অধ্যাপক রোহান গুণারত্নে সিঙ্গাপুরের ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর পলিটিক্যাল ভায়োলেন্স অ্যান্ড টেররিজম রিসার্চের প্রধান। সম্প্রতি ঢাকায় অনুষ্ঠিত পুলিশ প্রধানদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন গোলাম মর্তুজা
প্রথম আলো: আপনি বলেছেন হলি আর্টিজানে হামলায় আইএস জড়িত। ওই হামলার পর বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে তামিম চৌধুরীসহ জঙ্গিদের গুরুত্বপূর্ণ অনেক নেতা নিহত হয়েছেন, অনেকে গ্রেপ্তার হয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে আইএসের দিক থেকে বাংলাদেশের জন্য কোনো হুমকি দেখেন কি?
রোহান গুণারত্নে: কথিত ইসলামিক স্টেটের (আইএস) জন্মভূমি ইরাক ও সিরিয়াতেই এর পরিধি কমে আসছে। অস্তিত্ব বজায় রাখতে আইএস অন্য দেশগুলোয় বিস্তার লাভের চেষ্টা করছে। তাই আগামী ৫ থেকে ১০ বছরের মধ্যে আমরা আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ায় আইএসের বিস্তার দেখতে যাচ্ছি। বিশেষ করে, মুসলিম দেশগুলো এর দ্বারা আক্রান্ত হবে। বাংলাদেশের জন্য সন্ত্রাসবাদের হুমকিটাও দীর্ঘ মেয়াদে থাকবে। বাংলাদেশের পুলিশসহ অন্য নিরাপত্তা বাহিনীগুলো খুবই কার্যকর। কিন্তু এদের দিয়ে এই হুমকি ধ্বংস বা শেষ করা যাবে না। এই হুমকি চলমান, এটা কমছে না বা শেষ হচ্ছে না। কারণ, বাংলাদেশের যেসব আইএস সদস্য ইরাক ও সিরিয়ায় রয়েছেন, তাঁরা অনলাইনে আসছেন এবং অন্যদের আইএসে যুক্ত করছেন।
প্রথম আলো: কারা যুক্ত হচ্ছেন?
রোহান: শুধু দেশে বসবাসকারীদেরই নয়, দেশের বাইরে বসবাসকারী বাংলাদেশিদেরও তাঁরা যুক্ত করছেন। তাঁরা তহবিল সংগ্রহ করছেন। দেশে সুসংগঠিত নেটওয়ার্ক তৈরি ও হামলা চালাতে উৎসাহ জোগাচ্ছেন। বাংলাদেশের অভ্যন্তরের ওই নেটওয়ার্কগুলো একে অন্যের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে এবং দল গঠন করছে। তাই এটা সরকারের জন্য স্বীকার করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে আইএস এখানে কাজ করছে। কারণ, হলি আর্টিজানের হামলাই শেষ হামলা, এটা বলা যাচ্ছে না। যদিও তাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সরকার খুবই কার্যকর যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সন্ত্রাসবাদের এই চরিত্র অবশ্যই বুঝতে হবে যে এটা একটা দীর্ঘমেয়াদি হুমকি। এ জন্য এটা স্বীকার করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
প্রথম আলো: আপনি বলেছেন, শুধু বাংলাদেশ থেকেই নয়, বিদেশে বসবাসকারী বা অনাবাসী বাংলাদেশিরাও আইএসে যোগ দিচ্ছেন। আপনি কি এর একটা সংখ্যাগত ধারণা দিতে পারেন?
রোহান: অনাবাসী বাংলাদেশিদের অনেকেই এখন ইরাক ও সিরিয়ায় আছেন। তাঁদের কাউকে ভিডিওতেও বাংলাদেশকে হুমকি দিতে দেখা গেছে। এ রকম অনেক বাংলাদেশি সেখানে রয়েছেন। সরকারের উচিত এখন সে ব্যবস্থা নেওয়া, যাতে তাঁদের কেউ বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে উঠতে না পারেন।
প্রথম আলো: আল-কায়েদার আদর্শ অনুসরণকারীদের দিক থেকে বাংলাদেশের কী ধরনের হুমকি রয়েছে বলে আপনি মনে করেন?
রোহান: এ দেশে আনসার আল ইসলাম বা আনসারুল্লাহ বাংলা টিম আল-কায়েদার আদর্শ অনুসরণ করে। তাদের দিক থেকেও একটা ঝুঁকি আছে, তবে আইএসের মতো অতটা জোরালো নয়।
প্রথম আলো: সন্ত্রাসবাদ দমনে বাংলাদেশের কী ধরনের পদ্ধতি গ্রহণ করা উচিত?
রোহান: পুলিশি অভিযানের পাশাপাশি কৌশলগত পদক্ষেপসহ অন্যান্য কর্মসূচিও হাতে নিতে হবে। অপারেশনাল (অভিযান) পদ্ধতিটা হচ্ছে ধরা, মারা ও ধ্বংস করা। আর কৌশলগত পদক্ষেপটা (স্ট্র্যাটেজিক রেসপন্স) হচ্ছে সমাজের বিভিন্ন অংশকে যুক্ত করে সন্ত্রাসবাদবিরোধী কর্মসূচি তৈরি করা এবং আধুনিকতাকে উৎসাহিত করা। কারাগার ও হেফাজতে থাকা ব্যক্তিদের জঙ্গি মতবাদ থেকে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিয়ে যেতে হবে। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটা না করা হলে তাঁরা আবারও নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবেন। অন্যদেরও তাঁদের মতবাদ দিয়ে প্রভাবিত করবেন। এ প্রক্রিয়াগুলো ঠেকানোর জন্য বাংলাদেশ সরকারের উচিত জরুরি ভিত্তিতে কারাগারের অভ্যন্তরের জন্য এমন কর্মসূচি হাতে নেওয়া, যেখানে ধর্মীয় আলেমদের আনা হবে এবং শিক্ষকদের কাজে লাগাতে হবে। পরিবার ও সমাজের সঙ্গে তাঁদের পুনরায় যোগাযোগ ঘটিয়ে দিতে হবে। কারণ, জঙ্গিবাদে যুক্ত হওয়ার পরে অনেকেই পরিবার ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। পারিবারিক বন্ধনের মাধ্যমে তাঁদের মূলধারায় ফেরানোর চেষ্টা চালাতে হবে। তাঁদের উদ্বেগ, অবসাদ ও ঘৃণাগুলোর চিকিৎসা করতে হবে। দেশের সেরা শিল্পীদের কারাগারে নিতে হবে। গান-বাজনা, সুর ইত্যাদি দিয়ে থেরাপি দিতে হবে। তাঁদের মন যেন বাংলাদেশের নিজস্ব সংস্কৃতিটা গ্রহণ করতে পারে, যেটা থেকে তাঁরা দূরে রয়েছেন। তাঁদের ক্রীড়া প্রশিক্ষক দিয়ে প্রশিক্ষণের সুযোগ দিতে হবে। এ ছাড়া তাঁরা যাতে দ্বিতীয়বার জীবনে ফিরতে পারেন, সে জন্য তাঁদের বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে।
প্রথম আলো: বাংলাদেশের আলেমদের নিয়ে ইতিমধ্যে সন্ত্রাসবাদবিরোধী প্রচারণা শুরু হয়েছে। এটা কতখানি কার্যকর বলে আপনি মনে করেন?
রোহান: বাংলাদেশের আলেমরা সন্ত্রাসবাদবিরোধী কৌশলগত পদক্ষেপ নিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। বিশেষ করে, জঙ্গিগোষ্ঠী কোরআন ও হাদিসের যে ভুল ও খণ্ডিত ব্যাখ্যা দিচ্ছে, আলেমরা কোরআন ও হাদিসের আলোকে এগুলোকে খণ্ডন করতে পারেন।
উগ্রবাদীরা কখনো ধর্ম দ্বারা চালিত নয়, তারা নিজেদের কাজের যৌক্তিকতা প্রমাণ করতে কোরআন ও হাদিসের কিছু অংশকে বেছে নিচ্ছে। ইন্টারনেটে ঘুরতে থাকা এসব অপব্যাখ্যাকে মোকাবিলা করতে আলেমদের এখন নিজস্ব ওয়েবসাইট ও ব্লগ থাকা উচিত। সরকার, এনজিও ও বেসরকারি খাতের উচিত এ কাজে আলেমদের সহায়তা করা। আমি বাংলাদেশের কয়েকজন আলেমের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, তাঁদের কেউ কেউ ইতিমধ্যে এ কাজ শুরু করেছেন। এ কাজে তাঁদের জীবনের ঝুঁকি আসতে পারে। সেটা সরকারকে মোকাবিলা করতে হবে। বাংলাদেশের মানুষ শান্তি ভালোবাসে, এ মাটিতে উগ্রপন্থার কোনো জায়গা নেই।
প্রথম আলো: ঢাকায় পুলিশপ্রধানদের সম্মেলনে উপস্থাপিত একটি প্রবন্ধে দেখেছি যে উগ্রপন্থায় যুক্ত হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে বেশিরভাগই হয়েছে অনলাইন যোগাযোগের মাধ্যমে। এটা থামানোর উপায় কী?
রোহান: তরুণদের বড় অংশই এখন নতুন কিছু পাওয়ার আশায় সাইবার স্পেসে বেশি সময় কাটায়। তাই বিষয়টা দেখতে হবে, তারা যেন কোনো ফাঁদে না পড়ে। বাংলাদেশের সরকারকে দেশের বেসরকারি খাত, এনজিও, ধর্মীয় সংস্থা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম ও ইন্টারনেট সেবাদাতাদের সঙ্গে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে ইন্টারনেটে উগ্রবাদবিরোধী ওয়েবসাইট ও প্ল্যাটফর্ম গড়ে তুলতে হবে।
প্রথম আলো: আপনি সিঙ্গাপুরে থাকেন। সম্প্রতি সিঙ্গাপুর কর্তৃপক্ষ কয়েকজন বাংলাদেশিকে জঙ্গিবাদে যুক্ত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার করেছে এবং দেশে ফেরত পাঠিয়েছে। আপনি কি জেনেছেন তাঁরা কী পর্যায়ে জড়িত?
রোহান: বাংলাদেশের প্রবাসীরা সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়াসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশেও এমন অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছেন। কারণ, তাঁরা পা পিছলে উগ্রবাদের দিকে ধাবিত হয়েছিলেন। আমি বিশ্বাস করি, প্রবাসে থাকা বাংলাদেশিরা আইএস ও আল-কায়েদার কারণে অনেক চাপের শিকার হচ্ছেন। বাংলাদেশ সরকারের উচিত বিদেশি দূতাবাসগুলোর মাধ্যমে প্রবাসী শ্রমিকদের এমন কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা, যাতে তাঁরা আর জঙ্গিবাদের দিকে ধাবিত না হন।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
রোহান: আপনাকেও।
প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন