ধারণা না থাকলে শেয়ারবাজার আপনার নয়
07 January 2017, Saturday
অন্য সব বাজারের মতো শেয়ারবাজার নয়। তাই শেয়ারবাজারে এসে শেয়ার কেনা-বেচা করার আগে এ বাজার বিষয়ে জানতে হবে। পাশাপাশি বাজার সম্পর্কে সম্পূর্ণ ধারণাসহ প্রয়োজনীয় শিক্ষা গ্রহণ করার পর এখানে আসা উচিৎ। অন্যথায় এ বাজার আপনার জন্য নয়।
এমনটাই মনে করেন ডিএসইর ব্রোকারেজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) প্রথম নির্বাচিত নারী সহসভাপতি ও মডার্ন সিকিউরিটিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খুজিস্তা নূর-ই নাহরিন।
মতিঝিলে মডার্ন সিকিউরিটিজের কার্যালয়ে নিউজবাংলাদেশ.কমের স্টাফ রিপোর্টার মোহাম্মদ আনিসুজ্জামানের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এ মন্তব্য করেন।
শেয়ার ব্যবসায় ঝুঁকি রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “ঝুঁকি মাথায় নিয়ে এ ব্যবসা করতে হবে। তাই উদ্বৃত্ত অর্থ থাকলেই শেয়ারবাজারে আসা উচিত। কারণ হাতের শেষ সম্বল বিনিয়োগের জায়গা এ বাজারে নয়।”
শেয়ারবাজার মানে ঝুঁকিপূর্ণ জায়গা মন্তব্য করে তিনি বলেন, “এখানে যারা বিনিয়োগ করতে আসবেন তাদের অবশ্যই বাজার সম্পর্কে ভালো ধারণা থাকা জরুরি। না বুঝে বা কারো কথা শুনে এ বাজারে বিনিয়োগ আসা থেকে বিরত থাকুন।”
ডিবিএর নব-নির্বাচিত সহসভাপতি খুজিস্তা দীর্ঘদিন ধরে শেয়ারবাজারে সুনামের সঙ্গে ব্যবসা পরিচালনা করে আসছেন। বর্তমান ডিবিএর অবস্থান তৈরিতে তাকে অনেক শ্রম দিতে হয়েছে। তার মডার্ন সিকিউরিটিজ ২০০৫ সালে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সদস্যপদ লাভ করে। তিনি এ ব্রোকারেজ হাউজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
খুজিস্তা ২০১৩ সালের ১০ জুন ডিএসইর পরিচালনা পর্ষদের নির্বাচনে প্রথমবারের মতো পরিচালক নির্বাচিত হন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়ন বিভাগে অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। শিক্ষা জীবনের সকল স্তর কৃতিত্বের সঙ্গে অতিক্রম করেন তিনি। মরহুম ড. জাহাঙ্গীর সাত্তার টিংকুর স্ত্রী খুজিস্তা ব্যক্তি জীবনে দুই সন্তানের জননী। তিনি ব্যক্তিগত ও দাপ্তরিক কাজে যুক্তরাস্ট্র, কানাডা, ফিলিপাইন, যুক্তরাজ্য, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুরসহ বহু দেশ ভ্রমণ করেছেন।
ডিবিএর নির্বাচনে নির্বাচিত পর এক প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে খুজিস্তা বলেন, “নির্বাচনে জয়ী হওয়া অবশ্যই আনন্দের ব্যাপার। এটা আমার জীবনে বড় অর্জন। তাই আনন্দও অনেক বেশি। আমার এ আনন্দের ভাগ আমি ডিএসইর সব সদস্যদের দিচ্ছি।”
নিউজবাংলাদেশ: বর্তমান বাজার পরিস্থিতি আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
খুজিস্তা: বাজার ওঠানামার ক্ষেত্রে বর্তমানে সহনশীল পর্যায়ে রয়েছে। তবে আগের মতো পতন উত্থানের সম্ভাবনা ক্ষীণ। আমাদের শেয়ারবাজার পরিস্থিতি আগের চেয়ে বেশ ভালোর দিকে যাচ্ছে। এর পেছনে থাকা কারণগুলোর মধ্যে প্রধান হলো সব ধরনের বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরে আসা। পাশাপাশি বাজারে বিভিন্ন অনিয়ম কমে যাওয়া।
নিউজবাংলাদেশ: বিএসইসির চেয়ারম্যান ড. মো. খায়রুল হোসেন বলেছেন, স্বাভাবিক নিয়মে সূচক ১০ হাজারেও সমস্যা নেই। এটাকে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
খুজিস্তা: সম্পতি বিএসইসির চেয়ারম্যান বলেছেন স্বাভাবিক নিয়মে সূচক ১০ হাজারেও সমস্যা নেই। এটা কেন বলছেন সেটা আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। তবে মার্কেটের ভালমন্দ দুটোতেই তার ভালো জ্ঞান রয়েছে। বর্তমান বাজার দেখে, হতে পারে তার বিচার বিবেচনায় এমনটি মনে হয়েছে যে স্বাভাবিক নিয়মে সূচক ১০ হাজারেও সমস্যা নাই।
নিউজবাংলাদেশ: ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং অ্যাক্ট বাস্তবায়ন হলে বাজারে কি সুফল পাবে?
খুজিস্তা: ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং অ্যাক্টটি বাস্তবায়ন হলে শেয়ারবাজারে আর্থিক প্রতিবেদনের সমস্যাগুলো সমাধান হবে। আইনটি বাস্তবায়নে ফাইন্যান্সিয়াল কাউন্সিল গঠন হবে। এতে কোনো আর্থিক প্রতিবেদনের কোনো অংশে যদি কারও আপত্তি থাকে তবে তা জানানোর একটা জায়গা তৈরি হবে। এতে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষা পাবে।
নিউজবাংলাদেশ: আর্থিক অনিয়ম দূর করার উপায় বিযয়ে আপনার মতামত?
খুজিস্তা: আর্থিক প্রতিবেদনের অনিয়ম দূর করতে হলে ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং অ্যাক্ট বাস্তবায়ন জরুরি। আমরা আশা করি, আইনটি শিগগিরই বাস্তবায়ন করা হবে। আশা করি, এটি বাস্তবায়ন হলে সব সমস্যা দূর হবে।
নিউজবাংলাদেশ: শেয়ারবাজারের স্বচ্ছতা সম্পর্কে আপনার মতামত...।
খুজিস্তা: শেয়ারবাজারে স্বচ্ছতা আগের চেয়ে বেড়েছে। সামনে আরো বাড়বে। সেই লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাব। শেয়ারবাজারে স্বচ্ছতা বাড়লে অটো জবাবদিহিতা বৃদ্ধি পাবে। বাজারের স্বার্থেই সব বিধিবিধান সংশ্লিষ্ট পক্ষদের অবশ্যই মেনে চলতে হবে। তবে বাজারে স্বচ্ছতাসহ জবাবদিহিতা বৃদ্ধি পেয়ে ইতিবাচক মোড় স্থায়ী হবে।
নিউজবাংলাদেশ: কোম্পানিরগুলোর শেয়ার দর সম্পদমূল্যে ও ফেস ভ্যালুর নিচে থাকার কারণ কি?
খুজিস্তা: শেয়ারবাজারের অনেক কোম্পানির শেয়ার দর নিচে অবস্থান করছিল, তাদের দর এখন পরিবর্তন হচ্ছে। এর মধ্যে আমাদের বাজারে বেশ কয়েকটি বড় ধরনের উন্নয়নের কাজ হয়েছে। আরো উন্নয়ন কাজ হচ্ছে। তাই এসব কাজ সম্পূর্ণ হলে বাজার আরো সমৃদ্ধ হবে। এ ধারায় কোম্পানির শেয়ার দরের অবস্থার পরিবতন হবে। অবশ্য দর আরো ইতিবাচক দিকে আগাবে।
নিউজবাংলাদেশ: অস্বাভাবিকভাবে শেয়ার দর বৃদ্ধি আপনি কিভাবে দেখছেন?
খুজিস্তা: শেয়ারবাজার ফিক্সড প্রাইসের নয়। এখানে শেয়ার দর ওঠানামা করবে। এটা বাজারের ধর্ম। তাই আপনি কোনো কোম্পানির শেয়ার কিনে লাভ করবেন না ঠকবেন সেখানে স্টক এক্সচেঞ্জের করার কিছু নেই। তবে স্টক এক্সচেঞ্জ দেখে দর ওঠানামার ক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম হচ্ছে কিনা। যদি কেউ ওঠানামার ক্ষেত্রে অনিয়ম করে তখন এক্সচেঞ্জ তার বিরুদ্ধে অ্যাকশন নেয়।
নিউজবাংলাদেশ: ডে-ট্রেড ঝুঁকিপূর্ণ কিনা?
খুজিস্তা: ডে ট্রেডিংয়ে পারদর্শী না হলে অর্থ হারানোর সম্ভাবনা থাকে। কোনো কিছু না বুঝে বিনিয়োগকারীদের ডে-ট্রেডিংয়ে অংশগ্রহণ ঝুঁকিপূর্ণ। আগে ডে-ট্রেডিং বিষয়ে বুঝে, রপ্ত করে বেচা-কেনা করা উচিত।
নিউজবাংলাদেশ: ২০১০ সালের ধসের কারণ?
খুজিস্তা: বাংলাদেশ ব্যাংকের দূরদর্শিতার অভাবে ধস হয়েছে। শেয়ারবাজার পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে বাংলাদেশ ব্যাংক হঠাৎ করেই এক্সপোজার ইস্যু জারি করে। ফলে ব্যাংক শেয়ার ধারণ কমিয়ে দিল। নির্দেশনা জারি করলো যে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ দায় এর ১০ শতাংশ হতে হবে। এ জন্য ছয়মাস সময় দিয়েছিল। যদি তখন পাঁচবছরের বেশি সময় দিত তাহলে বাজারের এ ধস হতো না।
নিউজবাংলাদেশ: ২০১০ সালে ধসের পর অনুমোদিত অধিকাংশ কোম্পানির দরপতন হয়। এ বিযয়ে আপনার মত?
খুজিস্তা: ২০১০ সালের ধসের পর নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি বাজারে প্রায় ৮০টি কোম্পানি অনুমোদন দিয়েছে। এসব অনুমোদিত অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ার দর অভিহিত মূল্যের নিচে রয়েছে বর্তমানে। অনুমোদনের সময়ে নির্বাচন যথাযথ হয়নি বলে মনে করি। তাই সামনে এ দিকটায় বিএসইসিকে আরো সতর্ক হবে। পাশাপাশি যেসব ইস্যু কোম্পানি ভুল তথ্য দিয়ে বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে প্রতারণা করছে তাদের অবিলম্বে আইনের আওতায় আনা জরুরি।
নিউজবাংলাদেশ: বিএসইসিকে আইপিও বান্ধব ভূমিকায় থাকা আপনি কোন দৃষ্টিতে দেখছেন?
খুজিস্তা: বিএসইসিকে আইপিও বান্ধব নয়, বিনিয়োগ বান্ধব হতে হবে। কারণ যারা ইতিমধ্যে বাজারে বিনিয়োগ করেছেন তাদের স্বার্থ আগে দেখতে হবে। তার মানে আইপিও আনবে না এমনটি নয়। আইপিও অবশ্যই আনবে তবে ভাল মৌলভিত্তি কোম্পানি আনতে হবে। এ প্রসঙ্গে আমি আগেও বহুবার বলেছি, বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে বাজারে আনতে হবে। কারণ এসব কোম্পানির শেয়ারবাজারে এলে বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয় না।
নিউজবাংলাদেশ: শেয়ারবাজারের ইতিবাচক গতি ধরে রাখতে কি করা যেতে পারে?
খুজিস্তা: বাজারের ইতিবাচক গতির জন্য কোম্পানির সুশাসন খুব জরুরি। পাশাপাশি বাজারের স্বার্থে বিএসইসিকে আরো নড়েচড়ে বসতে হবে। বাজারে উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনে কঠোর সিন্ধান্ত নিতে হবে। বিনিয়োগকারীদের আরো সচেতন করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে বিএসইসিকে। সংশ্লিষ্টদেরও বাজারের স্বার্থে নানামুখী সচেতন কর্মসূচি নিতে হবে। পাশাপাশি বিনিয়োগকারীকে লেনদেনে আরো পরিপক্ক হতে হবে। তাদের বিশ্লেষণ করে শেয়ার বেচাকেনা করতে হবে। সব চেয়ে বড় কথা, গুজবভিত্তিক লেনদেন সম্পূর্ণ পরিহার করতে হবে।
নিউজবাংলাদেশ: বিনিয়োগকারীদের জন্য কিছু বলুন।
খুজিস্তা: বিনিয়োগকারীদের সবসময়ই বলে আসছি, আপনারা কোনো কোম্পানিতে বিনিয়োগের আগে সেই কোম্পানি সম্মন্ধে জানুন। কোম্পানির গ্রোথ, পিই রেশিও, আয়, সম্পদ মূল্য দেখে বিশ্লেষণ করে বুঝে বিনিয়োগ করুন। বিনিয়োগ আপনার তাই এ সিদ্ধান্ত কেবল আপনারই।
নিউজবাংলাদেশ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন