ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি। ১৯৫২ সালে ভাষার জন্য যুদ্ধ করে বাংলাদেশ বিশ্ব দরবারে অবিশ্বাস্য নজির স্থাপন করেছিল। আর কিছুদিন পর ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশসহ সাড়া পৃথিবী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করবে। অথচ এই ভাষার দেশে এখন সংমিশ্রণ ভাষার প্রভাব বেশি। বাংলা ভাষায় উর্দুর যে ক্ষমতায়ণ দেখানোর কথা ছিল সেটা সম্ভব না হলেও ইংরেজি ভাষা বাংলায় ক্রমস মিশে যাচ্ছে। বাংলা ভাষার জন্য যুদ্ধ হলেও আমরা কেন ইংরেজি তারিখে ভাষা দিবস পালন করি? বাংলা ভাষার নেপথ্য অনেক ইতিহাস আর এই নিয়ে নানান বিতর্কিত বিষয়ে কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড: আবুল কাশেম ফজলুল হক।
প্রিয়.কম: বিশ্বব্যাপী বাংলা ভাষার শক্ত অবস্থানের পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান কাদের?
আবুল কাশেম ফজলুল হক: বাংলা সমৃদ্ধ ভাষা। মধুসূদন ও বঙ্কিমচন্দ্রের কালে তাঁদের সমকক্ষ কোনো লেখক জাপান, চীন, ইন্দোচীন, ইন্দোনেশিয়া, বাংলার বাইরে ভারতের অন্যান্য প্রদেশ, আফগানিস্তান, ইরান, ইরাক, আরব, সিরিয়া, মিসর, লিবিয়া, আবিসিনিয়া ও দক্ষিণ আমেরিকার রাষ্ট্রসমূহের ভাষায় ছিল না। রামমোহন, দেবেন্দ্রনাথ, অক্ষয়কুমার, বিদ্যাসাগর, বিকেকাকন্দ, কালীপ্রসন্ন ঘোষ প্রমুখ মনীষী চিন্তা প্রকাশের ও সমাজসংস্কারের প্রয়োজনে, পরম ভালোবাসায়, কঠোর পরিশ্রম সহকারে বাংলা ভাষাকে গড়ে তুলেছিলেন। বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতিকে তাঁরা অভিন্ন সত্তা রূপে দেখেছিলেন। এ দুয়ের একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটির অস্তিত্ব তাঁরা কল্পনা করতে পারতেন না। জগদীশচন্দ্র বসু, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদি, রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল, শরৎচন্দ্র, রোকেয়া, নজরুল, জীবনানন্দ, বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কও, মানিক বাংলা ভাষায় যে সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন, তা পৃথিবীর যে কোনো উন্নত জাতির সাহিত্যেও সমতুল্য। ইসমাইল হোসেন সিরাজী, মোহাম্মদ লুতফর রহমান, এস ওয়াজেদ আলি, আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, আবুল হুসেন, কাজী আবদুল ওদুদ, কাজী মোতাহার হোসেন, মোতাহের হোসেন চৌধুরী, মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ, আবুল ফজল, আহমদ শরীফ, শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান ও আরো অনেক লেখক চিন্তা ও অনুভূতি প্রকাশেরও সমাজ প্রগতির প্রয়োজনে বাংলা ভাষায় লিখেছেন এবং ভাষাটিকে ক্রমাগত সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর করেছেন। জগদীশচন্দ্র বসু, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিস, মেঘনাদ সাহা, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, কাজী মোতাহার হোসেন প্রমুখ বিজ্ঞানী বিজ্ঞানচর্চা ও আবিষ্কার উদ্ভাবন দিয়ে বাংলার তো বটেই, বিশ্বের জ্ঞানভাণ্ডারকেও সমৃদ্ধ করেছেন।
প্রিয়.কম: ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর বর্তমানে বাংলা ভাষা সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কি?
আবুল কাশেম ফজলুল হক: বাংলা ভাষার অবস্থা এবং অবস্থান কোনোটাই এখন মোটেই ভালো নয়। তবে ওই আন্দোলনটি ছিল রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলন। আর ঘটনাক্রমে বর্তমানে বিভিন্ন মহল বিভিন্ন স্বার্থে ও বিভিন্ন তাগিদে এ সম্পর্কে নানারকম ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ দিচ্ছেন। কিন্তু আমরা যদি ঐতিহাসিকভাবে দেখি তাহলে দেখব যে পাকিস্তানের রাষ্ট্র কাঠামোতে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার জন্য তখন আন্দোলন করা হয়েছিল। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুর পাশে স্থান দিতে হবে এই দাবি ধীরে ধীরে প্রবল থেকে প্রবলতর হয়। কিন্তু বিষয়টি কেবল ভাষার ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ ছিল না। এর সাথে তখনকার পূর্ব বাংলার জনগণের জাতীয় সংস্কৃতির প্রশ্ন ছিল অর্থাৎ তখনকার পাকিস্তান সরকার পাকিস্তানী জাতীয় সংস্কৃতি প্রবর্তনের চেষ্টা করছিল।
প্রিয়.কম: বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলন হলেও দেশে ৮ ফাল্গুনের পরিবর্তে ইংরেজি তারিখ ২১ ফেব্রুয়ারি পালন করা হচ্ছে। এটাকে কিভাবে দেখছেন?
আবুল কাশেম ফজলুল হক: ২১ ফেব্রুয়ারির পরিবর্তে যারা ৮ ফাল্গুন পালন করতে চান তাদের দৃষ্টিভঙ্গী খুব বেশি আবেগ নির্ভর। তবে আমার মতে, বর্তমানে এই দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে চলা ঠিক হবে না। যখনই আপনি ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে ৮ ফাল্গুনে আসবেন তখনই যদি কেউ প্রশ্ন করে পলাশীর যুদ্ধ কবে হয়েছিল তার বাংলা তারিখ চাই। ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ কবে হয়েছিল তার বাংলা তারিখ চাই। ১৬ ডিসেম্বরের বদলে বা ২৬ মার্চের বদলে বাংলা তারিখ চাই। এরকম বহু বিষয় সামনে আসবে আর তখন আমরা একটা বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে যাব। এমনিতেই ভাষার বেহাল দশা; তাতে আরো বিভ্রান্তি বা বিতর্ক সৃষ্টি হলে সেটি ভালো হবে না।
প্রিয়.কম: উর্দু থেকে বাংলাকে প্রভাব মুক্ত রাখার জন্য আন্দোলন হলেও এখন আমরা ইংরেজির সাথে বাংলার সংমিশ্রণ করছি। সে ক্ষেত্রে কি বাংলা ভাষার স্বাতন্ত্রতা থাকছে?
আবুল কাশেম ফজলুল হক: আজ এই বিষয়টি চরম বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। গোটা বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশেই সবচেয়ে বেশি এনজিওর বিস্তার ঘটেছে। আর এসব এনজিওর কর্তা ব্যক্তি বা যারা এনজিওতে কাজ করেন তারা আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফাইনান্সিং এজেন্সির কাছ থেকে টাকা নিয়ে তাদের কর্মকাণ্ড চালান। তারা ইংরেজির মাধ্যমে কাজ করেন এবং একই সাথে রয়েছে অর্থ যোগ। ফলে তারা চান বাংলা দিয়ে দরকার কি ইংরেজি দিয়েই যদি আমাদের কর্মকাণ্ড চলে তাহলে সেটিই ভালো। তাছাড়া যাদের কাছ থেকে আমরা টাকা নেই তাদের ভাষা ব্যবহার করলে তারা খুশি হয়। ফলে এটি একটি কারণ ওই সব এনজিওদের ইংরেজির দিকে ঝুঁকে পড়ার। তাছাড়া আমাদের দেশে ইংরেজি ভাষার দিকে ঝুঁকে যাওয়ার আরেকটি কারণ হচ্ছে সিভিল সোসাইটি। এই সিভিল সোসাইটি বলতে আমরা বুঝি বুদ্ধিজীবীদের এনজিও। বিশ্বায়নের পক্ষে বিদেশে এবং দেশে যারা রয়েছেন তারাও বলতে শুরু করেছেন, বাংলা দিয়ে আর কি হবে; বাংলা কতদিনই বা থাকবে? এখনতো পৃথিবীতে এক ভাষাই হয়ে যাবে ইংরেজি; ফলে সবাইকে ইংরেজির দিকে যাওয়া উচিত। এ রকমভাবে নানান কথা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রচার করা হচ্ছে।
প্রিয়.কম: আমাদের দেশে ‘আদিবাসী’দের ভাষা সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন জানতে চাই।
আবুল কাশেম ফজলুল হক: বাংলাদেশে বাংলা ভাষা ছাড়াও আছে ৪৫টি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর ৪৫টি মাতৃভাষা। এই ৪৫টি জনগোষ্ঠীর মোট জনসংখ্যা বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার এক শতাংশের সামান্য বেশি। আবার কিছু লোকের মধ্যে আছে উর্দুভাষা। আরবি, সংস্কৃত ও পালি ভাষার সঙ্গে রয়েছে ধর্মীয় অনুষঙ্গ। বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল ও জাতিসংঘের প্রভাবে বাংলাদেশে কিছু জায়গায় কার্যকর রয়েছে ইংরেজি ভাষা। বাংলাদেশের যে নাগরিকেরা বাংলাভাষি নন, তারাও বাংলা শেখেন কিংবা শিখতে বাধ্য হন। বাংলা বাদ দিয়ে কেবল তাদের ভাষা নিয়ে যদি তারা চলতে চেষ্টা করে, তাহলে তা দ্বারা কি তারা উন্নতি করতে পারবে? বিলীয়মান মাতৃভাষাসমূহকে রক্ষা করার জন্য জাতিসংঘের যে আয়োজন, তা সফল হবে না। জাতিসংঘের আদিবাসী-নীতি ভুল। ‘আদিবাসী’দের চিরকালের জন্য ‘আদিবাসী’ করে রাখা, কিংবা ‘আদিবাসী’দের চিরকালে ‘আদিবাসী’ থাকা একটু উচিত নয়। যুক্তরাষ্ট্রে, কানাডায়, অস্ট্রেলিয়ায়, নিউজিল্যান্ডে প্রচলিত আদিবাসী নীতি ন্যায়সঙ্গত নয়। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অবস্থার পটভূমিতে ‘আদদিবাসী’দের ও ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীসমূহের ভাগ্য নির্ধারণে ‘আদিবাসী’দের ও ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীসমূহের স্বাধীন ভূমিকা বাঞ্ছনীয়।
প্রিয়.কম: ভাষা দিবস পালনকে অর্থবহ করতে এবং বাংলাকে সর্বক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠার জন্য আপনার পরামর্শ কি?
আবুল কাশেম ফজলুল হক: ভাষা দিবসকে অর্থবহ করতে বা সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রতিষ্ঠার জন্য শিক্ষা ব্যবস্থাকে পুনর্গঠিত করতে হবে। শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলা ভাষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। ইংরেজি আমরা শিখব, আমাদের সিলেবাসে যতখানি ইংরেজি আছে প্রয়োজন হলে তার চেয়ে বেশি করে নেব কিন্তু আমাদের জাতির বা রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ সব কিছুই আমরা বাংলা ভাষাতে করবো। দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে, আমাদের একটি রাষ্ট্রীয় ভাষা নীতি দরকার। এতে বাংলা ভাষায় কি কাজ করবো এবং ইংরেজি, আরবি, ফার্সী, উর্দু, সংষ্কৃত ও পালি এমনকি আমাদের আদিবাসীদের যে সমস্ত ভাষা রয়েছে সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট রাষ্ট্রীয় বা জাতীয় ভাষা নীতি থাকতে হবে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রাথমিক পর্যায় থেকে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত বাংলা ভাষাকে পরিপূর্ণ গুরুত্বের সাথে কার্যকর করতে হবে। ভাষা আন্দোলনের প্রকৃত ইতিহাস সকলকে জানাতে হবে। যেসকল পুস্তকে ভাষা আন্দোলনের প্রকৃত ইতিহাস আছে তা খুঁজে বের করে সকলকে সঠিক ইতিহাসের চর্চা আগামী দিনে বাংলা ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের ভুল সংশোধনে সহায়ক হবে। ভাষা আন্দোলনই স্বাধীনতা আন্দোলনের সূতিকাগার। বর্তমানে বাংলাদেশে একচ্ছত্র ক্ষমতা কোন শুভ লক্ষণ নয়। আগামী বাংলাদেশ বিনির্মাণে সঠিক নেতৃত্ব গড়ে তুলতে এখনই ছাত্র-যুব সমাজকে পদ দেখানোর জন্য সকল দেশপ্রেমিক ও জ্ঞানীদের নিকট আহ্বান জানাই।
https://www.priyo.com/articles/abul-quasem-fazlul-huq-interview-2017216
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন