ড. পিওতর তাপিচকানোভ যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক কার্নেগি এন্ডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস এর মস্কো সেন্টারের পরমাণুবিস্তার রোধ কর্মসূচির ফেলো। নিউক্লিয়ার উইপেন্স অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক সিকিউরিটি ইন সাউথ এশিয়া (২০১১) বইয়ের লেখক। ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় বিআইপিএসএস আয়োজিত ‘পারমাণবিক জ্বালানি যুগে বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক সেমিনারে যোগ দিতে বাংলাদেশ সফরে এলে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে তাঁর এই সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়।
* সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজানুর রহমান খান
প্রথম আলো :অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, রুশ পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রযুক্তির চেয়ে চীন ও দক্ষিণ কোরিয়ার প্রযুক্তি উত্তম। আপনার মন্তব্য কী?
পিওতর তাপিচকানোভ :উদাহরণ হিসেবে যদি চীনের সঙ্গে রাশিয়ার পারমাণবিক শিল্পের তুলনা করা হয়, তাহলে অনেক বড় পার্থক্য দেখা যাবে। পারমাণবিক প্ল্যান্ট তৈরিতে রাশিয়ার অভিজ্ঞতা দীর্ঘ সময়ের। চীন এখন পর্যন্ত শুধু পাকিস্তানকেই প্ল্যান্ট সরবরাহ করেছে। অন্যদিকে রুশ প্রযুক্তি বিভিন্ন ধরনের পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। যেমন ফিনল্যান্ড, ভারত ও বেলারুশ—কোথাও অসুবিধা নেই। নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়টিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। চীনের সঙ্গে তুলনা করে বলব, রুশ প্রযুক্তি অধিকতর অগ্রসর ও নিরাপদ। দক্ষিণ কোরিয়া অবশ্য আন্তর্জাতিক বাজারে খুবই সক্রিয় এবং উত্তম অভিজ্ঞতাপ্রসূত। তারা চীনের থেকে বেশি অভিজ্ঞ। এই প্রেক্ষাপটে আমি বলব, তাদের সঙ্গে কিছু ক্ষেত্রে এটা প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হতে পারে। চীনের ক্ষেত্রে এটা আমি বলব না।
প্রথম আলো :আপনি কি সেমিনারে এমনটাই বলছিলেন যে পারমাণবিক শক্তি কেন্দ্র স্থাপনে রূপপুরকে বেছে নিতে বাংলাদেশ স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এতে রুশরা কোনো প্রভাব ফেলেনি?
পিওতর তাপিচকানোভ :না। সেটা ঠিক নয়। আমার পয়েন্ট ছিল এটাই যে আন্তর্জাতিক অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সি (আইএইএ) মনে করেছে, রূপপুরের স্থানটি নিরাপদ। এই স্থানটি পারমাণবিক শক্তি কেন্দ্র স্থাপনে ব্যবহৃত হতে পারে। সুতরাং এটা বাংলাদেশ বা রাশিয়া নয়, এটা স্বাধীনভাবে আইএইএ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে আমি অবশ্যই বিশ্বাস করি যে এ ব্যাপারে বাংলাদেশের নিজস্ব মূল্যায়ন রয়েছে। আপনি বলছিলেন যে রাশিয়া কোনো ভূমিকা রেখেছে কি না?
প্রথম আলো :আসলে আমাদের মুখ্য উদ্বেগ হলো এটা জানা যে এটা রূপপুরে বসাতে বাংলাদেশ কি নিজেই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছে নাকি রাশিয়াও এই সিদ্ধান্ত তার মূল্যায়নে যথার্থ মনে করেছে?
পিওতর তাপিচকানোভ :এটা ঠিক এভাবে ঘটেনি। আমি আপনাকে বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে পারি। ধরুন, আপনি বাংলাদেশ, আমি রাশিয়া। আপনি ঘোষণা করেছেন যে আপনার একটি পারমাণবিক প্ল্যান্ট দরকার। আপনি সুপারিশ করেছেন যে কোন আয়তনের প্ল্যান্ট লাগবে। তখন আপনি আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান বা প্রতিযোগিতা উন্মুক্ত করলেন। তখন আমি রাশিয়া আপনার কাছে এলাম। আপনি বললেন এ জন্য আমার এক বা একাধিক সাইট রয়েছে। তখন রুশ বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশে এলেন এবং সবকিছুই মূল্যায়ন করলেন। কী করা যায়? নিরাপত্তার বিষয়টি কেমন? তখন আমরা হয়তো বললাম, হ্যাঁ, এই স্থানটি উপযুক্ত বলে আমাদের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। তবে যেকোনো উপায়েই হোক, এটা আপনারই সিদ্ধান্ত। আমরা শুধু দায়ী থাকব নির্মাণসংক্রান্ত যেকোনো বিষয়ে।
প্রথম আলো :পারমাণবিক বর্জ্য অপসারণে রাশিয়ার কী ভূমিকা থাকবে? কারণ, আমাদের মনে একটা শঙ্কা হলো, আপনারা চুক্তিমতে প্রথমে স্পেন্ট ফুয়েলসহ সব বর্জ্য নিয়ে যাবেন। এরপর তা থেকে প্লুটোনিয়াম ও ইউরেনিয়াম আলাদা করবেন। ইউরেনিয়াম ফেরত দেবেন। প্লুটোনিয়াম দেবেন না। কিন্তু এরপর যা বাকি থাকবে, তা অত্যন্ত তেজস্ক্রিয়সম্পন্ন বর্জ্য, সেটা নাকি আপনারা ফেরত দেবেন। তথ্য হিসেবে এটা কি ঠিক?
পিওতর তাপিচকানোভ : আমি বাংলাদেশ ও রাশিয়ার মধ্যে সম্পাদিত পারমাণবিক সহযোগিতা চুক্তি পড়িনি।
প্রথম আলো : কিন্তু এ বিষয়ে অন্যান্য দেশের সঙ্গে আপনাদের প্র্যাকটিস কী?
পিওতর তাপিচকানোভ :আমি জানি না। আমরা যেহেতু দ্বিপক্ষীয়ভাবে একমত হয়েছি। সাধারণ প্র্যাকটিস হলো, স্পেন্ট ফুয়েল আমরা নিয়ে যাই। কারণ, তা পরিত্যাগকরণের সুবিধাদি আমাদের আছে। মজুত করতেও আমাদের বিশেষ ব্যবস্থা আছে। সুতরাং এটাই স্বাভাবিক যে এই বর্জ্য স্বাগতিক দেশের মধ্যে আমরা ফেলে যাই না। কিন্তু এ বিষয়ে বাংলাদেশ ও রাশিয়ার মধ্যে কী চুক্তি হয়েছে, তা আমি পড়িনি।
প্রথম আলো :আমাদের চিন্তা হলো বর্জ্য আপনারা নেবেন, কিন্তু ইউরেনিয়াম বের করে নেওয়ার পরের যে বর্জ্য তার কী হবে? আচ্ছা, ভারত বা অন্য কোনো দেশে কী করা হয়েছে?
পিওতর তাপিচকানোভ :ইরানের কথা বলতে পারি। আমরা সেখান থেকে স্পেন্ট নিউক্লিয়ার ফুয়েল রুশ ভূখণ্ডে আমদানি করে থাকি।
স্পেন্ট ফুয়েল তারা স্পর্শও করতে পারে না। এর দায়দায়িত্ব পুরোটাই আমাদের। তাদের এটা মজুত করার কথা ভাবতেও হয় না। আমরা কিছু চুক্তির ক্ষেত্রে প্ল্যান্টের পুরো মেয়াদে নিউক্লিয়ার ফুয়েলও সরবরাহ করে থাকি। সুতরাং আমরা পারমাণবিক জ্বালানি আনি, আবার স্পেন্ট ফুয়েল নিয়েও যাই। খুবই সোজা কথা।
প্রথম আলো : পারমাণবিক বর্জ্য অপসারণের বিষয়টি রাশিয়ার জনগণ কীভাবে দেখে? এ নিয়ে কোনো প্রতিবাদ-বিক্ষোভ হয়নি?
পিওতর তাপিচকানোভ : না। এ রকম কোনো ব্যাপার নেই।
প্রথম আলো : মিডিয়ার রিপোর্ট মতে, ১৯৯৩ সালে রাশিয়া বেআইনিভাবে বিপুল পরিমাণ পারমাণবিক বর্জ্য সমুদ্রে অপসারণ করেছিল।
পিওতর তাপিচকানোভ : আমি জানি না। আমার এই রিপোর্ট পড়া দরকার।
প্রথম আলো :আপনি বলছিলেন যে একটি প্ল্যান্টের আয়ুষ্কাল হলো ৪০ থেকে ৫০ বছর। আর বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে অত্যন্ত উচ্চমাত্রার ঝুঁকিতে আছে। তাই আপনি কি মনে করেন এ দেশে পারমাণবিক স্থাপনার ঝুঁকি বাস্তবেই আছে?
পিওতর তাপিচকানোভ :হ্যাঁ, আছে।
প্রথম আলো :তাহলে রূপপুর প্ল্যান্টের ওপরে জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য প্রভাব কেমন হতে পারে?
পিওতর তাপিচকানোভ :জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে অনেক কিছুই ঘটতে পারে। প্রবল বন্যা ও ভারী বর্ষণ হতে পারে। আবার পানির অভাবও দেখা দিতে পারে। এসবের ফলে পারমাণবিক চুল্লি ঘিরে অস্থিতিশীল পরিবেশের উদ্ভব ঘটতে পারে। তাই এটা এমনভাবে সজ্জিত ও নির্মিত হতে হবে, যাতে বন্যা ও হারিকেনের মতো আঘাত থেকে রক্ষা পেতে পারে। প্ল্যান্টের জন্য দীর্ঘমেয়াদি ও স্থায়ীভাবে পানির সরবরাহব্যবস্থার সুরক্ষা থাকতে হবে।
প্রথম আলো :পরিকল্পনা অনুযায়ী পদ্মার পানিনির্ভর দুটি কুলিং টাওয়ার বসানো হবে। কিন্তু পানির অপর্যাপ্ততা নিয়ে বাংলাদেশি বিশেষজ্ঞদের মধ্যে একটা উদ্বেগ রয়েছে। নদী শুকিয়ে গেলে কী হবে?
পিওতর তাপিচকানোভ :সে জন্য জলাধার গড়ে তোলা প্রয়োজন। কিংবা কৃত্রিম অন্য কোনো ব্যবস্থা।
প্রথম আলো :তা কি সম্ভব? আপনারা এটা কোথাও করেছেন? না এ দেশেই প্রথম করবেন?
পিওতর তাপিচকানোভ :হ্যাঁ। এ পর্যন্ত কোথাও এমনটা আমরা করিনি। এখানেই প্রথম করা হবে। এ বিষয়ে আপনাদের যদি উদ্বেগ থাকে, রূপপুরের দায়িত্বে থাকা আমাদের প্রকৌশলীদের যদি মনে হয় যে সেই উদ্বেগ সঠিক, তাহলে কোনো অনিশ্চিত পানি সরবরাহের সূত্র এড়াতে এখনই ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব। সে ক্ষেত্রে কৃত্রিম পুকুর নির্মাণ অবশ্যই একটি ভালো বিকল্প। আমি জানি না কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তবে পক্ষসমূহ যদি এ রকম কিছু এড়াতে চায়, তাহলে সেটা সম্ভব।
প্রথম আলো : আণবিক প্রযুক্তি যেহেতু খুবই জটিল ও উচ্চ কারিগরি মানসম্পন্ন; তাই এটা পরিচালনায় বাংলাদেশি জনশক্তির সামর্থ্য সম্পর্কে আপনার কী বোঝাপড়া?
পিওতর তাপিচকানোভ : আমার বোঝাপড়া হলো, এটা আপনারা সবে শুরু করেছেন। আমি বলব, এটা শুরু করতে সোভিয়েত ইউনিয়ন এক দশক দেরি করেছিল। পারমাণবিক প্রযুক্তির ব্যাপারে আপনাদেরও গবেষণা ও ইতিহাস রয়েছে। তবে যেহেতু এই প্রথম আপনারা প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছেন, তাই এর পরিচালনা ও নিরাপত্তার বিষয়ে আপনাদের অভিজ্ঞতার ভান্ডার এখন সম্প্রসারণ করতে হবে।
প্রথম আলো : তুরস্ক আপনাদের সঙ্গে একটা ‘ব্ল্যাক বক্স’ (রুশরাই পুরো আয়ুষ্কাল প্ল্যান্ট চালাবে, তুর্কিরা তাতে প্রবেশও করবে না) ধরনের ব্যবস্থায় গেছে। তুরস্কের ওই সাইটে গেছেন আপনি?
পিওতর তাপিচকানোভ : ব্ল্যাক বক্স ছিল একটি প্রাথমিক ধারণা। আমি তুরস্কে গেছি কিন্তু তাদের সাইটে যাইনি। তবে স্বাগতিক দেশই ঠিক করবে যে তারা কী করবে। আমরা ব্ল্যাক বক্সের ধারণা গ্রহণ করেছি। পারমাণবিক প্রকল্পের ভেতরে তাদের লোকজন কখনোই প্রবেশ করবে না। তারা শুধু বাইরের নিরাপত্তায় থাকবে।
প্রথম আলো : তুরস্ক কি এই চুক্তি আপনাদের সঙ্গে চূড়ান্ত করেছে?
পিওতর তাপিচকানোভ : আমি মনে করি এই প্রশ্ন মনে হয় পরিবর্তনীয় একটা ব্যাপার। এটা বদলে যেতে পারে। মিশ্র ব্যবস্থাপনাও স্থির হতে পারে। চূড়ান্তভাবে কী ঘটেছে তা আমি জানি না।
প্রথম আলো : ব্ল্যাক বক্স ব্যবস্থায় কি বাংলাদেশ চাইলে এখন যেতে পারে নাকি সেই ধাপ অতিক্রান্ত হয়েছে?
পিওতর তাপিচকানোভ : আমি তা জানি না।
প্রথম আলো : এ বিষয়ে আমাদের কৌতূহলের কারণ হলো আমাদের বিশেষজ্ঞদের অনেকে মনে করেন যে প্ল্যান্ট পরিচালনায় আমরা কবে, কীভাবে সামর্থ্য অর্জন করব? আর তখন তাতে নিরাপত্তাবোধ আরও বাড়বে কি না? ব্যবস্থাপনাগত দক্ষতায় আমাদের পেশাজীবীদের সুনাম খুব বেশি পরীক্ষিত নয়। সে কারণেই ব্ল্যাক বক্সের কথা।
পিওতর তাপিচকানোভ : আমি জানি না। তবে বাংলাদেশ আদৌ যদি ব্ল্যাক বক্স চুক্তির কথা বলে তখন রাশিয়া বিষয়টি নিশ্চয় যথাগুরুত্বের সঙ্গে নেবে।
প্রথম আলো :ভারতের তামিলনাড়ুর কুদানকুলামে ত্রুটিপূর্ণ যন্ত্রাংশ (যার মধ্যে চারটি ভাল্ভ ছিল) সরবরাহের অভিযোগ উঠেছিল। ২০১৩ সালে ৬০ জন ভারতীয় বিজ্ঞানী এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠিও দেন।
পিওতর তাপিচকানোভ :ভারত সরকারিভাবে এ বিষয়ে কোনো অভিযোগ করেনি।
প্রথম আলো :ভারতীয় গণমাধ্যমেই এ বিষয়ে খবর বেরিয়েছে। আপনি কি এ বিষয়ে অবহিত নন?
পিওতর তাপিচকানোভ :ভারতীয়রা কোনো বিষয়ে সন্তুষ্ট না হলে সে ব্যাপারে অনতিবিলম্বে লাল পতাকা উড়িয়ে থাকে। তখন আমাদের তাতে অবশ্যই সাড়া দিতে হয়। তারা যেভাবে পরিবর্তন চায়, সেভাবে তা করে দিতে হয়।
প্রথম আলো :আপনার এই কথা কিন্তু নিশ্চিত করছে যে ভারতীয়রা আপনাদের বিশেষজ্ঞ জ্ঞানকে চ্যালেঞ্জ করার সামর্থ্য রাখে। সুতরাং পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনায় ভারতীয়রা যথেষ্ট কুশলী।
পিওতর তাপিচকানোভ :অবশ্যই। আমার কথা হলো, কুদানকুলামে যদি কিছু ভুলত্রুটি শনাক্ত হয় বা ভবিষ্যতে ঘটে, তাহলে সরকারি সূত্রগুলো থেকেই খুব দ্রুত সে বিষয়ে প্রতিক্রিয়া দেখায় বা দেখাবে। কিন্তু আমরা সেটা গণমাধ্যম থেকে নয়, সরকারিভাবেই অবহিত হব। আর ভারতের সরকারি মতে, কুদানকুলামে সবকিছুই ঠিকঠাক চলছে।
প্রথম আলো :আমাদের জানামতে যে চুক্তি বাংলাদেশের সঙ্গে হয়েছে, তাতে নির্মাণপ্রক্রিয়ায় যেকোনো ধরনের ত্রুটিবিচ্যুতি বা কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে তার শতভাগ দায় বাংলাদেশকেই নিতে হবে। আর আপনার জানামতেই ভারতীয়দের মতো আমাদের এখনো তেমন দক্ষ জনশক্তি গড়ে ওঠেনি। সুতরাং প্রশ্ন হলো, এই পর্যায়ে বাংলাদেশ শতভাগ দায় নেবে, সেটা কি করে যৌক্তিক হতে পারে? নির্মাণপ্রক্রিয়ায় কোনো রুশ টেকনিশিয়ানের ভুলেও কি দুর্ঘটনা ঘটতে পারে না?
পিওতর তাপিচকানোভ :যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে, তাহলে তার কারণ অনুসন্ধান করতে হবে দ্বিপক্ষীয় কমিশনের মাধ্যমে। দুই পক্ষকেই থাকতে হবে।
প্রথম আলো :এটা কি নির্মাণকালীন যেকোনো পর্যায়ের জন্যই প্রযোজ্য হবে?
পিওতর তাপিচকানোভ :আমি মনে করি এটা ‘প্রসেস অব অপারেটিং’ কালে প্রযোজ্য হবে। ত্রুটিবিচ্যুতি যা-ই হোক, সে বিষয়ে দ্বিপক্ষীয় তদন্ত কমিশনকে আমন্ত্রণ জানানোই হবে স্বাভাবিক। বিষয়টি যদি প্রযুক্তিগত বা ডিজাইন অরিজিনসংক্রান্ত হয়, তাহলে তা পুষিয়ে দিতে বাংলাদেশ অবশ্যই রাশিয়াকে অনুরোধ করবে। কিন্তু আপনাদের ‘স্টাফ অপারেটিং’ থেকে যদি কোনো বিচ্যুতি ঘটে, তাহলে তার দায় আপনাদেরই।
প্রথম আলো :ভারত ২০১০ সালে একটি লায়াবিলিটি আইন করেছে। বাংলাদেশও করতে পারে?
পিওতর তাপিচকানোভ :এটা বাংলাদেশের সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়।
প্রথম আলো :বাংলাদেশ তার দক্ষতার ঘাটতি পূরণে যদি দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি তৃতীয় পক্ষকে যুক্ত করতে চায়, তাহলে আপনাদের প্রতিক্রিয়া কী হবে?
পিওতর তাপিচকানোভ :কেন নয়? নিশ্চয়ই। এটা তো আপনাদের সংগত অধিকার। সে ক্ষেত্রে আপনি খুবই আগ্রহী হবেন কী ঘটছে সে বিষয়ে পেশাদারি মূল্যায়ন করতে। কারণ, এখানে প্রশ্ন হলো, ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনার জন্য কে অর্থ পরিশোধ করবে? সুতরাং প্রয়োজনে আপনি উভয় দেশের মধ্যে সম্পাদিত দ্বিপক্ষীয় চুক্তির আওতায় আপনার বিশেষজ্ঞ ডাকবেন। অবশ্য বাংলাদেশি কর্মকর্তাদের অনেকেই ইতিমধ্যে রাশিয়ায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হবেন।
প্রথম আলো :আপনার বিবেচনায় এখন থেকে কতটা সময় বা বছর বাংলাদেশিরা নিজেরাই একটি পারমাণবিক কেন্দ্রের দায়দায়িত্ব বুঝে নিতে সক্ষম হবে?
পিওতর তাপিচকানোভ :আমি বিশ্বাস করি যে এটা হবে একটা ‘লার্নিং প্রসেস’। রুশ প্রকৌশলীদের সঙ্গে তারা একযোগে কাজ করবেন। আমার ধারণা, বাংলাদেশিদের সামর্থ্য অর্জনে ১০ বছর সময় লাগতে পারে। এরপর তারা নিজেরাই পারবেন।
প্রথম আলো : পারমাণবিক অস্ত্রধারী ভারত, চীন ও পাকিস্তানবেষ্টিত বাংলাদেশে পারমাণবিক শক্তি কেন্দ্র স্থাপন কি কোনোভাবে আঞ্চলিক নিরাপত্তা সমীকরণে প্রভাব ফেলতে পারে?
পিওতর তাপিচকানোভ : রূপপুর আণবিক শক্তি কেন্দ্র যে একটি স্পর্শকাতর বিষয়, সে ব্যাপারে বাংলাদেশ নিশ্চয়ই সজাগ থাকবে। পারমাণবিক অস্ত্রধারী দেশগুলোর গুরুত্ব আলাদা। সুতরাং পারমাণবিক অস্ত্রধারী প্রতিবেশীদের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের পক্ষে অবশ্যই বারবার এই প্রশ্ন তোলা সংগত যে হে প্রতিবেশীগণ, তোমাদের অবশ্যই তীব্রতা বৃদ্ধি (এস্কেলেশন) পরিহার করতে হবে। আমরা তোমাদের দ্বারা ভিকটিম হতে পারি না। তবে আমি এটা কল্পনা করতে পারি না যে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র কীভাবে কোনো নিরাপত্তাগত প্রেক্ষাপটে বিবেচ্য হতে পারে। কারণ, এটা সম্পূর্ণরূপে শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনা। সুতরাং বাংলাদেশে একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন এ অঞ্চলের পারমাণবিক সামরিক ভারসাম্যে কোনো প্রভাব ফেলতে পারে না। এর কোনো উপায় আমি দেখি না। একটি বিষয়ে শুধু নির্দিষ্ট করে বলা যায়, সেটা হলো পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের স্থানগুলো অবশ্যই নিরাপদ রাখতে হবে। এর প্রতি হুমকি আসতে পারে এ রকম কোনো ঝুঁকি নেওয়া যাবে না। ভারত ও পাকিস্তান প্রতিবছরের শুরুতে তাদের কার কোথায় পারমাণবিক স্থাপনা আছে, সে বিষয়ে তালিকা বিনিময় করে। এবং তারা সম্মত হয় যে এর ওপর তারা কোনো হামলা চালাবে না। প্রতিবেশীদের সঙ্গে আপনাদের কিছু অনিষ্পন্ন বিষয় রয়েছে ঠিকই, কিন্তু ভারত-পাকিস্তানের মতো আপনাদের কোনো ‘কাশ্মীর’ নেই।
প্রথম আলো : অনেকে স্মরণ করেন যে রূপপুরে পারমাণবিক সাইট বেছে নেওয়ার পেছনে পাকিস্তানিদের মাথায় মূলত সামরিক চিন্তা ছিল।
পিওতর তাপিচকানোভ : সেটা তখনকার কথা। এখন এটা প্রযোজ্য নয়।
প্রথম আলো :আপনাকে ধন্যবাদ।
পিওতর তাপিচকানোভ :ধন্যবাদ।
প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন