালাওভাবে বলাটাও বোধহয় সঠিক নয়। দায়মুক্তি নয়, হয়তো কারও বিরুদ্ধে মামলা হয়নি। সেটা আমরাও করে থাকি। এটা আমার মনে হয় কিছুটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। সব কটি এফআইআর বা মামলাই যে চার্জশিটে পরিণত হবে তা নয়। তবে থিউরিটিক্যালি ফর অ্যান্টি করাপশন কমিশন এফআইআর হলে চার্জশিট হওয়াটাই উচিত। এটা বাঞ্ছনীয়, বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া। সব সময় রুলের বাইরেও কিছু ব্যাপার থাকে। একজন ভদ্রলোক যদি মারা যান, সে ক্ষেত্রে তো আপনি তার বিরুদ্ধে চার্জশিট দিতে পারবেন না। তাই দুদকের মামলা তখনই করা উচিত, যখন বিশ্বাস হবে, কোর্টে আপনি এটা প্রমাণ করতে পারবেন, আপনার কাছে তথ্যপ্রমাণ আছে। এসব বিষয় মাথায় নিয়েই আমরা এখন মামলা করার চেষ্টা করছি।
যুগান্তর : তাহলে কি বিষয়টা এমন যে অভিযোগ আছে, কিন্তু প্রমাণ করতে পারবেন না আদালতে- এ কারণে অনেক সময় দায়মুক্তি হয়ে যায়?
ইকবাল মাহমুদ : দেখেন, দুর্নীতি ছিল, দুর্নীতি আছে, দুর্নীতি থাকবে- এটাতো সত্যি। এখন হয়তো প্রশ্ন করবেন তাহলে কী হবে? আসলে বিষয়টা হচ্ছে মাত্রার। দুর্নীতির মাত্রা এমন পর্যায়ে গেছে, আপনি কোন্টা ধরবেন, কাকে ধরবেন, কাকে ছাড়বেন। আপনি যদি নৈতিকতার প্রশ্নে আসেন, আপনি যদি কাজের যে পদ্ধতি, সেই পদ্ধতিতে আসেন, সবকিছু মিলিয়েই আপনাকে ধারণা করতে হয় যে দুর্নীতি কোন্টা। এখন দুর্নীতির যে ব্যাপ্ত পরিসর, সেই পরিসরে আপনি কোন্টা ধরবেন, কোন্টা ধরবেন না- এ নিয়ে মানুষের আস্থার সংকট রয়েছে। দুর্নীতির ব্যাপকতা এমন জায়গায় চলে গেছে আপনি যেটাই ধরেন না কেন সেটাই ধর্তব্য। যে কারণে আপনি যাই ধরেন, মানুষ কিন্তু অত বিশ্বাস করে না, দুর্নীতি দমন কমিশন কিছু করছে। মানুষের যে আস্থার সংকট এ ক্ষেত্রে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। আমাদের বলতে হচ্ছে, দুদকের ১ হাজার ৭৩ জনবল দিয়ে এ ১৬ কোটি মানুষের দেশের দুর্নীতির মূলোৎপাটন আপনি করতে পারবেন না। এ কারণে আমাদের মৌলিক দর্শন হচ্ছে, বিল্ডিং অ্যাওয়ারনেস।
যুগান্তর : সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার মানে দুর্নীতি। আপনি সিভিল প্রশাসনে ছিলেন। এখন দুদকের চেয়ারম্যান। দু’ক্ষেত্রের অভিজ্ঞতায় কি বৈপরীত্য আছে?
ইকবাল মাহমুদ : আসলে রিকনসাইল বা মেলানো এ ক্ষেত্রে খুবই কঠিন। ওইটা (প্রশাসন) একটা পরিস্থিতি ছিল। এটা আরেকটা। ওখানে আমি আসামির কাঠগড়ায় ছিলাম, এখানে আমি ধরেন বিচার প্রক্রিয়ার অংশ। এ ক্ষেত্রে একটা কথা স্পষ্ট বলে দিতে চাই, কর্মকর্তা যদি নৈতিকতা ও মূল্যবোধ ধারণ করেন, তাহলে তার ওপরের পর্যায়ে যে অথরিটি থাকুক না কেন, দুর্নীতি হতে পারবে না। আজ (বৃহস্পতিবার) সরকারি একজন কর্মকর্তার একটি অভিযোগ নিয়ে শুনানি ছিল। সেই কর্মকর্তা বলেছেন, তার ওপর চাপ ছিল। এ ক্ষেত্রে আমার প্রশ্ন ছিল, আপনি চাপে পড়ে কাজ করলেন কেন? বলল, আমি যদি পেনশন না পাই। তার মানে আপনার টেনশন হল, পেনশন যদি না পান। এ পেনশন না পাওয়ার বিষয়টা নিয়ে ভাবছেন; কিন্তু আপনি যদি এখন মামলায় পড়ে যান তাহলে কী হবে? নাম বলতে চাই না, আমাকে একবার অনেক উচ্চ পদের একজন বলেছিলেন, দেখ মন্ত্রণালয়ের যদি কোনো কর্মকর্তা শক্ত অবস্থান নেয় তাহলে তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কিছু করার থাকে না। আমি বিনা বাক্যব্যয়ে বলেছিলাম স্যার সঠিক। আসলে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সঠিক পথে এবং নৈতিকতা মূল্যবোধের ওপর দাঁড়িয়ে যদি নিজের কাজটা করেন, দুর্নীতি হওয়ার কোনো প্রশ্ন নেই। যদি না আপনি নিজে কোনো দুর্নীতি করেন। আপনারা হয়তো জানেন, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মেয়াদের ২৫ বছর আগে চাকরিচ্যুত করা যায় না। হ্যাঁ তাকে বদলি করা যেতে পারে; কিন্তু এটা তো স্বাভাবিক, আপনি চাকরিতে আছেন, বদলি তো হবেই আপনার।
যুগান্তর : তাহলে কি বলা যাবে, সরকারি কর্মকর্তাদের কারও বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ থাকলে বিভাগীয়ভাবে তাকে সাজা দেয়ার বিধানটি দুর্বল বা নমনীয়?
ইকবাল মাহমুদ : আমরা গত বছর যে সুপারিশ করেছি, তাতে বলেছি- বদলির একটা নীতিমালা করতে হবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ভারতে চাইলেও কাউকে আপনি বদলি করতে পারবেন না। সেখানে একটি কমিটি আছে, একটা চেক অ্যান্ড ব্যালেন্সের প্রশ্ন সেখানে আছে। আমাদের এখানে এমন কিছু করতে হবে। আমরা সরকার বাহাদুরকে বলছি, একটা সুনির্দিষ্ট মডেল বদলি নীতিমালা তৈরি করুন। সেই নীতিমালা অনুযায়ী চলুক সবকিছু। তাহলে ওই চেয়ারের ভালোবাসা, প্লাস চাপ আর থাকবে না। উনি (সরকারি কর্মকর্তা) সাহসের সঙ্গে কাজ করতে পারবেন। ওইটুকু স্বাধীনতা তাকে দিতে হবে।
যুগান্তর : দেখা যায়, যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে বা ক্ষমতাসীন যারা তাদের দুর্নীতির খোঁজখবর দুদক বলতে গেলে করেই না। আপনার কমিশনও একই স্রোতে?
ইকবাল মাহমুদ : আপনাকেই জিজ্ঞেস করি, ক্ষমতাসীন বা ধরুন আমি যখন এ কমিশনে আছি, আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করাটা আসলে কঠিন। যারা ক্ষমতাসীন, তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তো আসে না। আপনি কয়টা পত্রিকার রিপোর্ট পেয়েছেন, অমুক অমুক রাজনীতিবিদ এ দুর্নীতি করেছে। এরকম রিপোর্ট নেই বলতে পারেন। যেগুলো আছে, সেগুলো আমরা কগনিজেন্স বা আমলে নিয়েছি। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হতে পারে, ১০ টাকার চাল নিয়ে যে দুর্নীতি হয়েছে। এ অভিযোগে অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের বিরুদ্ধে চার্জশিট হয়েছে। আমরা তদন্তে আছি, তদন্তের স্বার্থে এখন নাম বলতে পারছি না। তাই আপনার কথাটা সত্যি নয়। রিপোর্ট করেন, আমরা ব্যবস্থা নেব। আমরা তো বাসায় গিয়ে গিয়ে আর খুঁজে বের করতে পারব না।
যুগান্তর : দুদক আইন অনুযায়ী এ ক্ষেত্রে অভিযোগ ছাড়াও স্বপ্রণোদিত হয়ে দুর্নীতির অনুসন্ধানের সুযোগ রয়েছে?
ইকবাল মাহমুদ : এটা একটা ভালো প্রশ্ন করেছেন। স্বপ্রণোদিত হয়ে মানে অতি উৎসাহী হয়ে কাজটা করা, এটা সঠিক নয়। তবে হ্যাঁ, এখানে একটা সমস্যা হয়ে গেছে এ কমিশনে, এক বছরে আমি যা দেখলাম এখানে কোনো ইনটেলিজেন্স ইউনিট নেই। একটা ইনটেলিজেন্স ইউনিট থাকলে কোন্ সেক্টরে কী হচ্ছে না হচ্ছে এর একটা খতিয়ান বা চালচিত্র আপনি পেতেন। তখন আপনি অভিযোগ নিয়ে তদন্ত করতে পারতেন। এখন তো সেটা নেই। এর ফলে স্বপ্রণোদিত হয়ে আমরা যে একটা তদন্ত করব, সেই কাজটা আসলে হচ্ছে না। এখন দরখাস্ত আর আপনাদের রিপোর্টের ওপর নির্ভর করতে হয়; কিন্তু আপনারাই বা কতগুলো রিপোর্ট করেছেন। আসলে বাস্তবতা হল, আমি যখন ক্ষমতায় থাকি, ফাইল তো আমার কাছে থাকে, সব তথ্য আমার কাছে সংরক্ষিত। তাই আপনি কীভাবে দুর্নীতির তথ্য পাবেন, যেখানে আমি আছি। আমি চলে যাওয়ার পর আপনি আমার দুর্নীতির সব তথ্য পাবেন- এটাই কারণ। তাই প্রায়ই দেখবেন, দুর্নীতির খোঁজখবর আউটগোয়িং গভর্নমেন্টের বিরুদ্ধে হয়।
যুগান্তর : এ ছাড়া আইন অনুযায়ী দুদক চাইলে যে কারও সম্পত্তির হিসাব নিতে পারে। জাতীয় নির্বাচনের আগে প্রার্থীরা সম্পদের হিসাব জমা দেন, এর সঙ্গে পরবর্তী সময়ের অর্থ-বিত্তের হিসাব দুদক চাইলে কি নিতে পারে না? অন্তত যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির জনশ্রুতি আছে?
ইকবাল মাহমুদ : একটা প্লেটে যদি আপনি অনেক বিরিয়ানি নিয়ে রাখেন, খেতে পারবেন না। এটা (দুদক) একটা ছোট প্রতিষ্ঠান, আপনি যদি এত কিছু নিয়ে অগ্রসর হন, কোনোটাই করতে পারবেন না। এত সম্পদের হিসাব নিয়ে আপনি কী করবেন? এখানে কিছু কথা আছে, এনবিআর সম্পদের হিসাব নিচ্ছে, আবার আপনি নিচ্ছেন আইনের প্রেক্ষাপটে, এতে কিছু দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। এ জন্য সরকারকে বলেছি, আমরা এ ক্ষেত্রে আসলে কী করব? আমরা কোনদিকে যাব এখনও নিজেরা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি। আমরা সম্পদের হিসাবটা কীভাবে নেব, কীভাবে নেব না, এটা আমরা এখন চিন্তাভাবনা করছি। তবে আমরা কাজ বন্ধ রাখিনি, গণভাবে হয়তো হচ্ছে না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমরা সম্পদের হিসাব চাই। আর একটা জিনিস ট্যাক্সের জায়গাটা ঠিক না হলে আপনার সম্পদের হিসাব নিয়ে খুব বেশি লাভ হবে না। ট্যাক্স যে দিতে হবে, এ সংস্কৃতি আমরা এখনও গড়ে তুলতে পারিনি। অগ্রগতি হয়েছে; কিন্তু ট্যাক্স জিডিপি রেশিও খুবই কম। আমাদের আগামী প্রজন্মের স্বার্থে দেশের উন্নয়নের জন্য এটা আরও বেশি হওয়া দরকার। স্বনির্ভরতার জন্য এটা দরকার। আপনি একটা ট্যাক্স জমা দিলেই না বিকল্প তৈরি হয় আস্তে আস্তে, তখন সম্পত্তির হিসাবটা নেয়া সহজ। কিন্তু হুট করে এখন সম্পত্তির হিসাব চাইলে কোথায় কী আছে আপনি বলতে পারবেন না। আপনার টিভি কোথায় কবে কিনেছেন, সেটার হিসাব কোথায়, ট্যাক্সে দেখিয়েছেন কিনা, এতে অনেক ধরনের সমস্যা। তাই আমরা মূলত এনবিআরকে বলেছি, আপনারা ট্যাক্স আদায় ঠিক রাখেন। এনবিআর ট্যাক্স মেলা করছে, ট্যাক্সের হার বাড়ছে। আমি আশা করছি আরও বাড়বে। বাড়লে পরে হয় কী নির্দিষ্ট লোকের হিসাবটা নিলে, আর তার সম্পত্তি কী আছে দেখা যায়। তাই আপনি ট্যাক্স ঠিক করেন, দুর্নীতি অনেক কমবে। কারণ ট্যাক্সে প্রতিবছর আপনাকে জবাবদিহি করতে হচ্ছে। তাই দুর্নীতি ওখানে অনেক কমে যাবে।
যুগান্তর : ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর সরকারি দলের সাবেক ও বর্তমান ছয়জন সংসদ সদস্যের সম্পদের হিসাব নিয়েছিল দুদক...
ইকবাল মাহমুদ : সম্ভবত তিন-চারজনের অভিযোগ এখনও চলমান আছে। তবে এখনই নামটা বলতে পারব না। একটা জিনিস মনে রাখবেন, আমরা কমিশন কিন্তু নামটাম দেখি না। এ অভ্যাসটা আমরা করতে চাই না, নাম দেখে কাজ করা। আসলে ফ্যাক্ট দেখে কাজ করা উচিত। এ কারণে অনেক নাম মনে থাকে না। ওই ব্যক্তি কী করেছে সেটা দেখা উচিত, এ ক্ষেত্রে নামের বিষয়টাকে গুরুত্ব দিই না।
যুগান্তর : সামনে আমরা কি দেখব ক্ষমতাসীন, প্রভাবশালী যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আছে তাদের ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নিচ্ছেন?
ইকবাল মাহমুদ : আপনারা দেখছেন তো প্রভাবশালী যাদের অনেক বিত্তবৈভব রয়েছে, তারাও একটা মেসেজ পাচ্ছেন, সব সময়-সব দিন বিত্তবৈভব দিয়ে পার পাওয়া যায় না। আবার এটাও দেখেছেন বিশেষ করে গত বছর ২০১৬ সালে ক্ষমতা দেখিয়েও সব সময় পার পাওয়া যায়নি। বহু ক্ষমতাধর ব্যক্তিকে আমরা আইনের কাছে নিয়ে গেছি। বহু বিত্তবৈভবের মালিক এমন লোককেও আমরা আইনের কাছে নিয়ে গেছি।
যুগান্তর : এ ক্ষেত্রে ইন্দোনেশিয়ার অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে চাই। দেশটির দুর্নীতি নির্মূল কমিশন (কেপিকে) ২০০৪ থেকে ২০০৯- এ পাঁচ বছরে যাদের দুর্নীতির ঘটনা তদন্ত করেছে, বিচার প্রক্রিয়া ও অভিযোগ প্রমাণ করেছে তাদের মধ্যে ছিলেন ৪৫ এমপি, চারজন মন্ত্রী, চারজন প্রাদেশিক গভর্নর, একজন গভর্নর, তিনজন বিচারক, চারজন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর, ২৭ জন মেয়র, অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসের তিনজন প্রসিকিউটর, দূত ও কাউন্সেল জেনারেল এবং একজন পুলিশপ্রধান। আমাদের দেশে রাজনৈতিক সরকারের আমলে এমন নজির তো বলতে গেলে নেই।
ইকবাল মাহমুদ : সময় দিতে হবে আপনাকে। হুট করে একটা কিছু করলেন, এরপর আবার ফিরে আসবেন, এমন পরিস্থিতির মধ্যে আমরা কোনো সময় পড়তে চাই না। আমরা দেখেশুনে-বুঝে করতে চাই। আর ইন্দোনেশিয়ার প্রেক্ষাপট এক রকম, আমাদেরটা আরেক রকম। সেখানকার রাজনীতি, সামাজিক অবস্থা আরেক রকম। তাই ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে মেলালে হবে না। আবার ইন্দোনেশিয়ার অন্য চিত্র আপনারা জানেন কিনা। এখন ইন্দোনেশিয়ায় আগের মতো কেপিকে (দুর্নীতি নির্মূল কমিশন) কাজ করতে পারছে না। আমরা সে পর্যায়ে যেতে চাই না। ইন্দোনেশিয়ায় অনেক কিছু করেছে কেপিকে; কিন্তু কেপিকে এখন মোটামুটি একটা স্থবির প্রতিষ্ঠান। আমি যখন গিয়েছিলাম দেখেছি, তারা তখন মন্ত্রণালয়গুলোর সঙ্গে এমওইউ করছে যে তোমরা আমাদের তথ্য দেবে। অর্থাৎ দুর্নীতির বিরুদ্ধে আগে তাদের যে অ্যাপ্রোচ ছিল, সেখান থেকে সরে এসেছে। তাই আমরা সরে আসার অ্যাপ্রোচে যেতে চাই না। চিন্তাভাবনা ছাড়া এবং সবার সম্মতি ছাড়া আমরা ওই পর্যায়ে যাব না। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক, সামাজিক ও গণমাধ্যমের সম্মতি প্রয়োজন। যে কারণে আমরা বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠান করছি মানুষের সমর্থন আদায়ের জন্য। কারণ দুদকের জনবল কম। আমাদের জনবল মাত্র ১ হাজার ৭৩ জন, তদন্ত কর্মকর্তা ৩০০ আর কমিশন তিনজনের। তাই আমাদের বুঝতে হবে, এটার পক্ষে এতকিছু করা সম্ভব নয়।
যুগান্তর : কিন্তু এ সক্ষমতা দিয়েই উদাহরণ সৃষ্টি করার মতো কিছু কাজ কি দুদক করতে পারে না?
ইকবাল মাহমুদ : উদাহরণ সৃষ্টি হবে এবং হয়েছে। আপনারা এতদিন আমাদের প্রশ্ন করেছেন চুনোপুঁটি ধরছেন। কিন্তু বড় মাছ কি ধরিনি আমরা? গত এক বছরে যে ৪৩৮ জন গ্রেফতার হয়েছেন, এর মধ্যে ছোটও আছে, বড়ও আছে। তাই ওই প্রশ্নটা করার সুযোগ নেই যে, বড় নেই শুধু ছোট ধরছেন। তবে কমিশন কাউকে গ্রেফতারের কথা বলে না। এটা তদন্ত কর্মকর্তার সিদ্ধান্ত। মামলার অনুসন্ধান ও তদন্তের প্রয়োজনেই তারা অভিযান চালায়।
যুগান্তর : এ ক্ষেত্রে বেসিক ব্যাংকের দুর্নীতি মামলা নিয়ে দুদকের কার্যক্রমে প্রশ্ন রয়েছে। অভিযোগ আছে, ঋণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চু যুক্ত থাকলেও তাকে মামলার আসামি করা হয়নি। দীর্ঘদিন হলেও এখন পর্যন্ত এ সংক্রান্ত মামলাগুলোর তদন্ত রিপোর্ট দেয়া হয়নি।
ইকবাল মাহমুদ : এটি তদন্ত কর্মকর্তার বিষয়। আবদুল হাই বাচ্চুর কথা আমাকে কেউ বলেওনি। এটি সম্পূর্ণ নির্ভর করবে তদন্তের ওপর এবং তদন্ত কর্মকর্তার ওপর। আমাদের কাছে যদি সেটা আসে আমরা সেটা বিচার বিশ্লেষণ করব এবং সত্যিকার অর্থে যাদের বিরুদ্ধে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যাবে ব্যবস্থা নেয়া হবে। জড়িত নেই অথচ আমরা চার্জশিট দেব- এটা হবে না, এ বেআইনি কাজ আমরা করব না। আর আমি যতটুকু জেনেছি শিগগির বেসিক ব্যাংক দুর্নীতি মামলার তদন্ত রিপোর্ট দেয়া হবে।
যুগান্তর : বেসিক ব্যাংক দুর্নীতি নিয়ে আবদুল হাই বাচ্চুকে দায়ী করে সংসদে খোদ অর্থমন্ত্রী বক্তব্য রেখেছিলেন। সংসদীয় কমিটির অভিযোগের তীরও তার দিকে ছিল?
ইকবাল মাহমুদ : সেটা অন্য ইস্যু। মাঠের কথা এক রকম আর কাগজের কথা আরেক।
যুগান্তর : এ ছাড়া কমার্স ব্যাংকের একটি মামলায় আসামি ব্যাংক কর্মকর্তাদের কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হলেও মূল আসামি একজন এমপিকে গ্রেফতারে দুদকের পিছুটানের অভিযোগ আছে।
ইকবাল মাহমুদ : সেই এমপির ক্ষেত্রে কোনো বাধা ছিল না। আমাদের অভিযানের আগে সে জামিন নিয়ে ফেলেছে। এ ছাড়া সংসদ অধিবেশন চলার সময় কিছু বিধিবিধান আছে। আইনটা দেখতে হবে। তবে এতে একজন এমপিকে গ্রেফতারে কোনো বাধা আছে বলে আমি জানি না।
যুগান্তর : বিভিন্ন আমলেই দুদকের রাজনৈতিক ব্যবহার দেখা গেছে। বিশেষ করে বিরোধী দলে যারা থাকে তাদের বিরুদ্ধে দুদকের খড়গ নামে। অভিযোগ আছে, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার দুটি মামলা নিয়ে দুদক খুবই তৎপর; কিন্তু সরকারি দলের কারও কারও দুর্নীতি মামলার চার্জ গঠনই হচ্ছে না।
ইকবাল মাহমুদ : এটা দুদকের বিষয় নয়। এটা বিজ্ঞ আদালতের বিষয়। এ ব্যাপারে আমার কোনো মন্তব্য নেই। মামলা তদন্ত ও অনুসন্ধানের বিষয়ে আমার বক্তব্য আছে; কিন্তু মামলার চলমান প্রক্রিয়ায় বিজ্ঞ আদালতের সিদ্ধান্তে আমার কোনো প্রশ্ন নেই।
যুগান্তর : তাহলে কি দাবি করছেন রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে এখন দুদককে ব্যবহার করা হচ্ছে না?
ইকবাল মাহমুদ : এগুলো অনেক আগের কথা। এখন তো আর তাদের (বিএনপি) বিরুদ্ধে সেরকম অভিযোগ নেই। কারণ আগেরগুলোর তদন্ত হয়েছে, মামলা হয়েছে। আমি তো আর পুরনো জিনিস ঘেঁটে বের করব না। মানে পুরনো কিছু আর আমার কাছে নেই। আর রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক যখন জাতির উদ্দেশে ভাষণে বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশনকে শক্তিশালী করা হয়েছে, স্বাধীনভাবে কাজ করছে- কথা সম্পূর্ণ সত্য। আপনি এতক্ষণ বসে আছেন, কোনো টেলিফোন পেয়েছেন আমার মোবাইলে, আমার এখানে কী ফোন এসেছে? বাংলাদেশে তো অনেক লোক আছে সচিব-মন্ত্রী- এটা একটা উদাহরণ। কোনো রাজনৈতিক বা কোনো সামাজিক বা অর্থনৈতিক প্রভাব দুদকের ওপর নেই।
যুগান্তর : তাহলে চাইলেই স্বাধীনভাবে কাজ করা যায়?
ইকবাল মাহমুদ : অবশ্যই। করছিই তো, কেউ কিছু বলছে না। এটা ঠিক না যে, চাপ রয়েছে, এগুলো কিচ্ছু না। এগুলো হচ্ছে দায়িত্ব থেকে পলায়নপর মনোবৃত্তি। আর কাজ না করার জুজুর ভয়, হায় হায় কী হবে কী হবে?
যুগান্তর : দায়িত্বের প্রথম বছর ব্যাংক খাতের দুর্নীতির বিরুদ্ধে আপনাদের নজর বেশি ছিল।
ইকবাল মাহমুদ : ব্যাংক খাতে যথেষ্ট স্থিতিশীলতা এসেছে। ব্যবসায়ীদের জানাতে চাই, বাংলাদেশ ব্যাংক তার রিপোর্টে বলেছে, ক্রেডিট গ্রোথ ৬০ ভাগ হয়েছে। তাই এটা সত্য নয়, দুদকের কারণে ঋণ কমে গেছে। বরং দুদকের কারণে অনেক ক্ষেত্রে কু-ঋণ বন্ধ হয়েছে। জেনে খুশি হবেন, ব্যাংকগুলোর বোর্ড এখন খুব ভালোভাবে কাজ করছে। ব্যাংকাররাও খুব ভালোভাবে কাজ করছে। এটা আশার কথা। কারণ ব্যাংকিং সিস্টেম যদি নষ্ট হয়ে যায়, ব্যবসা বাণিজ্য, মানুষের ক্রয় সক্ষমতা, চাকরি সবকিছুই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেটা আমরা বুঝি। আমরাও চাই ব্যাংক অবশ্যই লোন দেবে। আমরা এটাকে সাপোর্ট দেব; কিন্তু ব্যাংক যাতে কু-ঋণের মধ্যে না পড়ে। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, আপনারা দেখছেন দুর্নীতিও কমছে- এটার প্রমাণ তো টিআই। টিআই এবার যে রিপোর্ট দিয়েছে সেই রিপোর্ট নিয়ে এবার কি কোনো প্রশ্ন উঠেছে? কেউ কি কোনো কথা বলেছে?
যুগান্তর : কিন্তু টিআইয়ের দুর্নীতির ধারণা সূচকে গড় স্কোর বা পাস নম্বর ৪৩। বাংলাদেশ এবারও ২৬ পেয়েছে, অর্থাৎ ফেল করেছে?
ইকবাল মাহমুদ : হ্যাঁ সেটা ঠিক আছে। পাস মার্ক আমরা পাইনি। শুধু আমরা না পাস মার্ক বহু দেশই পায়নি। দুর্নীতির এ করাল গ্রাসটা শুধু আমাদের দেশকে খাচ্ছে তা নয়, বহু দেশকেই খাচ্ছে। উন্নয়ন যত হবে, দুর্নীতির মাত্রাও বাড়তে থাকে, এটার লাগাম ধরে টেনে রাখাটাই হল দুর্নীতি দমনের কাজ। দুর্নীতি ও উন্নয়ন সমান্তরালভাবে এগোয়। এ ক্ষেত্রে উন্নয়নকে ছেড়ে দিয়ে দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরবেন কেন, দুটো ঘোড়াই একসঙ্গে চলবে- এটাই থিওরি।
যুগান্তর : দুদক সেই ঘোড়ার পেছনে দৌড়াতে বা লাগাম টেনে ধরতে কতটা সক্ষম?
ইকবাল মাহমুদ : আমরা দৌড়াতে পারছি। একটা সেন্স তো এসেছে, এটা করা ঠিক হবে না, এটা আইনের সমস্যা। দুর্নীতি দমন কমিশন যদি আবার ধরে, এমন ধারণা তো তৈরি হয়েছে, এটা তো সত্য।
যুগান্তর : সাধারণত সরকারি বড় বড় প্রকল্পে দুর্নীতির সুযোগ থাকে। এসব প্রকল্পে যাতে জবাবদিহিতা থাকে এজন্য সরকারকে দুদকের পক্ষ থেকে তদারকির প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। কোনো সাড়া পেলেন?
ইকবাল মাহমুদ : এখনও কোনো সাড়া আমরা পাইনি। প্রস্তাবনা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্রে আমরা বলেছি তারা যদি কোনো সাপোর্ট চায় বা আমাদের কোনো সহায়তা দরকার হয়- সেটার এখনও সাড়া পাইনি। তবে এনবিআর কিছু বিষয়ে সহায়তা চেয়েছে। কিছুদিন আগে এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ব্যাংক এসেছিল, তারা তাদের প্রকল্পে আমাদের সহায়তা সম্ভবত চাইবে। তবে সরকারি বড় বড় প্রকল্পে রেসপন্স আছে। সরকার যে এ বিষয়ে আন্তরিক তা বোঝা যায়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সবাইকে চিঠি দিয়েছে। লোক নিয়োগ, প্রকল্পের কেনাকাটায় প্রয়োজন হলে দুদকের সাহায্য নেয়ার জন্য। এখন তারা কী সাহায্য চাইবে এটা তাদের বিষয়- কিন্তু আমরা প্রস্তুত।
যুগান্তর : দুদকের পাঁচ বছরের কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণী মতবিনিময়ে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব নেয়ার সুপারিশ এসেছিল। এক্ষেত্রে কোনো উদ্যোগ আছে কি?
ইকবাল মাহমুদ : চিন্তা আছে; কিন্তু এটা একটা জটিল বিষয়। এটা সিঙ্গেল আউট করলে কিন্তু বিপদ হয়ে যাবে, যদি শক্তভাবে না করেন। এক্ষেত্রে একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত আসতে হবে। সেসব পর্যায়ের মানুষের সম্পত্তির হিসাব কীভাবে দেবে, কী প্রক্রিয়ায় দেবে এবং সেই হিসাব কী করবেন আপনি। আমার একটা অভিজ্ঞতা আছে, সম্পদের হিসাব চাওয়া হয়েছে, সবাই জমা দিয়েছে; কিন্তু এরপর কী হবে? ভারতের মতো দেশও কিছু করতে পারেনি। এক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনা কী হবে? তাই তারা ট্যাক্সের দিকে নজর দিয়েছে, আমরাও ট্যাক্সের দিকে নজর দিয়েছি। কারণ এটি একটি বিশাল বিষয়। সরকারি কর্মচারী ১২ লাখ; কিন্তু ব্যবসায়ী কত লাখ?
যুগান্তর : যেহেতু সাধারণ মানুষ সরকারি অফিসে বেশি ভুক্তভোগী, সরকারি প্রকল্পে দুর্নীতি হলে সাধারণ মানুষের বেশি ক্ষতি হয়। তাই তাদের সম্পদ নিয়েই বেশি কথা হয়?
ইকবাল মাহমুদ : শুধু সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী না বলে নাগরিকের কথা বলেন। দুর্নীতি শুধু সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী করছে না। যে কারণে আমি বলি যে দুর্নীতি শব্দটা আগে সংজ্ঞায়িত করা দরকার। ‘মিসইউজ অব পাওয়ার ইন পাবলিক অফিসার্স’ এই যে ডেফিনেশন এটা কতটুকু ভ্যালিড আই ডন্ট নো।
যুগান্তর : সরকারি কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে বিশেষ করে প্রশাসন ক্যাডারের কাউকে কাউকে ছাড় দেয়ার অভিযোগ আছে আপনার কমিশনের বিরুদ্ধে?
ইকবাল মাহমুদ : না, কোনো ছাড় নেই। কয়েকদিন আগেও তো সরকারি কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। একজন যুগ্ম সচিবও ছিলেন এর মধ্যে। যুগ্ম সচিব তো প্রশাসন ক্যাডারের নাকি? আপনারা সত্য ঘটনা বলেন, সেটা আমরা চাই। এখানে ক্যাডারের কোনো প্রশ্ন নেই। এখানে প্রশ্ন হল দুর্নীতি করেছেন কী করেননি। এখানে ক্যাডারের দিকে তাকিয়ে আমরা বসে নেই।
যুগান্তর : দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রমে রাজনৈতিক নেতাদের টুলস হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এক্ষেত্রে ইন্দোনেশিয়ার কথা বলছিলেন। কিন্তু দুদকের ৫ বছরমেয়াদি কর্মপরিকল্পনার মতবিনিময়ে রাজনৈতিক নেতাদের কিন্তু ডাকেননি। কেন?
ইকবাল মাহমুদ : আমাদের বিভিন্ন কর্মসূচিতে মাননীয় মন্ত্রী-এমপিরা আসছেন। যখনই আমরা ডাকছি ওনারা আসছেন। নিশ্চয়ই ওনারা অঙ্গীকার নিয়েই আসছেন। প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেমন রংপুরের মিঠাপুকুরে দুদকের কর্মসূচিতে একজন স্থায়ী কমিটির সদস্য ছিলেন। আমরা ধীরে ধীরে এগোচ্ছি। ওনারা আসছেন, দুর্নীতির ব্যাপারে ওনারা সোচ্চার হচ্ছেন। সংসদে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলছেন। ওনারা বলছেন, সরকার এক্ষেত্রে জিরো টলারেন্সে।
যুগান্তর : এক্ষেত্রে দুর্নীতিবিরোধী সংসদীয় ককাস হতে পারে কি? যেমনটি আমরা দেখছি আদিবাসী বিষয়ক ককাসের ক্ষেত্রে?
ইকবাল মাহমুদ : মাননীয় স্পিকারের সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা হতে পারে।
যুগান্তর : দুর্নীতিবিরোধী সচেতনতা তৈরি ও সরকারি সেবাখাতে জবাবদিহিতা আনতে দুদক গণশুনানি করছে; কিন্তু এতে কোনো কোনো সেবাখাতে ঘুষের রেট বেড়ে যাওয়ার অভিযোগ রয়েছে?
ইকবাল মাহমুদ : গণশুনানিতে আমাদের যে ত্রুটি ছিল তা হল আগে এতে ফলোআপ করা হতো না। আমরা এখন ফলোআপ করছি। রাজউকের গণশুনানির ফালোআপ হয়েছে। সেখানে দেখা গেছে শতকরা পঞ্চাশ ভাগ কাজ হয়েছে। আমরা একটা স্টাডি করছি ইমপ্যাক্ট স্টাডি, সেটা দেখলে আমরা বুঝব কী হচ্ছে।
যুগান্তর : এছাড়া ২০টিরও বেশি সেবাখাতের দুর্নীতি-অনিয়ম তদারকিতে টিম গঠন করেছেন। এর প্রভাব কতটা? অতীতের অভিজ্ঞতা কিন্তু এসব ক্ষেত্রে ভালো নয়।
ইকবাল মাহমুদ : আমরা সফল হব ইনশাআল্লাহ। এটা ছোট্ট একটা বিষয়, দুর্নীতির ক্ষেত্রগুলো বের করা, ছিদ্রগুলো বের করা। আমরা রিভিউ মিটিং করেছি, ছিদ্রগুলো বন্ধ করার সিস্টেমিক যে ইমপ্র“ভমেন্ট সেটা আমরা করব। কারণ আমাদের দুর্নীতিবিরোধী চোখ আছে, ওই ডিপার্টমেন্টগুলোর তা নেই। যেহেতু আমরা দুর্নীতি নিয়ে কাজ করছি, আমরা বুঝতে পারব যে দুর্নীতির উৎসগুলো কী কী। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, পেনশনের কথা। পেনশন নিয়ে অনেক কথা হয় এবং দুর্নীতিও হয়। একটা সিস্টেম যদি থাকে, সিস্টেমের গলদটা কোথায়, ঘুষটা কোথায় নেয়া হচ্ছে সেটা বের করার জন্য কাজ করছি আমরা। আমার স্থির বিশ্বাস এটা একটা ভালো ফল বয়ে আনবে।
যুগান্তর : এক্ষেত্রে দুর্নীতির তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেলে কি আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে, নাকি শুধু সুপারিশমূলক রিপোর্টই দেয়া হবে?
ইকবাল মাহমুদ : আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে; কিন্তু মূল বিষয়টা হবে সিস্টেমিক ইমপ্রুভমেন্টের জন্য আমরা কেবিনেট ডিভিশনকে অনুরোধ করব।
যুগান্তর : ফাঁদ পেতে ঘুষখোর ধরার অভিযান চালাচ্ছে দুদক। এর প্রভাব কতটা?
ইকবাল মাহমুদ : এটা খুব ভালো প্রভাব ফেলছে বলে আমরা মনে করছি। এখন ঘুষ নিতে বেশ সাবধান থাকে মানুষ। আগে হয়তো অফিসে টেবিলে বসেই ঘুষ নিত, এখন সেটা নেয় না। যতটুকু জেনেছি অফিসে বসে ঘুষ নিয়ে অফিসকে আর অপবিত্র করতে চায় না, বাইরে কোথায় কিছু করে। বাইরে কোথায় কী হচ্ছে তা-ও আমরা নজরদারিতে রাখছি, ফাঁদ পাতছি।
যুগান্তর : শুধু দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়াই নয়, এসব ক্ষেত্রে দুদকের জবাবদিহিতার প্রশ্নও আছে না?
ইকবাল মাহমুদ : আইনে একটা কমিটি করার কথা আছে। এখন সেই কমিটি আপনি করবেন কী করবেন না, আমরা এখনও চিন্তা করিনি। তবে জবাবদিহিতার বিষয়টা পরিষ্কার। আমরা একটা রিপোর্ট দেই। রিপোর্টটা পার্লামেন্টে যায়। পার্লামেন্টে ডিবেট হয়ে একটা গাইডলাইন হয়ে আসার কথা।
যুগান্তর : কিন্তু দুদকের রিপোর্ট নিয়ে পার্লামেন্টে ডিবেটের নজির বলতে গেলে নেই।
ইকবাল মাহমুদ : আমরা আশা করি এটা নিয়ে ডিবেট হবে। আমরা চাই ডিবেট হোক। আমরা চাই সংসদ থেকে একটা গাইডলাইন আসুক যে আমরা কীভাবে কার্যক্রম চালাব। আমরা চাই জবাবদিহিতার আওতায় আসতে, চাই সমালোচনা এবং সেটি যেন গঠনমূলক হয়। আমরা চাই আমাদের এখানে কী দুর্নীতি হয় সেটা নিয়ে আপনারা রিপোর্ট করেন।
যুগান্তর : দুর্নীতি প্রতিরোধে নতুন আর কী কী পদক্ষেপ নিচ্ছেন?
ইকবাল মাহমুদ : আমরা আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন চেয়েছি। হাজতখানা তৈরি হচ্ছে। এছাড়া মানুষ যাতে সহজে অভিযোগ জানাতে পারে এজন্য হটলাইন হচ্ছে। ১০৬ নম্বরে ফোন করে ভুক্তভোগীরা বিনা খরচে তাদের অভিযোগ আর সমস্যার কথা দুদককে জানাতে পারবেন। এরই মধ্যে ক্যাপাসিটি বিল্ডিং-এর মাধ্যমে ৪০০ মানুষকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে বেস্ট প্রাকটিসের জন্য।
যুগান্তর : এসব ক্ষেত্রে সরকারের আর্থিক সহযোগিতা কতটা পাচ্ছেন?
ইকবাল মাহমুদ : শতভাগ সহযোগিতা পাচ্ছি। আমার বিশ্বাস আগামী দিনেও সরকার কমিশনকে সাপোর্ট দেবে।
যুগান্তর : ধন্যবাদ আপনাকে।
ইকবাল মাহমুদ : ধন্যবাদ।
যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন