জাতিসংঘের রাজনীতি বিষয়ক সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর উপস্থিতিতে ২০১৩ সালে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির মধ্যে যে সমঝোতা হয়েছিলো, তা তখনই প্রকাশ করা উচিৎ ছিলো বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়।
তিনি বলেছেন, “বিএনপি নয়, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ আছে। গণতন্ত্র সমুন্নত রাখতে সব দলের অংশগ্রহণমূলক একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করার জন্য সরকারের ওপর চাপ আছে।”
নিউজবাংলাদেশের সঙ্গে একান্ত আলাপে নির্বাচনকালীন সরকার, আন্তর্জাতিক চাপ, বিএনপির পুনর্গঠন, আন্দোলন, জনসম্পৃক্ততা, সংলাপ, জামায়াত ছাড়া না ছাড়া, নির্বাচনে অংশগ্রহণসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেন গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নিউজবাংলাদেশের সিনিয়র রিপোর্টার রফিক রাফি।
বিএনপি মহাসচিব বলেছেন, তারানকোর উপস্থিতিতে যে সমঝোতা হয়েছিলো আওয়ামী লীগ তা অস্বীকার করেছে…
গয়েশ্বর: বিএনপি মহাসচিব যা বলেছেন, সত্য বলেছেন। কিন্তু এটা গোপন ছিলো বলেই তারা (আ.লীগ) অস্বীকার করছে। যখন আলোচনার টেবিলে বসেছিলো, তখন জয়েন্ট স্টেটমেন্ট দিতে পারতো। তারানকোর উপস্থিতিতে বৈঠকের বিষয়বস্তু যদি প্রকাশ করা হতো, তাহলে জনগণ বিশ্বাস করতো যে তারা (আ.লীগ) কথা রাখেনি। এখন জনগণ মির্জা ফখরুল নাকি তোফায়েলের কথা বিশ্বাস করবে? এখানে আমাদের ত্রুটি রয়ে গেছে। যেহেতু জনগণের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়, তাই প্রকাশ করা উচিৎ ছিলো।
আওয়ামী লীগ অস্বীকার করছে কিন্তু তারানকো বা জাতিসংঘ কি বলবে তারা মিথ্যা বলছে- এমন প্রশ্ন রাখেন তিনি।
আগামী নির্বাচনে যাওয়ার জন্য বিএনপির ওপর কোনো আন্তর্জাতিক চাপ আছে কি না?
গয়েশ্বর: আমার জানা মতে নাই। বহির্বিশ্বের চাপ আছে, তবে সেটা সরকারের ওপর। সকল দলের অংশগ্রহণমূলক একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করার জন্য সরকারের ওপর চাপ আছে। বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং গণতান্ত্রিক বিশ্বের সঙ্গে যুক্ত। বিচ্ছিন্ন কোনো দ্বীপ না। তাই গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখতে যে সব প্রক্রিয়া অনুসরণ করা দরকার সেটা নিয়ে আন্তর্জাতিক পরামর্শ আছে।
বিএনপি নির্বাচনকালীন যে নির্দলীয় সরকারের কথা বলছে, সেটা তো সংবিধানে নেই।
গয়েশ্বর: এখন সংবিধানের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু ৯৬ সালে যখন বিএনপি ক্ষমতায় ছিলো, তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংবিধানে ছিলো না। কিন্তু আওয়ামী লীগের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে আড়াই দিনের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংবিধানে অন্তর্ভূক্ত করে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়েছে বিএনপি।
আওয়ামী লীগ সংবিধানের কথা বলছে, সেটা বুঝতাম যদি তারা ১৪ সালের ৫ জানুয়ারি একতরফা নির্বাচনের ৩ মাসের মধ্যে নির্বাচন দিতো। কিন্তু তারা তা করেনি। তারা সংসদ বলবৎ রেখে নির্বাচন করেছে।
আদালতের সংক্ষিপ্ত রায়ে বলা হয়েছিলো, আগামী ২ টার্ম তত্ত্বাবধায়কের অধীনে নির্বাচন হতে পারে। কিন্তু ১৬ মাস পর প্রকাশিত পূর্ণাঙ্গ রায়ে সেটা রাখা হয়নি। সংবিধানে যে সব সংশোধনী আনা হয়েছে, তার অনেকগুলো মৌলিকতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এটা তাদের মনগড়া সংবিধান। সংসদ বলবৎ রেখে নির্বাচন হলে সেটা কোনোমতেই সুষ্ঠু হবে না। তত্ত্বাধায়ক ব্যবস্থা আওয়ামী লীগের ব্রেন চাইল্ড ছিলো, যেই সিস্টেম কোনো দেশের সংবিধানে নেই।
তিনি বলেন, সংবিধান সময়ের, জনগণের ও দেশের প্রয়োজনে পরিবর্তনযোগ্য এবং পরিবর্তনশীল।
সংবিধানে ৭ মার্চের ভাষণ অন্তর্ভূক্ত করার সমালোচনা করে তিনি বলেন, পৃথিবীতে অনেক বড় নেতার বড় বড় কথা ও বাণী রয়েছে। কিন্তু কোনো দেশের সংবিধানে তা অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এছাড়া অনেকগুলো ধারা সংশোধন করা হয়েছে যা পরিবর্তন করা যাবে না। পৃথিবীর কোন সংবিধানে এমন ধারা আছে?
বিএনপি পুনর্গঠন কতটুকু এগিয়েছে?
গয়েশ্বর: পুনর্গঠন একটি চলমান প্রক্রিয়া, এটার কোনো মেয়াদ নেই। যেখানে সমস্যা দেখা দেবে সেখানেই কাজ হবে। এটার শেষ নেই। টাইম ফ্রেম বেঁধে দিয়ে সাংগঠনিক কাজ হয় না।
বিএনপির অঙ্গ সংগঠনগুলো ভূমিকা রাখতে পারছে না কেন?
গয়েশ্বর: আমাদের কিছু প্রক্রিয়াগত ত্রুটি আছে। এছাড়া দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশের অভাবে যার যে দায়িত্ব পালন করার কথা তা পারছে না। কেউ কেউ ব্যর্থতা ঢাকতে চায়।
তিনি বলেন, মনোনীত নেতৃত্ব কখনো দেশ বা সংগঠনকে ভালো কিছু দিতে পারে না। নির্বাচিত নেতৃত্ব না হলে তার কোনো দায়বদ্ধতা থাকে না। নেতারা মাঠে না গেলে সংগঠন শক্তিশালী করা সম্ভব না। মাঠ ফেস করে না এলে সে আন্দোলনে ভূমিকা রাখতে পারবে না। আর আমাদের নেতা নির্বাচনের প্রক্রিয়া সঠিক না।
সংকট নিরসনে বিএনপির পক্ষ থেকে আলোচনার কথা বারবার বলা হলেও আওয়ামী লীগ নাকচ করে দিচ্ছে...
গয়েশ্চর: আলোচনা করে সংকট নিরসন করতে চাইলে কোনো বাধা নেই। কিন্তু না করার অনেক পথ আছে।
জামায়াতকে বাদ দিলে আলোচনা হবে, ক্ষমতাসীনদের এমন বক্তব্য নিয়ে আপনার কী মত?
গয়েশ্বর: জামায়াতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের কোন সম্পর্ক ছিলো না, তা তো নয়। জামায়াত-আওয়ামী লীগ আলাদা হাঁটলেও তাদের লক্ষ্য এক ছিলো। তত্ত্বাবধায়কের জন্য জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে আওয়ামী লীগ আন্দোলন করেছে। তাদেরটা যদি রাজনৈতিক কৌশল হয়ে থাকে, তাহলে বিএনপিরটা কেন হবে না। সরকার যখন আলোচনার দাওয়াত দেবে তখন এই প্রশ্ন উঠবে।
তিনি বলেন, জামায়াতের তো নিবন্ধন নেই। জামায়াত যদি গণতন্ত্র এবং দেশের জন্য ক্ষতিকর হয়, তাহলে তাকে নিষিদ্ধ কেন করছে না সরকার? সেই ক্ষমতা তো সরকারের আছে। আওয়ামী লীগের নেতারা যে জামায়াতের সঙ্গে গোপনে বসে না তার কি গ্যারান্টি আছে?
বর্তমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে কী করা উচিৎ বলে আপনি মনে করেন?
গয়েশ্বর: গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলে জনগণের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকলে আলোচনার টেবিলে যে কোনো সমস্যা সমাধান সম্ভব। আর বিবাদ জিইয়ে রাখে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চাইলে, ক্ষমতাকে প্রলম্বিত করতে চাইলে, অনেক অজুহাত দেয়া যায়।
বিএনপি আন্দোলনের জন্য কতটুকু প্রস্তুত?
গয়েশ্বর: আন্দোলন সময় দিয়ে হয় না। যুদ্ধ লাগলে কি এই প্রশ্ন তোলা হবে, সেনাবাহিনী প্রস্তুত কি না। প্রতিমুহূর্তে সেনাবাহিনীকে প্রস্তুত থাকতে হয়। কারণ যারা আক্রমন করবে তারা তো দিন তারিখ দিয়ে করবে না। ২০১৩ সালের শেষ পর্যন্ত সারাদেশে যে আন্দোলন হয়েছে, তা আগে কখনো দেখিনি।
সাবেক এই যুবদল সভাপতি বলেন, আন্দোলন সফল হয়নি এটা বলা যাবে না। আন্দোলন তো যুদ্ধ না। ঢাকায় আমারা নামতে না পারলেও পুলিশ নামছে, গাড়ি চলে নাই। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে কোনো লোক ছিলো না। ভাষা আন্দোলন শুরু হয় ৪৮ সালে, তখন কি কেউ জানতো ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে স্বাধীনতার অংকুর বপন হয়েছে। যে জন্য আন্দোলন করছি সেটা সফল হতে সময় লাগতে পারে কিন্তু বলা যাবে না যে ব্যর্থ।
খালেদা জিয়াকে ছাড়া কি বিএনপি নির্বাচনে যাবে?
গয়েশ্বর: খালেদা জিয়া ব্যক্তিগতভাবে নির্বাচন নাও করতে পারেন। কিন্তু এমন কোনো পরিস্থিতি যদি সৃষ্টি হয় যে তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। সেই নির্বাচন হবে কেন? ষড়যন্ত্র বুঝেও সেই নির্বাচনের কথা বিএনপি ভাববে কেন?
তিনি বলেন, এক-এগারোতে দুই নেত্রীকে মাইনাস করার ষড়যন্ত্র হয়, কিন্তু দল ও জনগণ মাইনাস করে নাই। সেটা ছিলো ষড়যন্ত্র। যারা সেই ষড়যন্ত্র করেছে তারা সবাই মারা যায়নি। কেউ কেউ আছে, তাদের মাথা থেকে কি এই চিন্তা চলে গেছে।
এখন একজন যদি আরেকজনকে মাইনাস করতে চায়, আরেকজন থাকতে পারবে তো? কারণ যারা টু মাইনাসে বিশ্বাস করে তারা এই সমাজে রয়ে গেছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
জনগণ রাজনীতি বিমুখ হয়ে পড়ছে কেন?
গয়েশ্বর: জনগণতো সারাক্ষণ রাজনীতি করে না। তারা যা আশা করে, তা পূরণ না হলে কষ্ট পায়। বিমুখ নয়, চাপা ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। এই ক্ষোভের বহির্প্রকাশ কিভাবে হবে সেটা বলা কঠিন। বেশি দিন চাপা দিয়ে রাখলে তা বার্স্ট হয়ে যায়। আমরা এবং সরকার যদি জনগণকে প্রকাশ করতে না দেই, তাহলে কখন কী হবে তা কেউ বলতে পারে না।
জনসম্পৃক্ত বিষয়ে জোরালো আন্দোলন হচ্ছে না কেন?
গয়েশ্বর: যারা রাজনীতি করে তারাও জনগণের অংশ। গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে বিএনপি কর্মসূচি পালন করেছে। প্রতিবাদের ভাষা ক্ষীণ হলেও প্রতিবাদ, জোরালো হলেও প্রতিবাদ। আমাদের দেশে প্রতিবাদ ভাষা যদি জ্বালাও পোড়াও হরতাল অবরোধ হয়, সেটা করলে আবার সমালোচনা হয়। কিন্তু উন্নত বিশ্বে ১০ জন দাঁড়িয়ে মানববন্ধন করলেও সেই প্রতিবাদে ফল হয়, আর আমাদের দেশে ২ হাজার মানুষ প্রতিবাদ করলেও কিছু হয় না।
নিউজবাংলাদেশ.
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন