অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক। তিনি শিক্ষাদানের মাধ্যমে জাতি গঠনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে আসছেন। তিনি একজন শিক্ষাবিদ হিসেবে, একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে দেশের যেকোনো সংকট মুহূর্তে সজাগ কণ্ঠস্বর হিসেবে অবতীর্ণ হন। তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা কমিটির সদস্য সচিব হিসেবে এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। রামপালে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ও জাতীয় কমিটির নানা বিষয়-আশয় নিয়ে জানতে আনু মুহাম্মদের মুখোমুখি হয়েছেন পরিবর্তন ডটকমের নিজস্ব প্রতিবেদক জিনাত জান কবীর
তেল-গ্যাস ও খনিজ সম্পদ রক্ষা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন আপনি। এই আন্দোলনের প্রেক্ষাপট নিয়ে কিছু বলবেন?
আনু মুহাম্মদ: এই কমিটি গঠিত হয়েছিল ১৯৯৮ সালে। বাংলাদেশের গ্যাস সম্পদ একটি মার্কিন কোম্পানি রপ্তানি করতে চেয়েছিল, সেটার বিরোধিতার মধ্য দিয়েই এই কমিটি গঠিত হয়। কমিটি গঠিত হওয়ার পর দেখা গেল শুধু যে রপ্তানি করতে চাচ্ছে তা না, আমাদের গ্যাস সম্পদ নিয়ে বিদেশি কোম্পানির সাথে যেসব চুক্তি করা হয়েছে সেগুলো খুবই ক্ষতিকর, আত্মঘাতী এবং দেশের ভবিষ্যৎ জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। সে কারণে পিএসসি মডেল চুক্তি বাংলায় যেটাকে বলে উৎপাদন অংশীদারি চুক্তি সেটার বিরোধিতা। এই গ্যাস রপ্তানির বিরোধিতার মধ্য দিয়েই এই কমিটি গঠিত হয়। আমাদের বক্তব্য ছিল- আমাদের গ্যাস সম্পদ সীমিত, সেটা বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং শিল্প-কারখানায় ব্যবহার করতে হবে। সেটা কোনভাবেই বিদেশে রপ্তানি করা যাবে না। এবং এর মালিকানা বাংলাদেশের মানুষের হাতে থাকতে হবে। এই অবস্থান থেকেই কমিটির উদ্ভব। তারপর কমিটি আরো কিছু আন্দোলনের মধ্যে যুক্ত হয়, যেমন চট্রগ্রাম বন্দর একটা আমেরিকান কোম্পানিকে ২০০ বছরের জন্য লিজ দেয়া হচ্ছিল। আমরা এর বিরোধিতা করি। এর মধ্য দিয়েই পরে আবিষ্কার হয়- ঐ কোম্পানিটা একেবারেই ভুয়া ও জালিয়াত কোম্পানি ছিল। আর ভুয়া ওই কোম্পানির কাছেই চট্টগ্রাম বন্দর লিজ দেয়ার জন্য সেসময়কার সরকারের একেবারে উচ্চমহল থেকে চেষ্টা করা হচ্ছিল। যাই হোক আমাদের আন্দোলন সফল হয়। গ্যাস রপ্তানি বন্ধ হয়। চট্টগ্রাম বন্দরও রক্ষা পায়।
এরপর আমাদের আরেকটা বড় আন্দোলন ছিল ফুলবাড়িতে। ফুলবাড়িতে উন্মুক্ত খনির মাধ্যমে একটা বিদেশি কোম্পানিকে শতকরা ৬ ভাগ রয়্যালটির বিনিময়ে কয়লার খনিটা দিয়ে দেয়া হচ্ছিল। ওই কয়লা খনিটা হলে উত্তরবঙ্গ একটা ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হতো। মাটি নষ্ট হতো, নদী নষ্ট হতো, তারপর আবাদি জমি নষ্ট হতো, একই সঙ্গে কয়েক লাখ মানুষ উদ্বাস্তুতে পরিণত হতো। কয়লা রপ্তানি করার আয়ও বাংলাদেশ পেত না। কয়লা সম্পদও যেত, জ্বালানি নিরাপত্তাও যেত, আবার পানি নিরাপত্তা, খাদ্য নিরাপত্তা, জন নিরাপত্তা সবই বিপনন হতো। এরকম ভয়ঙ্কর প্রকল্পকে উন্নয়ন প্রকল্প হিসেবে হাজির করা হয়েছিল। ফুলবাড়ী আন্দোলনে তিনজন শহীদ হন।সেখানে এখন পর্যন্ত এই আন্দোলন এবং প্রতিরোধ আছে। এ কারণে ঐ ধ্বংসযজ্ঞের প্রকল্পটা কোন সরকারই বাস্তবায়ন করতে পারে নাই। যদিও প্রত্যেকটা সরকারই করার চেষ্টা করছে। এরমধ্যে ছোটছোট আরও আন্দোলন হয়েছে। সর্বশেষ আন্দোলন হচ্ছে সুন্দরবন। কাজেই সবগুলো আন্দোলন দেখলে এটা পরিষ্কার যে জাতীয় কমিটির কেন্দ্রীয় বিষয়টা হচ্ছে বাংলাদেশে যে সম্পদ আছে (যেমন জ্বালানি-খনিজ) সেগুলোর শতভাগ মালিকানা চাই। এটা আমাদের এক নাম্বার এজেন্ডা। আর দুই নাম্বার এজেন্ডা হচ্ছে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ প্রকল্প যেসব হচ্ছে সেসব প্রকল্প দেশের মানুষের স্বার্থ, পরিবেশ সকল কিছুকে নিশ্চিত করে করতে হবে। গ্যাস সম্পদ, কয়লা সম্পদের উপর জনগণের মালিকানা নিশ্চিত করতে হবে এবং জাতীয় সক্ষমতা বাড়াতে হবে। জাতীয় সক্ষমতা বাড়াতে পারলে এবং বঙ্গোপসাগরের খনিজ সম্পদ যদি অনুসন্ধানের মাধ্যমে নিজেরা উত্তোলন করতে পারি, তাহলে বিপুল সম্ভাবনা আছে। ঐ গ্যাস থেকে যদি বিদ্যুৎ হয়, তাহলে কম অর্থে পরিবেশ নষ্ট না করে জ্বালানি চাহিদা মেটানো সম্ভব।
উন্নয়ন বললেই উন্নয়ন হয় না। যে ধরণের প্রকল্পে দেশের মানুষের ক্ষতি হয় কিংবা দেশ বিপন্ন হয়, এগুলো উন্নয়ন প্রকল্প না। উন্নয়ন প্রকল্প নামে বিদেশি স্বার্থ কিংবা দেশি লুটেরাদের স্বার্থ রক্ষা করার আয়োজনের আমরা বিরোধিতা করি। এর মধ্য দিয়ে জাতীয় ইস্যুতে জনগণকে সজাগ করা এবং জনগনকে সাথে নিয়ে জনগণের স্বার্থকে কেন্দ্রে রেখে উন্নয়নকে নিশ্চিত করাই হচ্ছে আমাদের লক্ষ্য।
রামপাল প্রকল্পকে কেন আপনারা সুন্দরবনের জন্য হুমকি বলছেন?
আনু মুহাম্মদ: হুমকির বিষয়টি বুঝতে গেলে দুটো দিক দেখতে হবে। প্রথমত, কোনো স্থানে একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র কী ধরনের প্রভাব ফেলে, পরিবেশ কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দ্বিতীয়ত, সুন্দরবন যেহেতু এখানে মূল বিবেচনার বিষয়, বন হিসেবে তার বৈশিষ্ট্যগুলো কি কি। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তেই করা হোক না কেন, সেটা শহর হোক, গ্রাম হোক, জনবসতি থাকুক আর না থাকুক- কিছু না কিছু পরিবেশ দূষণের ব্যাপার আছে। প্রযুক্তি অনুযায়ী এর মাত্রাভেদ হয়। কয়লা যখন পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় তখন এমন কিছু বিষাক্ত পদার্থ নিঃসৃত হয় যা বায়ুকে দূষিত করে, মাটিকে দূষিত করে, পানিকে দূষিত করে। কয়লা যেটা পুড়ানো হয়, তার পুরোটাতো পুড়ে বিদ্যুৎ হয় না, তার কিছু অবশিষ্ট থাকে। এর কোনোটাকে ফ্লাই অ্যাশ বলে, কোনোটাকে বটম অ্যাশ বলে। এছাড়া আর্সেনিকসহ বিভিন্ন ধরণের রাসায়নিক দ্রব্য রয়েছে- এগুলোর কোনটা পানিতে মেশে কোনটা বাতাসে মেশে। যার ফলে আশেপাশের বিশাল এলাকা জুড়ে একটা ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে। যেকোনো জায়গারই ক্ষতি হয়। এটা যদি নদীর ধারে হয় তাহলে নদীর বেশি ক্ষতি হবে। আর যদি বনের ধারে হয় তাহলে বনের ক্ষতি হবে।
সে কারণে সুন্দরবনের বিষয়টা বুঝতে হবে। এটি একাধারে বন ও নদীর সমষ্টি। সুন্দরবন হচ্ছে পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট। এটা অতুলনীয় কারণ এই ধরণের বন পৃথিবীতে খুব কম আছে। লোনা পানি-মিষ্টি পানির সমন্বয়, নদী ও ভূমির সমাবেশ- এ সবের মধ্য দিয়ে বিশেষ ধরণের বাস্তুসংস্থানের তৈরি হয়েছে সুন্দরবনে। যার ফলে এর প্রাণবৈচিত্র্য অনেক সমৃদ্ধ। সুন্দরবনে রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণির বসতি, এই সুন্দরবনই তাদের অভয়ারণ্য, বিচরণ ভূমি।
বন হিসেবে এটি প্রতিবেশগতভাবে খুবই সংবেদনশীল। এ কারণে একটি গ্রামে বা শহরে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করলে তার যতটা ক্ষতি হবে তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতি হবে সুন্দরবনের।এই সুন্দরবন বিলীন হলে ৪০ লক্ষ মানুষের জীবিকা নষ্ট হবে, ৫ কোটি মানুষের জীবন ও সম্পদ বিপন্ন হবে, রয়েল বেঙ্গল টাইগারের গল্প তো শেষ হবেই।
এ রকম ক্ষতি কোনোভাবেই পূরণযোগ্য নয়। সেজন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পরিবেশ আইনে, কোথাও যদি বন কিংবা নদী থাকে, তাহলে অনেকরকম বিধিনিষেধ থাকে। যেমন ভারতের পরিবেশগত নির্দেশনায় আছে যে, কোথাও বন কিংবা লোকালয় থাকে তাহলে ২৫ কিলোমিটারের মধ্যে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করা যাবে না। ভারত এই বিধিনিষেধ আরোপ করেছে এই জন্য যে, কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রে ভারতের অভিজ্ঞতা কয়েক দশকেরও বেশি। অভিজ্ঞতার কারণে ভারতে এই আইনটা করেছে। ভারতে বছরে প্রায় ১ লাখের বেশি মানুষ অকালে মৃত্যুবরণ করে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য। আর কয়েক লক্ষ মানুষ গুরুতর অসুস্থতায় ভোগে। এই কারণে ২০১০ সালে তারা এই বিধানটা করেছে। সম্প্রতি দেখলাম মধ্যপ্রদেশে খাজুরাহো, যেখানে একটি প্রাচীন মন্দির আছে, সেখান থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রস্তাব তারা প্রত্যাখ্যান করেছে। এই এনটিপিসি’ই সেটা করতে চেয়েছিল। ক্ষতির কথা ভেবে তারা মন্দিরটি ৩০ কিলোমিটার দূরে হওয়ায়ও ভয় পাচ্ছে। বাংলাদেশে যেটা করা হচ্ছে সেটা সুন্দরবন থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে। আর আমরা যদি বাফার জোন ধরি, বাফার জোন হচ্ছে একটা আঙ্গিনা। বাফার জোন ধরলে এটা ৪ কিলোমিটার। ভারতের আইন অনুযায়ী পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রে সাংঘাতিক পরিমাণ ক্ষতি হবে। কয়লা পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ফলে মাটি, পানি, বায়ু দূষিত হবে। এর ফলে সুন্দরবন ক্রমান্বয়ে বিনাশপ্রাপ্ত হবে। এখানেই বিপদটা শেষ না।
আরেকটা বাড়তি বিপদ হচ্ছে পরিবহন। সুন্দরবনে যে কয়লা পরিবহন হবে, তা হবে বঙ্গোপসাগরে বড় জাহাজ থেকে স্থানান্তর করে ছোট জাহাজে, সুন্দরবনের একমাথা থেকে অন্য মাথায়। পশুর নদী দিয়ে প্রতিদিন ১৩ হাজার টন আর বছরে ৪৭ লক্ষ টন কয়লা পরিবহন হবে। পরিবহনে একদিনও বিরতি দেয়া যাবে না। অন্যান্য ক্ষতির সাথে সাথে দুর্ঘটনার ঝুঁকি ভয়াবহ। সেখানে ৫০০ টন কয়লা, ৫০০ টন তেল নিয়ে জাহাজডুবি হয়েছে, সেগুলোই সরকার ম্যানেজ করতে পারেনি। কয়েকদিন আগে ১ হাজার টন কয়লা নিয়ে জাহাজ ডুবে গেছে। ১ মাসেও সরকার কিছু করতে পারে নাই। আর প্রতিদিন ১৩ হাজার টন কয়লা নিয়ে যাবে, আর সরকার বলছে কিছুই হবে না। কয়লা পোড়ানো এবং পরিবহন- দুটোই মারাত্মক ক্ষতিকর। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে সম্পর্কিত সুবিধাভোগী ছাড়া বাংলাদেশ ও ভারতের সকল বিশেষজ্ঞ এবং ইউনেস্কোর মতো প্রতিষ্ঠানসহ অন্যান্য সকল বিশেষজ্ঞ তাই বলছেন- রামপাল কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র করলে সর্বনাশ হবে। সেখানে সরকারের বুঝতে অসুবিধা কোথায়?
প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের নীতি-নির্ধারকরা বলেছেন রামপালে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন হলে সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি হবে না। তারা এ ক্ষেত্রে যুক্তি ও তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরছেন। সেক্ষেত্রে আপনি কি বলবেন?
আনু মুহাম্মদ: সরকার যে ভুল করছে তার জন্য এই কথাটিই যথেষ্ট। প্রধানমন্ত্রী যেমন একবার বলছেন আমরা ছোটবেলায় কয়লা দিয়ে দাঁত মেজেছি, কয়লা দিয়ে পানি পরিষ্কার করেছি, কয়লার জাহাজ ডুবলে অসুবিধা কোথায়? এ থেকে কঠিন সত্য প্রকাশিত হয়। প্রধানমন্ত্রী কাঠ কয়লা এবং খনিজ কয়লার পার্থক্য বুঝতে পারছেন না। গ্রামে কাঠ জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করলে কয়লা হয়। সেই কয়লা দিয়ে আমরাও ছোটবেলায় দাঁত মেজেছি। কয়লা থেকে যে ছাই হয়- সেটা সার হিসেবেও ব্যবহার হয়। আর খনিজ কয়লা হলো হাজার হাজার বছর মাটির নিচে তৈরি হয়। খনিজ কয়লার মধ্যে রাসায়নিক বিষাক্ত পদার্থ থাকে। এ জন্য খানিজ কয়লা দিয়ে দাঁত মাজলে দাঁত পড়ে যাবে- এটা নিশ্চিত। তেমনি খনিজ কয়লা কোন জমিতে দিলে সেই জমিও নষ্ট হয়ে যাবে। সে জমিতে আর ফসল হবে না। প্রধানমন্ত্রী নিজে জানেন না কাঠ কয়লা আর খনিজ কয়লার পার্থক্য কি? তিনি কি ধরণের বিশেষজ্ঞ পরিবেষ্টিত আছেন যে, এরকম প্রাথমিক তথ্যও তারা প্রধানমন্ত্রীকে দিতে পারেন না। এরাই নাকি সুন্দরবন বাঁচাবে!
সুন্দরবনে যেসব মৎস্যজীবি-বনজীবী রয়েছে তাদের সংখ্যা ৩৫-৪০ লাখ। সুন্দরবন না থাকলে এরা কাজ হারাবে। সুন্দরবন প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রাচীর হিসেবে কাজ করে। সুন্দরবন না থাকলে ঐ অঞ্চলসহ খুলনা, বাগেরহাটের অরক্ষিত হয়ে পড়বে। এক কথায় ভারসাম্যহীন হয়ে পড়বে বাংলাদেশের।
সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলন জনগণের কাছে কতটা পৌঁছতে পেরেছে? এ আন্দোলন বা কতটুকু সার্থক হয়েছে?
আনু মুহাম্মদ: ২০১১ সাল থেকে সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলন শুরু হয়। আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে স্বচ্ছভাবে মানুষের সামনে সত্য উপস্থাপন করা। বৈজ্ঞানিক তথ্যের ভিত্তিতে উপস্থাপন করা। সুন্দরবন না থাকলে দেশের সকলের ক্ষতি। এটা একটা সামাজিক দায়িত্বের ব্যাপার। যখন বুঝতে পারছি এত বড় সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছে তখনতো আমাদের প্রতিরোধ করতেই হবে।
গবেষণা, খোলা চিঠি, প্রকাশনা, আলোচনা সভা, তথ্যচিত্র, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আমরা মানুষকে জানাতে শুরু করি। প্রথম দিকে তো মানুষ জানতোই না। এখন মানুষ বুঝতে পারছে- কেন রামপালে কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্র ক্ষতিকর। কিন্তু সরকার পাল্টা প্রচারণা চালাচ্ছে। সরকার এটাও বুঝতে পারছে যে, সরকারের কথা কেউ বিশ্বাস করতে পারছে না। সেজন্যই সরকার পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিচ্ছে। বিজ্ঞাপনতো দেয়ার দরকার নেই, তারা কিছু বললে তাতো মিডিয়ার মাধ্যমে এমনিতেই সব মানুষের কাছে পৌছানোর ব্যবস্থা আছে। রেডিও-টেলিভিশন-পত্র-পত্রিকা তাদের দখলে। তাদের কথা কেউ বিশ্বাস করছে না বলেই বিজ্ঞাপনী সংস্থা ভাড়া করছে এবং দমন পীড়ন করছে, নির্যাতন চালাচ্ছে। ইটের ভাটায় যে কয়লা পোড়ানো হয় তার চেয়ে দেড় হাজার গুণ বেশি কয়লা পোড়ানো হবে। সরকার বলছে, সুপার ক্রিটিক্যাল টেকনোলজি ব্যবহার করবো। সেটাও আমরা অনুসন্ধান করেছি। দেখেছি এটা নিয়েও তারা যা বলছে সেটা মিথ্যাচার।
বনের মানুষকে দরকার নাই, মানুষ না থাকলেও বন থাকবে। কিন্তু বন দরকার মানুষেরই, বন না থাকলে মানুষ একদিনও টিকতে পারবে না। শুধুমাত্র জিডিপির গ্রোথ হলেতো হবে না। জিডিপির গ্রোথ হলো কিন্তু আমি শ্বাস নিতে পারলাম না, পানি খেতে পারলাম না, এটাকে উন্নয়ন বলা যায না। ফুসফুস, হার্ট, ব্রেন, সাডেন ডেথসহ অধিকাংশ অসুখ পরিবেশ দূষণের কারণে হচ্ছে। উন্নয়নের নামে বিভিন্ন নদী-নালা, খালা-বিল দখল-দূষণের কারণে হচ্ছে। এখন মানুষ এই বিষয়ে পড়ছে, শিখছে- এটাও আন্দোলনের সার্থকতা। পুরোপুরি সাফল্য হবে সুন্দরবন রক্ষার মধ্য দিয়ে।সাধারণ মানুষের মধ্যে যে সচেতনতা তৈরি হচ্ছে তার দীর্ঘমেয়াদী সুফল বাংলাদেশের মানুষ পাবে।
গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিচ্ছে, গণ্যমাধ্যমগুলো তাদের দখলের কথা বলছেন কিন্তু এটিএন নিউজের রিপোর্টার ঈশান দিদার ও ক্যামেরাম্যান আব্দুল আলিমকে পুলিশ প্রকাশ্যে পিটিয়ে আহত করলো- এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কি?
আনু মুহাম্মদ: গণমাধ্যমের দুটো দিক। এক, যারা কাজ করে আর যারা মালিক। সাংবাদিক আর মালিক এক কথা নয়। গণমাধ্যমের অনেক কর্মী সম্পর্কে আমি জানি তারা নিজেরা খুব আন্তরিক এবং সাহসের সঙ্গে জনস্বার্থ যেন সংরক্ষিত হয়- সে বিষয় মাথায় রেখে জীবনের ঝুঁকি মাথায় নিয়ে কাজ করেন।আবার অনেক মালিক আছেন যারা অন্য ব্যবসায় সুবিধা করার লক্ষ্যে সরকারকে সন্তুষ্ট রাখার তারা সাংবাদিকদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সংগৃহীত সংবাদ প্রকাশ করতে দেন না।
আমরা আগেই বলেছি হরতালে আমরা ভাংচুর করবো না। গাড়ি ভাংচুরের কোনো ঘটনা তাই ঘটেনি। শান্তিপূর্ণ সমাবেশে পুলিশ বর্বর আক্রমণ চালালো। শুধু তাই নয়, মানুষকে বিভ্রান্ত করতে হরতালের দিন প্রত্যেক পত্রিকায় একটা করে বিজ্ঞাপন ছাপিয়েছে। পুলিশ দিয়ে হামলা চালিয়ে ভয় দেখানোর চেষ্টা করেছে।হরতালের সময় ৮ ঘণ্টা তরুণরা মোকাবেলা করে আহত হয়েছে। সেই ঘটনা সততার সঙ্গে বস্তুনিষ্ঠ রিপোর্ট করতে গেছে সাংবাদিকরা। সেই ভয়ে পুলিশ সাংবাদিকদের আঘাত করেছে। নাগরিক স্বার্থে আন্দোলন করতে গেলে অপরাধ, সাংবাদিকরা তাদের দায়িত্ব পালন করতে গেলে সেটাও তাদের ‘অপরাধ’। ‘সেই সব অপরাধে’ তাদের যেভাবে মারছে, নির্যাতন করছে, তাতে তারা পুরোপুরি সুস্থ হতে পারবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ। এটা সরকারের সফলতার লক্ষণ নয়, এটা দুর্বলতার লক্ষণ, নৈতিক পরাজয়ের লক্ষণ। সত্য প্রকাশের ভয়ে তারা আক্রমণ করছে। এর তীব্র নিন্দা জানাই।
আপনারা সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলন করছেন। বলছেন- এটা জনগণের আন্দোলন। কিসের উপর ভিত্তি করে বলছেন এ আন্দোলনে জনসমর্থন আছে?
আনু মুহাম্মদ: এই সমস্যাটি জনগণের, সর্বজনের। তাই তারা নিজ স্বার্থেই ভয়ভীতি উপেক্ষা করে আরও সম্পৃক্ত হবে। পথে-ঘাটে, রাস্তায়, ট্রেনে কথা হলে বুঝি, ই-মেইল পাই, ফেসবুকে যে রেসপন্স পাই, চিঠি পাই তাতে বুঝতে পারি রামপাল প্রকল্পের সুবিধাভোগী কতিপয় গোষ্ঠী, বাকি সকলেই এই প্রকল্প বিরোধী। গত কয়েকমাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, ইডেন কলেজসহ ২০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এই নিয়ে জনমত জরিপ হয়েছে, তাতে অংশ নিয়েছেন ৪০ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী ও শিক্ষক। সেখানে ৯২ শতাংশেরও বেশি মানুষ রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরোধী।এই আন্দালনে সাধারণ মানুষের সমর্থন রয়েছে। একের পর এক আন্দোলনে আমরা দেখছি সমর্থনের সঙ্গে সঙ্গে সক্রিয় ভূমিকাও বাড়ছে।
আপনারা ক্রমাগত আন্দোলন করে যাচ্ছেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে সরকার আপনাদের সঙ্গে আলোচনার আহবান জানিয়েছে কি?
আনু মুহাম্মদ: বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় থেকে আমাদের আহবান জানিয়েছিল। আমরা বসেছি তাদের সঙ্গে। তারা তাদের কথা বলেছে। আমরা আমাদের কথা বলেছি। এরপর সংসদীয় কমিটির একটা বৈঠকে ডেকেছিল। সেখানেও সরকার আগে থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে আলোচনা সভা ডাকে। আলোচনা সভাতো বসে বিষয়গুলো বুঝে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য।কিন্তু সমস্যা হলো, তারা আলোচনায় ডাকে লোক দেখানোর জন্য। সরকারের একগুঁয়েমি ভাব এবং বৈজ্ঞানিক তথ্যের ভিত্তিতে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত না নেওয়ায় বোঝা যায়- রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে তাদের কোনো ধরণের দায় নেই। দেশের মধ্যে কিছু গোষ্ঠী সুন্দরবনকে ঘিরে জমি এবং বন দখল করছে। তারা সরকারের খুব ঘনিষ্ট। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে সুন্দরবনকে গ্রাস করতে পারবে তারা। আর সাথে ভারতের বাণিজ্যিক স্বার্থ এবং কৌশলগত স্বার্থ রয়েছে।
রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র না করে যদি অন্য কোন জায়গায় সরকার বিদ্যুৎকেন্দ্র করতে চায় সেক্ষেত্রে আপনার অভিমত কি?
আনু মুহাম্মদ: বিদ্যুৎকেন্দ্র কোন জায়গায় হবে সেটা যথাযথ সমীক্ষার উপর নির্ভর করে। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করতে হলে পরিবেশগত কারণে ইনভায়রনমেন্ট ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট, ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি করার বাধ্যবাধকতা আরও বেশি। এই সমস্ত নিয়ম কানুন মেনে স্বচ্ছতার সঙ্গে যেকোন জায়গায় করুক আমাদের কোন আপত্তি নেই। বিকল্প স্থানের বিষয়ে ড.বদরুল ইমাম এবং অন্যান্য বিশেষজ্ঞরাও বিভিন্ন প্রস্তাব দিচ্ছেন। সেই জায়গাগুলো প্রাথমিক সিলেকশন করে সরকার অনুসন্ধান করতে পারে। প্রথমে রামপাল চু্ক্তি স্থগিত করতে হবে। বাণিজ্যিক তৎপরতা বন্ধ করতে হবে। জাহাজ নিয়ে যাওয়ার জন্য পশুর নদী উপযুক্ত নয়- এ জন্য ড্রেজিং করছে। ড্রেজিংয়ের কারণে এবং আশেপাশে মাটি ভরাটের কারণে সেখানে ইতোমধ্যে ক্ষতি শুরু হয়েছে। গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করলে পরিবেশের ক্ষতি হবে না বরং খরচও কম হবে। সেসব না করে সরকার বেশি ইন্টারেস্ট, কমিশন ও শক্তিশালী লবিস্টের দ্বারা পরিচালিত হয়ে দেশের জন্য সর্বনাশা মেগা প্রজেক্ট করতে চায়। অথচ কমখরচে বিদ্যুৎ সংকট সমাধানের উপায় আমরা বারবারই বলছি।
আপনারা তেল-গ্যাস ও খনিজ সম্পদ রক্ষা কমিটির পক্ষ থেকে যে আন্দোলন করছেন তা মূল্যায়ন করে ভবিষ্যতে কি করবেন সে সম্পর্কে কিছু বলুন…
আনু মুহাম্মদ: সরকার রামপাল প্রকল্প বাতিল করলে আমরা আন্দোলন এখনই স্থগিত করে দেব। সরকার একগুয়েমি করলে আন্দোলন আরও বিস্তৃত হবে। সুন্দরবন রক্ষা আন্দোলন ছাড়াও টেকসই জ্বালানি ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন করার জন্য আমাদের তৎপরতাও অব্যাহত থাকবে।যে সরকারই ক্ষমতায় থাক না কেন, আমরা চাই জাতীয় স্বার্থ বিরোধী তৎপরতার বিরুদ্ধে মানুষ সোচ্চার থাকুক, সজাগ থাকুক। যাতে উন্নয়নের নামে মানুষকে ধোঁকা না দেয়া হয়। উন্নয়নের নামে প্রাকৃতিক সম্পদ লুন্ঠন করা না হয, উন্নয়নের নামে দেশকে বিপর্যস্ত করা না হয় সেই সব হচ্ছে আমাদের আন্দোলনের বিষয়। আমাদের একাডেমিক কাজ যেমন গবেষণা ও অনুসন্ধান, আবার জনগণকে সাথে নিয়ে আন্দোলনের জন্য মাঠেও নামতে হয়।এই দুই ধরণের কাজ ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে। মানুষের মধ্যে উন্নয়ন সম্পর্কে সজাগ অবস্থা থাকলে যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক না কেন তারা উন্নয়নের নামে দেশকে বিপন্ন করতে পারবে না, দেশি বিদেশি লুটেরাদের হাতে দেশ থাকবে না, প্রাকৃতিক সম্পদ লুন্ঠন বা বিনষ্ট করতে পারবে না।
পরিবর্তন
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন