'মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠন রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত নয়'
14 March 2017, Tuesday
[জাফর ইমাম মুক্তিযুদ্ধের একজন দুঃসাহসী যোদ্ধা। ২ নম্বর সেক্টরের রাজনগর সাব-সেক্টরের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ফেনীর বিলোনিয়া যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দশম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা অধিনায়ক এ মুক্তিযোদ্ধা একাত্তরে বিশেষ অবদানের জন্য বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত হন। পরে রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে মন্ত্রীত্বও পেয়েছিলেন। কর্নেল (অব:) জাফর ইমাম মুক্তিযুদ্ধ ও সংশ্লিষ্ট নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন আরটিভি অনলাইনের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সিয়াম সারোয়ার জামিল।]
আরটিভি অনলাইন : আপনি ক্যান্টনমেন্ট থেকে পালিয়েছিলেন কীভাবে?
জাফর ইমাম : স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণের আগে আমি ছিলাম ক্যাপ্টেন; কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে পদাতিক বাহিনীতে কর্মরত। আমার ইউনিট ছিল ২৪-এফএফ রেজিমেন্ট। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে ২৬ মার্চ রাতে আমার সঙ্গে আরেকজন বাঙালি অফিসারকে নিরস্ত্র করে বন্দি অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হয় চট্টগ্রামে। চট্টগ্রাম থেকে আমাকে তৎকালিন পশ্চিম পাকিস্তানে বদলির উদ্দেশ্যে আরো ক'জন অফিসারসহ হেলিকপ্টারযোগে পাঠিয়ে দেয়া হয় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে। হেলিকপ্টারটি ঢাকা পুরাতন বিমানবন্দরে অবতরণের সঙ্গে সঙ্গে আমি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এয়ারপোর্ট টয়লেটে ঢুকি। ইউনিফর্ম খুলে সিভিল পোশাক পরে এয়ারপোর্টের বাইরে চলে আসি।
আরটিভি অনলাইন : ধরা পড়েননি?
জাফর ইমাম: না। যদি পড়ে যেতাম, তাহলে বলতাম, আমি ক্যান্টনমেন্টে যাবার আর্মি ট্রান্সপোর্ট খুঁজছি, না পেলে সিভিল ট্যাক্সি অথবা বেবিট্যাক্সিতে ক্যান্টনমেন্টে চলে যাবো। (হাসি) পরের দিন ’৭১-এর এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহ অথবা তৃতীয় সপ্তাহের প্রথম দিকে আমি কুমিল্লার কসবা সীমান্ত অতিক্রম করি। পরে ভারতের মেলাঘরে ২ নম্বর সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। সেখানে কর্নেল এমএজি ওসমানীও ছিলেন। তিনি বললেন সাবাস। পরে আমাকে পাঠালেন বিলোনিয়া সেক্টরে।
আরটিভি অনলাইন : বিলোনিয়ার মত একেবারে নতুন একটা জায়গায় কীভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করলেন?
জাফর ইমাম : বিলোনিয়াতে যাবার সময় সঙ্গে ছিলেন কর্নেল আকবর ও ক্যাপ্টেন আমিনুল হক। তারা ক'দিন থেকে চলে যান ২ নম্বর সেক্টরের অন্য রণাঙ্গনের দায়িত্বে। বিলোনিয়াতে বিলোনিয়া সেক্টরের বিএসএফ কমান্ডার মেজর প্রধানের সঙ্গে দেখা করি। পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ করি। আমি যেহেতু পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পদাতিক বাহিনীর অফিসার ছিলাম তাই তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ও উৎসাহ লক্ষ্য করলাম। সম্ভবত এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহ হবে, আমি মেজর প্রধানকে সঙ্গে নিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের সুসংগঠিত করার কাজ শুরু করলাম। ৩-৪ দিনের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা (ছাত্র, শ্রমিক, জনতা) ও প্রাক্তন ইপিআর বাঙালি সৈনিক, পুলিশ এদেরকে একতাবদ্ধ করে ২ নম্বর সাব সেক্টর গঠন করে সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি নিলাম। ভারত সীমান্তের রাজনগর ও বড় কাসারিতে গড়লাম ট্রেনিং ক্যাম্প। এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে আমরা শুরু করলাম বিচ্ছিন্ন সামরিক ও গেরিলা অভিযান। ফেনীর দিকে মুখ করে বিখ্যাত মুন্সিরহাট ডিফেন্স তৈরি করে পজিশন গ্রহণ করি। উদ্দেশ্য ছিল মুন্সিরহাট ডিফেন্সকে শক্তিশালী মুক্তিবাহিনীর ঘাঁটি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে পরবর্তীতে ফেনী মুক্ত করা।
আরটিভি অনলাইন : বিলোনিয়া যুদ্ধের গল্প শুনতে চাই
জাফর ইমাম: এ যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন ইস্ট পাকিস্তান রেজিমেন্টের সদস্যরা। পরে যোগ দেন ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সদস্যরা। পাকিস্তান থেকে সমুদ্রপথে ট্যাঙ্ক, মাইনের মতো আধুনিক সব সমরাস্ত্র ঢুকবে বাংলাদেশে। ফেনীতে যুদ্ধরত অকুতোভয় সেনাদলের ওপর দায়িত্ব পড়ল সমরাস্ত্রবাহী গাড়িগুলোর পথ রুখে দিতে হবে। শুরু হলো প্রচণ্ড যুদ্ধ। পাকবাহিনী পেরে না উঠে যুদ্ধবিমান থেকে ছুঁড়ল বোমা। তাতেও দমেননি আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা। রণকৌশল বদলে নিয়ে ভূপাতিত করলাম সেই যুদ্ধবিমান। প্রাণ যায় অনেক মুক্তিসেনার। পরে ১০ নভেম্বর আসে কাঙ্ক্ষিত বিজয়। এক অফিসারসহ ৭২ পাকিস্তানি সেনা আত্মসমর্পণ করে। ভৌগলিক দিক থেকে বিলোনিয়া যুদ্ধটি বেশ কঠিন এক যুদ্ধ ছিল। রণকৌশলের দিক থেকে এ যুদ্ধটি ছিল বেশ ভয়ানক। এ যুদ্ধে পাকসেনারা কিন্তু মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেনি। তারা করেছিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কাছে।
আরটিভি অনলাইন : নোয়াখালীতেও তো আপনি মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করেছিলেন
জাফর ইমাম : হ্যাঁ । সেখানেও একইভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করা হয়েছিল। যাতে তারা নিজ অঞ্চলে থেকে নিজস্ব এলাকাতে যুদ্ধ পরিচালনা করতে পারেন। আমরা ওইসব অঞ্চলের তৎকালিন আওয়ামী লীগের সাংসদ ও নেতাদের মাধ্যমে সামরিক ও গেরিলা যুদ্ধের রণকৌশল প্রশিক্ষণ দিতাম। তাদের অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করতাম।
আরটিভি অনলাইন : মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠন গুলো কার্যক্রম সম্পর্কে বলুন।
জাফর ইমাম : যুদ্ধশেষে মুক্তিযুদ্ধের মূল চালিকাশক্তি কে, জেড, এস ফোর্সগুলোর রেগুলার বাহিনী ও বেঙ্গল রেজিমেন্টগুলো ফিরে গেলো ক্যান্টনমেন্টে। ১৬ ডিসেম্বর পরবর্তীতে এলাকাভিত্তিক মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন সংগঠন গড়ে ওঠেছিল। যারা স্বাধীন বাংলা সরকারের বিভিন্ন সেক্টর ও, কে, জেড, এস, ফোর্স-এর অধীনে বেঙ্গল রেজিমেন্টগুলোর নেতৃত্বে মূলযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তারাও ওইসব আঞ্চলিক মুক্তিযোদ্ধা সংগঠনগুলোতে নাম লেখাতে বাধ্য হলেন। অবশ্য অনেকে আজো এসব সংসদ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নামে গঠিত বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে জড়িত নেই। এছাড়া সংসদ ও এসব সংগঠন রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত নয়। তাই বাংলাদেশের সর্বস্তরের মুক্তিযোদ্ধার প্রতিনিধিত্ব এরা দাবি করতে পারেন না।
আরটিভি অনলাইন : মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি বক্তব্য জানতে চাই।
জাফর ইমাম : একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা এখনো নির্ধারণ হয়নি। যুদ্ধের সময় যারা মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার দিয়েছেন, আমরা বলি তারা সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু তারা এখন শুধু মুক্তিযোদ্ধা না, মুক্তিযোদ্ধাদেরও নেতা হয়ে গেছেন। আমি বলছি না, মুক্তিযুদ্ধে তাদের ভূমিকা নেই। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা নির্ধারণ না করার কারণে এই ধুম্রজালটা সৃষ্টি হয়েছে। এ সুযোগে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ক্রমেই বেড়েছে। রাজনৈতিক সুযোগ এটা আরো ব্যপকহারে আকারে ছড়িয়েছে।
আরটিভি
পাঠক মন্তব্য
My hat is off to your astute command over this tob-icpravo!
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন