ড. আকবর আলি খানের জন্ম ১৯৪৪ সালে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে সম্মান ও স্নাতকোত্তর করেছেন। কানাডার কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে করেছেন এমএ ও পিএইচডি। কর্মজীবনে অর্থ সচিব ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব ছিলেন। দায়িত্বে ছিলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টার। তবে এসব পরিচয় ছাড়িয়ে তিনি নিজের মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়কে বড় করে দেখেন। সরকারি কর্মকর্তা হয়েও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করায় পাকিস্তানি জান্তা তার অনুপস্থিতিতে তাকে ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছিল। লিখছেন দীর্ঘদিন ধরে। বাংলাদেশের রাজনীতি, প্রশাসন, বিচার বিভাগ, নির্বাচনী ব্যবস্থা ও সুশীলসমাজের ভূমিকা নিয়ে সম্প্রতি বেরিয়েছে তার গবেষণা গ্রন্থ ‘অবাক বাংলাদেশ : বিচিত্র ছলনাজালে রাজনীতি’। এ নিয়ে তিনি বিস্তারিত কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আলমগীর স্বপন
যুগান্তর : ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিতে আপনার প্রকাশিত বই ‘অবাক বাংলাদেশ : বিচিত্র ছলনাজালে রাজনীতি’ নিয়ে আলোচনা শুরু করতে চাই। বইয়ের এমন নামকরণের তাৎপর্য কী?
ড. আকবর আলি খান : ‘অবাক বাংলাদেশ’ সুকান্ত ভট্টাচার্যের অবাক পৃথিবী কবিতা থেকে ধার করা। এর মানে হল বাংলাদেশে অনেক কিছু ঘটছে, যেগুলো সহজে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। আসলে বাংলাদেশ নিজেই তার এসব কীর্তিকলাপে অবাক। আর ছলনাজালে রাজনীতি কথাটা বলতে চেয়েছি বাংলাদেশের রাজনীতিকে ব্যাখ্যা করার জন্য। আসলে এদেশের রাজনীতিকে আমরা যত সহজভাবে দেখি এর ব্যাখ্যা এত সহজ নয়। আমাদের অনেক সমস্যা রয়েছে। ইতিহাসের মধ্যে এ সমস্যার উৎস খুঁজতে হবে। দুর্ভাগ্যবশত আমরা বাংলাদেশ সম্পর্কে অনেক কথা বলি, যেগুলোতে ইতিহাস চেতনা অনুপস্থিত। বিশ্বের অন্যান্য দেশে কী হচ্ছে এর খবরও আমরা কম রাখি। সুতরাং বাংলাদেশ এবং সাম্প্রতিক দৃষ্টিকোণ থেকে যদি এদেশের রাজনীতি বিশ্লেষণ করি সেটা সঠিক হবে না। কিন্তু যখনই আমরা অতীত ও বর্তমানের অন্য যেসব সমাজ আছে সেগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশকে তুলনামূলকভাবে বিশ্লেষণ করব তখন অনেক বৈপরীত্য ও স্ববিরোধিতা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে।
যুগান্তর : সেই বৈপরীত্য বা স্ববিরোধিতাটা কী রকম? আপনি বলছেন, ‘বাংলাদেশ একটি রহস্যঘেরা প্রহেলিকাচ্ছন্ন হেঁয়ালি’। কেন?
আকবর আলি খান : হেঁয়ালি বলেছি এ কারণে যে, বাংলাদেশে অনেক কিছু ঘটছে যেগুলো ঘটা উচিত নয়। বাংলাদেশ হল পৃথিবীর মধ্যে একটা এক্সট্রিমলি হোমোজেনাস (অসাধারণ সমরূপ) কান্ট্রি। এখানে আমরা ৯৮ থেকে ৯৯ শতাংশ মানুষ একই ভাষায় কথা বলি। এখানে প্রায় ৯০ শতাংশ লোক একই ধর্মের। এখানে জনগোষ্ঠীর দিক থেকে প্রায় ৯৯ শতাংশ মানুষ একই ধরনের জনগোষ্ঠী। পৃথিবীর খুব কম দেশই আছে যেখানে সমগোত্রীয় জনগোষ্ঠী রয়েছে। অথচ বাংলাদেশ, পৃথিবীর মধ্যে যত দেশ আছে এর মধ্যে যে ২০ শতাংশ দেশ অস্থিতিশীল, তার অন্তর্ভুক্ত। এখানে যেভাবে হরতাল হয়, যেভাবে রাজনৈতিক সহিংসতা বিরাজ করছে এর সঙ্গে সমগোত্রীয় জনগোষ্ঠীর কোনো মিল নেই। এরকমভাবে আমাদের ইতিহাসের চাকা উল্টো পথে। সেজন্যই বাংলাদেশকে হেঁয়ালি বলে মনে হয়।
বাংলাদেশ যখন প্রতিষ্ঠিত হয় তখন রাজনীতিবিদ খান আবদুল গাফফার খানকে একজন সাংবাদিক বলেছিল, বাংলাদেশ সম্পর্কে আপনার ভবিষ্যদ্বাণী কী? তখন গাফফার খান বলেছিলেন, এটা গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে হয়েছে এবং গণতন্ত্র অবশ্যই টিকে থাকবে। কিন্তু দেখা গেল বাংলাদেশের গণতন্ত্রের অবস্থান একেবারে দুর্বল এবং বাংলাদেশের যে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ছিল সেটা ছিল ভয়াবহ। আবার অন্যদিকে বাংলাদেশকে বলা হতো টেস্ট কেস ফর ডেভেলপমেন্ট। অথচ সেই বাংলাদেশ কিন্তু এখন নিন্ম আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। এগুলো কিন্তু সবই বৈপরীত্য। এ বৈপরীত্যের কারণ কী? তত্ত্বে বলা হয়ে থাকে, যে দেশে সুশাসন আছে সেখানে অনেক উন্নতি হয়। যেখানে সুশাসনের অনুপস্থিতি সেখানে অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। বাংলাদেশে সবাই স্বীকার করে যে, আমাদের সুশাসনের সমস্যা রয়েছে। এরপরও এখানে অর্থনৈতিক অগ্রগতি হচ্ছে। এগুলোকে আমি হেঁয়ালি বলেছি।
যুগান্তর : রাজনৈতিক অবক্ষয় ও সুশাসনের অভাবকে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কীভাবে দেখেন? এ নিয়ে মানসিক কষ্ট কাজ করে কি?
আকবর আলি খান : যন্ত্রণা কাজ করে এজন্য যে, বাংলাদেশ এ ধরনের দেশ হবে আমরা এটা কখনও চিন্তা করিনি। আজকে সংঘাতমুখর দেশ এবং এখানে কোনো মূল্যাবোধ ঠিকমতো বিকশিত হচ্ছে না। এখানে হানাহানি চলছে। এখানে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিপন্ন- এ ধরনের দেশ তো আমরা চাইনি। সুতরাং এটা আমাদের বিবেককে দংশন করে। কী ধরনের দেশ আমরা সৃষ্টি করলাম যে আমরা আজকে এ অবস্থায় আছি। এটাই আমাদের মানসিক যন্ত্রণা। আমাদের পক্ষে এর চেয়েও অনেক ভালো থাকা সম্ভব ছিল।
যুগান্তর : এর কারণ কী, এখানে গণতন্ত্রের বিকাশ ঠিকমতো হয়নি?
আকবর আলি খান : বাংলাদেশে আমরা মনে করি একটা সুষ্ঠু নির্বাচন হলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। নির্বাচনের প্রয়োজন অবশ্যই রয়েছে। কিন্তু নির্বাচন হলেই সব সমস্যার সমাধান হবে না। এর প্রমাণ হল ১৯৯১ সালে মোটামুটি সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে, ’৯৬ সালেও সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে, ২০০১ ও ২০০৮-এর নির্বাচনও সুষ্ঠু হয়েছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে একেকটা সরকার পরিবর্তনের পর সমস্যা আরও অনেক বেড়ে যাচ্ছে। এখানে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের তিনটি সমস্যা সম্বন্ধে আমাদের সজাগ হওয়া দরকার। প্রথম সমস্যা হল, আমাদের গণতন্ত্রের মূল্যবোধ ক্ষয়ে গেছে এবং উদারনৈতিক মূল্যবোধ ছাড়া গণতন্ত্র চর্চা করা সম্ভব নয়। এখানে সহিংস ও সাংঘর্ষিক পরিবেশে আমাদের মূল্যবোধের দারুণ অবনতি ঘটেছে। এটা অবশ্য সবাই স্বীকার করে। আরও দুটি বিষয়, যেটা বেশি আলোচিত হয় না সেটা হল, বাংলাদেশের ভোটাররা একদিনের বাদশা। তারা ভোটের সময় এসে ভোট দেয়, তারপর সরকার এসে মৌরশিপাট্টার মতো দেশকে শাসন করে, তাদের যা খুশি তাই করে। দুর্ভাগ্যবশত বেশির ভাগ সরকারই কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে নির্বাচিত হয় না। তারা নির্বাচিত হন ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ ভোটে। অথচ দেশকে তারা দাপটের সঙ্গে শাসন করেন। এটা আসলে সঠিক নয়। যেটা হওয়া উচিত সেটা হল, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের চেতনার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে দেশ পরিচালনা করা উচিত। এটা কিন্তু গণতন্ত্রের জন্য, শুধু আমাদের দেশ নয়, পৃথিবীর সব দেশে গণতন্ত্রের জন্য একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যুগান্তর : কম-বেশি এভাবেই চলছে এদেশের গণতন্ত্র এবং আমাদের দেশ চালকরা এতেই মনে হয় খুশি?
আকবর আলি খান : প্লেটো কিংবা অ্যারিস্টটল যে অর্থে গণতন্ত্রকে সংজ্ঞায়িত করেছেন, আমি সেই অর্থে গণতন্ত্র বুঝি না। আমার গণতন্ত্রের সংজ্ঞা দিয়েছেন পেরিক্লিস, যিনি এথেন্সের জননায়ক ছিলেন। পেরিক্লিসের বক্তব্য হল, গণতন্ত্র হল সেই ব্যবস্থা, যেখানে সব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত সব মানুষের মতামত নিয়ে নির্ধারণ করা হয়। তবে সে সময় এথেন্সের জনসংখ্যা কম ছিল, অধিকাংশ লোকেরই ভোটাধিকার ছিল না, সেখানে এ ব্যবস্থা সম্ভব ছিল। এখন যেহেতু সর্বজনীন ভোটাধিকার রয়েছে এবং অনেক বেশি জনসংখ্যা, সেহেতু এ ব্যবস্থা আর নেই। এ ব্যবস্থা না থাকার ফলে যেটা হচ্ছে সেটা হল, সিদ্ধান্ত নেয় জনপ্রতিনিধিরা। এখানে আমাদের প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র করা হয়েছে। প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়। এটার পরিবর্তনের প্রয়োজন রয়েছে। এবং এটা পরিবর্তন করা সম্ভব, কারণ আগে আপনার বক্তব্য সবার কাছে নিয়ে যাওয়া কঠিন ছিল, কিন্তু এখন সারা দেশে টেলিভিশন ছড়িয়ে পড়েছে। এর মাধ্যমে সরাসরি আপনার বক্তব্য জনগণের কাছে নিয়ে যাওয়া এখন সম্ভব। গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে গণভোটের ব্যবস্থা প্রবর্তন করা যেতে পারে, যাতে জনগণের অংশগ্রহণ সম্ভব। যে রকম ইংল্যান্ডে গণভোটের মাধ্যমে বিরাট সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, তারা ব্রেক্সিট করে বেরিয়ে এসেছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে। একইভাবে স্কটল্যান্ড স্বাধীন হবে কী হবে না এর ওপর গণভোট হয়েছে। পৃথিবীর বেশির ভাগ উন্নত দেশে গণভোটের চর্চা করা হচ্ছে। বাংলাদেশে গণভোটের চর্চা আদৌ করা হচ্ছে না। যেমন ধরেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার হবে কী হবে না- এ সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক দলগুলোর নির্ধারণ করা উচিত নয়। এটা গণভোটে জনগণের কাছে দেয়া হোক এবং জনগণ যা বলবে তাই হবে। গণভোটের প্রবর্তন হলে দেশে বর্তমানে যে হরতাল সংস্কৃতি সেটাও অনেকাংশে দুর্বল হয়ে যাবে। সুতরাং গণভোটের বিষয়টি আমি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করি।
যুগান্তর : কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে গণভোটের অভিজ্ঞতা তো ভালো নয়। সামরিক শাসনের সময় গণভোটে বড় ধরনের জালিয়াতির অভিযোগও ছিল।
আকবর আলি খান : এর আগে যা হয়েছে সেটা মার্শাল ল’ বা সামরিক সরকারকে জায়েজ করার জন্য, সেটা গণভোটের বিষয় নয়। আমি মনে করি, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে গণভোটের বিধান থাকা উচিত। অবশ্য শাসনতন্ত্রে গণভোটের বিধান ছাড়াও গণভোট করা যেতে পারে। বিলাতে কোনো শাসনতন্ত্র নেই, গণভোটের কোনো বিধানও নেই। সরকারের সিদ্ধান্তের ওপরই গণভোট করা হচ্ছে এবং গণভোট যদি ঠিকমতো পরিচালিত হয় তাহলে আমাদের রাজনৈতিক সমস্যা অনেক কমে যাবে। দেশের লোকও দেশ শাসন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে পারবে।
যুগান্তর : রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ এবং সুন্দরবন রক্ষা প্রশ্নে বিতর্ক চলছে- এ নিয়েও গণভোট হতে পারে?
আকবর আলি খান : হতে পারে। এটা হওয়া উচিত। তবে এটাও মনে রাখতে হবে, সব বিষয়ে এবং প্রত্যেক দিন গণভোট হওয়া উচিত নয়। এক্ষেত্রে আইন করে এবং কত লোক চাইলে গণভোট হবে তা নির্ধারণ করা উচিত।
যুগান্তর : আপনি গণভোটের পাশাপাশি আনুপাতিক হারে নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রবর্তনের কথা বলছিলেন।
আকবর আলি খান : আমাদের দেশে আনুপাতিক হারে নির্বাচন প্রবর্তন করা উচিত। আনুপাতিক হারের নির্বাচন পদ্ধতিতে বাংলাদেশের মতো ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ ভোট নিয়ে সরকার পরিচালনা করা সম্ভব নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে দেখেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প ২৮ লাখ ৬০ হাজার ভোট কম পেয়েছেন হিলারি ক্লিনটনের চেয়ে; কিন্তু ইলেকটোরাল কলেজ ভোটে ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। সেদেশের জনসংখ্যার কমপক্ষে ২ শতাংশ ট্রাম্পের চেয়ে হিলারি ক্লিনটনকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে বেশি পছন্দ করেছিলেন। এ অবস্থা ভারতে, যুক্তরাজ্যে। এ অবস্থা কানাডায়। প্রায় সব দেশে এ ব্যবস্থা আছে। আবার কোনো কোনো দেশে মিশ্র পদ্ধতি প্রবর্তন করা হয়েছে। আপনি যদি দুটি হাউস করেন। একটা হাউসে একই নির্বাচনে আপনার সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে নির্বাচন হবে, আরেকটি নির্বাচন হবে আনুপাতিক হারে। এ দুটি কক্ষ নিয়ে যদি একটি সংসদ হয় এবং উভয় কক্ষে যদি সরকারের মেজরিটি লাগে, তাহলে এ ধরনের সরকারে শুধু জনসাধারণের মতামতেরই প্রতিফলন হবে না, একদলের পক্ষে দেশ শাসন করাও কঠিন হবে। এসব ক্ষেত্রে সাধারণত কোয়ালিশন সরকার হয়। দেশে সংঘর্ষের রাজনীতি দূর করার একটা উপায় হল কোয়ালিশন সরকার প্রতিষ্ঠা করা। এছাড়া আনুপাতিক হারের নির্বাচনী ব্যবস্থায় ভোট জাল করে কোনো লাভ হয় না। কারণ এক্ষেত্রে ৩ লাখ ভোট জাল করলে একজন প্রতিনিধি পাবেন। আর বর্তমানে দেশে যে পদ্ধতি আছে সেখানে ঠিকমতো ১০০ ভোট জাল করতে পারলেও আপনার প্রার্থী চলে আসবে। সুতরাং আমাদের এখানে যে পরিস্থিতি সেখানে ভোট জাল বন্ধ করা সম্ভব নয়; কিন্তু আনুপাতিক হারে নির্বাচন হলে অনেক বেশি সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব। এ পরিস্থিতিতে এ বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের চিন্তা করা দরকার। এগুলো শুধু বাংলাদেশের বিষয় নয়। এগুলো গণতন্ত্রের আগামী দিনের সমস্যা।
যুগান্তর : তবে রাজনৈতিক দলসহ বিশিষ্টজনদের অনেকেই অভিযোগ করে থাকেন, ভোটের অধিকারই বাংলাদেশে এখন প্রশ্নবিদ্ধ।
আকবর আলি খান : বাংলাদেশে যে নির্বাচনী ব্যবস্থা, এটা অত্যন্ত কেন্দ্রীভূত। এখানে একদিনে সারা দেশে নির্বাচন হয়। আবার সামরিক-বেসামরিক, সরকারি-স্বায়ত্তশাসিত ও অন্যান্য সংস্থা মিলে ১৬ থেকে ১৭ লাখ সরকারি কর্মচারী ভোটের দায়িত্বে থাকে। এদের প্রত্যেকেই ফলাফলের ওপর প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা রাখে। নির্বাচন কমিশনের পাঁচজন লোকের পক্ষে এ ১৭ লাখ লোককে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। আরও একটা সমস্যা হচ্ছে, আমাদের দেশের সরকার একস্তর বিশিষ্ট। এখানে বিভিন্ন স্তরে সরকার নেই। না থাকার ফলে কেন্দ্র থেকে যে সিদ্ধান্ত হয় এটা একেবারে গ্রাম পর্যন্ত কার্যকর করা সম্ভব। কিন্তু ভারতে এটা সম্ভব নয়। ভারতে পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দোপাধ্যায় একদলের মুখ্যমন্ত্রী। মোদি কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধানমন্ত্রী, তিনি আরেক দলের। কলকাতা শহরের পুলিশ কিন্তু নিয়ন্ত্রণ করেন মমতা, সেখানে মোদির নিয়ন্ত্রণ নেই। এ ধরনের চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স আমাদের নেই।
আমাদের এখানে গত তিন দশকে ক্রমাগত আমলাতন্ত্রকে রাজনীতিকরণ করা হয়েছে। এতে সরকারি কর্মচারীদের প্রতি জনগণের শ্রদ্ধা অনেক কমে গেছে। ভারতে যখন দুই মাস, তিন মাস ধরে নির্বাচন হয় তখন প্রথমদিকের ব্যালট বাক্সগুলো সরকারি কর্মচারীদের হেফাজতে থাকে। আমার সন্দেহ, বাংলাদেশে একজন সরকারি কর্মচারী পাবেন কিনা যার কাছে সব দল ২৪ ঘণ্টার জন্য ব্যালট বাক্স রাখতে রাজি হবে। এ ধরনের অনাস্থা যেখানে, সেখানে সরকার যদি ক্রিয়াশীল না হয় তাহলে সুষ্ঠু নির্বাচন করা শক্ত। আসলে পুরোপুরি সুষ্ঠু নির্বাচন কোনো অবস্থাতেই সম্ভব নয়। সুষ্ঠু নির্বাচন ক্রমেই আমাদের জন্য শক্ত হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
যুগান্তর : এক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের বড় ভূমিকা রয়েছে।
আকবর আলি খান : নির্বাচন কমিশন অনেক কাজ করতে পারে, যেগুলো এখন পর্যন্ত কোনো নির্বাচন কমিশন করেনি। যেমন একটা ভোট কেন্দ্রে ৯০ শতাংশের বেশি ভোট যদি পড়ে, তাহলে কার্যত ধরে নিতে পারেন সেখানে জাল ভোট হয়েছে। এখন নির্বাচন কমিশন ফলাফল প্রকাশের আগে দেখতে পারে কোন কেন্দ্রে কত শতাংশ ভোট পড়েছে। যেখানে ৯০ শতাংশ ভোট পড়েছে সেটা বাদ দিলে যদি ফলাফল পরিবর্তিত হয়ে যায়, তাহলে নির্বাচন কমিশন সেখানে ফল ঘোষণা না করে সেই কেন্দ্রের ফলাফল বাতিল করতে পারে। আবার পুনর্নির্বাচনও করতে পারে। একইভাবে যদি দেখা যায়, একটি নির্বাচন কেন্দ্রে গত চারটি নির্বাচনে শতকরা ৬০ থেকে ৭০ ভাগ ভোট পড়েছে, আর বর্তমানে পড়েছে মাত্র ২০ ভাগ- সেক্ষেত্রে ধরে নিতে হবে কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটেছে। এখানেও নির্বাচন কমিশনের উচিত হবে কম্পিউটারের মাধ্যমে সেগুলো চিহ্নিত করে বাতিল করে দেয়া। এ ধরনের অতিসহজ কাজও কোনো নির্বাচন কমিশন কোনোদিন করেনি। নিচ থেকে রেজাল্ট আসে সেটাকেই তারা অনুমতি দিয়ে দেয়। এ কারণে নির্বাচন কমিশনের অনেক পরিবর্তনের প্রয়োজন রয়েছে। সরকারের সহযোগিতার প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু এগুলোর সব ক্ষেত্রেই ক্রমেই অবনতি ঘটছে। তো এটাকে যদি উন্নত না করা হয়, তাহলে আমার মনে হয় না আমরা সুষ্ঠু নির্বাচনের কাছাকাছি যেতে পারব।
যুগান্তর : নির্বাচন কমিশন নিয়ে প্রতি পাঁচ বছর পরপর বিতর্ক তৈরি হয়। সদ্য গঠিত নির্বাচন কমিশন নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। এক্ষেত্রে আইনও নেই।
আকবর আলি খান : আইনটাকে খুব বড় সমস্যা মনে করি না। আইন করেই যদি সমস্যার সমাধান করা যেত, তাহলে বহু আগেই আইন হয়ে যেত। আর নির্বাচন কমিশন সম্বন্ধে ভবিষ্যদ্বাণী করা অত্যন্ত শক্ত। আপনি পাঁচজনকে নির্বাচন করলেন, এরপর দেখা গেল তারা সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারেনি। কেন পারেনি? তাদের সাহসের অভাব। তবে যখন সাহসের প্রয়োজন হবে তখন কে কতটা সাহসী হবে, সমস্যা আসার আগে সেটা বলা সম্ভব নয়। আবার অনেক ক্ষেত্রে যাদের মনে হয় তারা দালালি করবে, তারাই দেখা যায় সাংঘাতিক স্বাধীনভাবে কাজ করবে। যেমন ধরেন ভারতের সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার টিএন সেশন। তিনি রাজীব গান্ধীর অত্যন্ত প্রিয় কর্মকর্তা ছিলেন। তাকে যখন নির্বাচন কমিশনে পাঠানো হয় তখন ধরা হয়েছিল তিনি রাজীব গান্ধীর এজেন্ট হিসেবে কাজ করবেন। অথচ ভারতের নির্বাচন কমিশনের ইতিহাসে স্বাধীনচেতা নির্বাচন কমিশনার হিসেবে সবার আগে এখন সেশনের নাম করা হয়। আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথা যদি ধরেন, সেখানকার সবচেয়ে লিবারেল কোর্ট হিসেবে পরিচিত আর্ল ওয়ারেনের কোর্ট। আর্ল ওয়ারেন ছিলেন রিপাবলিকান পার্টির লোক, তিনি দু’বার ক্যালিফোর্নিয়ায় রিপাবলিকান দল থেকে নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে রিপাবলিকান দল থেকে নির্বাচন করে হেরে গেছেন। কাজেই তিনি কী রকম রিপাবলিকান তা নিয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। অথচ তিনিই ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে লিবারেল প্রধান বিচারপতি। আসলে কমিশনে দরকার উপযুক্ত ব্যক্তিদের। যারা আইনকানুন জানেন। যাদের আইনের প্রতি শ্রদ্ধা আছে। যারা দলাদলিতে অংশ নেননি। এরকম ব্যক্তিদের নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দিলে তারা কাজ করতে পারবেন। কিন্তু এর সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের কাজের পদ্ধতি পরিবর্তনেরও প্রয়োজন রয়েছে।
যুগান্তর : কিন্তু নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা ও স্বাধীনতা থাকলেও যারা দায়িত্বে থাকেন তারা তা প্রয়োগ করেন না। এক ধরনের নতজানু মনোভাব দেখা যায়, তাদের সাহসী হতে দেখা যায় না।
আকবর আলি খান : কে সাহসী হবে আর কে হবে না এটা কিন্তু আগে থেকেই নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। যাকে ভীরু মনে হয় সেও সাহসী হতে পারে। ভারতে লাল বাহাদুর শাস্ত্রী যখন প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন, তখন অনেকেই ধরেই নিয়েছিল এই ছোটখাটো অহিংস মানুষটি মোটেই সাহসী হবেন না। অথচ ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় অসাধারণ নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। কাজেই এটা গ্যাম্বলিংয়ের মতো। আগে থেকে নির্ধারণ করা যায় না।
যুগান্তর : কিন্তু এখন পর্যন্ত যারাই দায়িত্ব পেয়েছেন বেশির ভাগেরই নিজেদের ক্ষমতা প্রয়োগের নজির কম।
আকবর আলি খান : হয়তো তারা বিতর্কে যেতে চাননি বা চান না। এটা একটা কারণ হতে পারে। আরেকটি সমস্যা হল, নির্বাচন কমিশনে এখন সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সুতরাং সেখানে যদি দলীয় প্রতিনিধি থাকে তাহলে সমস্যা হয়।
যুগান্তর : নির্বাচন কমিশনের ওপর সরকারের অনেক চাপ থাকে?
আকবর আলি খান : যে নির্বাচন কমিশন নতজানু হবে না, সে ধরনের নির্বাচন কমিশনের কাছে অনুরোধ করার আগে সরকার অনেকবার চিন্তাভাবনা করে।
যুগান্তর : তাহলে নির্বাচন কমিশনের কাজের ওপরই কি নির্ভর করবে সরকার চাপ প্রয়োগ করবে কী করবে না?
আকবর আলি খান : হ্যাঁ, তাদের কাজের ওপরই নির্ভর করবে সব। টিএন সেশন যেটা করেছেন সেটা হল, যেখানে ভারত সরকার অন্যায় আদেশ দিয়েছে সেখানে তিনি সরকারের বিরুদ্ধে সুপ্রিমকোর্টে মামলা পর্যন্ত করেছেন। কাজেই এ ধরনের নজিরের কোনো অভাব নেই। আমার মনে হয়, নির্বাচন কমিশন যদি একটা টিম হিসেবে কাজ করতে পারে তাহলে এটা অনেক শক্তিশালী হবে। সেখানে যদি বিভিন্ন ধরনের উপাদান আসে যারা পরস্পর একটা টিম গড়ে তুলতে পারে না, সেই নির্বাচন কমিশন দুর্বল হয়।
যুগান্তর : এখানে নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সরকারের সহযোগিতা ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন করা কঠিন। ২০১৯ সালের জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে রাজনীতির মূল আলোচনাই এখন এটি।
আকবর আলি খান : নির্বাচনের সময় অনেক ধরনের ব্যবস্থা হতে পারে। একটা হল, যে সরকার ক্ষমতায় আছে সেই সরকারই নির্বাচন করবে। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই এটা করা হয়। সেসব দেশে নির্বাচনকালীন সরকার কোথায় ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবে আর কোথায় পারবে না এটা নিয়ে কোনো সংশয় নেই। কিন্তু আমাদের দেশে ১৬ থেকে ১৭ লাখ সরকারি কর্মচারীসহ একদিনে ভোট অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে সরকারি কর্মচারীরা বিতর্কিত এবং যেখানে সরকারের প্রভাব ভোটের ওপর পড়ে সেখানে ক্ষমতাসীন সরকার নির্বাচন করলে সেটা নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠবে।
দ্বিতীয় ফর্মুলা হতে পারে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা। আমাদের এখানে সুপ্রিমকোর্ট এটাকে বেআইনি বলেছেন। কারণ হল তত্ত্বাবধায়ক সরকার অনির্বাচিত সরকার। আমি আমার বইয়ে দেখিয়েছি, ইচ্ছা করলে সংবিধান সংশোধন করে নির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারও করা যায়। সেক্ষেত্রে রায় কার্যকর হবে না। পাকিস্তানে অতি সম্প্রতি সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান করা হয়েছে এবং সুপ্রিমকোর্ট এতে অংশগ্রহণ করছে। কাজেই এটা যে একেবারেই অসম্ভব তা নয়।
আরেকটা পদ্ধতি হতে পারে নির্বাচনের আগে একটা সর্বদলীয় সরকার করা। সেই সর্বদলীয় সরকারে যদি সংসদের সব দল থাকে তাহলে সুবিধা হয়। কিন্তু এভাবে সর্বদলীয় সরকার করা হলে সেখানে বিএনপির কোনো প্রতিনিধি থাকবে না। তবে সংবিধানে যেহেতু শতকরা ১০ ভাগ অনির্বাচিত মন্ত্রী নেয়া সম্ভব, সেহেতু বিএনপির একজন অথবা ২০ জনের মন্ত্রিপরিষদ হলে সেখানে দু’জন তাদের প্রতিনিধি নেয়া সম্ভব। কিন্তু সমস্যা হল, দেশ তো মন্ত্রিসভা শাসন করে না। দেশ শাসন করেন প্রধানমন্ত্রী। কাজেই প্রধানমন্ত্রীর যে ক্ষমতা সেটা ওই সময়ে হ্রাস করতে হবে। সেটা সংবিধান সংশোধন না করেও হ্রাস করা সম্ভব। রুলস অব বিজনেসে যেসব বিধান আছে সেগুলোকে নির্বাচনের সময় সংশোধন করা অর্থাৎ কে ডিসি হবে বা এসপি হবে এটা প্রধানমন্ত্রী অনুমোদন করবেন না। এটা অনুমোদন করবে মন্ত্রিসভা। যদি মন্ত্রিসভায় সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদন না হয়, তাহলে সে ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে পরামর্শ করে রাষ্ট্রপতি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন।
আরেকটি বিষয়, আমি মনে করি যদি সর্বদলীয় সরকার গঠিত হয়, যিনি প্রধানমন্ত্রী থাকেন তাকে দলের প্রধান থাকা উচিত হবে না। সাধারণ সম্পাদকের ক্ষেত্রেও তা-ই। তাকেও ওই ধরনের মন্ত্রিসভায় রাখা উচিত হবে না। সরকারের মন্ত্রিসভায় থাকবেন, দলেও থাকবেন- এটা আমাদের দেশেও ছিল না। বঙ্গবন্ধু যখন রাষ্ট্রপতি হলেন তখন তিনি অন্য ব্যক্তিকে দলের সভাপতি করেছেন। কিন্তু আমরা এখন কি তা মানছি? এটা হওয়া উচিত নয়। এর ফলে নির্বাচনের ওপর প্রভাব পড়ে।
এ ধরনের ব্যবস্থা করতে পারলে আমার মনে হয়, সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার না করেও একটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে।
যুগান্তর : নতুন করে আবার ই-ভোটিং চালু নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। সরকার এর পক্ষে, বিএনপি বিপক্ষে। কী বলবেন?
আকবর আলি খান : আমি মনে করি, ই-ভোটিং এক সময় প্রবর্তন করতে হবে। কিন্তু এখন আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের টাকা বাঁচাতে পারি না, সেই অবস্থাতে যদি ই-ভোটিংয়ে যাই, তাহলে অনেক কেলেংকারি হবে। যে দেশ সেন্ট্রাল ব্যাংকের টাকা রক্ষা করতে পারে না, ডিজিটালাইজেশনে সেই দেশ নির্বাচনে কী করতে পারবে সেটা নিয়ে সন্দেহ আছে। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এখন অভিযোগ উঠেছে, রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনকে প্রভাবিত করেছে।
যুগান্তর : ই-ভোটিং কি তাহলে ধাপে ধাপে হওয়া উচিত?
আকবর আলি খান : এটা ধাপে ধাপে হওয়া উচিত। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা উচিত। প্রথম পরীক্ষার পর বিগত নির্বাচন কমিশন কিন্তু এটাকে চালু করতে রাজি হয়নি। তারা নিশ্চিত ছিল না যে এটা ঠিকমতো কাজ করছে।
যুগান্তর : আপনার বইয়ে বিচার বিভাগের বিষয়টিও এসেছে। বলেছেন, ‘বিচার ব্যবস্থায় মামলা মিথ্যা দিয়ে শুরু মিথ্যা দিয়ে শেষ’।
আকবর আলি খান : বিচার বিভাগের সমস্যা অনেক জটিল। বিচার বিভাগ সম্বন্ধে বঙ্গবন্ধু যেটা বলে গেছেন সেটা হল চূড়ান্ত কথা। এখানে মিথ্যা দিয়ে মামলা শুরু করতে হয়। মিথ্যা দিয়ে মামলা শেষ করতে হয়। তিনি বলেছেন, এদেশে মানুষ কোনো ইনসাফ পায় কিনা সন্দেহ আছে- আমি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে শতকরা একশ ভাগ একমত।
যুগান্তর : এর পেছনের কারণ কী মনে করেন?
আকবর আলি খান : এর কারণ হল, ব্রিটিশরা আমাদের দেশে বিচারব্যবস্থা প্রবর্তন করেছে তাদের দেশের অনুকরণে। বিলাতে বেশির ভাগ মামলা হয় যেখানে কোনো উকিল থাকে না, ফৌজদারি মামলায়ও না, দেওয়ানি মামলায়ও না। আর আমাদের এখানে এমন একটা মামলা নেই যেখানে উকিল নেই। এই ব্যবহারজীবীরা (আইনজীবী) যেখানে মামলা আছে সেখানে পাল্টা মামলা করছে। এভাবে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছে। যদি বাংলাদেশের আজকের বিচারব্যবস্থার অবক্ষয় আমরা দেখি, এর একটা বড় দায় ব্যবহারজীবীদের গ্রহণ করতে হবে। আসলে বিচারব্যবস্থা সংস্কারের কোনো বন্ধু নেই। আমার বাবা একজন আইনজীবী ছিলেন এবং তিনি এ ধরনের কাজ করতেন না। আমি জানি, এখনও অনেক আইনজীবী আছেন যারা খারাপ কাজ করেন না। কিন্তু সামগ্রিকভাবে যদি দেখি তাহলে আইনজীবীদের যে অবদান সেটা সম্বন্ধে সন্দেহ রয়েছে।
যুগান্তর : বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে সরকার ও বিচার বিভাগের ঠোকাঠুকি দেখা যায়। সাম্প্রতিক সময়ে কিছু কর্মকাণ্ডে এমনটা লক্ষ করা গেছে।
আকবর আলি খান : ঠোকাঠুকি তো থাকবেই। যদি দুটি সমান ক্ষমতাসম্পন্ন শক্তি থাকে, তাহলে তাদের মধ্যে ঠোকাঠুকি থাকবেই। আসলে প্রশ্ন হল, আপনি উপযুক্ত বিচারক নিয়োগ করছেন কিনা। উপযুক্ত বিচারক যদি নিয়োগ করেন তাহলে যে লোকটা দায়িত্ব পালন করবে, সে লোকটা এমনভাবে দায়িত্ব পালন করবে যেটা তার বিবেকের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। একটু আগে আমি আর্ল ওয়ারেনের কথা বলেছিলাম। আর্ল ওয়ারেন রিপাবলিকান পার্টির সদস্য হওয়া সত্ত্বেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে লিবারেল জাজ ছিলেন। আমাদের এখানেও বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে পেশাগত যোগ্যতার ওপর সবচেয়ে গুরুত্ব দেয়া উচিত। কিন্তু আমরা খবরের কাগজে দেখতে পাই, এমন বিচারকও নাকি নিয়োগ দেয়া হয়েছিল, যিনি আদৌ আইন পাস করেননি। এ ধরনের বিচারক নিয়োগ করলে তো স্বাধীনতার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।
যুগান্তর : আপনি নিজে আমলা ছিলেন। কাছ থেকে দেখেছেন আমলাতন্ত্রকে। সেখানে যোগ্যতা কতটা মানা হচ্ছে এখন? আর রাজনীতিই বা কতটা ভর করেছে আমলাতন্ত্রে?
আকবর আলি খান : এটাকে আমি গ্রেশামস ল’ সিনড্রোম বলি। গ্রেশামস ল’ বলে, বেড মানি ড্রাইভস গুড মানি। বাংলাদেশে এখন ভালো কাজের কোনো চাহিদাও নেই, মূল্যায়নও নেই। এখন খারাপ কাজ করেও আমলাতন্ত্রে সফল হওয়া সম্ভব। এটা ঠিক করতে গেলে আমলাতন্ত্রকে সম্পূর্ণরূপে নতুন করে সাজাতে হবে। বর্তমানে যে আমলাতন্ত্র, এই আমলাতন্ত্র অবিশ্বাসের ওপর প্রতিষ্ঠিত। আমাদের এমন আমলাতন্ত্র করতে হবে, যেটা বিশ্বাসের ওপর প্রতিষ্ঠিত। সেটা করতে গেলে এই যে এত স্তরে স্তরে অনুমোদন, সেগুলোর পরিবর্তনের প্রয়োজন রয়েছে। এর সঙ্গে সরকারের দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাও অনেক বাড়াতে হবে। বাংলাদেশে যে কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে যে সময় লাগে, তার দশ ভাগের এক ভাগ সময়ে উন্নত দেশে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
যুগান্তর : বিভিন্ন ইস্যুতে সুশীলসমাজ সোচ্চার। তাদের ভূমিকা নিয়ে সরকারের প্রশ্ন আছে। বিরোধী পক্ষও মতের মিল না হলে সমালোচনা করেন তাদের।
আকবর আলি খান : বাংলাদেশে সুশীলসমাজ অত্যন্ত দুর্বল অবস্থায় আছে। এর কারণ হল সুশীলসমাজের ভেতরে রাজনীতি ঢুকে পড়েছে। রাজনীতির বাইরে যারা আছেন তারাও কিন্তু এ দায় থেকে রক্ষা পাচ্ছেন না। কারণ যারা রাজনীতি করেন তারা কৌশলে রাজনীতি করেন না, তাদের ওপর উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে রাজনৈতিক রঙ আরোপ করেন। বলেন, এরাও রাজনীতি করছে। এ অবস্থায় সুশীলসমাজ খুবই দুর্বল। অন্যদিকে সুশীলসমাজ যেসব দাবি-দাওয়া উত্থাপন করেছে এর অনেক বাস্তবায়িত হয়েছে, কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। আমাদের এখানে মানবাধিকার কমিশন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে; কিন্তু মানবাধিকার পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি হয়েছে বলে আমরা কোনো খবর পাইনি। আমাদের এখানে তথ্য অধিকার আইন হয়েছে; কিন্তু এর মাধ্যমে যে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এ ধরনের কোনো খবর পাওয়া যায়নি। আমাদের এখানে বিচার বিভাগ পৃথক করা হয়েছে; কিন্তু এর সুফল জনগণ পেয়েছে এ ধরনের কোনো তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। এসব সংস্কারের দাবি তুলে সুশীলসমাজ অনেক আশা জাগিয়েছিল। কিন্তু যদি দেখা যায় এগুলো থেকে কোনো লাভ হয় না, তখন তাদের প্রতি জনগণের আস্থা অনেক কমে যাবে বলে আমার মনে হয়। সেজন্য সুশীলসমাজের প্রথম যেটা করা উচিত তা হল তাদের মধ্যে ঐক্য গড়ে তোলা। ঐক্য গড়তে পারলে সুশীলসমাজের কথা সরকার শুনতে বাধ্য হবে এবং অন্যরাও শুনতে বাধ্য হবে। কিন্তু যদি আজকের মতো বিভক্ত সুশীলসমাজ থাকে তাহলে তার পক্ষে বড় পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়।
যুগান্তর : সুশীলসমাজের অবস্থান নিয়ে আশাবাদের জায়গাও আছে। সাফল্যও আছে।
আকবর আলি খান : এ সাফল্যের তো কোনো ফল পাওয়া যায়নি। এটাই হল দুঃখ। ফল পাওয়া না যাওয়ার কারণ হল সুশীলসমাজ বলে আসছে, বিভিন্ন কমিশনে প্রার্থী মনোনয়নের জন্য স্বাধীন কমিটি করতে হবে। কিন্তু স্বাধীন কমিটি বাংলাদেশে যেভাবে কাজ করে এতে ফল পাওয়া যাচ্ছে না। একটি কমিটিও কোনো অসাধারণ ব্যক্তিকে সামনে আনতে পারেনি। এর কারণ হল কমিটি কাগজপত্র দেখে একজনকে নির্বাচন করে। এখন এ কাগজপত্রের পেছনে আরও কী আছে সেগুলোর ওপর হিয়ারিং নেয়া উচিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সেজন্য স্বাধীন কমিটির দ্বারা নির্বাচন করা হয় না। সরকারই নির্বাচন করে। সরকারের নির্বাচিত যে প্রার্থী, তাকে সংসদীয় কমিটির সামনে যেতে হয় এবং সংসদীয় কমিটির কাছে তখন বিভিন্ন লোকজন সেই ব্যক্তির বিরুদ্ধে তথ্য নিয়ে আসে এবং সেসব তথ্য সেখানে আলোচিত হয়। যেমন, এবার ডোনাল্ড ট্রাম্প লেবার সেক্রেটারি হিসেবে যাকে নিয়ে এসেছেন, তার সম্পর্কে তথ্য হল তিনি একজন মেইডকে নিয়োগ করেছেন যিনি অবৈধ অভিবাসী। এর ফলে রিপাবলিকানরা বলল, আমরা তাকে সমর্থন করি না। এবং সে নির্বাচিত হয়নি। যারা অত্যন্ত খারাপ তাদের বের করার এটাই উপায়। কিন্তু স্বাধীন কমিটি কোনোদিন বের করতে পারবে না কে ভালো আর কে খারাপ।
যুগান্তর : তাহলে তাদের দাবির ভিত্তি নিয়ে কি প্রশ্ন তুলছেন? অনেকেই তকমা দিতে চান ডোনারনির্ভর সুশীলসমাজের।
আকবর আলি খান : সুশীলসমাজের কিছু কিছু প্রতিনিধির পক্ষ থেকে যেসব দাবি-দাওয়া করা হয়, সেসব আসলে ডোনারদেরও দাবি-দাওয়া। কিন্তু আসলে ডোনাররা বাংলাদেশের প্রকৃত পরিস্থিতি জানে কিনা এ নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। যেমন ধরেন, এখানে তথ্য অধিকার আইন নিয়ে অনেক হৈচৈই করা হচ্ছিল। কিন্তু বাংলাদেশে তথ্য অধিকারের কোনো সমস্যা আছে বলে আমি মনে করি না। এমন কোনো সরকারি নথি নেই যেটা সম্বন্ধে খবরের কাগজে নিউজ বের হয় না। তথ্য অধিকার আইনে গেলে আপনি এসব তথ্য না-ও পেতে পারেন। কিন্তু অন্যভাবে গেলে পাওয়া যায়। তাই বাংলাদেশের যে পরিস্থিতি সে অনুযায়ী সুশীলসমাজের দাবি-দাওয়া উত্থাপন করা উচিত বলে আমি মনে করি।
যুগান্তর : এতকিছুর পরও বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, আমাদের সামনে আশার আলো কি দেখেন?
আকবর আলি খান : আশাবাদের জায়গা হল, আমাদের এখানে বাইরে থেকে গণতন্ত্র আসেনি। এখানে গণতন্ত্রচর্চার ইতিহাস দীর্ঘদিনের। পাল বংশের উত্থান গণতান্ত্রিকভাবে হয়েছে। আর দ্বিতীয়ত, আমাদের এখানে অনেক কিছু তর্ক-বিতর্কের মাধ্যমে নিষ্পন্ন হয়েছে। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন একটা সুন্দর বই লিখেছেন- ‘আর্গুমেন্টেটিভ ইন্ডিয়ান’। সেই বইতে তিনি দেখিয়েছেন আমাদের এখানে গণবিতর্কের যে ঐতিহ্য রয়েছে সেই ঐতিহ্য এবং আমাদের যে গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য- এগুলোকে ভিত্তি করে যদি সামনের দিকে এগিয়ে যাই, তাহলে নিশ্চয়ই আমরা ভালো করতে পারব।
যুগান্তর : ধন্যবাদ সময় দেয়ার জন্য।
আকবর আলি খান : ধন্যবাদ।
যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন