অধ্যাপক শাহিদুজ্জামান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক। প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন ভারত সফর এবং চীনের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের নানান দিক নিয়ে নয়া দিগন্ত প্রতিনিধির সাথে কথা বলেছেন। অধ্যাপক শাহিদুজ্জামানের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নয়া দিগন্তের সহকারী সম্পাদক আলফাজ আনাম
নয়া দিগন্ত : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরে যাচ্ছেন। এবারের সফরের তাৎপর্য কী?
শাহিদুজ্জামান : নীতিগতভাবে আমি মনে করি, বাংলাদেশের স্বার্থ যদি চিন্তা করা হয়, এই সফরের মূল বিষয় হওয়া উচিত তিস্তা নদীর পানি বণ্টন। সুস্পষ্টভাবে ভারতকে এটুকু জানিয়ে দেয়া- এ বিষয়ে একটি অঙ্গীকার ছিল এবং বাংলাদেশ উত্তর-পূর্ব ভারতের নিরাপত্তার প্রশ্নে বড় ধরনের কৌশলগত সহযোগিতা ভারতকে দিয়েছে। বাংলাদেশের মানুষও আশা করেছিল ভারত বাংলাদেশের স্বার্থ দেখবে। এ বিষয়ে যে দীর্ঘসূত্রতা এবং ইচ্ছাকৃতভাবে তিস্তা বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত না নেয়াটা দুঃখজনক। এখন আমরা জানতে পারছি প্রণব মুখার্জি মধ্যস্থতা করতে পারেন। এ প্রক্রিয়া তো অনেক আগেই শুরু করা উচিত ছিল। নরেন্দ্র মোদি কেন মমতা ব্যানার্জির দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে পদক্ষেপ নিলেন না? বলতে গেলে বাংলাদেশের স্বার্থকে একেবারেই অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। বাংলাদেশ যত সহজে উত্তর-পূর্ব ভারতের নিরাপত্তার ব্যাপারে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, তার মূল্য একমাত্র তিস্তা সমস্যা সমাধানের সাথে মিলতে পারে বা অর্থবহ হতে পারে। এই অর্থবহ প্রক্রিয়াকে ব্যবহার না করে ভারত কালক্ষেপণ করছে। এমনকি অনেকের মনে এই ধারণা আছে- তিস্তার ব্যাপারে ভারত শেষ পর্যন্ত দীর্ঘমেয়াদি কোনো চুক্তিই করবে না।
নয়া দিগন্ত : কেন এমন ধারণা হচ্ছে?
শাহিদুজ্জামান : ভারতের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা রয়েছে তিস্তার পানির প্রবাহের গতি পরিবর্তন করে আন্তঃনদী সংযোগের মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গসহ বিহার বা আশপাশের এলাকার কৃষির জন্য ব্যবহার করা। সে দিক থেকে দেখতে গেলে আন্তর্জাতিক আইনের যে লঙ্ঘন ভারত করে আসছে, তার ধারাবাহিকতা হয়তো বজায় রাখবে।
নয়া দিগন্ত : তিস্তা তো আমাদের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ; কিন্তু ভারতের দিক থেকে একটি প্রতিরক্ষা চুক্তির বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করা হয়েছে। এর কারণ কী?
শাহিদুজ্জামান : প্রতিরক্ষা চুক্তির বিষয়টি কেন ভারত এত বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে, তা বোধগম্য নয়। তবে এ কথা বলা যায়, বিজেপি সরকার ভারতে এখন যে নতুন নেতৃত্ব গড়ে তুলছে তারা নতুন ধরনের কৌশলগত উৎকর্ষ অর্জনের জন্য একান্তভাবে বাংলাদেশকে ব্যবহার করতে চায়। বাংলাদেশকে এখন ভারতের আঞ্চলিক কৌশলগত চিন্তাধারায় জালে মাছ ধরার মতো করে আটকে ফেলতে চায়। ইতোমধ্যে আমরা দেখছি, নেপাল ও শ্রীলঙ্কাকে দীর্ঘ সময় ধরে ভারত নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা বলয়ে নেয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল তা চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হতে যাচ্ছে। মাত্র কয়েক দিন আগে চীনা প্রতিরক্ষামন্ত্রী নেপাল ও শ্রীলঙ্কা সফর করেছেন। এ সময়ে তিনি বাংলাদেশেও আসতে পারতেন। কিন্তু তিনি আসেননি। বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতের এ ধরনের আচরণে চীন ক্ষুব্ধ। বাংলাদেশকে সম্প্রতি দুটো সাবমেরিন দেয়া সত্ত্বেও চীনা প্রতিরক্ষামন্ত্রী ঢাকা এলেন না। বরং রোহিঙ্গা প্রশ্নে নিরাপত্তা পরিষদে মিয়ানমারের পক্ষে চীন ভেটো দিয়েছে। রাশিয়াও চীনের সাথে যোগ দিয়েছে। রোহিঙ্গা বিষয়ে চীনের যে বিশেষ দূত ঢাকা আসার কথা তিনি হঠাৎ করে তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে আসেননি। সব কিছু মিলিয়ে বলা যায় চীন কিছুতেই এ দিকগুলো পছন্দ করেনি। এমনকি চীন ভারতকেও এমন বার্তা দেয়ার চেষ্টা করছে, দেশটির এই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণযোগ্য নয়।
নয়া দিগন্ত : তাহলে কি চীনের সাথে বাংলাদেশের যে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, তা থেকে বের করে আনতে প্রতিরক্ষা চুক্তির আগ্রহ দেখাচ্ছে ভারত?
শাহিদুজ্জামান : একদম ঠিক। এতে কোনো সন্দেহ নেই। ভারতের এই পরিকল্পনা অবাস্তব, কৃত্রিম ও সামর্থ্যহীন একটি প্রয়াস। ভারতের অত্যন্ত করুণ অতীত অভিজ্ঞতা রয়েছে মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কায়। এই দুই দেশে ভারতীয় বাহিনী পাঠিয়ে সেখানে রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করার পর তাদেরকে যেভাবে বহিষ্কার করা হয়, রাজিব গান্ধী তখন প্রাণ দিয়েছেন। সে সময়ের কথা আমার মনে পড়ে, তখন ভারতের অবস্থা ছিল ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি বলে আর্তনাদ করে উঠেছিল। তখন মনে হয়েছিল, ভারত আর কখনো পাশর্^বর্তী দেশের নিরাপত্তাব্যবস্থায় জড়াবে না। নেপালের ভূখণ্ড যেহেতু চার দিক থেকে ভূমিবেষ্টিত, সে কারণে নেপালে ভারত বারবার সুযোগ নিয়েছে। কিন্তু নেপালের জনগণ ভয়াবহভাবে অতিষ্ঠ ভারতের হস্তক্ষেপের প্রবণতায়। নেপাল যখন চীনের সাথে প্রতিরক্ষা সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে তখন ভারত নগ্নভাবে বাধা দেয়ার চেষ্টা করেছে। এ কারণে দেখা যায়, নেপালের সাম্প্রতিক সরকারগুলো ভারতের চাপের পরও কিন্তু চীনের সাথে প্রতিরক্ষা সম্পর্ক বজায় রাখতে সচেষ্ট। একই ধারাবাহিকতায় চীনের সাথে বাংলাদেশের যে দীর্ঘ সময় থেকে নিরাপত্তা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, সেখানে ভারত বাধা দেয়ার চেষ্টা করেছে।
নয়া দিগন্ত : ভারত তো বাংলাদেশকে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা দিতে চাইছে...
শাহিদুজ্জামান : ভারতের ভূমিকা দ্বৈতমূলক। শোনা যাচ্ছে সাড়ে তিন শ’ মিলিয়ন প্রতিরক্ষা সহায়তা ঋণ দেবে। এটা তো ভারতের সামর্থ্যকে বাধাগ্রস্ত করছে। বাংলাদেশের এই অর্থের কোনো প্রয়োজন নেই। আমাদের অর্থমন্ত্রী বা সরকারের তরফ থেকে কখনো বলাও হয়নি যে ভারতের ঋণসহায়তা কাম্য। বরং অতীতের দেয়া দুই বিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়ে বাংলাদেশ ক্লান্ত। ভারতের সেই ঋণের বোঝা ব্যবহার উপযোগী করার ব্যাপারে ভারত যে অনীহা দেখিয়েছে, নিম্নমানের জিনিসপত্র বাংলাদেশে পাঠিয়েছে, এরপর এ ধরনের ঋণের ব্যাপারে বাংলাদেশের কোনো আগ্রহ নেই। তার পরও আজকের কাগজে খবর জানলাম- সাড়ে তিন মিলিয়ন ডলার দিতে চাইছে। এই ঋণের কোনা প্রয়োজন নেই। বাংলাদেশের এখন একমাত্র এবং গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ হচ্ছে তিস্তার ব্যাপারে একটি ব্যবস্থা নেয়া।
নয়া দিগন্ত : বলা হচ্ছে তিস্তাচুক্তির ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার একটি বাধা।
শাহিদুজ্জামান : না। ভারতকে এখন বলতে হবে যে আসলে তারা তিস্তাচুক্তি করবে, নাকি করবে না। এত দিন ধরে বলা হয়েছে, ভারতের সংবিধানে বাধা রয়েছে যে রাজ্য সরকারের অনুমতি লাগবে। এই বাধাও কিন্তু বিশেষভাবে অতিক্রম করা যায়। যদি জাতীয় স্বার্থ বা নিরাপত্তার স্বার্থ থাকে, তখন রাজ্য সরকার ভিন্নমতাবলম্বী হলেও ভারতের প্রধানমন্ত্রী পার্লামেন্টের মতামতসাপেক্ষে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। ভারতের রাষ্ট্রপতি এ বিষয়ে অনেক আগে থেকেই কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারতেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত সে রকম কোনো পদক্ষেপ তিনি নেননি। সব মিলিয়ে দেখা যায়, বাংলাদেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ তিস্তার পানি নিয়ে ভারত একধরনের খেলা করছে। আমি কয়েক দিন আগে জানতে পারলাম- তিস্তার পানিপ্রবাহে যদি কোনো বাধা না থাকত তাহলে শুধু বাংলাদেশের চাহিদা পূরণ করত না, দক্ষিণ দিক থেকে যে লবণাক্ততা দেখা দিচ্ছে তার ঝুঁকিও অনেকাংশ কমিয়ে দিত। প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় সে রকম হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু ভারত তা অসম্ভব করে তুলেছে। এ ধরনের আচরণকে সুস্পষ্টভাবে শত্রুতার আচরণ ছাড়া আমি আর কিছুই আখ্যায়িত করতে পারি না।
নয়া দিগন্ত : প্রতিরক্ষা সহযোগিতা প্রসঙ্গে আসি, গণমাধ্যমে খবর এসেছে বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা বিষয়ে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করতে চায় বিষয়টি কিভাবে দেখছেন?
শাহিদুজ্জামান : এটা মোটেও কাঙ্ক্ষিত নয়। এ ধরনের সমঝোতার প্রস্তাব আমাদের দিক থেকে কখনো দেয়াই হয়নি। বরং আভাসে-ইঙ্গিতে বাংলাদেশ বারবার বলে যাচ্ছে যে, কোনো রকমের সমঝোতা স্মারক বা চুক্তির প্রয়োজন নেই। কেননা, ভারতের কোনো প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম আমাদের দেশে আসুক, এটা চাই না। সম্প্রতি আমরা দেখছি নানা অজুহাতে ভারতের সেনাবাহিনীর সদস্যরা বাংলাদেশে প্রবেশ করছেন। তারা সাইকেল চালিয়ে যান, যৌথ মহড়া করতে আসছেন, আমাদের তো এগুলোর কোনো প্রয়োজন নেই। ভারত যদি নিজের স্বার্থে সীমান্ত বন্ধ করতে চায়, যা তাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন, সেটাই তো তারা করবে। সমঝোতা তো দূরের কথা ভারত বাংলাদেশে দ্বৈতনীতি প্রয়োগ করছে। এক দিকে প্রদর্শনমূলক নীতি যেখানে তারা বলছে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা দেবে, দুই দেশের সেনাবাহিনী একসাথে ট্রেনিং করবে, বাংলাদেশে অস্ত্র বিক্রি করবে- এটা হলো বাইরের দিক; কিন্তু এটাই কি ভারতের আসল প্রতিরক্ষা নীতি? মোটেও না। ভারতের যে আসল প্রতিরক্ষা নীতি তা পুরোপুরি স্বার্থভিত্তিক অত্যন্ত কট্টর নীতি। ভারতের আসল নীতির দিকে আমাদের লক্ষ রাখতে হবে। ভারত অত্যন্ত দ্রুত একটি ধর্মরাজ্যে পরিণত হচ্ছে। যাকে আমরা বলি থিওলজিক্যাল স্টেট। এই ধর্মরাজ্যের পরিণতিতে ভারত এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠীকে বড় রকমের হুমকি হিসেবে দেখছে। এ কারণে রাজনাথ সিং বারবার বলে আসছেন, ২০১৮ সালের মধ্যে সীমান্ত বন্ধ করা হবে। প্রথমে তিনি বাংলাদেশের কথা বললেন, তারপর পাকিস্তানের কথা বললেন। এখন ভারত আমাদের কাছে প্রতিরক্ষা সমঝোতা চায় আবার পাকিস্তানের মতো বাংলাদেশের সীমান্ত বন্ধ করতে চায়। এক দিকে বাংলাদেশের সাথে কানেকটিভিটি চাচ্ছে, ট্রানজিট চুক্তি চাচ্ছে আবার বর্ডার সিল করার কথা বলছে। এর অর্থ হচ্ছে, সীমান্তে কোনো যোগাযোগ থাকবে না। দেয়াল তুলে দেয়া হবে। তাহলে ভারতের আসল নীতি কী? আসল নীতি হচ্ছে একদম স্বার্থভিত্তিক প্রতিরক্ষা নীতি, বাংলাদেশে যেকোনো উপায়ে সেনাবাহিনী অনুপ্রবেশ করার মতো সামর্থ্য ও আইনগত প্রক্রিয়া অর্জন করা। ভারতের আসল নীতিতে মোটেই বন্ধুত্বের পরিচয় নেই।
নয়া দিগন্ত : দুই দেশের সম্পর্কে কি বন্ধুত্বের ভিত্তি দেখছেন না?
শাহিদুজ্জামান : কোথায়? প্রতিটি ক্ষেত্রে তারা বাংলাদেশের উন্নত মানের প্রযুক্তি কেনার ক্ষেত্রে বাধা দিয়েছে। দুটো চীনা সাবমেরিন কেনার পর তারা আপত্তি তুলছে। এর আগে দক্ষিণ কোরিয়া থেকে আরেকটি ফ্রিগেট কেনার কথা ছিল, তা চাপ দিয়ে বন্ধ করে দিয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রদূত নিজে আমাকে কয়েক দিন আগে তা জানালেন। আমেরিকা আমাদের একটি কার্টার শিপ দিয়েছে, অত্যন্ত দ্রুতগতিসম্পন্ন এই যান নৌবাহিনী ব্যবহার করে। দ্বিতীয় আরেকটি দেয়ার কথা ছিল সেটিও ভারতের চাপে আমেরিকা দেয়নি।
নয়া দিগন্ত : প্রধানমন্ত্রীর সফরের আগে ভারতের সেনাপ্রধান আসছেন। এটা কি কাকতালীয় কিছু?
শাহিদুজ্জামান : তিনি হয়তো কৌশলগতভাবে নতুন কিছু প্রস্তাব নিয়ে আসবেন। তার উদ্দেশ্য হচ্ছে, বাংলাদেশের ভেতরে যাতে ভারতের সেনাবাহিনীর সদস্যরা মহড়া করতে পারেন। এটা আমাদের দেশের মানুষের জন্য অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়। কোনোভাবেই ভারতীয় সেনাবাহিনীর উপস্থিতি এ দেশের মানুষ মেনে নেবে না। সরকারের বোঝা উচিত এ দেশের মানুষ ভারতকে কোন চোখে দেখে। ভারতের সেনাবাহিনীপ্রধান অন্যান্য দেশেও যান, হয়তো এখানেও আসছেন- এ দেশের মানুষ অনেক বেশি খুশি হতো চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী যদি বাংলাদেশ সফরে আসতেন। যিনি কয়েক দিন আগে নেপাল ও শ্রীলঙ্কা সফর করেছেন। তিনি যদি বাংলাদেশ সফরে আসতেন তাহলে আরো অর্থপূর্ণ ও প্রতিরক্ষা প্রয়োজনের জন্য বাস্তবসম্মত হতো। ভারতের সেনাপ্রধানের বাংলাদেশ সফরে কী প্রয়োজন আমরা জানি না। তার দেশের প্রতিরক্ষা সামর্থ্য যথেষ্ট দুর্বল ও অপ্রতুল; বিশেষ করে ভারতের সামরিক বাহিনীর ভেতরে দুর্নীতির বিষয় বহুবার কাগজে এসেছে। বিভিন্ন সময়ে ভারতে নি¤œমানের অস্ত্রের মজুদে বিস্ফোরণ ঘটে। কিছু দিন আগে রাজস্থানে এমন ঘটনা ঘটেছে। বিভিন্ন সময়ে ভারতের পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে পারমাণবিক তেজস্ক্রিয়তা নিঃসরণ হয়, যা খুবই ভয়াবহ। এগুলো আমরা জানি। নিম্নমানের ভারতীয় প্রতিরক্ষাপ্রক্রিয়ায় আমাদের ভাগিদার করার কোনোভাবেই আমাদের প্রয়োজন নেই। এ ধরনের প্রস্তাব আমাদের জন্য খুবই বিব্রতকর।
নয়া দিগন্ত : তাহলে চীন ও ভারতের মধ্যে ভারসাম্যমূলক অবস্থান নিতে বাংলাদেশ কি ব্যর্থ হচ্ছে মনে করেন?
শাহিদুজ্জামান : দেখুন চীনের ব্যাপারে ভারত যে নীতি নিয়েছে তা উদ্বেগজনক। চীনের সব প্রয়াসে ভারত প্রতিবাদ করে। চীনের সাথে আমাদের ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে। শত বছরের পুরনো সম্পর্ক। ভারত সেখানে বাগাড়ম্বর করার কে? পাকিস্তানের সাথে চীনের ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড কার্যক্রমকে মোদি সরকার প্রত্যাখ্যান করে। অথচ এর আগে কংগ্রেস সরকারের আপত্তি থাকলেও সেটা মেনে নিয়েছিল। চীন বারবার ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোডের অর্থনৈতিক গুরুত্ব ও বাস্তবতা তুলে ধরেছে। চীনকে ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগর থেকে দূরে রাখতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাধ্যমে ভারত ব্যবহৃত হচ্ছে। ভারতের এই নীতি আত্মঘাতী। এর সাথে আমাদের কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে না।
ভারত যদি এই পথে যায়, তাহলে তারা কিভাবে চীনকে মোকাবেলা করবে? ভারত এক দিকে চায় চীনের অর্থনৈতিক সাহায্য। খবর বেরিয়েছে মোদি সরকার নাকি চীনের মাধ্যমে সমগ্র ভারতে বুলেট ট্রেন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চায়। চীনের সহযোগিতা যদি ভারত চায়, তাহলে চীনের সাথে এই প্রতিযোগিতায় নামার তো কোনো অর্থ হয় না। চীনের প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফরের সময় যেসব প্রতিশ্রুতি আমরা পেয়েছি, তা বাধাগ্রস্ত করাই যেন এখন ভারতের উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলাই হচ্ছে ভারতের মূল উদ্দেশ্য- এটা সাধারণ জ্ঞানে বোঝা যায়।
আমরা আলাদা দেশ, আমাদের আলাদা ইতিহাস ও সংস্কৃতি রয়েছে। আমাদের এখন যে প্রক্রিয়া চলছে তা হলো, ভারতের সাথে আগে যেসব ভুলবোঝাবুঝি ছিল তা কমিয়ে আনা। একটা সহনশীল প্রক্রিয়া গড়ে তোলা। কিন্তু সেই সুযোগে ভারত যদি এখন আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নগ্নহস্তক্ষেপ করে, তাহলে ভুল হবে। মনে রাখতে হবে ভারত কিন্তু শ্রীলঙ্কায় নাকে খত দিয়েছে। এখন নেপালে দিচ্ছে। বাংলাদেশ জনসংখ্যায় পৃথিবীর সপ্তম বৃহৎ দেশ। এ দেশকে এভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা তাদের ভুল সিদ্ধান্ত। বৃহৎ শক্তি হিসেবে দেখানোর এই প্রচেষ্টা নিতান্ত প্রদর্শনমূলক। এর কোনো ভিত্তি নেই, কার্যকারিতা নেই। আমাদের স্বার্থ হচ্ছে প্রতিবেশী হিসেবে যেসব সমস্যা রয়েছে, সেগুলো সমাধান করা। বঙ্গোপসাগরের সীমানা নির্ধারণ যেমন আন্তর্জাতিক আইনের মাধ্যমে সম্ভব হয়েছে, এখন তিস্তা প্রশ্নে যাতে সম্ভব হয় সে চেষ্টা করা। আমার মনে হয় প্রধানমন্ত্রী সে চেষ্টাই করবেন। প্রধানমন্ত্রী ভারতে যাচ্ছেন- আমি মনে করি, এখনি দরকার তিস্তা ইস্যু ভারতের সামনে তুলে ধরা। এ ব্যাপারে তিনি যদি না এগোতে পারেন তাহলে আগামী নির্বাচনে মানুষের কাছে কী জবাব দেবেন? ভারতের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে মানুষ কী চায়, প্রধানমন্ত্রী বা সরকার নিশ্চয়ই তা বুঝতে পারছেন।
নয়া দিগন্ত : আপনাকে ধন্যবাদ।
শাহিদুজ্জামান : আপনাকেও।
নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন