নবনিযুক্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) খান মোহাম্মদ নুরুল হুদাকে ২০০১ সালে বিএনপি বাধ্যতামূলক অবসর দিয়েছিল। বিএনপি সূত্র যদিও বলেছে, জনতার মঞ্চের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কারণে তাঁর বিরুদ্ধে ওই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। প্রথম আলোকে দেওয়া এক টেলিফোন সাক্ষাৎকারে এই কর্মকর্তা সেই অভিযোগ খণ্ডন করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমি তখন কুমিল্লার ডিসি ছিলাম। আমি জনতার মঞ্চে যোগ দিইনি এবং বিএনপিও সেই অভিযোগ আনেনি। চাকরিতে ২৫ বছর হলে কোনো কারণ না দেখিয়ে কাউকে অবসর দেওয়া যায়। কিন্তু আমি তার বিরুদ্ধে আইনি লড়াই করেছি। আদালতের রায়ে চাকরি ফিরে পেয়েছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি পেছনের দিকে তাকাতে চাই না। কারও প্রতি রাগ বা অনুরাগের বশবর্তী হব না। আমি নিরপেক্ষভাবে আমার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট থাকব।’
প্রথম আলো: জনতার মঞ্চ এবং বিএনপির প্রতি আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কী? বিএনপির একটি সূত্র বলেছে, জনতার মঞ্চে আপনার সম্পৃক্ততা ছিল।
খান মোহাম্মদ নুরুল হুদা: বিএনপি কিছু বলেছে? আমি শুনিনি।
প্রথম আলো: সাবেক সচিব ও প্রাক্তন বিএনপি নেতা মোফাজ্জল করিম দাবি করেছেন, জনতার মঞ্চের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কারণেই তাঁরা আপনার বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিয়েছিলেন।
নুরুল হুদা: জনতার মঞ্চে আমি ছিলাম না। আমি ছিলাম কুমিল্লার ডেপুটি কমিশনার (ডিসি)। আর জনতা মঞ্চ ছিল ঢাকায়। সুতরাং, কুমিল্লার ডিসি হয়ে ঢাকায় অংশগ্রহণের প্রশ্ন আসে না।
প্রথম আলো: জনতার মঞ্চ যখন ঢাকায় চলছিল, তখন কুমিল্লায় ডিসি অফিস থেকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ছবি নামানোর ঘটনা ঘটেছিল। সেটা ঠিক?
নুরুল হুদা: এ রকমের একটি ঘটনা ঘটেছিল বলে আমি শুনেছিলাম। ডিসি চলে আসার পরে রাতে একটি দপ্তরে যদি কিছু ঘটে, তা ডিসির জানার কথা নয়। কারণ, ডিসি রাতে অফিসে থাকেন না। তখনকার দিনে কে নামিয়েছে বা নামায়নি, তা আমি জানি না।
প্রথম আলো: বিএনপি আপনাকে কী অভিযোগে চাকরিচ্যুত করেছিল?
নুরুল হুদা: চাকরিচ্যুত নয়, তারা আমাকে বাধ্যতামূলক অবসর দিয়েছিল। তার আমি কোনো কারণ জানি না। কোনো কারণ উল্লেখ করা হয়নি। সরকারি চাকরি বিধি অনুযায়ী কোনো সরকারি কর্মকর্তার চাকরির মেয়াদ যদি ২৫ বছর পূর্ণ হয়, তাহলে তাঁকে অবসর দিতে পারে। এ জন্য কারণ দেখাতে হয় না।
প্রথম আলো: আপনি তখন কী পদে দায়িত্ব পালন করছিলেন?
নুরুল হুদা: তখন ছিলাম ঢাকা সিটি করপোরেশনের চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার।
প্রথম আলো: ওই পদ থাকার আগে আপনি ঢাকায় আর কী পদে দায়িত্ব পালন করেছিলেন?
নুরুল হুদা: নন-ফরমাল এডুকেশনে পরিচালক ছিলাম প্রায় দুই বছর। দুই বছরের বেশি সংসদ সচিবালয়ে যুগ্ম সচিব ছিলাম। এরপর পরিবেশ মন্ত্রণালয়ে যুগ্ম সচিব ছিলাম অনেক দিন, স্থানীয় সরকারের একটি প্রকল্পে ঢাকা ডেপুটি ডিরেক্টর অব লোকাল গভর্নমেন্ট, ঢাকা বিভাগের ১৬ জেলার পরিচালক ছিলাম।
প্রথম আলো: যখন আপনি বাধ্যতামূলক অবসরে আসেন, তখন আপনার পদবি কী ছিল?
নুরুল হুদা: যুগ্ম সচিব।
প্রথম আলো: আপনি কোন সালে চাকরিতে পুনর্বহাল হয়েছিলেন?
নুরুল হুদা: ২০০৮-০৯ সালে।
প্রথম আলো: তাহলে কি আওয়ামী লীগ সরকার এসে আপনাকে পুনর্বহাল করেছে?
নুরুল হুদা: ঠিক সেভাবে বলা যাবে না। কারণ, আদালতের রায়ের কারণে আমি চাকরি ফিরে পেয়েছি। আদালতের রায় ছিল, ভূতাপেক্ষভাবে সব সুযোগ-সুবিধা, পদমর্যাদাসহ আমাকে চাকরি ফিরিয়ে দিতে হবে।
প্রথম আলো: আপনি কি অতিরিক্ত সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন?
নুরুল হুদা: না।
প্রথম আলো: তাহলে কি অতিরিক্ত সচিব ও সচিব এই দুই পদমর্যাদাই ভূতাপেক্ষভাবে কার্যকর হয়েছিল?
নুরুল হুদা: ঠিক তাই।
প্রথম আলো: ২০০১ সালের পর আপনি আর নিয়মিত চাকরিতে ফেরেননি?
নুরুল হুদা: না, আর ফিরে যাইনি।
প্রথম আলো: অবসরজীবনে এসে কিছু করেছেন কি? বর্তমান সরকারের সময়ে আপনি কী কাজ করেছেন?
নুরুল হুদা: অনেক কিছু করেছি। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে মিউনিসিপ্যাল ডেভেলপমেন্ট ফান্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলাম পাঁচ বছর। এর আগে প্রায় তিন বছর বেসরকারি জেমকন গ্রুপের পরিচালক ছিলাম। কাজী শাহেদ আহমেদের জেমকন গ্রুপে। নর্থ ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানির চেয়ারম্যান ছিলাম। এটাও সরকারি—২০১০ পর্যন্ত ছিলাম।
প্রথম আলো: সর্বশেষ কী করছিলেন?
নুরুল হুদা: কনসালট্যান্সি করছিলাম ২০১৫ সাল থেকে। আরবান ডেভেলপমেন্ট, ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে।
প্রথম আলো: আপনি কি সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন? ৭১-এর ১৮ নভেম্বর পটুয়াখালীর গলাচিপার পানপট্টিতে?
নুরুল হুদা: হ্যাঁ, আমি ওই যুদ্ধের কমান্ডার ছিলাম। হতাহতের সংখ্যা সঠিক মনে নেই। তবে কেউ কেউ বলেন, পাঁচ-ছয়জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়েছিল।
প্রথম আলো: আরেকটি বিষয়, আপনি যে ভূতাপেক্ষভাবে চাকরি পেলেন, সেটা কি প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল না সুপ্রিম কোর্টের রায়ে?
নুরুল হুদা: এখানে দুই আদালতেরই সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। তবে আমার মামলাটি নির্দিষ্ট করে বললে, প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের রায়ে নিষ্পত্তি হয়েছে। আমার আগে হাতেম আলী খান নামের এক ভদ্রলোকের মামলার রায়, যেটা প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল দিয়েছিলেন, তা সুপ্রিম কোর্ট বহাল রাখেন। সে কারণেই আমাদেরগুলো যেহেতু একই মেরিটের (বৈশিষ্ট্যপূর্ণ) মামলা, তাই আমাদেরগুলো আর সুপ্রিম কোর্টে যায়নি।
প্রথম আলো: তাহলে হাতেম আলী খান বনাম সরকার মামলায় সুপ্রিম কোর্ট যে রায় দিয়েছিলেন, তার আলোকে আপনি চাকরি ফিরে পেয়েছেন?
নুরুল হুদা: হ্যাঁ। এই মামলার রায়ের পর আমার মামলার রায়ের বিষয়ে প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল যে রায় দিয়েছেন, তার বিরুদ্ধে সরকার আপিলে যায়নি। ওই রায়ের আলোকেই আমাদের চাকরি ফিরে পাওয়া সম্ভব হয়েছে।
প্রথম আলো: এ রায় কোন সালে হয়েছিল? হাতেম আলী খান কি বেঁচে আছেন?
নুরুল হুদা: সম্ভবত ২০০৯ সালে। না, তিনি মারা গেছেন। তিনিও যুগ্ম সচিব ছিলেন। এবং সচিব হিসেবে অবসরে এসেছেন।
প্রথম আলো: তিনি কি জনতার মঞ্চের কারণে বাধ্যতামূলক অবসরে গিয়েছিলেন?
নুরুল হুদা: আমি ঠিক তাঁর বিষয়টি জানি না। এ রকমই হয়তো ‘পলিটিক্যালি মোটিভেটেড’ ম্যাটার ছিল।
প্রথম আলো: তাহলে জনতার মঞ্চে আপনার উপস্থিতির তথ্য সম্পূর্ণ অসত্য?
নুরুল হুদা: অবশ্যই। (হেসে) কীভাবে তা সম্ভব? আমি তো তখন কুমিল্লার ফুলটাইম ডিসি ছিলাম। আমি ফরিদপুরের ডিসি ছিলাম ১৯৯২-৯৫ সময়ে। কুমিল্লায় ছিলাম ১৯৯৫-৯৭ পর্যন্ত।
প্রথম আলো: আওয়ামী লীগ বা কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আপনার জীবনে কখনো কি কোনো সংশ্লিষ্টতা ঘটেছিল?
নুরুল হুদা: না। আমি কোনো পার্টির কোনো সদস্য নই। দলের সঙ্গে কোনো অ্যাফিলিয়েশন নেই। কোনো দলের সঙ্গে কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।
প্রথম আলো: আপনার পড়াশোনা? ছাত্ররাজনীতি?
নুরুল হুদা: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যানে। অনার্সে ভর্তি হয়েছিলাম ১৯৬৬ সালে। মাস্টার্স শেষ হয়েছিল ১৯৭২ সালে। ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা ছিল। তখন কোনো না কোনো ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে সবাই যুক্ত থাকতেন। আমি ছিলাম ফজলুল হক হল ইউনিয়নের ছাত্রলীগ থেকে নির্বাচিত নাট্য ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক।
প্রথম আলো: এরপর?
নুরুল হুদা: ১৯৭২ সালে আমি পিএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে উত্তীর্ণ হই। ১৯৭৩ সালে চাকরি হয়। এরপর আর রাজনীতিতে আসার সুযোগ কোথায়?
প্রথম আলো: সর্বশেষ মন্তব্য?
নুরুল হুদা: আমি অতীত ভুলে যেতে চাই। নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে চাই। বিএনপি কী করেছে বা করবে? আওয়ামী লীগ কী করবে বা করবে না, তা আমার কাছে একেবারেই বিবেচ্য বিষয় নয়। একটা বিষয় খুব স্পষ্ট করে বলতে চাই, কোনো দলের ওপরই আমার কোনো মান-অভিমান বা ক্ষোভ কোনো কিছুই নেই।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
নুরুল হুদা: ধন্যবাদ।
প্রথম আলো:
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন