আসিফ নজরুল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক, টকশোর তুখোড় বক্তা, ক্ষুরধার এক লেখক-সাংবাদিক। লেখালেখি ও বাগ্মীতায় স্পষ্টবাদী, আপসহীন-সাহসী ও অনলবর্ষী এই ব্যক্তিত্ব বলেছেন তার সৃজনশীল লেখালেখি নিয়ে। যেখানে অনিবার্যভাবে হাজির হয়েছে ব্যক্তিজীবন। পার্শ্ব বা প্রধান চরিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে স্ত্রী শীলা আহমেদসহ আরও অনেকে। প্রথমবারের মতো তিনি বলেছেন এবারের বইমেলায় প্রকাশিত বই ‘অসমাপ্তির গল্প’ নিয়ে; যা তার নিজের জীবনের ঘটনা বলে আলোচনা রয়েছে। না বলা এ রকম নানা প্রসঙ্গ শুনেছেন কাজল রশীদ শাহীন
কাজল রশীদ শাহীন : কেমন আছেন? আপনার শিক্ষকতা, লেখালেখি আর মধ্যরাতের টকশোতে ঝড় তোলা কেমন হচ্ছে।
আসিফ নজরুল : ভালো। এককথায় এটা বলাই উত্তম। বিস্তারিত বলতে গেলে আসবে বহু জটিল কথা। আজ কি আমরা সেই বিষয়ে কথা বলব, নাকি শুধু লেখালেখি-তাও আবার সৃজনশীল লেখালেখি নিয়ে থাকব।
কাজল : লেখালেখি নিয়েই থাকতে চান, ওকে ফাইন। এবারের বইমেলায় আপনার একটা উপন্যাস বেরিয়েছে ‘অসমাপ্তির গল্প’। কেমন রেসপন্স পেলেন? টিভি টকশোর আসিফ নজরুল কে তো আমরা এখানে অন্যভাবে পেয়েছি। একেবারে চেনাই যায় না?
আসিফ : হা হা হা। চেনার দরকার আছে কি? আমার যে পরিচয় এখন দাঁড়িয়ে গেছে, বিশেষ করে টকশোর বক্তা-আলোচক হিসেবে, সেটা কিন্তু আমার সাম্প্রতিক পরিচয়। তারও আগে, এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষকতার আগেও আমি কিন্তু সাংবাদিক ছিলাম। এবং বিচিত্রার মাধ্যমে যে ক’জন সাংবাদিক আলোচিত হয়েছে-নিজেদেরকে অন্যভাবে উপস্থাপন করতে পেরেছে, আমি মনে হয় তাদের একজন। বিচিত্রায় সাংবাদিকতা করার সময়ই আমি উপন্যাস লিখি, এবং অবশ্বাস্য রকমের সাড়া পায়।
কাজল : জানি তো। আপনার ‘নিষিদ্ধ কয়েকজন’ ও ‘ক্যাম্পাসের যুবক’ ঈর্ষণীয় সাড়া ফেলেছিল। ‘আক্রোশ’, ছোঁয়াকে পাঠক সেই সময়ের জনপ্রিয় সাহিত্যিকদের মতোই গ্রহণ করেছিল। কিন্তু সেসব বইয়ের আসিফ নজরুল আর ‘অসমাপ্তির গল্প’র আসিফ নজরুলকে ঠিক মেলানো যায় না, তাই বলছিলাম চেনাই যায় না।
আসিফ : হয়তো ঠিকই ধরেছেন কাজল। ওই বইগুলো আর এই বইয়ে একটা বড় ফারাক আছে। থাক এ প্রসঙ্গ। আপনি অন্য প্রশ্ন করেন।
কাজল: অসমাপ্তির গল্প’র পাঠক প্রতিক্রিয়া কেমন?
আসিফ : পাঠক প্রতিক্রিয়া ভালো। বেশ ভালো। অনেকেই ভালো বলেছেন। আমার স্ত্রী শীলা খুশি হয়েছে, এটা আমার জন্য অনেক বড় প্রাপ্তি।
কাজল : তার খুশিটাকে আপনি বিশেষ ভাবে নিয়েছেন, কিন্তু কেন? আর এর শানে নুযুলইবা কী?
আসিফ : কারণ, ও শুধু আমার স্ত্রী না। ও এদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিকের কন্যা। ওর বাবা হুমায়ূন আহমেদ। হুমায়ূনের অনেক বইয়ের প্রথম পাঠক সে। তার কথায় অনেক কিছু পরিমার্জনা করতেন তিনি। আমি জানি এসব। এইরকম একজন কঠিন পাঠককে সন্তুষ্ট করা নিশ্চয় সহজ কথা নয়।
কাজল : অবশ্যই সহজ কথা নয়। কিন্তু তিনি খুশি হয়েছে আপনি কি করে বুঝলেন, তাছাড়া আপনাকে খুশি করার জন্যও তো অমন কথা বলতে পারে। আফটার অল আপনি তার হাজব্যান্ড।
আসিফ : শীলা ওরকম মেয়ে না। শোনেন কাজল, ওর সাথে আমার সংসারের বয়স তিন বছর হলেও আমি ওকে ১৮ বছর ধরে চিনি। কাউকে খুশি করার জন্য একটা বাক্যও সে বলবে না। এতে যদি পৃথিবী গোল্লায় যায়, তাতেও তার কিছু যায় আসে না। আর হ্যাঁ, প্রকাশনা সংস্থা থেকেও আমাকে জানানো হয়েছে, আমার বইয়ের প্রথম সংস্করণ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। সুতরাং, শীলা যে যথার্থই বলেছে, তা অনেকটা নিশ্চিত। যাহোক আপনি কি তার অসাধারণ ফেসবুক স্ট্যাটাসটি পড়েছেন। আমি ভাগ্যবান আমার লেখাকে উপলক্ষ করেই সে লিখেছে এটা।
কাজল : আপনি যে স্ট্যাটাসটার কথা বলছেন, সেখানে তো অনেকগুলো বিষয় এসেছে। এমনকি এই উপন্যাসে আপনার জীবনের ছাপ রয়েছে বলেও ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। আপনার হাঁড়ির খবর ফাঁস করে দেওয়া হয়েছে।
আসিফ : ফাঁস করে দেওয়ার কিছু নেই। কারণ, এটা আমার বন্ধুরা সবাই জানে।
কাজল : আপনার সমসাময়িক যারা, তারা হয়তো জানে। নতুন প্রজন্ম জানে না নিশ্চয়। আর জানলেও তাদের কাছে হয়তো স্পষ্ট নয়, কথিত। আসিফ ভাই, আমরা শীলার লেখাটা এখানে তুলে ধরি? এমনটা হলে পাঠকদের আমাদের আলাপচারিতা বুঝতে সহজ ও সহায়ক হবে।
আসিফ : ভাল বলেছেন। লেখাটা আছে আপনার কাছে? থাকলে দেন।
কাজল : হ্যাঁ আছে। শীলা লিখেছেন – ‘‘আমার বাবা ছিলেন লেখক মানুষ। তার ছোট্ট কাঠের একটা টুল ছিল। সেটা নিয়ে যেখানে সেখানে লিখতে বসে যেতেন। আমাদের খেলা-ঝগড়া-হাসাহাসি কোনো কিছু্ তার লেখালেখিতে সমস্যার সৃষ্টি করতে পারতো না। এবার প্রথম আমার বরকে দেখলাম লেখক হিসেবে। একেবারে বাবার উল্টো। ওর লেখার জন্য পিসফুল মাইন্ড লাগে। চুপচাপ বাসা লাগে। আর লেখার সময় কেউ ওর সাথে কথা কথা বলতে পারবে না।
বেচারারা জন্য বিরাট ঝামেলা হয়ে গেল! পিসফুল মাইন্ড সম্ভব না, কারণ ছোটবেলা থেকে আমি খুব ঝগড়াটে। চুপচাপ বাসা সম্ভব না, কারণ বাসায় চারটা বাচ্চা। আর ওকে একটু পর পর ডাকাডাকি করা আমার স্বভাব। এতো ঝামেলার মধ্যে ও যখন একটা উপন্যাসের অর্ধেকের মতো লিখে ফেললো, তখন আমাকে পড়তে দিল। বলল-পড়ে দেখোতো কেমন হয়েছে? কোন জায়গা ঠিক করতে হলে, বলো!
আমি বললাম- অবশ্যই পড়ব, কিন্তু কোনো জায়গা ঠিক করতে হবে কিনা, বলতে পারব না। আমি তো লেখকের মেয়ে, সারাজীবন দেখেছি লেখকরা আলোচনা সহ্য করতে পারে না। বাবাকে কোনো লেখা নিয়ে একটু কিছু বললে প্রচণ্ড রেগে যেত। এমন বকাবকি শুরু করতো ভয়ে অনেকক্ষণ সামনে যেতাম না! ও হাসতে হাসতে বলল- আরে ধুর আমি কি তোমার বাবার মতো ছেলেমানুষ নাকি! আমাকে চিনো না? আমি খুব ভালোভাবে সমালোচনা নিতে পারি। তুমি নির্দয়ভাবে সমালোচনা করবে।
: কেমন হয়েছে?
: ভালো!
: ভালো মানে কি? ঠিকমতো বল।
আমি ওকে অল্পকিছু বলি। মনে হয় এই জায়গাটায় একটু তাড়াহুড়া করছো… । কিছুক্ষণ স্বাভাবিকমুখে আমার কথা শুনে। তারপর রাগীরাগী হয়ে যায়। আমাকে বলে-‘থাক তোমার আর বলা লাগবে না। আমি তো দেখলাম তুমি লাইন বাদ দিয়ে দিয়ে পড়ছিলে। তোমার মন ছিল না পড়ার মধ্যে।’
আমি ওর হাত ধরি। বলি-‘রাগ করছো কেন?’ ও আরো রেগে যায়। উঠে চলে যায় আমার সামনে থেকে। রাতে ভাত খায় না ঠিকমতো। আমি বকা খাওয়ার ভয়ে তাড়াতাড়ি ঘুমাতে চলে যাই। অনেক সকালে ও আমাকে ডেকে তুলে। বলে- আসোতো, পড়ে দেখ এখন। আমি ঠিক করেছি।
ওর লেখা পড়তে গিয়ে আমার কান্না চলে আসে। কতোদিন পর আবার এক রকম ঘটনা ফিরে আসলো! বাবাও তো কিছুক্ষণ পর পর ডাকতো-‘শীলা বাবা, এখন পড়ে দেখতো ঠিক করেছি।’ যেন আমি (!) কতোবড় একজন ক্রিটিক! যেন কতোকিছু যায় আসে আমার ভালো লাগায়, আর না লাগায়!
আমার বাবা ছিলেন একজন লেখক। আর আমার কাছে আমাদের বাসাটা ছিল লেখকের বাসা। ছোট্ট কাঠের টুলে বাবা লিখতো। মা চা বানিয়ে দিতো একটু পরপর। প্রকাশকরা আসতেন। মা প্রুফ দেখে দিত। ধ্রুব এষ প্রচ্ছদ নিয়ে এসে চুপচাপ বসে থাকতেন ঘরের কোনায়! যখন বই বের হতো বইয়ের সাথে সাথে বাসায় মিষ্টি আসতো। আমার চারজন (মা, নোভা, আমি আর বিপাশা) চারটা বই খুলে বসতাম। বাবা পায়চারী করতে করতে সিগারেট খেতো। বই পড়তে পড়তে কখনো হেসে উঠলে সাথে সাথে জিজ্ঞেস করতো- ‘কোন জায়গাটা পড়ছো বাবা?’ বই পড়া শেষ হলে বলতো- ‘বাবা চোখে পানি এসেছে?’ আমরা খারাপ কোয়ালিটির পাঠক ছিলোম, বাবার সব বই পড়েই চোখে পানি চলে আসতো।
আমার বরের উপন্যাস লেখা শেষ হয়। একরাতে ও আমার হাতে ওর নতুন বইয়ের একটা কপি তুলে দিয়ে বলে-এটা তোমার জন্য! তুমি খুশী তো? প্রিয়তম স্বামী, আমি প্রচন্ড খুশী। তোমার বই মাস্টারপিস হয়েছে অথবা কিছু্ হয়নি তার জন্য খুশী না। খুশী এজন্য যে তোমার এই বই আর বই লেখার জার্নি আমাকে প্রাউড করেছে, নষ্টালজিক করেছে, একটু একটু জেলাস (প্রথম প্রেম নিয়ে উপন্যাস লিখলে তো একটু জেলাস হবোই!) করেছে।
হ্যাঁ এটা ঠিক যে, আমাদের এখন কোনো ছোট্ট লেখার টুল নাই, প্রকাশকদের আড্ডা নাই, চুলায় সারক্ষণ চা নাই, ধ্রুব এষের প্রচ্ছদ নিয়ে আসা নাই (এখন প্রচ্ছদ নেটে চলে আসে!), মিষ্টিও নাই । তাতে কি! এটা না হয় আমাদের অন্যরকম লেখকের বাসা হলো! তোমার জন্য অনেক শুভকামনা আর দোয়া!’’
কাজল : ‘অসমাপ্তির গল্প’ কি আপনার প্রথম প্রেম নিয়ে লেখা উপন্যাস, আত্মজৈবনিক?
আসিফ : ঠিক আত্মজৈবনিক না, তবে ছাপ রয়েছে। এ কারণে উপন্যাসটা লেখার সময়ই আমি শীলার অনুমতি চেয়ে নিয়েছিলাম।
কাজল : কি রকম, প্রেক্ষাপটটা একটু বলেন তো?
আসিফ : শীলা আমাকে প্রায়শ বলতো, তুমি গল্প-উপন্যাস লিখো না কেন? ওর বাবাকে যেহেতু ও লেখালেখির মধ্যেই সারাক্ষণ পেয়েছে, এ কারণে ও হয়তো চাই তার ঘরের মানুষটাও লেখালেখি করুক। এর মধ্যেই হলো কি কাজল, প্রথম আলো আমার একটা রাজনৈতিক লেখা ছাপাতে অপারগতা প্রকাশ করল। যেটা আমার সারা জীবনের লেখালেখিতে হয়নি, সেটা হওয়ায় আমি খুব আহত হলাম। এই নিয়ে সম্পাদক মতিউর রহমানের সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে, উনি হাসতে হাসতে বললেন ‘ধুর, এসব লেখালেখি করে আর কি হবে, আপনি উপন্যাস লেখেন। প্রথমা থেকে ছাপিয়ে দেব। উনার কথাটা শীলার সঙ্গে শেয়ার করলাম, শীলাও আমাকে বেশ আন্তরিকতার সাথে লেখার জন্য বললো, অনুরোধও করলো। বললাম, লিখতে পারি তবে সেটা আমার প্রথম প্রেম নিয়ে লিখব।
কাজল : যেটার কথা শীলা জানতো না, তাইতো?
আসিফ : জানতো, আমার সবকিছুই সে জানে।
কাজল : যদি জানেই, তাহলে আর অনুমতি নেওয়ার প্রসঙ্গে আসলো কেন?
আসিফ : জানা আর ঘটা করে উপন্যাস লেখা ভিন্ন না? তার উৎসাহেই লিখে ফেললাম ‘অসমাপ্তির গল্প’। ঈদ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশ পেল, তারপর বই হয়ে এলো এবারের বইমেলায়।
কাজল : বইমেলায় কেমন যান? কেমন লাগে লেখক-প্রকাশক আর পাঠকের এ মিলনমেলা।
আসিফ : অসম্ভব ভাল লাগে। একসময় বইমেলায় প্রায় নিয়মিতই যেতাম। এখন আর আগের মতো যাওয়া হয় না। এবার সবে মাত্র একদিন গিয়েছি। বইমেলার পরিবেশটা যেমন কেমন হয়ে গেছে। সবাই খালি ফেসবুকে ছবি তুলে, চারদিক পুলিশ আর টিভি ক্যামেরা। তাছাড়া বই বিক্রির জন্য আমাদের লেখকদের কেউ কেউ যে বাড়াবাড়ির পরিচয় দেয়, তা শুধু হাস্যকর নয় লজ্জাকরও বটে। ফেসবুকে লেখকরা যা করে আর লেখে, তা রীতিমত বালখিল্য ছাড়া কিছুই না। আমার অমুক পাঠক, এই বইটি কিনলেন। এ ধরণের কথা লেখক কেন লিখবেন, বড়োজোর পাঠক লিখতে পারেন।
কাজল: হুমায়ূন আহমেদ নেই। কিন্তু তার জনপ্রিয়তা এখনও তুঙ্গে। এটাকে কীভাবে দেখেন?
আসিফ : এটাতে প্রমাণ হয়, হুমায়ূন আহমেদের কাছাকাছিও বাংলাদেশের কোনে লেখক নেই।
কাজল : মুহম্মদ জাফর ইকবাল?
আসিফ : তিনি অবশ্যই জনপ্রিয় লেখক। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয়তার ধারে কাছেও উনি নেই। জাফর ইকবাল অনেক সারফেস লেবেল থেকে লেখেন। উনার প্রথম দিকের লেখাগুলো যতটা ভাল, এখনকারগুলো সে তুলনায় দুর্বল। ইমদাদুল হক মিলন, আনিসুল হক এরা জনপ্রিয় লেখক ঠিকই। কিন্তু হুমায়ূনের জনপ্রিয়তার সাথে এদের তুলনা হয় না।
কাজল : হুমায়ূনের এই জনপ্রিয়তা অর্জিত, নাকি বাই চান্ছ পাওয়া?
আসিফ : এখানে বাইচান্ছের কোনো জায়গা নেই। হুমায়ূনের সমস্ত কিছু অনেক লড়াই-সংগ্রাম করে অর্জন করা। গ্রাম থেকে আসা একটা ছেলেকে একেবারে নিজের চেষ্টায় এই শহরে একটা জায়গা করে নিতে হয়েছে। যেখানে কেউ কাউকে জায়গা দেয় না, সেখানে তার এই অর্জন কতখানি লড়াইয়ে সম্ভবপর হয়েছে, তা একবার চিন্তা করলেই অনুমেয়। আমি নিজে জানি, পত্রিকা অফিস, প্রকাশক পাড়া কেউ তো তাকে জায়গা দিতে চায়নি, তাকে জায়গা করে নিতে হয়েছে।
কাজল : তার সঙ্গে আপনার পরিচয় নিয়ে বলেন।
আসিফ : আমার নিজের কথায় বলি। বিচিত্রা অফিসে উনি আসার পর শাহরিয়ার (শাহরিয়ার কবীর) ভাই বললেন, হুমায়ূন আহমেদ এসেছে, তাকে নিয়ে একটা কাভার স্টোরি করতে হবে তোমাকে। এখন মনে হলে লজ্জা লাগে, আমি সেদিন বেয়াদবের মতো বলেছিলাম, উনাকে আমার টেবিলে পাঠিয়ে দেন। উনি এলেন এবং নিজে থেকেই বললেন, আমি হুমায়ূন আহমেদ। তারপর অবশ্য, উনার সাথে আমার ঘনিষ্ঠ একটা সম্পর্ক হয়। আমি প্রায়ই উনার বাসায় যেতাম, উনার স্ত্রী ভালো কিছু রান্না হলে আমাকে আসতে বলতেন। তখন সারারাত জেগে হুমায়ূন আহমেদের সাথে দাবা খেলতাম। উনি ভীষণ ভাল দাবা খেলতেন। আমি যেহেতু অনেক জেদ নিয়ে খেলতাম। উনি বিষয়টা এনজয় করতেন এবং মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে আমার কাছে হেরে যেতেন। অবশ্য উনার মেয়েরা চাইতেন আমি যেন হেরে যাই। খেলার সময় দেখতাম, নোভা শীলা আর বিপাশা বাবার পক্ষ নিয়েছেন, এবং প্রত্যেকটা চালের বেলায়ই বলছেন, বাবা তুমি আসিফ নজরুলকে হারিয়ে, ভর্তা বানিয়ে দাও। শুধু উনার স্ত্রী আমার পক্ষে থাকতেন। উনি বলতেন, এই তোমরা আসিফের সাথে এমনটা করছে কেন?
কাজল : হুমায়ূন আহমেদ কে ইর্ষা করতেন কখনও। আপনিও যেহেতু লেখালেখি করতেন, আপনার কি মনে হতো তাকেও টপকে যাবেন আপনি?
আসিফ : অবশ্যই মনে করতাম। আমি তো তখন অনেক বেশি দুর্বিনীত, বেয়াদব টাইপের ছিলাম। আমার প্রায়ই মনে হতো আমি চার-পাঁচ বছর টানা লেখালেখি করতে পারলে হুমায়ূন আহমেদকে ছাড়িয়ে যাব। কিন্তু এখন বুঝি, তাকে ছাড়িয়ে যাওয়া আমার পক্ষে দিবাস্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই না। তার কাছাকাছি যাওয়ার যোগ্যতাও আমার নেই।
কাজল : হুমায়ূনের জীবদ্দশায় আমরা তাকে ঘিরে উচ্ছ্বাস ও উন্নাসিকতা দুটো দেখেছি। আপনি কীভাবে এটাকে দেখেন।
আসিফ : হুমায়ূনকে নিয়ে যারা উন্নাসিকতা দেখায় তারা সেটা করে জাতে ওঠার জন্য। হুমায়ূন হলো একটা সিঁড়ি, যাকে ব্যবহার করে সবাই উপরে উঠতে চায়। এখন এই সিঁড়িটাকে একেকজন একেকভাবে ব্যবহার করে। আমি তো নিজেই দেখেছি, আমাদের দেশের অনেকেই তার লেখালেখি নিয়ে বিরূপ-চাঁচাছোলা কথাবার্তা বলতো, আবার তার সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকতো। আড়ালে এক কথা আর সামনাসামনি আরেক কথা বলতো। এরকম লোক যেমন এসমাজে আছে, তেমনি লেখক-কবি-সাংবাদিক-সমালোচক-অধ্যাপকও রয়েছে।
কাজল : যেমন?
আসিফ : কার নাম বলব, বলুন? অভাব তো নেই। অল্প কিছু হাতে গোণা ব্যতিক্রম ছাড়া।
কাজল : আপনার উপন্যাস প্রসঙ্গে আসি, শেষটা কিন্তু বেশ চমৎকার। পাঠ করলে বুকের ভেতরটা হাহাকার করে ওঠে।
আসিফ : তাই!খুশি হলাম শুনে।
কাজল : শেরি কি আপনার প্রথম প্রেমিকা?
আসিফ : শেরির মধ্যে আমার প্রথম ভালোলাগা রয়েছে। শেরির যে পরিণতি হয়েছে, তারও সেই পরিণতি হয়েছিল।
কাজল : তার মানে আপনিই মামুন, যাকে শেরি বলেছিল, একদিন সে অনেক বড় হবে, সবার চেয়ে বড় হবে। অসমাপ্তির গল্প’র শেষটা কেন এতো চমৎকার সেটাও বুঝেছি।
আসিফ : কাজল, বাদ দেন এসব। অন্যপ্রসঙ্গে প্রশ্ন করেন।
কাজল : অসমাপ্তির গল্প’র মধ্য দিয়ে ঔপন্যাসিক আসিফ নজরুলের নব জন্ম হলো? উপন্যাস যেহেতু আপনার হাতে খোলতাই হয়, তাহলে এখন থেকে নিশ্চয় নিয়মিত লিখবেন?
আসিফ : হ্যাঁ নিয়মিত লিখব। পরের উপন্যাসের বিষয়টাও ঠিক করে ফেলেছি। আমি মনে করি এ উপন্যাসে পাঠকদের প্রত্যাশা আরও বেশিমাত্রায় পূরণ হবে। তাদের চেনাজানা আসিফ নজরুলকে খুঁজে পাবে। উপন্যাসের বিষয়টা কিন্তু ভারি চমৎকার।
http://www.poriborton.com/interview/37747
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন