বাংলাদেশে জঙ্গিবাদবিরোধী লড়াইয়ে অগ্রগতির কথা স্বীকার করেছেন দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়াল। তবে এ নিয়ে বাংলাদেশকে আরও অনেক পদক্ষেপ নিতে হবে বলে মনে করছেন তিনি। বাংলা ট্রিবিউনকে দেওয়া এক একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন নিশা দেশাই। যুক্তরাষ্ট্র শুরু থেকেই বলে আসছে, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক জঙ্গি হামলাগুলোতে আইএস-আল কায়েদার মতো আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। সাক্ষাৎকারে সেই মার্কিন অবস্থানের পক্ষে যুক্তিও তুলে ধরেন নিশা।
উল্লেখ্য, গুলশানের হলি আর্টিজানের হামলার পরপরই ঢাকায় এসেছিলেন নিশা দেশাই। হামলার প্রসঙ্গ টেনে নিশা বলেন, ‘হলি বেকারির হামলাটি ছিল একটি বড় ধরনের সতর্কবার্তা। জঙ্গি সংগঠনগুলো কী ধরনের হুমকি তৈরি করে এবং তরুণদের কাছে নিজেদের মতাদর্শ পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের সক্ষমতা কতটুকু তা নিয়ে বাংলাদেশ সরকার এবং বাংলাদেশি জনগণের যে উদ্বেগ ছিল সেক্ষেত্রে এ ঘটনাটি বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছে।’
ওই হামলার প্রসঙ্গ টেনে বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি আরও বলেন, ‘বাস্তবতা হলো, সেখানকার হামলাকারীদের অনেকেই ছিল তরুণ, অনেকেই ধনী পরিবারের সন্তান এবং পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত, অভিজাত স্কুলে যাদের পড়াশোনা, যাদের সামনে প্রচুর সুযোগ সুবিধা ছিল এবং তারপরও তারা জঙ্গিবাদে জড়িয়েছে। আমি মনে করি, কার্যকরীভাবে এসব বিষয় মোকাবেলার জন্য এবং বাংলাদেশিদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করার ক্ষেত্রে এ ঘটনাটি একটি বড় মুহূর্ত।’
এ সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে নিশা বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনা মোকাবেলায় আমরা ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছি এবং তাদেরকে সহায়তা দিচ্ছি। আমি মনে করি, এক্ষেত্রে বেশ কিছু অগ্রগতি হয়েছে কিন্তু এখনও অনেক কাজ করার আছে।’
সাম্প্রতিক জঙ্গি হামলার প্রেক্ষাপটে সৃষ্ট পরিস্থিকে বেশ জটিল, উদ্বেগজনক এবং ভয়াবহ বলে উল্লেখ করেছেন নিশা। তিনি বলেছেন, ‘আমি মনে করি, পরিস্থিতিটা সত্যিই বেশ জটিল। হলি আর্টিজানের হামলা এবং মার্কিন সরকারি কর্মীকে নৃশংসভাবে হত্যাসহ এর আগে সংঘটিত বিভিন্ন হামলা থেকে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের ভয়াবহ বিস্তৃতির ইঙ্গিত পাওয়া যায়। বিদেশি জঙ্গি সংগঠনগুলো এইসব হামলার পথ তৈরি করেছে। আল কায়েদা অথবা ইসলামিক স্টেটের মতো জঙ্গি সংগঠনগুলো বাংলাদেশের স্থানীয় জঙ্গি সংগঠনগুলোকে নিজেদের অঙ্গীভূত করে তারা (আল কায়েদা-আইএস)এইসব তৎপরতা চালিয়েছে যা খুবই বিপদজনক এবং ভয়াবহ উদ্বেগের।’
নিশা দেশাই বাংলাদেশের বর্তমান সরকারকে সতর্ক করে বলেন, সফলভাবে জঙ্গিবাদবিরোধী লড়াই চালাতে গিয়ে গণতন্ত্রের মৌলিক মূল্যবোধ যেন উপেক্ষিত না হয়।
নিশা মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশসহ সব সমাজের বেলাতেই জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের হুমকি মোকাবেলার পথ নির্ধারণের ক্ষেত্রে একটি ঝুঁকি থেকে যায়। জঙ্গিবাদের হুমকি মোকাবেলার চেষ্টা করতে গিয়ে আমরা অনেকসময় এতোটাই অকার্যকর এবং ছকবদ্ধ হয়ে পড়ি যে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে আমাদের স্ব-নির্ধারিত নীতি ও মূল্যবোধকে লঙ্ঘন করি। নিশার মতে, আমরা তখন এমন প্রক্রিয়া অবলম্বন করি, যার কারণে খোদ ব্যক্তি-স্বাধীনতার মৌলিক নীতিগুলোতেই পচন শুরু হয়। অথচ স্বাধীনতার ওই মূলনীতিগুলোই গণতন্ত্রের নির্ধারক।
নিশা দেশাই বলেন, বাংলাদেশ, যুক্তরাষ্ট্র, ভারতসহ বিশ্বজুড়ে স্বাধীনতা হরণের ওইসব ঝুঁকিকে ঠেকিয়ে রাখতে হবে। নিরাপত্তার স্বার্থে যেন গণতন্ত্র ক্ষুণ্ন না হয় সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।’ নিশা আরও বলেন, ‘আমি মনে করি, এটি এমন এক বিপদ যা নজরে রাখতে হবে। আমরা বাংলাদেশ সরকারকে সতর্ক করে বলেছি, কিভাবে নিরাপত্তা রক্ষা করা হবে এবং জঙ্গিবিরোধী লড়াই চালানো হবে সে ব্যাপারে তাদেরকে সতর্ক হতে হবে এবং গতানুগতিক মাপকাঠিগুলো পরিহার করতে হবে । আর এর মধ্য দিয়ে তারা তাদের গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।’
এক প্রশ্নের জবাবে নিশা দেশাই মন্তব্য করেন, অনেক ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের অবিশ্বাস্য অগ্রগতি হয়েছে। তিনি বলেন, ‘অর্থনৈতিক ও উন্নয়নমূলক ক্ষেত্রগুলোতে আমরা দেখেছি, কৃষির অগ্রগতি আর স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিতের মধ্য দিয়ে মানুষকে দারিদ্র্য থেকে বের করে আনা সম্ভব হয়েছে। আমরা অনেক ক্ষেত্রেই অগ্রগতি দেখেছি। বাংলাদেশ এবং এর জনগণের অগ্রগতির চেষ্টায় যে কোনও পন্থায় অংশীদারত্ব নিশ্চিত করতে পারায় যুক্তরাষ্ট্র গর্ববোধ করছে।’ নিশা মনে করেন, এই সম্পর্ক গভীর এবং দীর্ঘস্থায়ী হবে। দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড়াবে সেই সম্পর্ক।
দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের প্রশ্নে নিশা বলেন, ‘নিরাপত্তাজনিত ক্ষেত্রে আমরা বাংলাদেশকে সমর্থন যুগিয়ে যাব। কেবল বাংলাদেশের ক্ষেত্রেই নয় বরং শান্তিরক্ষার মাধ্যমে সারা বিশ্বের নিরাপত্তায় অগ্রগতি আনতে বাংলাদেশ যে ভূমিকা রাখছে তার জন্যও আমাদের সমর্থন থাকবে।‘ নিশা জানান, নিরাপত্তার বিষয়টি বাংলাদেশে মার্কিন সহযোগিতার আরেকটি দীর্ঘস্থায়ী খাত। গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে মার্কিন নিরাপত্তা সহায়তা বিস্তৃত হয়েছে। এই সহায়তা অব্যহত রাখারও অঙ্গীকার করেন নিশা।
‘রাজনৈতিক সম্পর্কজনিত ইস্যুগুলোর ক্ষেত্রে দুই দেশের সরকারের মধ্যে আরও বেশি ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা, বিশ্বজুড়ে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অগ্রগতি নিশ্চিত এবং তাদের শক্তিশালী করতে যুক্তরাষ্ট্র চেষ্টা করেছে বলে আমি মনে করি। বিশ্বজুড়ে আমরা আমাদের সম্পর্ককে গভীর করতে চেয়েছি। ক্ষমতাসীন দল ও সরকারের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে তা এমন উপায়ে করেছি যা আমাদেরকে আস্থা ও স্বচ্ছতা গঠনে এবং আমাদের বন্ধনকে গভীর করতে সহায়তা করে।’ বলে যান নিশা দেশাই।
সবশেষ নিশা বলেন, ‘আমরা সুশীল সমাজের পাশে থাকব এবং তাদের প্রতি সমর্থন যুগিয়ে যাব। সেখানকার প্রতিধ্বনিকারী সুশীল সমাজ ও মিডিয়াকে সমর্থন দিয়ে যাব এবং একটি সর্বব্যাপী ও বহুত্ববাদী রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে সমর্থন দিব। এবং আমরা তা এমন উপায়ে করতে যাচ্ছি যার মধ্য দিয়ে আমাদের সরকার অনুভব করবে যে দুই দেশের মধ্যে গভীর আস্থা ও অংশীদারত্ব রয়েছে।’
বাংলা ট্রিবিউন
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন