ড. বদিউল আলম মজুমদার। স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর সাধারণ সম্পাদক। সমাজ-রাজনীতির নানা বিষয় নিয়ে লিখছেন নিয়মিত। যুক্ত আছেন জনসম্পৃক্ত নানা আন্দোলনের সঙ্গেও। নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে ফের উত্তপ্ত দেশের রাজনীতি। সকলের দৃষ্টি এখন সার্চ (অনুসন্ধান) কমিটির দিকে। সার্চ কমিটির সঙ্গে মতবিনিময় সভায় বিশিষ্টজনের মধ্যে ড. বদিউল আলমও গুরুত্বপূর্ণ মতামত তুলে ধরেন। কী আলোচনা হয় সার্চ কমিটির সঙ্গে, আগামী নির্বাচন কমিশনের কাছে প্রত্যাশা কী, গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ কী-এমন সব প্রশ্ন নিয়ে সম্প্রতি মুখোমুখি হন সাপ্তাহিক-এর। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু
সাপ্তাহিক : রাজনীতি ফের নির্বাচনমুখী। সবার দৃষ্টি এখন সার্চ কমিটির দিকে। বিশিষ্ট নাগরিকদের সঙ্গে সার্চ কমিটির বৈঠকে আপনিও ছিলেন। কী আলোচনা হলো বৈঠকে?
ড. বদিউল আলম মজুমদার : সার্চ কমিটির বৈঠকে আমি স্পষ্টভাবে মতামত তুলে ধরেছি। আমি বলেছি, সুজনÑসুশাসনের জন্য নাগরিক’-এর পক্ষ থেকে আমরা বহুদিন থেকেই বাংলাদেশের নির্বাচন ও নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য করার লক্ষ্যে কাজ করে আসছি। হুদা কমিশনের সময়কালে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় যেসব সংস্কার হয়েছে, তার প্রায় সবগুলোর ক্ষেত্রেই আমাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। বিশেষ করে ভূমিকা ছিল নির্বাচনে প্রার্থীদের সম্পর্কে ভোটারদের তথ্য প্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে। এ কারণে নির্বাচন কমিশন নিয়ে মতামত তুলে ধরা আমরা দায় মনে করেছি। চিঠির মাধ্যমে আমাকে আমন্ত্রণ জানানোয় আমি ধন্যবাদও ব্যক্ত করেছি সার্চ কমিটিকে।
সাপ্তাহিক : আপনার উদ্দেশে লেখা সার্চ কমিটির চিঠিতে কী ছিল?
ড. বদিউল আলম মজুমদার : মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কাছ থেকে আমি যে চিঠি পেয়েছি, তাতে বলা হয়েছে যে, ‘বাংলাদেশের নির্বাচন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সাথে ... মতবিনিময়’ করার অভিপ্রায় থেকে অনুসন্ধান কমিটি আমাদের ডেকেছে। কিন্তু চিঠিতে কোনো এজেন্ডা দেওয়া নেই। তাই আমি নিশ্চিত ছিলাম না যে, কমিটি কোন বিষয়ে আমার মতামত শুনতে চাইছে।
সাপ্তাহিক : এমন মতবিনিময় তো অতিতেও হয়েছে। ফলাফল তো ইতিবাচক হয়নি...
ড. বদিউল আলম মজুমদার : হ্যাঁ, অতীতের এমন ধরনের মতবিনিময় সভার ফলাফল সম্পর্কে বাংলাদেশে আমাদের অভিজ্ঞতা ইতিবাচক নয়।
অনেকেরই স্মরণ আছে, ২০১১ সালের সংবিধান সংশোধনের লক্ষ্যে বেগম সাজেদা চৌধুরীর নেতৃত্বে ১৫ সদস্য নিয়ে গঠিত বিশেষ সংসদীয় কমিটির কথা। সেই কমিটি তিনজন সাবেক প্রধান বিচারপতি, ১১ জন শীর্ষ আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ, ১৮ জন বুদ্ধিজীবী, ১৮টি দৈনিকের সম্পাদক, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল ও সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম নেতাদের মতামত নেয়। আমারও ওই অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার সুযোগ হয়।
বিশেষজ্ঞ ও বিশিষ্ট নাগরিকদের অধিকাংশই সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বহাল রাখার এবং ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে না রাখার পক্ষে মত দিয়েছিলেন। কিন্তু এসব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির কোনো সুপারিশ না রেখেই কমিটি তার প্রতিবেদন চূড়ান্ত করে।
সাপ্তাহিক : এই সার্চ কমিটি নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?
ড. বদিউল আলম মজুমদার : রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশনের পুনর্গঠন বিষয়ে ৩১টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন। এরপর তিনি আগের ছকেই অনুসন্ধান কমিটি গঠন করেছেন, একমাত্র ব্যতিক্রম হলো নাগরিক সমাজের একজন প্রতিনিধি এবং একজন নারীকে কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা। আমাদের মনে প্রশ্ন; অধিকাংশ রাজনৈতিক দল কি এই ধরনের অনুসন্ধান কমিটিরই প্রস্তাব করেছিল? রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্তে কি সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দলের মতামত প্রতিফলিত হয়েছে? তা যদি না করে থাকে এবং রাষ্ট্রপতি যদি রাজনৈতিক দলের মতামত আমলে না নিয়ে থাকেন, তাহলে পুরো সংলাপ প্রক্রিয়াই ছিল একটি অর্থহীন আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। রাষ্ট্রপতি বিষয়টি খোলাসা করলে আমরা আশ্বস্ত হতাম।
সাপ্তাহিক : নির্বাচন কমিশন গঠনে আইন করার প্রসঙ্গ সামনে আসছে। এ ব্যাপারে আপনার মত জানতে চাই?
ড. বদিউল আলম মজুমদার : অধিকাংশ দলই সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদের নির্দেশনা অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের লক্ষ্যে একটি আইন প্রণয়ন করার পক্ষে মত দিয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে এ ব্যাপারে কোনো সুপারিশ আমাদের চোখে পড়েনি। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, নির্বাচন কমিশনে নিয়োগের ব্যাপারে আইন প্রণয়ন না করার কারণেই এরইমধ্যে অনেক বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। আপনাদের কমিটির আইন ও সাংবিধানিক ভিত্তি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। আইন থাকলে আইনেই নির্ধারিত করা থাকত কাদের নিয়ে অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা হবে। তাই আইন প্রণয়নের ব্যাপারে রাষ্ট্রপতির উদ্যোগহীনতা আমাদের হতাশ করেছে।
সাপ্তাহিক : তাহলে এমন আনুষ্ঠানিকতার অর্থ কী দাঁড়ায়?
ড. বদিউল আলম মজুমদার : আমাদের সমাজে একটি কথা প্রচলিত আছেÑ ‘আমার কাজ আমি করমু, তোরে শুধু জি¹াই লমু’। আমি আশা করি যে, আমাদের সঙ্গে মতবিনিময়ও যেন নিতান্তই লোক দেখানো বিষয়ে পরিণত না হয়। আমি তাই বলেছি, এটা যেন আমাদের মুখ বন্ধ করার একটা পদক্ষেপও না হয়। আমার প্রত্যাশা থাকবে যে, আজকে যেসব বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ এখানে উপস্থিত হয়েছেন তাঁদের মতামত যথাযথভাবে বিবেচনায় নিয়েই কমিটি তার সুপারিশ প্রণয়ন করবে। এই মতামত কীভাবে এবং কতটুকু বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে তার একটি প্রতিবেদন কমিটি তার সুপারিশের সঙ্গে প্রকাশ করবেÑ সেই প্রত্যাশাও আমি ব্যক্ত করছি।’
সাপ্তাহিক : সমালোচনা থাকলেও সার্চ কমিটির আলাপ-আলোচনাকে অনেকে ইতিবাচকভাবেও দেখছেন।
ড. বদিউল আলম মজুমদার : আলাপ-আলোচনা ও মতবিনিময় করাই গণতান্ত্রিক পদ্ধতি। শিষ্টাচার বজায় রেখে সমালোচনা করাও গণতান্ত্রিক পদ্ধতির অংশ। তাই নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের ব্যাপারে প্রথমবারের মতো নাগরিকদের মতামত নেওয়ার এই প্রচেষ্টাকে আমি ইতিবাচক হিসেবেই দেখছি।
সাপ্তাহিক : সার্চ কমিটির কাছে আপনার প্রত্যাশা কী?
ড. বদিউল আলম মজুমদার : কমিটির কাছে আমার প্রত্যাশা হলোÑ তারা যেন কতগুলো সুস্পষ্ট মানদণ্ডের (ড়নলবপঃরাব পৎরঃবৎরধ) আলোকে সুপারিশ তৈরি করেন, অস্পষ্ট বিবেচনার (সবৎব লঁফমবসবহঃ) ভিত্তিতে নয়। সার্চ কমিটি মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে যে নামগুলো সুপারিশ করবে তাতে যেন বস্তুনিষ্ঠতা থাকে।
আরও সুস্পষ্টভাবে বলতে গেলে, আমি প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনার হওয়ার যোগ্যতা ও অযোগ্যতার মাপকাঠি নির্ধারণ করে তার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অনুরোধ করছি।
সাপ্তাহিক : এ ব্যাপারে তো প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে...
ড. বদিউল আলম মজুমদার : রাষ্ট্রপতি তার সুপারিশে যোগ্যতার একটিমাত্র মানদণ্ডই নির্ধারিত করে দিয়েছেন, তা হলো যে কমিশনারদের মধ্যে অবশ্যই একজনকে নারী হতে হবে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্য কমিশনারদের যোগ্যতার মানদণ্ডে সম্পর্কে ২৫ জানুয়ারি ২০১৭ তারিখে জারি করা প্রজ্ঞাপনে কিছুই বলা নেই। তাই কাজটি আরও সুচারুরূপে সম্পন্ন করার এবং সিদ্ধান্তকে নাগরিকদের কাছে গ্রহণযোগ্য করার লক্ষ্যে বিবেচনাধীন ব্যক্তিদের যোগ্যতা-অযোগ্যতার মানদণ্ড নির্ধারণ করার আহ্বান জানিয়েছি। তবেই কমিটির পক্ষে নিতান্তই ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের পরিবর্তে বস্তুনিষ্ঠভাবে ‘ক’-এর জায়গায় ‘খ’-কে অথবা ‘খ’-এর জায়গায় ‘ক’-কে বেছে নেওয়া সম্ভব হবে। সুস্পষ্ট মানদণ্ড নির্ধারণের ব্যাপারে অন্য দেশের আইন পর্যালোচনা করা যেতে পারে।
সাপ্তাহিক : রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে ৫টি নাম প্রস্তাব করা হয়েছে। এ নিয়ে আপনার মতামত কী?
ড. বদিউল আলম মজুমদার : আমি মনে করি, যে কোনো আগ্রহী নাগরিকেরই নাম প্রস্তাব করার সুযোগ থাকা উচিত। কারণ নির্বাচন শুধু রাজনৈতিক দলের বিষয় নয়। নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য না হলে সব নাগরিককেই তার মাশুল দিতে হয়।
আমি আরও আশা করি যে, প্রস্তাবিত নামগুলো, বিশেষত রাষ্ট্রপতির আহ্বানে রাজনৈতিক দলগুলোর জমা দেওয়া নামগুলো যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেওয়া হবে। আমি মনে করি, এসব নামের মধ্যে যেগুলো নির্ধারিত মানদণ্ড পূরণ করবে সেগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ সমর্থন পাওয়া নামগুলোকে অনুসন্ধান কমিটির পক্ষ থেকে সুপারিশ করা হবে।
সাপ্তাহিক : নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রস্তাবিত নামের সংক্ষিপ্ত তালিকা জনসম্মুখে প্রকাশের প্রশ্ন উঠেছে।
ড. বদিউল আলম মজুমদার : আমরা মত দিয়েছি, যে নামগুলো সার্চ কমিটি পাবে সেগুলো থেকে, নির্ধারিত মানদণ্ডের আলোকে, একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা তৈরি করবে এবং তালিকার অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিদের সম্মতি সাপেক্ষে, জনগণের অবগতির জন্য তা প্রকাশ করবে।
আমার পরামর্শ ছিল, তালিকায় থাকা ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকারও নেবে। এছাড়াও সংক্ষিপ্ত তালিকায় থাকা ব্যক্তিদের সম্পর্কে একটি গণশুনানির আয়োজন করবে। কমিটি যাদের নাম রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করবে, তাঁদের সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে তা জনসম্মুখে প্রকাশ করবে।
আমরা আরও বলেছি, প্রতিবেদনে সুপারিশকৃত ব্যক্তিদের প্রোফাইল অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পাশাপাশি, তাদের বেছে নেওয়ার যৌক্তিকতা এবং বিশিষ্ট নাগরিক ও রাজনৈতিক দলের মতামত কীভাবে এবং কতটুকু বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে তা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করবে।
নাগরিকরা যদি জানতে পারে যে, নিতান্তই ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের পরিবর্তে বস্তুনিষ্ঠ মানদণ্ডের আলোকে এবং স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় নির্বাচন কমিশনে নিয়োগের জন্য নামগুলো সুপারিশ করা হয়েছে, তাহলে কমিটির এই প্রচেষ্টা নাগরিকদের কাছে অধিক গ্রহণযোগ্যতা পাবে।
প্রসঙ্গত, বিখ্যাত মার্কিন বিচারক লুইস ব্রেন্ডাইসের মতে, সূর্যের আলোই সর্বাধিক কার্যকর রোগ প্রতিষেধক।
সাপ্তাহিক : সার্চ কমিটির প্রসঙ্গে বললেন। নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে আপনার কোনো বিশেষ সুপারিশ আছে কিনা?
ড. বদিউল আলম মজুমদার : বাংলাদেশ সংবিধানের ১১৮(১) অনুচ্ছেদে বলা আছে: ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অনধিক চারজন নির্বাচন কমিশনার লইয়া বাংলাদেশের একটি নির্বাচন কমিশন থাকিবে এবং উক্ত বিষয়ে প্রণীত কোন আইনের বিধানাবলী-সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগ দান করিবেন।’
অর্থাৎ আমাদের সংবিধান অনুযায়ী, সর্বোচ্চ পাঁচজনকে নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন হওয়ার কথা। কিন্তু ২৫ জানুয়ারির প্রজ্ঞাপনে কতজন কমিশনারকে নিয়ে কমিশন গঠন করা হবে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট করে কিছু বলা হয়নি। বরং প্রতিটি শূন্যপদের বিপরীতে দুইজন ব্যক্তির নাম সুপারিশের অনুরোধ করা হয়েছে।
সাপ্তাহিক : এ ব্যাপারে আপনার নিজস্ব কোনো মত আছে কিনা?
ড. বদিউল আলম মজুমদার : আমি মনে করি, পাঁচজন নয়, নির্বাচন কমিশনে তিন জন হলে ভালো হয়। তিনজনকে নিয়ে আমাদের কমিশন গঠন হওয়া উচিত, কারণ পাঁচজনের পরিবর্তে তিনজনকে নিয়ে ঐকমত্যের ভিত্তিতে কাজ করা অপেক্ষাকৃত সহজ।
সাপ্তাহিক : এটি কেন মনে করছেন?
ড. বদিউল আলম মজুমদার : পাশের দেশ আমাদের কাছে উৎকৃষ্ট উদাহরণ। ভারতের মতো বিশাল রাষ্ট্রে তিনজন কমিশনার নিয়েই সফলতার সঙ্গে নির্বাচন পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে। আমাদের দেশেও তিনজনকে নিয়ে গঠিত হুদা কমিশন কৃতিত্বের সঙ্গে তাদের দায়িত্ব পালন করেছেন। তাই আমি প্রত্যাশা করব যে, অনুসন্ধান কমিটি সর্বোচ্চ তিনজনকে নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠনের সুপারিশ রাষ্ট্রপতির কাছে করবেন।
একইসঙ্গে আমার প্রত্যাশা হলো, প্রথমেই প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগ দেয়া হবে এবং পরবর্তী নিয়োগগুলো ধাপে ধাপে দেওয়া হবে। অর্থাৎ প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের ছয়মাস পর একজন নির্বাচন কমিশনার এবং তারও ছয় মাস পর আরেকজন কমিশনারকে নিয়োগ দেওয়া হবে।
সাপ্তাহিক : এমনটি চাইছেন কেন?
ড. বদিউল আলম মজুমদার : এভাবে নিয়োগের ফলে নির্বাচন কমিশনের কাজে ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে। আমি আশা করি যে, রাষ্ট্রপতির কাছে এই ধরনের সুপারিশ কমিটির এখতিয়ারবহির্ভূত হবে না, কারণ রাষ্ট্রপতি তাঁর সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুবিধার্থেই তাদের সহায়তা নিচ্ছেন।
সাপ্তাহিক : সার্চ কমিটিকে দেয়া সময়সীমা নিয়ে আপনার কোনো অভিমত আছে কিনা?
ড. বদিউল আলম মজুমদার : প্রসঙ্গত, সুপারিশ পেশ করার জন্য কমিটিকে দশ কর্মদিবস সময় দেওয়া হয়েছে। এই স্বল্প সময়ে যদি কাজ সঠিকভাবে সম্পন্ন করা যাবে না বলে তারা মনে করেন, তাহলে রাষ্ট্রপতির কাছে আরও সময় চাওয়ার আমি পরামর্শ দেব। কারণ বর্তমান নির্বাচন কমিশনের বিদায়ের আগে নতুন কমিশন নিয়োগ না দিলে রামায়ণ-মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না।
সাপ্তাহিক : আগামী নির্বাচন কমিশনের কাছে আপনার প্রত্যাশা কী?
ড. বদিউল আলম মজুমদার : নির্বাচন কমিশন ও কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে আমাদের দেশে বহুদিন থেকেই বিতর্ক চলে আসছে। বিতর্কের কারণে অনেক কমিশনকেই তাদের মেয়াদ শেষ হবার আগেই পদত্যাগ করতে হয়েছে। কোনো কোনো কমিশনকে অমর্যাদার সঙ্গেও বিদায় নিতে হয়েছে।
দুর্ভাগ্যবশত, বিদায়ী রকিবউদ্দিন কমিশনেরও বিশ্বাসযোগ্যতা এবং আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর জনগণের আস্থাহীনতা আজ ব্যাপক। দায়িত্বে অবহেলার জন্য বর্তমান কমিশনের সকল সদস্যকে উচ্চ আদালতে গিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা পর্যন্ত করতে হয়েছে।
তাই আগত কমিশনের দায়িত্ব হবে নির্বাচন কমিশনকে ধ্বংসের পথ থেকে রক্ষা করা এবং নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর জনগণের আস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। কমিশনের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মনোবল ফিরিয়ে আনা।
একইসঙ্গে অনেক নারী ভোটারের বাদ পড়ার কারণে ভোটার তালিকায় যে ত্রুটি দেখা দিয়েছে, তা জরুরি ভিত্তিতে দূর করা।
সাপ্তাহিক : কমিশনে এমন আস্থা রাখা যায়?
ড. বদিউল আলম মজুমদার : আমরা আশাবাদী মানুষ। আস্থার জন্য প্রয়োজন হবে সৎ, যোগ্য, নিরপেক্ষ ও সাহসী ব্যক্তিদের নিয়ে আগামী নির্বাচন কমিশন গঠন করা। এমন একটি নির্বাচন কমিশন গঠনের কাজে সহায়তা করার গুরুদায়িত্ব পড়েছে সার্চ কমিটির ওপর। আমি কায়মনোবাক্যে কমিটির সর্বাত্মক সফলতা কামনা করি।
সাপ্তাহিক : নির্বাচন ঘিরে যে সংকট সৃষ্টি হয়েছে, এর মধ্যে আমাদের ভবিষ্যৎ কী?
ড. বদিউল আলম মজুমদার : গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট অনেক বদলে গেছে। এই সময়ে পদ্মা নদীতে অনেক জল গড়িয়েছে। আমরা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অনেকদূর এগিয়েছি, কিন্তু কার্যকর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে পড়েছি।
গণতান্ত্রিক যাত্রাপথের সূচনা হয় সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ তথা গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে, যে নির্বাচন হয় প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক। আজ আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রায় ধ্বংসের মুখে এবং গণতন্ত্র সংকটাপন্ন।
চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছি যে, যেসব দেশে গণতন্ত্রহীনতা বিরাজ করে, সেসব দেশেই ধর্মীয় উগ্রবাদের বিস্তার ঘটছে। বিখ্যাত মার্কিন লেখক সারা চেইস তার ‘থিবস অব স্টেট’ গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে, আফগানিস্তানে তালেবানের উত্থানের পেছনে রয়েছে প্রহসনমূলক নির্বাচন, সর্বস্তরের ব্যাপক দুর্নীতি ও মানুষের ব্যাপক বঞ্চনা।
আমরা দেশেও ধর্মীয় উগ্রবাদের উষ্ণ নিঃশ্বাস আমাদের ঘাড়ে অনুভব করছি, যা পাঁচ বছর আগেও ছিল বহুলাংশে অনুপস্থিত। এ অবস্থায় সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনের স্বার্থে সঠিক ও সাহসী ব্যক্তিদের নিয়ে একটি নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠনে সহায়তার দায়িত্ব আজ সার্চ কমিটির ওপর। জাতির বৃহত্তর স্বার্থে আশা করব, এই গুরুদায়িত্বটি কমিটি সঠিকভাবে পালন করবে, যাতে আমরা আরও ভয়াবহ সংকটে নিপতিত না হই।
সাপ্তাহিক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন